ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সাক্ষাৎকার : সন্তোষ সাউ


    ডাকবাংলা.কম (January 3, 2025)
     

    বিষাণ অর্থাৎ পশুর শিং। তাকে পুড়িয়ে নরম করে কেটে বোতাম, চিরুনি, পিঠছরা, বাক্স, চামচ, ধূপদান, লবণদান, কলমদান, চুলের ক্লিপ ইত্যাদি হরেকরকম নিত্য ব্যবহার্য এবং নানা খেলনা, অলংকার ও গৃহসজ্জার উপকরণ তৈরি করার যে-শিল্প, তা-ই বিষাণশিল্প নামে পরিচিত। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর-২ এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট ব্লক একসময় বিষাণশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। কোলাঘাটের বৈষ্ণবচক, দূর্বাচটি, ভোড়দহ, কলাগাছিয়া, কুড়হান্ডা, গৌরাঙ্গচক, কিসমত খয়রা, নিজ খয়রা, রায়চক, পদিমাচক এবং দাসপুরের মাগুরিয়া, দুধকোমরা, শ্যামগঞ্জ, জোৎঘনশ্যাম, নারায়ণচক, ডোঙাভাঙা ইত্যদি বেশ কয়েকটি গ্রামের প্রধান জীবিকা ছিল বিষাণশিল্প। কাঁচামাল, আধুনিক প্রশিক্ষণ, সরকারি উদ্যোগ, উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ইত্যাদির অভাবে বর্তমানে শিল্পটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। শিল্পীরা অধিকাংশই জীবিকা পরিবর্তন করে চাষবাস, সোনারুপোর কাজ বা কাঠের কাজে চলে গেছেন। কোলাঘাটের শিঙের কাজ এক সময়ে রপ্তানি হত বিদেশে; ঘরে-ঘরে গড়ে উঠেছিল শিঙের কারখানা; সেখানে আজ অবশিষ্ট মাত্র একচল্লিশজন শিল্পী— অধিকাংশেরই বয়স পঞ্চাশের কোটায়। তবু প্রায়বিলুপ্ত এই শিল্পটিকে এখনও আঁকড়ে ধরে রয়েছেন কলাগাছিয়ার প্রবীণ শিল্পী সন্তোষ সাউ। কারণ, এই কাজই তাঁর নেশা। ১৯৭০ থেকে ২০২৪— এখনও কাজ করে চলেছেন তিনি। এই সাক্ষাৎকারে ধরা রইল তাঁর কারিগর-জীবনের কথা, শিল্পের দর্শন, আনন্দ-বেদনার খতিয়ান; ধরা রইল একটি হারিয়ে যেতে বসা শিল্পের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি। কথা বললেন গৌরবকেতন লাহিড়ী। 

    নমস্কার সন্তোষবাবু, বিষাণশিল্প, মূলত মেদিনীপুরের বিষাণশিল্প নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই যাঁদের নাম আসে— তাঁদের মধ্যে আপনি অন্যতম। প্রায় পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর ধরে একটা শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা, এবং এই বয়সেও কাজ চালিয়ে যাওয়া— সেটা তো খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়!

    আমার এখন বাহাত্তর কি তিয়াত্তর হবে। কুড়ি-বাইশ বছর বয়স থেকে শুরু হয়েছিল। সেই থেকেই এই কাজের সঙ্গে জুড়ে আছি।

    এই কাজের উত্তরাধিকার কি পৈতৃক?

    না, না। আমাদের এই বৈষ্ণবচকে একটা কমন ফেসিলিটি সেন্টার হয়েছিল। উড়িষ্যা থেকে মাস্টারমশাই এসেছিলেন দুজন। তাঁরা সত্যি-সত্যিই বড় মাস্টারমশাই ছিলেন! গুরুদেব! ওঁদের কাছে আমরা কিছুটা শিখেছিলাম, বুঝলেন, যতটা শিখেছিলাম— করে খাওয়ার মতো। এখানের আরও অনেক শিল্পীই শিখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আমিই এখনও অবধি লেগে আছি। আসলে আমার খুবই ভাল লাগে এই কাজ করতে। নাহলে এই বয়সেও কাজ করি বলুন! ইন্টারেস্ট পাই এখনও।

    তবে এখন তো কাজ সেরকম থাকে না। প্রোজেক্ট তোলার জন্য সরকার অনেকরকম চেষ্টা করছে বটে। কিন্তু আমাদের শিল্পীদের মধ্যে একতা নেই। শিল্পীও তো কম। এই দেখুন না— আমাদের সমিতির যে-জায়গা, রায়ত যেটা আছে, সেটার কাগজপত্র এতদিন ধরে বলে-বলে আমি জোগাড় করেছি। সেক্রেটারি-সভাপতি ওঁরা তো কেউ করলেন না, তাই আমাকেই করতে হল। এবার ডিআইসি-তে পাঠাব।

    Article about Santosh Sau, the folk artist
    ‘আমার একটু নতুন জিনিসের প্রতি টান ছিল’

    একটা সময়ে তো এই কোলাঘাটের অন্তর্গত দুটো গোটা ব্লক বিষাণশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। প্রায় সব ঘরেই এই কাজ হত। এখন সেটা কমতে-কমতে বোধহয় শুধু নারায়ণচক আর বৈষ্ণবচক? আর কোথাও কি এই ধরনের কাজ হচ্ছে এখন?

