ভালবাসার বাগান
ফ্ল্যাশব্যাক। প্রায় ৪০ বছর আগের ঘটনা। আমি তখন ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালের রেজিস্ট্রার। কোয়ার্টারে থাকি, উইকেন্ডে বাড়ি যাই। রবিবার সকালে টুকটাক প্র্যাকটিস করি। সন্ধেবেলা নাটকের রিহার্সাল করে সোমবার সকালে হাসপাতালে ফিরে আউটডোর করি। নানা ধরনের ক্যানসার রোগীদের ভিড় লেগে থাকে হাসপাতালে। আউটডোরে রোগীকে আমিই প্রথম দেখি। তারপর আমার স্যার প্রয়াত ডাক্তার সরোজ গুপ্তর পরামর্শে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে নিই। কেউ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে, কেউ-বা আর্লি স্টেজে। অনেকে এই দুইয়ের মাঝামাঝি।
পুরুলিয়ার বিজন মাহাতো ছিলেন এই মাঝামাঝির দলেই। ওখানে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সম্ভবত কারও সুপারিশপত্র ছিল বিজনবাবুর সঙ্গে। পরের দিন বায়োপসি করি। রোগীর গলার ভিতরে জিভের পিছনের দিকে, যাকে বলে বেস অফ টাঙ, সেখানেই ক্যানসারের ক্ষত ছিল। ডানপাশে, গলার উপরের দিকে ছোট একটি গ্ল্যান্ড বা গুটলিও ছিল। সপ্তাহখানেক বাদে রিপোর্ট এল পজেটিভ। অর্থাৎ বিজন বাবুর জিভে ক্যানসার হয়েছে; পরেরদিন থেকেই রেডিওথেরাপি বা রে দিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। দু’সপ্তাহ বাদে শুরু হল কেমোথেরাপি অর্থাৎ ইনজেকশন দিয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা।
আরও পড়ুন : কলকাতা শহরেই রয়েছে ক্যান্সার আক্রান্তদের নিয়ে নানাবিধ সামাজিক ট্যাবু? প্রান্তর চক্রবর্তীর কলমে মেডিসিনারি-র নবম পর্ব …
বিজনবাবু মানুষটিকে আমার প্রথম দর্শনেই ভাল লেগেছিল; ধীর লয়ে ভারি সুন্দর করে কথা বলেন। শিক্ষক মানুষ, স্কুলে জীবনবিজ্ঞান পড়ান। ক্যানসার নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করতেন আমাকে। রোগটা কী, কেন হয়, ছোঁয়াচে কি না, ভাল হবে কি না, বায়োপসি করলে বাড়ে কিনা— এমনতর নানা প্রশ্ন। সাধ্যমত উত্তর দিতাম আমি। সকালে-দুপুরে রোগী নিয়ে বড় ব্যস্ততা থাকত আমার। সন্ধের রাউন্ড শেষে ওকে নিয়ে মাঝে-মাঝে হাসপাতালের লনে হাঁটতে-হাঁটতে গল্প করতাম, কখনও-বা পুকুর-পাড়ে গিয়ে বসতাম। বিজন বাবু বলছি বটে, বয়সে কিন্তু আমরা কাছাকাছিই ছিলাম। দু’জনেরই তখন ২৭-২৮ হবে। ও আমাকে স্যার বলত, আমি বিজনকে তুমি করে বলতাম।
ক্যানসারটা ওর কোন স্টেজে, পুরোপুরি ভাল হওয়ার চান্স যে ভীষণ কম, বিজন সেটা জানত। তবু কোনওদিন ওকে এটা নিয়ে ভেঙে পড়তে দেখিনি। তবে একটু বিচলিত ছিল ওর প্রেমিকাকে নিয়ে। কি নাম বলেছিল প্রেমিকার, আজ আর মনে পড়ে না। তবে মাস ছয়েক বাদে যে বিয়ের দিন ঠিক হয়ে আছে, সেটা আমাকে জানিয়েছিল। আমি বিজনের কাছে গোপন করিনি কিছুই। ক্যানসার বিদ্যা সেই সময় যেটুকু শিখেছিলাম, তার ভিত্তিতেই ওকে