রাম বললেই যে যে ছবি আমরা মনের মধ্যে পাই, সেগুলিকে নিয়ে যদি আমার আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, সবক’টিই কমবেশি আলাদা। সেই রামের ‘রামত্ব’-ও কিন্তু আলাদা আলাদা। আমরা রামায়ণের আখ্যানকে কোন দৃষ্টিতে বা কার চোখ দিয়ে দেখতে চাইছি, তার ওপর নির্ভর করে, আমাদের রাম কেমন হবে। আমরা যদি কবির দৃষ্টিতে রামকে দেখি, রাম একরকম, যদি সীতার দৃষ্টিতে দেখি তাহলে একরকম, যদি লক্ষণের দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে একরকম, আবার রাবণ বা হনুমান বা বিভীষণের দৃষ্টিতে দেখলে রাম পৃথক পৃথক হয়ে যেতে থাকেন। রাম কৃপাসিন্ধু হরির অংশ, হরি যেমন অনন্ত, হরিকথা যেমন অনন্ত, তেমনই রামও অনন্ত, রামকথাও অনন্ত। একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আছে, রাম বা রামকথা বাংলায় ছিল না কি ছিল না? এর উত্তর, অবশ্যই ছিল, আছে, থাকবেও, তবে তার স্বরূপ সার্বিকভাবে ভিন্ন।
বাংলার রাম কেমন? কিঞ্চিৎ স্থূল, শান্ত দৃষ্টি, মুখে স্ফীত হাসি, নাকের তলায় একটা পাকানো গোঁফ, এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, রামের গাত্রবর্ণ সবুজ। চোখ কুঁচকে গেল? স্বাভাবিক। কিন্তু রামের গায়ের রং হঠাৎ সবুজ কেন? বাংলা, ওড়িষ্যা এবং দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রামের গায়ের রং সবুজ। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, রাম আকর্ষণের দিক থেকে কামদেবের সমান, সুতরাং কামদেবের সবুজ গাত্রবর্ণের অনুকরণে রামের গায়ের রংও সবুজ। তবে অন্য একটি মতে, শ্রীরামকে ‘নব দূর্বাদল শ্যাম’ হিসেবে বর্ণনা করার ফলেই শ্রীরামের গায়ের রং সবুজ।
এ তো গেল বাংলার রামের চেহারার বর্ণনা, কিন্তু বাংলার রামকথা?
আরও পড়ুন : রবীন্দ্রনাথের বিজয়াই কি ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো? লিখছেন আশিস পাঠক…
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে কৃত্তিবাস ওঝার নাম আসবে না, সেটা তো হতে পারে না। একটা মহাকাব্য যে কেবল একজন ব্যক্তির জয়গান নয়, তার মধ্যে মিশে থাকে সার্বিক সমাজচিত্র, যার মাধ্যমে পৌঁছে যাওয়া যায় এক বৃহৎ জনগণের কাছে এবং পরিবর্তন করা যায় তাদের মনকে, এটি বুঝেছিলেন কৃত্তিবাস; এটি গোস্বামী তুলসীদাসও বুঝেছিলেন, তবে তাঁর প্রেক্ষিত ছিল মধ্য ভারতে, আর কৃত্তিবাসের প্রেক্ষিতে ছিল ছিন্ন হয়ে যাওয়া বঙ্গসমাজ।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ তথা ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ কেন গুরুত্বপূর্ণ? গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কারণে। আজকের বাংলাতেও অন্য একটি সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা লক্ষ করা যায়, কৃত্তিবাস সেই প্রবণতায় হাঁটেননি। যে-কোনও শিল্পকর্মকে স্থানীকরণ করা যেমন একটি কঠিন কাজ, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কাজও বটে। কৃত্তিবাস সেই স্থানীকরণের কাজটি করেছিলেন খুব সচেতনভাবে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর রিয়েলিটি আলাদা, মধ্য ভারতের রিয়ালিটিকে বাংলায় প্রযুক্ত করতে গেলে রামকে তথা সম্পূর্ণ আখ্যানটিকে করে তুলতে হবে বাঙালি। কৃত্তিবাস সেই কাজটি করেন এবং তাঁর ‘রিক্রিয়েশন’ যে জনপ্রিয়তা পায়, তা আজও অটুট।