    না, না। আর কোনও গ্রাম নেই। একমাত্র মেদিনীপুরেই ছিল তো! আর কোনও জেলায় এসব হত না। আর উড়িষ্যাতে আছে। উড়িষ্যা থেকে একবার দশ-বারোজন পরিদর্শনে এসেছিলেন এখানে। ছোট-ছোট কারখানাগুলোতে ঘুরে-ঘুরে কীরকম কাজ হয় দেখেছিলেন সব। ওঁরা কিন্তু বলেছিলেন— এখানকার কাজ উড়িষ্যার থেকেও ভাল! তবে আমার যিনি গুরু, নীলকণ্ঠ মহারাণা, উনিও উড়িষ্যার, তিনি প্রণম্য! আরেকজন ছিলেন, হরিহর মঙ্গল। উনি কুঁদের কাজ করতেন। কুঁদের কাজ ভাল, কিন্তু আমাদের এখানে কোনও শিল্পীই ব্যাপারটা ঠিক রপ্ত করতে পারেনি। 

    পঞ্চাননবাবুও (দাসপুরের প্রবীন বিষাণশিল্পী পঞ্চানন্দ দাস) কি আপনাদের সঙ্গেই শিখেছিলেন?

    না, না, ওঁরা ডোঙাভাঙার। ওঁদের ট্রেনার আলাদা ছিল। কালন্দি বেহরা। আরেকজন ছিলেন, নাম ভুলে গেছি।

    এটা কত সালের কথা? যখন আপনাদের ট্রেনিং হয়েছিল?

    ১৯৫৬ সাল থেকে ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়েছিল। বিধান রায়ের আমলে। আমি কাজ শিখেছি সত্তর সাল থেকে। আর এই কাজে আমার প্রথমবার পুরস্কার পাওয়া বাহাত্তরে। দ্বিতীয় পুরস্কার। একটা ক্যালেন্ডারের ছবি দেখে রামের মূর্তি বানিয়েছিলাম, বুঝলেন। সেই থেকে মোট আটবার পুরস্কার পেয়েছি। রাজ্যে। চারবার প্রথম পুরস্কার, দ্বিতীয় দু-বার, তৃতীয় দু-বার। এই পশ্চিম মেদিনীপুরে এতবার আর কেউ পায়নি। 

    ‘আমি বলি, আমার কিন্তু পসারের থেকেও মূল লক্ষ্য ছিল পুরস্কার, সরকারের খাতায় নাম তোলা’

    হঠাৎ কেন শিঙের কাজ করতে ইচ্ছে হল আপনার?

    ব্যাপার হচ্ছে কী, আমার একটু নতুন জিনিসের প্রতি টান ছিল। এখন এই শিল্পটা তো তখন নতুন— আমাদের এখানে গৌরহরি বেড়া নামে এক মহাশয় ছিলেন। উনি চিরুনির ব্যবসা করতেন, উড়িষ্যায়। উনিই কিন্তু এখানে ওই মাস্টারমশাইদের এনে শেখানোর জন্য ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। তার আগে ব্যাপারটা ছিল না। মানে, এইসব আর্টের কাজ ছিল না। তো আমি দেখলাম, সত্যিই তো, এই কাজটা তো আশ্চর্য ধরনের! নতুন একটা ব্যাপার।

    তারপর দেখলাম অনেকেই এইসব বানাতে শুরু করল। তখন এই নতুন জিনিস বানানোর যে-নেশা, সেটা আমাকেও পেয়ে বসল। আমাদের এখানে একটা সমিতি (বৈষ্ণবচক বিষাণ শিল্প সমবায় সমিতি লিমিটেড) তৈরি হয়েছিল। কমন ফেসিলিটি সেন্টারে সব ট্রেনিং নিতে যেত। কিন্তু শুধু শিখলেই তো হবে না— বাড়িতেও তো করতে হবে, পয়সা ইনকাম করতে হবে। তো ওই সমিতি তখন আমাদের থেকে মাল কিনত। তখন আমরা বাইরে যেতাম না। সমিতিই সব মাল কিনে নিয়ে বাইরে এক্সপোর্ট করত। তখন কিন্তু খেলনাই বেশি হত।

    এক্সপোর্টের কাজ পরে আমরা কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে শুরু করেছিলাম। মানিকতলায় নকুল সেন বলে এক মহাশয় ছিলেন, উনি খুব আগ্রহী ছিলেন, সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এইসব হাতের কাজ করতেন। উনি কিন্তু নিজেই নিজের কাজ বাইরে এক্সপোর্ট করতেন। ওঁর মাধ্যমেই আমরা সব শিখি, এক্সপোর্টের কাজ শুরু করি। আর একজন ছিলেন, বারুইপুরে। আমরা ট্রেনিং করাতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, বরেন ঘোষ। উনিও দারুণ মানুষ। সুলেখা কালিতে চাকরি করতেন। ছেড়ে দিয়ে এই কাজে এসেছিলেন। উনি মারা গেছেন, কিন্তু ওঁর হাতের কাজ ছিল চমৎকার! 

    সন্তোষ সাউয়ের কাজ

    সেই যে সত্তর থেকে যে শুরু করলেন, প্রথমেই তো আর পসার হয়ে যায়নি। সেটা তো কারুরই হয় না…

    পসার না। আমি বলি, আমার কিন্তু পসারের থেকেও মূল লক্ষ্য ছিল পুরস্কার, সরকারের খাতায় নাম তোলা। শিল্পী হিসেবে আমি কখনও সরকারি পুরস্কার পাব— এটাই তখন ভাবতাম। কাজ তো সবাই করে, পয়সা আসে, কিন্তু নাম-যশ তো সবার হয় না। আমার এটাই প্রধান ছিল। পড়াশোনা তো বেশি করিনি। ফাইভ অবধি। কিন্তু যখন মনে হল এই কাজটা করে নাম হবে, তখন মন দিয়ে এটাই করতে শুরু করলাম। শিল্পের সবথেকে বড় পুরস্কার তো এই বাহবা পাওয়াটাই! এই যে বিশ্ব বাংলা, পরপর দু-বছর আমার কাছ থেকে দুটো ময়ূর কিনেছে। এক-একটা বারো-তেরো হাজার টাকা করে। এখনো সাজানো আছে ওদের অফিসে। এটাই আমার কাছে আনন্দের।