আশ্বস্ত করেছিলাম। তখন আমি নাটক করার পাশাপাশি টুকটাক লেখালিখিও করছি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। কিছুটা শখ করেই কিংবদন্তি অভিনেত্রী কানন দেবীকে রাজি করিয়ে ওঁর ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম একটি পত্রিকার জন্য। সেটি প্রকাশিত হলে, এক কপি নিয়ে আমি বিজনের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ও খুব যত্ন নিয়ে পত্রিকাটি উলটে-পালটে দেখল, তারপর আমার হাতে তুলে দিল ওর লেখা একটি কবিতার বই। আমি চোখ কপালে তুলে বলেছিলাম, সে কি! তুমি কবিতা লেখ! এতদিন বলোনি কেন! ও বলেছিল, আপনি এগুলো পছন্দ করেন কিনা জানিনা তো, আজ যখন জানলাম তখন দিতে সাহস হল। এরপর থেকে লেখালেখি নিয়ে আমাদের দু’জনের মধ্যে প্রায়ই কথা হত।
প্রথম কোর্স কেমো নেওয়ার পর মারাত্মক রিঅ্যাকশন হয় বিজনের। খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, ব্লাড কাউন্ট কমে যায়, মুখে ঘা হয়। রক্ত দিয়ে, ফ্লুইড চালিয়ে— সে যাত্রায় সামাল দেওয়া হল। তবে ও খুব উইক হয়ে পড়ে। মরণ ছোবল কাকে বলে টের পায়ে বিজন। এ-নিয়ে একটা কবিতাও লেখে। কবিতায় ছিল বিষণ্ণতার সুর। আমি বিজনকে চিয়ার-আপ করি। জিভের ক্ষতটা যে কুড়িটা রে নেওয়ার পর অনেকটাই মিলিয়ে গেছে, সেটাও ওকে জানাই। বিজন যতটা না তার অসুখ নিয়ে বিচলিত ছিল, তার থেকে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিল ওর প্রেমিকাকে নিয়ে। কী করা উচিত বুঝতে পারছিল না! ওর হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের অন্যত্র মেয়ের বিয়ে দিতেও অনুরোধ করেছিল, ওরা রাজি হয়নি। সব শুনে আমি বললাম, ওয়েট অ্যান্ড সি, অনেক দেরি আছে, এর মধ্যে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। বিজন আমার হাত দুটো ধরে বলেছিল, সত্যি হব তো!? আমাদের বংশে আমিই প্রথম গ্রাজুয়েট হয়ে সরকারি চাকরি করছি। বোনটা ছোট, কলেজে পড়ছে, ওর বিয়ে দিতে হবে— পুরো সংসারটাই আমার মুখ চেয়ে যে বেঁচে আছে স্যার, ওদের জন্য যে আমাকে সুস্থ হতেই হবে।
ক্যানসারটা ওর কোন স্টেজে, পুরোপুরি ভাল হওয়ার চান্স যে ভীষণ কম, বিজন সেটা জানত। তবু কোনওদিন ওকে এটা নিয়ে ভেঙে পড়তে দেখিনি। তবে একটু বিচলিত ছিল ওর প্রেমিকাকে নিয়ে। কি নাম বলেছিল প্রেমিকার, আজ আর মনে পড়ে না। তবে মাস ছয়েক বাদে যে বিয়ের দিন ঠিক হয়ে আছে, সেটা আমাকে জানিয়েছিল।