তবে এই লেখার মধ্যে কি ভেস্টেড ইন্টারেস্ট বা কায়েমি স্বার্থ ছিল না? অবশ্যই ছিল। সেটি কীরকম? তার জন্য আমাদের ফিরে দেখতে হবে তৎকালীন বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অবস্থা। যদিও এটি একটি বিতর্কিত বিষয় যে, কৃত্তিবাস রাজা গণেশের সভাকবি ছিলেন না কি ছিলেন রুকনুদ্দিন বারবক শাহ-র সভাকবি, তবে কৃত্তিবাসের এই কাব্য রচনার পিছনে তো অবশ্যই একটা লক্ষ্য ছিল, তা হল ছত্রভঙ্গ হিন্দুদের একজায়গায় আনা এবং পাপ থেকে নিস্তার দেওয়ার জন্য রামের মূর্তিকে তুলে ধরা। তৎকালীন সময়ে বাংলায় তুর্কি আক্রমণ হয়ে গেছে, নিম্নবর্গের হিন্দু আর বৌদ্ধরা ধর্মান্তরিত হয়েছে ইসলামে, আর যারা থেকে গেছে, তারা জাতি এবং বর্ণবৈষম্যে জর্জরিত, তাদের সংঘবদ্ধ করার জন্য একদিকে যেমন তৈরি হচ্ছে মঙ্গলকাব্য, অন্যদিকে রচিত হচ্ছে কৃত্তিবাসের রামায়ণ। সেই সময়ে পাপের থেকে নিস্তার পাওয়া একটি বিশেষ গুরুত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, আর সেই নিস্তারের পথ দেখান কৃত্তিবাস।
কৃত্তিবাস লিখছেন,
মরা মরা বলিতে আইল রামনাম।
পাইল সকল পাপে দস্যু পরিত্রাণ।।
তূলারাশি যেমন অগ্নিতে ভস্ম হয়।
একবার রাম নামে সর্ব্বপাপ ক্ষয়।।
কেবল আদিকাণ্ড নয়, তরণীসেনের যুদ্ধ ও পতন, রাবণের কাছে রামের রাজনীতি-শিক্ষা প্রভৃতি বিভিন্ন অংশে এই পাপবোধ ও তার থেকে নিষ্কৃতির পথ খুলে রেখে গিয়েছেন কৃত্তিবাস। তাই হয়তো এখনও এতটা জনপ্রিয় এই কাব্য।
তবে এ তো গেল বাংলা রামকথার ‘ম্যাগনাম ওপাস’-এর কথা, তবে বাংলা রামকথা শুধুই কি তাই, না। অনেক যুগ অবহেলার পর আজ চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ নিয়ে কথা বলা শুরু হয়েছে, আলোচনা শুরু হয়েছে। বাংলা ভাষায় কোনও মহিলা-রচিত প্রথম রামায়ণ এটি। বাংলার রামকথার নিরিখে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ যেন এক কাউন্টার ন্যারেটিভ। এই রামায়ণে রামের অকারণ স্তুতি নেই, রাম ঈশ্বরপুরুষও নন, এই কাব্যে রাম যেন এক প্রতারক জীবনসঙ্গী। সচেতন পাঠক, যাঁরা ময়মনসিংহ গীতিকা সম্পর্কে, নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ‘চন্দ্রাবতী’ পালা সম্পর্কে অবগত, তাঁরা হয়তো বুঝতে পারছেন, রাম এই কাব্যে কেবল রাম নন, তিনি চন্দ্রাবতীর প্রতারক প্রেমিক জয়ানন্দরই ছায়ামাত্র। তবে এ-প্রসঙ্গ ছাড়াও আরও অনেকগুলি কারণে গুরুত্বপূর্ণ চন্দ্রাবতীর রামায়ণ।
প্রথমত, এই রামায়ণ সীতার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। চন্দ্রাবতী সীতার জন্মকাহিনি বুনেছেন এক নতুন আঙ্গিকে। সীতা এখানে রাবণপত্নী মন্দোদরীর সন্তান। এক অলৌকিক উপায়ে মন্দোদরীর গর্ভে ডিম আকারে সীতার জন্ম। সেই ডিমকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় সমুদ্রে। সতা নামক একটি নারীচরিত্রে সেই ডিমকে প্রতিপালন করে সেখান থেকে সীতার জন্ম দেন, সতার নাম অনুযায়ী কন্যার নাম হয় সীতা। তারপর তাঁকে তুলে দেওয়া হয় মহারাজ জনকের হাতে।
দ্বিতীয়ত, কেবল সীতার জন্মকথা না, ফর্মের দিক থেকে এই রামায়ণ গুরুত্বপূর্ণ। রামায়ণ বলা হলেও রাম এখানে গৌণ, সেটা আগেই বলা হয়েছে। চন্দ্রাবতী সীতার জীবনচিত্র লিখতে গিয়ে এই কাব্যে তুলে এনেছেন মঙ্গলকাব্যের ঢঙে ‘সীতার বারোমাস্যা’, রামায়ণের ক্ষেত্রে এটি বিরলতম। প্রাথমিকভাবে দীনেশচন্দ্র সেন ও পরবর্তীতে নবনীতা দেবসেনের হাত ধরে ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ আজ আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে।
চন্দ্রাবতী সীতার জন্মকাহিনি বুনেছেন এক নতুন আঙ্গিকে। সীতা এখানে রাবণপত্নী মন্দোদরীর সন্তান। এক অলৌকিক উপায়ে মন্দোদরীর গর্ভে ডিম আকারে সীতার জন্ম। সেই ডিমকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় সমুদ্রে। সতা নামক একটি নারীচরিত্রে সেই ডিমকে প্রতিপালন করে সেখান থেকে সীতার জন্ম দেন, সতার নাম অনুযায়ী কন্যার নাম হয় সীতা। তারপর তাঁকে তুলে দেওয়া হয় মহারাজ জনকের হাতে।