    তারপর ধরুন ইকোপার্কে মেলায় প্রথম প্রথম আমরা যখন যেতুম, এক ভদ্রলোক আসতেন। ভগবান করুন বেঁচে থাকুন তিনি। তো এক নম্বর দিন, দু-নম্বর দিন, এরকম করে ঘুরে-ঘুরে সব দেখতেন। পরখ করতেন, প্রশ্ন করতেন। তারপর শেষদিনে বা শেষের আগের দিনে এসে প্রচুর জিনিস কিনতেন। দাম নিয়ে কোনও দরাদরি করতেন না। ফি বছর আসতেন। শিল্প, শিল্পীর প্রতি এই ভালোবাসাটা কি টাকা দিয়ে পাওয়া যায়? তারপরে ধরুন এই যে রাজস্থান যাওয়া…

    ডেমনস্ট্রেশনের জন্যে যেটা গেছিলেন?

    হ্যাঁ, তখন ডিআইসি মেদিনীপুরই ছিল। তারপর তো ভাগ হল। সেটা বোধহয় ২০০০ সাল। ওরাই নাম পাঠিয়েছিল। শিংটিং পাথরটাথর নিয়ে আমরা মোট তেরোজন শিল্পী গেছিলাম। বাঁকুড়ার নয়ন দত্ত বলে একজন ছিলেন, পাথরের কাজ করতেন। উফ্‌! গুরুদেব লোক, সে-ও গেছিল। শিল্পগ্রামে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এত আপ্যায়ন, খাতির-যত্ন পেয়েছি! দুটো থেকে আটটা অবধি ডেমনস্ট্রেশন হত। সেই সময়টায় আমাদের জন্য ওই গ্রামের মহিলারা মাটির কলসি করে ঠান্ডা জল বয়ে নিয়ে আসতেন রোজ। সত্যি! আমরা এরকম করতে পারব না। তারপর সেখানে আমাদের সরকারি গাড়িতে চাপিয়ে রাণা প্রতাপের বাড়ি-টাড়ি সব ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল।

    তার আগে একবার টিভি সেন্টারেও গেছিলাম। বললে বিশ্বাস করবেন না, একশো পঞ্চান্ন টাকা দিয়েছিল! তখন তো বাড়িতে টিভিও নেই, তবু কী আনন্দ, টিভিতে দেখাবে! সুতরাং চিরকালই যশের দিকটাই আমার লক্ষ্য ছিল, অর্থ নয়। এই বয়েসে তো কেউ আর কাজ করে না, তবু আমি করি, শেষ দিন অবধি করে যেতে চাই। আমি তো থাকব না। নামটা রয়ে যাবে। কাজটা রয়ে যাবে। সেজন্যেই করি। 

    নিজেকে শিল্পী বলতে আপনার বেশি ভাল লাগে, না কারিগর?

    নাহ্‌! আমি কারিগর কারিগরই ভাল। নিজে হাতে কাজ করি। কারিগর বললে অসুবিধেটা কোথায়? একটা কথা মনে রাখবেন : শিল্পী ভাবলেই অহং আসবে, কারিগর ভাবলে কিন্তু অহং নেই।

    আচ্ছা কাঁচামাল, মানে শিং, শিং-কে শিল্পবস্তুতে রূপান্তরিত করার এই যে পুরো পদ্ধতিটা— এটা যদি একটু বলেন…

    আমার পাশের ঘরেই শিং রয়েছে, দেখাচ্ছি আপনাকে, দেখবেন কত বড়-বড় শিং রাখা আছে! শিং-এর কালেকশন করতে হয়, বেছে নিয়ে আসতে হয়। এবার যে যেমন কাজ করবে সেই অনুযায়ী কাটতে হবে। তারপর সেটাকে আগুনে সেঁকে নরম করে নিতে হবে।

    প্রায় পুরো কাজটাই হাতে করা হয়। মেশিনের কাজ সামান্যই। কাটাকাটির কাজ, ঘষার কাজ এগুলোর জন্য মেশিন লাগে। না হলে পারফেক্ট হয় না। আগে অবশ্য সেটাও হাতেই করা হত। গতানুগতিক কাজের জন্য এখন টিনের ফর্মা আছে, ব্লক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চিরুনি, নুনদানি, পেনদানি, বাক্স : এগুলো ফর্মাতে হয়ে যায়। ফর্মাও আপনাকে দেখাব— কত রকমের যে ফর্মা আছে— ফর্মার পাহাড়!

    সেঁকা শিং চাপ দিয়ে পাত করে ফর্মায় ফেলে কেটে নিতে হয়। তারপর ঘষে-ঘষে সমান করা। তারপর পালিশ। তবে ফর্মায় তো সব কাজ হয় না। তাহলে আর শিল্পী কী করল! এই কিছুদিন আগেই একটা ভালো শিং ছিল, আমার ছেলে কেটে এনে বলল, বাবা, একটা হাতি বানাতে হবে, ভল্যুমে, মানে থ্রি-ডি। সেটা কি আর ফর্মায় হবে!

