সাগরময় ঘোষ অসামান্য সম্পাদক ছিলেন, সেকথা তো সবাই জানে। তাঁর মতো মনোযোগী সম্পাদক আমি অন্তত আর দেখিনি।
আমি যখন ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প-উপন্যাস জমা দিতে যেতাম, দেখতাম, তিনি মন দিয়ে সারাদিন পাণ্ডুলিপি পড়ে চলেছেন। ‘দেশ’-এর জন্য কত যে লেখা জমা পড়ত, ইয়ত্তা নেই। সেগুলো সবই হাতে লেখা, আর এক-একজনের লেখা উদ্ধার করা তো রীতিমতো দুষ্কর। কিন্তু তিনি সমস্ত লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। এবং সেই খনি থেকেই তিনি তুলে এনেছিলেন দুরন্ত সব লেখককে। সত্যজিৎ রায়ও তাঁরই অনুরোধে ফেলুদা সিরিজ লিখতে আরম্ভ করেন ‘দেশ’ পত্রিকায়।
কেবল লেখক আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত ছিলেন, তেমনটা নয়। পাঁচের দশকের শেষে কিংবা ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে, যখন ভাবা হত, পত্রিকায় শুধু গল্প-উপন্যাসই থাকবে, তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় চালু করলেন নানারকম বিভাগ। প্রবন্ধ, সমালোচনা ইত্যাদি। তাঁর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলা সাহিত্যে নতুন লেখকদের নতুন ধারা আনতে সাহায্য করেছে, নতুন চিন্তাকে ক্রমাগত উৎসাহিত করেছে।
আরও পড়ুন : তখন আমার দু’ভাগ, খানিকটা ময়মনসিংহে, আর খানিকটা কলকাতায়! পড়ুন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কলমে নীল কেটলি…
তিনি তাঁর সম্পাদনায় এমন কিছু উপন্যাস প্রকাশ করেছেন, যা সেই সময় খুবই বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ গোষ্ঠীর তৎকালীন কর্ণধার অশোক সরকার জানতেন, কার ওপর কোন দায়িত্ব ন্যস্ত করতে হবে। তিনি সাগরময় ঘোষের হাতে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পূর্ণ ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন, কখনও হস্তক্ষেপ করেননি। এবং সাগরদাও তাঁর সারাজীবনের ব্রত করে নিয়েছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনাকে।
সাগরদা খুব ভাল গান গাইতেন, লেখার হাত ছিল চমৎকার। একটা সময় ছিল, যখন সাগরদা গাইতেন এবং তাঁর দাদা শান্তিদেব ঘোষ নাচতেন। তারপর শান্তিদেব নাচ ছাড়লেন এবং গানে মনোনিবেশ করলেন। আর সাগরদা গান ছেড়ে সম্পাদনায় ডুবে গেলেন। একেবারে সন্তানসম ভালবাসতেন ‘দেশ’ পত্রিকাকে। কেউ ‘দেশ’ পত্রিকা সম্পর্কে দু’টি বাজে কথা বললে, সাগরদা খুব আঘাত পেতেন এবং বেশ একটা তুলকালাম করতেন।
আমি যখন ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প-উপন্যাস জমা দিতে যেতাম, দেখতাম, তিনি মন দিয়ে সারাদিন পাণ্ডুলিপি পড়ে চলেছেন। ‘দেশ’-এর জন্য কত যে লেখা জমা পড়ত, ইয়ত্তা নেই। সেগুলো সবই হাতে লেখা, আর এক-একজনের লেখা উদ্ধার করা তো রীতিমতো দুষ্কর। কিন্তু তিনি সমস্ত লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন।
এমনিতে সাগরদাকে দেখলে ভারি গম্ভীর লোক বলে মনে হত: সারাদিন পড়ছেন, ভাবছেন। কিন্তু মিশলে বোঝা যেত, তিনি ততটাও ভারিক্কি মেজাজের নন। আমি যে তাঁর সঙ্গে খুব আড্ডা দিয়েছি তা নয়, কিন্তু তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ঠিক সময়ে লেখা জমা দিই না বলে বাজারে আমার নাম আছে। একবার আমি ‘দেশ’ পত্রিকায় উপন্যাসের পর-পর দু’কিস্তি জমা দিতে পারলাম না। সাগরদা আমায় খুব বকাঝকা করে বললেন, ‘দেশ পত্রিকার ইতিহাসে যা হয়নি, তুমি তা-ই করলে।’
তবু আমার লেখা ছাপা হল। বকাঝকা যতই করুন, লেখা পছন্দ হলে তিনি ছাপবেনই। এটা কেবল আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা নয়। লেখা ভাল হলে সাগরদার কাছে সাত খুন মাফ। তবে আমার ডেডলাইন মিস করা নিয়ে সাগরদা একবার টেলিভিশনে বলেছিলেন, ‘শীর্ষেন্দু আমার হার্ট-অ্যাটাকের কারণ হবে!’
তা হয়নি বটে, কিন্তু সাগরদা চলে গিয়ে আমার মাথার ওপর একটা মস্ত ছাতা সরে গিয়েছে।