‘অদ্ভুত রামায়ণ’, ‘ভীল রামায়ণ’ প্রভৃতি বই নিয়ে বিশদে আলোচনা আপাতত মুলতবি থাক। মধ্যযুগ থেকে সরাসরি চলে আসি আধুনিক যুগে। আধুনিক বাংলায় রামায়ণ বা সার্বিক রামকথা নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে, হয়ে চলেছে। বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’, মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’, রাজশেখর বসু কর্তৃক ‘বাল্মীকি রামায়ণ’-এর সারানুবাদ, অবনীন্দ্রনাথের ‘খুদ্দুর যাত্রা’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘ছেলেদের রামায়ণ’, সুকুমার রায়ের ‘লক্ষণের শক্তিশেল’, অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘মারীচ সংবাদ’-সহ বাংলা ভাষায় রচিত আরও প্রচুর লেখায় রামায়ণের গল্প ধরা থেকেছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এসেছে রামায়ণের প্রসঙ্গ, তবে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। বাংলার বুকে এক দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে রামায়ণের বিনির্মাণ, তারই ফসল ওপরে উল্লেখ করা সাহিত্যকর্মগুলি।
রামায়ণ ও রবীন্দ্রনাথ— এই প্রসঙ্গে বলতে গেলেই হুড়মুড় করে মনে চলে আসে ‘কাহিনি’ কাব্যগ্রন্থের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতার কথা। রবীন্দ্রনাথ প্রায় অ্যারিস্টটলের ‘পূরণকারক সত্য’-র ভঙ্গিতে আমাদের মনে করিয়ে দেন,
…সেই সত্য যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।
তবে এই কবিতা নিয়ে ইতিমধ্যে এত কথা বলা হয়ে গেছে, যে, নতুন করে বলার কিছু নেই, যেমন নতুন করে বলার নেই ‘রক্তকরবী’-র প্রস্তাবনায় কর্ষণজীবি বনাম আকর্ষণজীবির দ্বন্দ্বের কথা, আধুনিক যুগের রাবণের দশ মাথার পরিবর্তে একটি মাথার সপক্ষে যুক্তির কথা। সুতরাং, এই প্রসঙ্গ শেষ করি রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাচীন সাহিত্য’ প্রবন্ধগ্রন্থের অন্তর্গত ‘রামায়ণ’ প্রবন্ধের একটি অংশ দিয়ে। এই প্রবন্ধটি দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’ বইটির ভূমিকা হিসেবে রচিত হয়। এই প্রবন্ধে একটি অংশে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
‘রাম যে একই কালে আমাদের কাছে দেবতা এবং মানুষ, রামায়ণ যে একই কালে আমাদের কাছে ভক্তি এবং প্রীতি পাইয়াছে, ইহা কখনোই সম্ভব হইত না যদি এই মহাগ্রন্থের কবিত্ব ভারতবর্ষের পক্ষে কেবল সুদূর কল্পলোকেরই সামগ্রী হইত, যদি তাহা আমাদের সংসারসীমার মধ্যেও ধরা না দিত।’
ওই প্রবন্ধের আর-এক অংশে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
‘আমি কেবল এই কথাটুকু মাত্র জানাইতে চাহি যে, বাল্মীকির রামচরিত-কথাকে পাঠকগণ কেবলমাত্র কবির কাব্য বলিয়া দেখিবেন না, তাহাকে ভারতবর্ষের রামায়ণ বলিয়া জানিবেন। তাহা হইলে রামায়ণের দ্বারা ভারতবর্ষকে ও ভারতবর্ষের দ্বারা রামায়ণকে যথার্থভাবে বুঝিতে পারিবেন।… ভারতবাসীর ঘরের লোক এত সত্য নহে, রাম লক্ষ্ণণ সীতা তাহার পক্ষে যত সত্য।’
এই দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে বাংলার রাম, রামায়ণ ও রামকথার একটি অসম্পূর্ণ তবে প্রাথমিক রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করা হল। বেশ কিছু বিদগ্ধ মানুষ রামকে বাংলার ক্ষেত্রে বহিরাগত বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। এই বক্তব্য সত্য নয়। শ্রীরামপুরের রাম, হাওড়ার রামরাজতলার রাম-সহ বাংলায় কোনায় কোনায় ছড়িয়ে আছে রাম, রাম-নামাঙ্কিত স্থান। তবে হ্যাঁ, রামকে উদযাপনের এই রীতি বাংলার ক্ষেত্রে নতুন তো বটেই। অকাল বোধন, শ্রীরাম পাঁচালী অথবা রামকৃষ্ণ মিশনের ‘শুদ্ধ ব্রহ্ম পরাৎপর রাম’-এর মধ্যে দিয়েই বাঙলি উদযাপন করে এসেছে রামকে। এখন এআই যুগের বাঙলি কীভাবে রামকে আত্তীকরণ করবে, সেটি সম্পূর্ণই তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।