    দেখুন (হাতিটা দেখিয়ে) এটাতে একটা কার্ভ আছে— ভল্যুম; অন্য সব কাজ কিন্তু চ্যাপটামতো হয়। এটা বিশেষ শিং থেকে তৈরি। শিং তো ফাঁপা হয়, সলিড পাওয়া যায় না। এটাও ফাঁপা ছিল। এই ডায়মেনশনটা আনার জন্য ভেতরে একটু কোটিং করতে হয়েছে। কালকেই কাটা হয়েছে এটা। হাতেই কেটেছি…

    প্রায় পুরো কাজটাই হাতে করা হয়। মেশিনের কাজ সামান্যই। কাটাকাটির কাজ, ঘষার কাজ এগুলোর জন্য মেশিন লাগে। না হলে পারফেক্ট হয় না। আগে অবশ্য সেটাও হাতেই করা হত। গতানুগতিক কাজের জন্য এখন টিনের ফর্মা আছে, ব্লক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চিরুনি, নুনদানি, পেনদানি, বাক্স : এগুলো ফর্মাতে হয়ে যায়। ফর্মাও আপনাকে দেখাব— কত রকমের যে ফর্মা আছে— ফর্মার পাহাড়!

    চমৎকার হয়েছে! এই কাজগুলো করতে কীরকম সময় লাগে?

    এটা ধরুন একবেলায় কেটে ফেললাম। মেশিন থাকলে সুবিধে। কিন্তু মেশিনে কেবল আউটলাইনগুলোই হয়। আগে তো ফিগারটা আঁকতে হবে। তারপর কেটে নেওয়া। তারপর আউটলাইন। আউটলাইন আগে হাতেই ঘষে ঘষে করা হত। এখন গোলশন আছে। এটা দিয়ে কোনটোনগুলো সারাই করা হয়। প্রথম যখন কাজ শিখি তখন কিন্তু এসব কিছুই ছিল না।  

    গুলশন ছাড়া আর কী কী টুল ব্যবহার হয়?

    এই যে এটা গোলশন, আরেকটা আছে চওড়া মতো, ক্লারশন। আর করাত লাগে, বিভিন্ন মাপের। ঘষার জন্য হাফরাউন্ড। তারপর ধরুন বিভিন্ন নাম্বারের ফাইলটাইল, ড্রিল মেশিন— এইসব। এছাড়া ছোট কাজগুলোতে ডিজাইন করার জন্য জুয়েলারির পাত-টাত লাগে। মেশিন, মানে মোটর আসতে প্রোডাকশনের পরিমাণটা বেড়েছে কেবল। কারণ সময় কম লাগে। নইলে হাতেই সব হয়ে যায়।

    তবে শিক্ষক ভাল হতে হবে। নাহলে হাজার মেশিনেও কাজ ভাল হবে না। ভুয়া শিক্ষক হলে ভুয়া কারিগর পয়দা হবে। আমাদের যে-মাস্টারমশাইয়ের কথা বলছিলাম, মহারাণা— হোগলবন থেকে কোলাব্যাঙ ধরে নিয়ে এসে আমাদের দেখাতেন, শরীরের কোথায় কী ভাঁজ আছে। এরকম করে এখন আর কেউ শেখাবে? এখন অনেকেই শিঙের ব্যাঙ করে দেখি— পা উঠে থাকে। কিন্তু ব্যাঙের পা তো পাতা হয়। মাটিতে বসলে সেটা কখনওই উঠে থাকে না! আমি এক ধরনের ব্যাঙ করি— যখন ব্যাঙ ডাকে, দেখবেন গলাটা ফুলে থাকে— সেইরকম ব্যাঙ। সেটা আবার বরেন ঘোষের থেকে শেখা। এমনও হয়েছে আমি বার বার ব্যাঙ করে নিয়ে গেছি, দেখে বলেছে হয়নি। আবার শিখিয়েছে। বলছি না— অনেক জুতোর ঠোক্কর খেয়ে এসব শিখেছি। এখনও শিখছি।

    আপনি তো এখনও রোজ কাজ করেন?

    হ্যাঁ, আমি নিজে হাতেই সব করি। এই যাকে দেখছেন, ওই একজনই— কর্মচারী, ছাত্র, সহায়ক। ওর নাম অশোক দাস।

    আপনার ছেলে এই কাজে আসেননি?

    না।

    আপনার কখনও পরবর্তী প্রজন্মকে কাজ শেখাতে ইচ্ছে হয়নি?

    গত বৎসর এখানে প্রায় তিরিশজন ভদ্রমহিলাকে একত্র করে কাজ শেখানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি ছিলাম, অনিল হাজরা মহাশয় ছিলেন। দুজন মাস্টারমশাই। উনিও খুব ভাল শিল্পী। একই গুরুদেবের ছাত্র আমরা। আমরা দুজনে মিলে ট্রেনিং দিয়েছিলাম।

    অনিল হাজরা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করছি, উনি কি শিল্পী শঙ্করী হাজরার কেউ হন?

    না, না। শঙ্করী হাজরা ওঁর কেউ নয়। শঙ্করী হাজরা কিন্তু মূলত সেলসম্যান। ওঁর স্বামী ভাল কাজ করেন। আমরা যখন ট্রেনিং করিয়েছিলাম, আমার ভাগে বৈষ্ণবচক অংশটা পড়েছিল। তো আমি বলেছিলাম, ‘বউমা’ বলি আমি, বলেছিলাম, ‘বউমা, তুমি একজন ভাল কারিগরের স্ত্রী, তুমি এখনো বসতে শিখলে না!’

    কারিগরের বসাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এরকম বলে ফেলি। আজকে আমার কোমরের অসুখ হয়ে গেছে বলে আমায় টুলে বসে কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে কাজ করা যায় না। মাটিতে বসে কাজ করতে হয়। আমরা যখন বারুইপুরে কুলতলায় ট্রেনিং করাতে গেছিলাম, সেখানেও আমাদের টেবিল দিয়েছিল, আমি বলেছিলাম তাঁদের— টেবিলে বসে এই কাজ হয় না!