আজ বিজনের ছুটি। রে, কেমোথেরাপি গতকালই শেষ হয়েছে। আগামীকাল খুব ভোরে বেরিয়ে পড়বে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরার জন্য। আউটডোরে নিয়ে গিয়ে ওকে ভাল করে পরীক্ষা করলাম। তারপর ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখে সব কিছু বুঝিয়ে দিলাম। চিকিৎসায় দারুণ সারা মিলেছে। ওর জিভের পিছনের ক্যানসারের ঘা-টা আর নেই, গলার ছোট্ট গ্ল্যান্ডটাও ভ্যানিশ। ডাক্তার হিসেবে খুব খুশি হলাম আমি। দু’সপ্তাহ বাদে আবার চেক-আপে আসতে বললাম। বিজনের সঙ্গে সন্ধ্যার রাউন্ডে অনেক আড্ডা হল। আসবার আগে হাসপাতালে বসে ওর লেখা গোটা কুড়ি কবিতা লেখা একটা ডায়েরি আমাকে দিয়ে বলল, পড়বেন, ভুল মনে হলে কারেকশন করে দেবেন। আমি বললাম, পড়ব নিশ্চয়, কিন্তু কারেকশন করতে পারব না। বরং নেক্সট চেক-আপে যখন তুমি আসবে, কেমন লেগেছে কবিতাগুলো, সে ব্যাপারে তোমাকে আমার মতামত জানাব।
কোয়ার্টারে ফিরে রাতেই কয়েকটি কবিতা পড়ে ফেললাম। এত বছর বাদে সেগুলোর আর কিছুই প্রায় মনে নেই, তবে কয়েকটি কবিতা ভাল লেগেছিল বেশ। একটি কবিতার শুরুটা অনেকটা এইরকম ছিল- ভালবাসার বাগানে শুয়ে আছি আমি/ মৃত্যু প্রহরী তুমি ফিরে যাও/ শিশিরের মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছে ভালবাসা/ প্লিজ ওদের ঝরতে দাও।
ভোরবেলা টেলিফোনের আর্তনাদে ঘুমটা ভেঙে গেল। ওয়ার্ড থেকে সিস্টারের জরুরি তলব। বিজন মাহাতো, বেড নম্বর 134, সিমস টু বি এক্সপায়ার্ড। এক মুহূর্ত দেরি না করে ছুটে গেলাম ওয়ার্ডে। রক্তের বিছানায় শুয়ে আছে বিজন। ভোরে উঠে স্নান করে ধুতি আর বাংলা শার্ট পরে সেজেগুজে অপেক্ষা করছিল। বাড়ির লোক গাড়ি নিয়ে তাকে নিতে আসবে। হঠাৎ ওর প্রচণ্ড কাশি শুরু হয়। ঝলকে-ঝলকে টাটকা রক্ত উঠে আসে। সিস্টার এবং ওয়ার্ডবয়রা সাকশন করে, ফ্লুইড চালিয়েও অবস্থা সামাল দিতে পারেনি। পরীক্ষা করে দেখলাম বিজন নেই, এক্সপায়ার্ড। ঘটনার আকস্মিকতায় আমিও অন্য সবার মত হতবাক হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা কি ঘটেছিল, ডাক্তারি জ্ঞান থেকে আমার সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না, কিন্তু মেনে নিতে পারছিলাম না। বিজনের জিভের পিছনে যেখানে ক্যানসার হয়েছিল সেখানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রক্তনালী থাকে। ক্যানসার ছোবল মেরেছিল সেখানেও, রক্তনালী ছিঁড়ে গিয়ে এই ডিজাস্টার ঘটল।
বিজনের মৃত্যু আমায় খুবই ধাক্কা দেয়; তরুণ বয়সে সমবয়সির অকাল-বিদায় মেনে নিতে অনেক সময় লেগেছিল। বিজনের মৃত্যুর মাস-দু’য়েক বাদে সেই কবিতার খাতাটি ওর প্রেমিকাকে ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলাম; আমায় ফোন করে, মাকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটি আমার কোয়ার্টারে এসেছিল। কেন এবং কীভাবে বিজনের মৃত্যু হল, জানতে চেয়েছিল। শুনতে-শুনতে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। ওর কান্না ভেজা চোখ দুটো মনে আছে, কিন্তু নামটা আজ আর মনে নেই। ভালবাসার বাগানে শুয়ে থাকতে চেয়েছিল বিজন এই মেয়েটিকেই ভালবেসে। কেন পারল না, ডাক্তার হয়েও এর উত্তর আমি খুঁজে পাইনি আজও ।