বাংলা নাট্যমঞ্চে যে-পরিমাণ বের্টোল্ট ব্রেশটের নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছে, সেই অনুপাতে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাটকের মঞ্চায়ন সেভাবে হয়নি। ‘রাজা লিয়র’ যখন মঞ্চস্থ হয়েছিল, তার পরে পরে ‘ওথেলো’ করেছিল ‘নয়ে নাটুয়া’, ‘স্বপ্নসন্ধানী’ করেছিল ‘ম্যাকবেথ’, সম্প্রতি ওরা ‘হ্যামলেট’ করেছে, এর আগে ‘অন্য থিয়েটার’-ও করেছিল ‘হ্যামলেট’, ‘অথৈ’ হয়েছে, ‘ড্রিম ড্রিম’ বা ‘ফাগুন রাতের গপ্পো’ হয়েছে, সম্প্রতি অঞ্জন দত্ত করেছেন ‘আরও একটা লিয়র’। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে শেক্সপিয়র ব্রেশটের অনুপাতে পিছিয়েই আছেন বাংলা মঞ্চের নিরিখে।
পৃথিবী জুড়ে যাবতীয় সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির জবাব শেক্সপিয়রে রয়েছে। কিন্তু শেক্সপিয়রকে মঞ্চে নিয়ে আসার অন্য়তম অন্তরায় হচ্ছে, শেক্সপিয়রের ভাষা ও তার অনুবাদ। শেক্সপিয়রীয় ভাষা থেকে আমরা ক্রমে দূরেই চলে গিয়েছি। মঞ্চে কাব্য বলা— এই অনুশীলন আমাদের আর নেই। গল্পের নির্যাস নিয়ে হয়তো কিছু করা যেতে পারে, যেমনটা করেছেন বিশাল ভরদ্বাজ। ‘অথৈ’-ও তেমনভাবেই হয়েছে।
আরও পড়ুন : আট বছর বয়সেই লেনিনের মগজে প্রোথিত হয়েছিল বিপ্লবের বীজ? লিখছেন সায়ন্তন সেন…
শেক্সপিয়রের যে জগৎ, যে আখ্যান, পৃথিবীর যে-কোনও পরিস্থিতিতেই তার প্রেক্ষিত আসলে পাওয়া যায়, তার অভিঘাতও আছে। সে ঐ্রতিহাসিক নাটক হোক, ট্র্যাজেডি হোক, বা কমেডি— বর্তমান সময়ের সঙ্গে তার একটা যোগাযোগ, সাযুজ্য এবং সংলাপ আছে। পিটার ব্রুক যাকে বলেছেন, প্রস্তরীভূত কয়লার মতো। বহুদিন আগে তা মাটির তলায় নিহিত আছে। তা আবার খনি থেকে উঠে এসেছে। বহুযুগ পর মানুষ হয়তো শীতকালে সেই কয়লার আগুন থেকেই উত্তাপ নিচ্ছে। হাজার হাজার বছর ধরে এই উত্তাপ আমরাও নিয়ে চলেছি। তাই সারা পৃথিবীতেই তা অভিনীত হয়ে চলেছে বারবার।
শেক্সপিয়রের ভাষা বাদ দিয়ে শেক্সপিয়রকে কতটা ধরা যায়, তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। কিন্তু বাংলা মঞ্চে শেক্সপিয়র আরও হওয়া উচিত ছিল, প্রয়োজন ছিল বলেই মনে করি। রবীন্দ্রনাথকে মঞ্চে আনার থেকেও বিরত থাকার একটা বড় কারণ— এই ভাষা-ই। ভাষার জগৎ থেকে আমরা ক্রমশ দূরে চলে গিয়েছি। এখন সবই ‘অ্যাব্রিভিয়েশন’। মূল ভাষার সঙ্গে আমাদের দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই চলেছে। শেক্সপিয়রের ভাষার যে স্থাপত্য, তার জন্য যে চর্যা প্রয়োজন, তার মধ্যে আমরা আর নেই, একথা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল।
শেক্সপিয়রের গল্পকে অন্য প্রেক্ষিতে ফেলে দেওয়া নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু তাতে শেক্সপিয়র করা হয় না। তাকে শেক্সপিয়র অনুপ্রাণিত বলা যেতে পারে। শেক্সপিয়র কেবল নয়, আর্থার মিলার থেকে ব্রেশট— ভাষা তাঁদের নাট্যকীর্তির অংশ। ভাষার বিন্যাসটাকে না ধরলে তাঁদের নাট্যকর্মকেও ধরাছোঁয়া বাকি থেকে যাবে।