    যে-কথা বলছিলাম— পরবর্তী প্রজন্মকে শেখানোর ক্ষেত্রে, সত্যি বলতে কী, সরকারকে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা সাহায্য করব। আগে এরকম হয়েছে— সরকারি ট্রেনিং-এ হয়তো সরকার দুটো মোটর দিল, কিছু টুল্‌স দিল, বাকিটা আমরা নিজেদের যন্ত্রপাতি, মোটর দিয়ে চালিয়ে নিলাম। কিন্তু উদ্যোগটা তো সরকারকে নিতে হবে।

    ঠিক। সেটা যেমন একটা দিক, সন্তোষবাবু— তেমন পারিবারিক যে শিল্পশিক্ষার ধারাটা, মানে, এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে যেভাবে বিদ্যাটা সঞ্চারিত হয়— আপনার ছেলে বা নাতির ক্ষেত্রে, সেই ধারাটা কি বজায় থাকবে না?

    না। আমার ছেলে কাজ জানে, ভালই জানে। কিন্তু সে এখন ছোটখাট একটা চাকরি পেয়ে গেছে। তাই আর কাজ করে না। আর নাতি তো ছোট— ওই যে এসেছিল দেখলেন তো!

    তাহলে এই ধারাটা আপনার প্রজন্মেই শেষ হয়ে যাবে?

    হ্যাঁ!

    সেটা নিয়ে আপনার কোনও দুঃখ নেই?

    না, আমার আগ্রহ আছে, আছে বলেই আমি এখনও কাজ করে যাচ্ছি। আগামী দিনেও করে যাব। কিন্তু কারো যদি ইন্টারেস্ট না থাকে, তার পক্ষে তো এরকমভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। বরং ইয়ং যারা সত্যিই শিখতে চায় তাদের জন্যে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। একটা প্রোজেক্টই হয় না! আমাদের একটা পুরাতন কারখানা ছিল, বুঝলেন, সমিতির। সেটার একেবারে ভগ্নদশা, দেওয়াল-টেওয়াল সব খসে খসে পড়ছে। বিডিও, আইডিও, ইঞ্জিনিয়ার সবাই এসে দেখে গেছে। দেড় কোটি টাকা স্যাংশন হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু এমন সেক্রেটারি, সভাপতি, বলতে খারাপ লাগে, ওঁরা একটা কাগজ জোগাড় করে দিতে পারছেন না! আমাদের বার বার ডিআইসি থেকে ফোন করছে যে সমিতিটা কার নামে; সেটা কেউ একটু হেল্প করছেন না। সরকারি উদ্যোগ দরকার— যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে, কাঁচামালের ক্ষেত্রে। নিজেদের যন্ত্র হবে। আস্তে-আস্তে হবে। কিন্তু শুরুতে তো সরকারের সাহায্য লাগবে। আমারও তো একটা মোটর থেকে শুরু করে ছ-সাতটা মোটর হয়েছে, পয়সা হয়েছে, নাম হয়েছে। কিন্তু সরকার সাহায্য না করলে কিচ্ছু হবে না। কেউ শিখতেও আসবে না, শিল্পটাও হারিয়ে যাবে। এটা নিয়ে আমার দুঃখ আছে!

    বর্তমানে এই শিল্পটার বাণিজ্যিক দিকটা কী অবস্থায় রয়েছে?

    করোনার পর থেকে খুব খারাপ হয়ে গেছে। আসলে আগে প্রচুর এক্সপোর্টের কাজ আসত। দু-দশটা খেলনা জিনিসপত্র বানিয়ে তো লাভ নেই। তাতে সংসার চলে না। আগে এখানে এক্সপোর্টের ফর্মা ভর্তি হয়ে থাকত। জাপান, জার্মানি কত জায়গায় জিনিস বানিয়ে পাঠিয়েছি। চিনা প্রতিনিধিরা আমাদের সমিতিতে এসেছেন। কাজ দেখে অর্ডার করে গেছেন। কিন্তু ধীরে-ধীরে অনেকেই শিং ছেড়ে দিয়ে কাঠের কাজে ঢুকে গেল। কাজও কমতে শুরু করল। কাঠের কাজে লাভ অনেক বেশি। লোকাল মার্কেটে অনেক অর্ডার। আর করোনার পর তো সবই একেবারে বসে গেছে। কিন্তু কী বুঝলেন, শিং হচ্ছে শিং! সে-কাজে চ্যালেঞ্জ বেশি, তার কদরও বেশি, আর খরিদ্দারও আলাদা, যে-সে খরিদ্দার নয়! শিঙের কিন্তু কোনো রিঅ্যাকশনও নেই। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে দেখেছেন।

    আপনাদের শিং কোথা কোথা থেকে আসে?

    কলকাতা। রাজাবাজার থেকে…

    উলুবেড়িয়া তো বোধহয় এখান থেকে বেশি কাছে পড়ে?

    উলুবেড়িয়াতে আছে। আমরাও মাঝে মাঝে আনি সেখান থেকে। তবে রাজাবাজার হচ্ছে খাঁটি জায়গা।

    শিঙের জোগান কি আগের মতো আছে? না এখন খানিকটা কমেছে?

    জোগান কমেছে। দামও বেড়েছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। ব্যবসায়ী আর খরিদ্দার তো পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। আপনি ব্যবসা করছেন। আমি যদি না কিনতে যাই আপনার ব্যবসা চলবে? আপনি আর ব্যবসা করবেন? শিল্পী কমছে, তাই শিঙের যোগানও কমছে। আমার এখানে আগে দশ-বারোজন কারিগর রাত্রে শুত। আর এখন ওই একজন। দেখুন না, পাঁচখানা মোটর আর দুজন মোটে কাজের লোক! 

    সত্তর-একাত্তরে যখন শুরু করেছিলেন, তখন তো একাই কাজ করতেন?

    হ্যাঁ। তারপর বেশি অর্ডার আসতে শুরু করল। একা হাতে পারছিলাম না। একটু-একটু করে এই জায়গাটা ঘিরে, লোকজন নিয়ে কারখানা করতে হল। তারপর একটা সময় ছিল, যখন আমি শুধু অর্ডারই ধরতাম। কাজ করার সময় হত না। 

    মেলার সিজনেও নিশ্চয়ই বেশি লোকের প্রয়োজন পড়ত?

    মেলাটেলায় যেতাম আমরা, যেতাম না তা নয়। মেলায় তো সবাই চান্স পেত না। আমরা কয়েকজন হয়তো পেতাম। তাতে যে খুব বিক্রি হত তেমন না। তবে এখন এই যা জিনিসপত্র দেখছেন— এসব মেলার জন্যেই। এখন তো আর অত অর্ডার নেই! আর কলকাতার মেলা বলতে ধর্মতলায় যখন মেলা হত, সবচেয়ে ভাল বিক্রি হত। সেটা বোধহয় ২০০০ সাল হবে। সায়েন্স সিটিতেও মেলা ভাল ছিল। এখন তো ইকো পার্কে হয়। ওই যখন ধর্মতলায় মেলা, তখনই সরকার আমাকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছিল— কাজ দেখাতে, কাজ শেখাতে। দিল্লি, বম্বে, রাজস্থান— কত জায়গায় যে গেছি! ডেমনস্ট্রেশন করার জন্যে সার্টিফিকেটও দিয়েছিল। 

    কী ধরনের কাজ নিয়ে যেতেন?

    অনেকরকম। আগে তো এখানে শুধুই চিরুনি হত।

    সে তো অনেক আগে— যশোর থেকে যে-ধারাটা এসেছিল! ভারতলক্ষ্মী, সিঁথি, বঙ্গনারী, আশালতা, তেলকম… 

    হ্যাঁ, তা ছিল। ঠিকই। সেসব চিরুনির খুব বাজার ছিল। এখান থেকে মাল যেত চেতলার হাটে। প্রচুর বিক্রি! তবে তেলকমের কথা আর বলবেন না। লোকে জানে না, তাই তেলকম নিয়ে লাফালাফি করে। তেলকম হচ্ছে, আমি চিরুনিতে তেলটা ভরলাম, প্যাঁচটা আঁটলাম, কিন্তু ঝরে যাচ্ছে তো! আমাদের এক মাস্টারমশাইও তেলকম বানাতেন। কিন্তু পদ্ধতিটা ঠিক নয়। আমি ওঁর ছাত্র, আমার বলাটা ঠিক নয়, কিন্তু ওই পদ্ধতিটা চলে না। এমন যদি হত যে শুধু ব্যবহার করার সময়েই তেলটা পড়বে— তা হলে ঠিক ছিল। কিন্তু তা তো নয়। তেল যখন ইচ্ছে পড়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে হাত দিয়ে মাখা ভাল। আমি একজন ছোটখাটো শিল্পী হয়েও বলছি, তেলকম শুধুই চমক, আর কিছু নয়! তবে শিঙের চিরুনি ছিল, এখনও আছে।

    কিন্তু এই বৈচিত্র্যটা কি আছে?

    ততটা নেই। তবে যেহেতু মার্কেট আছে, চিরুনিও আছে। থাকবেও। শিঙের চিরুনির একটা উপকারিতা হল মাথায় খুসকি হয় না। আমাদের জন্মের আগে থেকেই তো এখানকার চিরুনি বিখ্যাত! 

    চিরুনি ছাড়া আর কী কী নিয়ে যেতেন?

    আর্টের জিনিস বলতে হাতি, চিংড়ি মাছ। এই যে ছোট-ছোট চিংড়িগুলো, চাবির রিং হয়। বড় চিংড়ি দিয়ে শো-পিস। তারপর ফুলদানি, পেনদানি, নুনদানি, বাক্স, খেলনা, গেলাস, বাটি এসবও থাকত। বড় পাখি, বড় মাছ, মূর্তি এগুলো আর্ট পিস! বিভিন্নরকম জিনিস বানাতাম, বানাই এখনও। তাছাড়া আপনি যেটার ছবি দেবেন সেটাই বানিয়ে দেব। একদম নিখুঁত! বাইরে থেকে যখন অর্ডার আসে, স্যাম্পল পাঠায় না ওরা। ছবি পাঠায়। ছবি দেখে আমরা করে দিই। আমাদের এক কোম্পানির স্যার বলতেন, ‘তোমরা কী করে করো! ছবি আঁকা সহজ কিন্তু শিং দিয়ে বানানো তো সহজ নয়।’ আসলে হাতের কাজ ব্যাপারটা এখানে দরকার হয়। তার সামান্য কিছুটা হয়তো আয়ত্ত করতে পেরেছি। পঞ্চুদাও (পঞ্চানন্দ দাস, পূর্বে উল্লিখিত) ভাল শিল্পী। তবে মাস্টারমশাইয়ের গুণে তো অনেকটা হয়— ফলে এখনও পর্যন্ত ডোঙাভাঙা আর বৈষ্ণবচকের কাজের তফাত রয়ে গেছে।

    কীরকম তফাত?

    ফিনিশিং-এর পার্থক্য। ওটাই ফারাক করে দেয়! স্থানবিশেষে দেখলে, আগে বোঝা যেত, এই তফাতটা…

    আচ্ছা একটু আগে যে সাদা শিংটা দেখাচ্ছিলেন, উলুবেড়িয়া থেকে এনেছেন বললেন, সেটা কি বিশেষ কিছু বানাবেন বলে?

    ওটা আসলে একটা পিঠছড়া বানাব বলে কেনা। ওটা কিন্তু গোরুর শিং। গোরুর শিং পাতলা হয়। ওই যে হাতিটা দেখালাম, ওটা মহিষের শিঙের, মোটা। ওরকম মোটা শিং সবসময়ে পাওয়া যায় না। কিন্তু মোটা শিং হলে অন্যরকম কাজ করা যায়। এখন মহিষের শিংটা কম আসে, গোরুর শিংটাই বেশি পাওয়া যায়। 

    মোষ আর গোরুর শিঙের গড়ন, গঠন, টেক্সচারের তো পার্থক্য আছে?

    হ্যাঁ।

    সেটা কীরকম?

    মহিষের শিং আলাদা জিনিস। তাকে একবার লম্প জ্বেলে সেঁকে নিলে যেখানে যা বাঁক দেবেন সব হয়ে যাবে। কিন্তু গোরুর শিঙের চোঁচ একটু ঘন। ম্যাটার আলাদা, রস নেই, ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই যে শিঙাটিঙাগুলো হয় এগুলো সব গোরুর শিঙের। এমনিতে গোরুর শিংটা পাতলা হয় তো। 

    আর কোনও পশুর শিং কি ব্যবহার হয়?

    আগে আমরা হরিণের শিং দিয়ে জয়েন্ট বানাতাম। কিন্তু এখন হরিণের শিং তো আর পাওয়া যায় না। এখন ওসব করলে জেলে ভরে দেবে… (হাসি)

    তখন সাপ্লাই কীভাবে পেতেন? মানে কোথা থেকে আসত?

    তখন আসত। রাজাবাজার থেকেই পেতাম। বড়-বড় ডালপালাসমেত হরিণের শিং। 

    মহিষের শিং আলাদা জিনিস। তাকে একবার লম্প জ্বেলে সেঁকে নিলে যেখানে যা বাঁক দেবেন সব হয়ে যাবে। কিন্তু গোরুর শিঙের চোঁচ একটু ঘন। ম্যাটার আলাদা, রস নেই, ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই যে শিঙাটিঙাগুলো হয় এগুলো সব গোরুর শিঙের। এমনিতে গোরুর শিংটা পাতলা হয় তো। 

    দামের পার্থক্য ছিল নিশ্চয়ই?

    তেমন নয়। তখন খুব কম দামেই পাওয়া যেত। তখন আমরা চোখ দিতাম হরিণের শিঙের। এই যে কচ্ছপ, মাছ, ব্যাঙ, হাতি, পাখি, ময়ূর— এই সব কিছুর চোখ বানানো হত হরিণের শিং দিয়ে। এখন তো প্লাস্টিকের চুড়ি, শঙ্খ এসবের টুকরো দিয়ে চোখ দিই।

    আপনার বেশ কিছু কাজে দেখছি শিঙের সঙ্গে কাঠেরও ব্যবহার রয়েছে। শিঙের সঙ্গে জোড় দেওয়ার জন্য কি বিশেষ কোনও কাঠ লাগে?

    দেখুন, আমি যে-কাঠই লাগিয়ে দিই, আপনি কি বুঝতে পারবেন? একবার পালিশ হয়ে গেলে কাঠের কিছুই বোঝা যায় না। আমি নিজেই মায়াপুরে চন্দন কাঠ কিনতে গিয়ে ঠকে চলে এসেছি। কিন্তু কাঠ যদি বলেন, শিঙের সঙ্গে সবচেয়ে ভাল জোড় খায় নিমকাঠ। শিঙের সঙ্গে ঝিনুকও ভাল জোড় হয়। আপনাকে মহিষের শিঙের যে-পাখিটা দেখালাম, সেটার চোখে যে-গোলমতো পিসটা— সেটা কিন্তু ঝিনুকের পিস। 

    ওটা মোষের শিঙের! মোষের শিং সাদা হয়?

    হয় তো! কালোই বেশি হয়, তবে সাদাও হয়। আর গোরুর শিং বেশি সাদা পাওয়া যায়। এক সময়ে জানেন, শিং কিনে এনেছি আড়াই টাকা সের! আর এখন সেই শিঙের কী দাম হয়েছে!

    এই যে শিঙের সঙ্গে কাঠ বা ঝিনুক বা শঙ্খ জোড় দেন, এক্ষেত্রে কোনও বিশেষ আঠা ব্যবহার করেন আপনারা?

    না না, বিশেষ কিছু না। ওই ফেভিকল, এয়ারোলাইট, ফেভিকুইক এসব দিয়েই আটকে যায়। 

    আচ্ছা এই শিল্পের কোনও বাই-প্রোডাক্ট আছে? এই যে শিঙের অব্যবহৃত টুকরোটাকরা, হর্ন-ডাস্ট— এগুলো কি আলাদা করে বিক্রি হয়?

    ওরেব্বাবা! এর ডিম্যান্ড তো আরও বেশি। ফুলবাড়িতে বিক্রি করি তো আমরা। পঞ্চাশ টাকা কেজি। ও থেকে সার তৈরি হয়। কিছুই ওয়েস্টেজ নেই।

    উড়িষ্যা, মানে যেখানকার বিষাণশিল্প সবচেয়ে বিখ্যাত, সেই উড়িষ্যায় কখনো গেছেন? সেখানকার কাজ দেখা, শেখার চেষ্টা করেছেন?

    না, ওই মাস্টারমশাইদের থেকে যেটুকু শেখার শিখেছি। নিজে থেকে কখনও যাওয়া হয়নি। তবে এই কয়েক বছর আগে উড়িষ্যা থেকে বারো-তেরোজন এসেছিলেন— এখানকার শিল্পীদের কাজ দেখতে। একটা তক্তপোষে মাল সাজিয়ে দিয়েছিলাম। ওঁরা সব হাতে নিয়ে দেখছিলেন। ওঁরা কিন্তু স্বীকার করেছিলেন আমাদের কাজ অন্য ধরনের, ওখানকার মতো নয়। তবে আমি আমি উড়িষ্যার শিল্পীদের কাজ দেখেছি, কয়েকটা মেলায়। ওদের বানানো হাতি সত্যিই অপূর্ব।

    উড়িষ্যায় কিন্তু বর্তমানে এই শিল্পটার অবস্থা এ-রাজ্যের তুলনায় ভাল। এখানে কি নতুন শিল্পী তৈরি হচ্ছে?

    না, নতুন লোক খুব একটা আসছে না। যে ক-জন আছি এখন, বৈষ্ণবচক, কলাগাছিয়া, জুলপের হাটি সব মিলিয়ে এই চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ জন, এই ক-জনই। ডিআইসি-কে আমি এদের নামও পাঠিয়েছি তালিকা করে। অনেকেই ছেড়ে দিয়েছে, কাঠের কাজে চলে গেছে। নিয়মিত কেনার লোক না থাকলে আর কী হবে! সে একদিন গেছে— রাত জেগে কাজ করতে হয়েছে; প্রত্যেক শনিবার কতকাতায় যেতে হত মাল দিতে; তখন কত চাহিদা, কত সেল! সে সব গেছে।

    তাহলে এই শিল্পটার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী মনে হয় আপনার?

    ভবিষ্যৎ হয়তো চলবে। শিঙের কাজ কোনওদিন বন্ধ হবে না। নতুন কেউ-না-কেউ তো নিশ্চয়ই আসবেন। এই বিশ্বাসটাই করি। সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। তিন মাস ট্রেনিং দিলেই কত নতুন শিল্পী তৈরি হবে। এখানে মেয়েরা অনেকেই হেল্পারের কাজ করে। তারা কাজ জানে। ট্রেনিং দিলে তাদের হাত আরও পাকা হবে, ভাল শিল্পী হয়ে উঠবেন। এইসব ছোটখাট মেশিনে কাজ করা কোনও ব্যাপারই নয়। 

    আর সরকারি কোনও পদক্ষেপ যদি নেওয়া না হয়?

    তাহলে মরে যাবে। আমরা এই চার-পাঁচ ঘর মিলিয়ে যে ক-জন আছি, ব্যাস! তারপর শেষ হয়ে যাবে। সব কিছুই তো একদিন বন্ধ হবে। ইস্কুলে ছাত্র যদি না আসে তাহলে ইস্কুল কেমন করে চলবে বলুন! নারায়ণচকের দিকটায় তো সব কাঠের কাজ  করে এখন। একমাত্র পঞ্চুদা বাদে। আর এখানে বৈষ্ণবচক, জুলপেরহাটি— ব্যাস! আর কই!

    একটা ঘটনা বলি আপনাকে। আমাদের সোসাইটির ফান্ডে আগে তিন-সাড়ে তিন লাখ টাকা ছিল। করোনার সময়ে যখন কাজ বসে গেল, প্রত্যেক মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে সদস্যদের দেওয়া হয়েছে। সবাই তো আর আমার মতো মাসে আট হাজার টাকা করে সরকারি ভাতা পায় না! তার জন্য একটা কমিটিও করা হয়েছিল। উপদেষ্টা হিসেবে আমাকে আর জয়দেব জানা মহাশয়কে রাখা হয়েছিল সেখানে। এখন সেই টাকা, কী বলব আপনাকে, মিটিং-এ বলা হয়েছিল ‘অনুদান’ হিসেবে দেওয়া হবে। আর সেক্রেটারি যিনি, টাকা দেওয়ার সময়ে তিনি বিল কাটছেন ‘অগ্রিম’ লিখে। ভাবুন! লেখা ছিল ‘অনুদান’, তাতে কমিটির সই ছিল, আমারও সই ছিল। কেন বিলে ‘অগ্রিম’ লেখা থাকবে? আমি যদি করোনায় মরে যাই তাহলে আমার ছেলে তো বলবে বাবা দেনা করে মরেছে! কারিগরদেরও দোষ আছে। এই যে মেলা হয়, একই অন্নে তিনজন আছে, তারা তিনটে আলাদা স্টল নেয় কী করে! সেখানে তো আরেকজন কারিগর সুযোগ পেতে পারত। পায় না। আমি একবার আইডিও-কে বলেওছিলাম। কিন্তু কিছুই লাভ হয়নি। আমি হয়তো খুব বড়ো কেউ নই, কিন্তু এই সামান্য ভুলগুলো ধরার হক তো আমার আছে। 

    নিশ্চয়ই আছে। এবং আমি আশা করব, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে-পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন—ভবিষ্যতে সে-বিষয়ে সরকারি সংস্থাগুলি ভাববে এবং এগিয়ে আসবে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সন্তোষবাবু, এতটা সময় আপনি আমায় দিলেন…

    ধন্যবাদ দেওয়া উচিত আপনাকে। এত দূর থেকে এসেছেন আমার মতো সাধারণ মানুষের ইন্টারভিউ করতে। আপনাদের মতো মানুষের জন্যই তো ছোট শিল্পগুলো বেঁচে আছে। বেঁচে থাকবে। নমস্কার আপনাকে!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook