আমার কাছে প্রীতীশ নন্দী, আমাদের সময়ের স্কুলের হেডস্যরের মতো। যখন কথা বলার প্রয়োজন হত, তখন কিন্তু তিনি ফিসফাস করতেন না। সব কথাই ছিল স্পষ্ট, সোচ্চার নির্দেশ! ভারী বুট মচমচিয়ে আসতেন যখন, তখন প্রায় অ্যালার্মের মতো ঠেকত কানে— ‘ওই তিনি আসছেন’ জাতীয় একটা ফিসফাস। যখন কোনও বড় হলে ঢুকতেন, বা নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসতেন, তখন যেন ওঁকে ঘিরে একটা শব্দবলয় তৈরি হত, যা ওঁর সঙ্গে-সঙ্গেই পায়চারি করত। সামান্য ঘাড় কাত করে হাঁটতেন; সব কিছু সাদা, শুধু জুতোটা কালো। মাঝারি উচ্চতা। হেঁটে যেতে-যেতে হয়তো হঠাৎ উঁকি দিলেন ফিচার এডিটরের টেবিলে সেঁটে থাকা কপি বোর্ডে; ‘নিখিল, নরসিংহ-র ‘এইচ’-টা মিসিং! ঠিক করো!’ হুংকার দিতেন যেন। নিখিল লক্ষ্মণ ছিল আমার বন্ধু, ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’-র ফিচার এডিটর। প্রসঙ্গত, এখানে নরসিংহ মানে, নরসিংহ রাও। নিখিল তৎক্ষণাৎ সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে হয়তো বলত, ‘হ্যাঁ মিস্টার নন্দী!’ এই ঘটনা আদতেই ঘটেছিল সেইদিন, যেদিন আমি ওঁর সঙ্গে প্রথম দেখা করতে গিয়েছি। তারিখটাও মনে আছে— ২ জানুয়ারি, ১৯৮৬। সেই আমার ওঁকে নিয়ে প্রথম, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এর আগে বারদুয়েক গেছিলাম, ওঁর সঙ্গে দেখা হয়নি।
আরও পড়ুন : কলকাতা নয়, ‘ক্যালকাটা’কে ভালবেসেছিলেন প্রীতীশ নন্দী…
আমার বন্ধু নিখিল বলেছিল, প্রীতীশ নন্দী এক ঝলকেই, এমনকী আড়চোখ বুলিয়েও, ধরে ফেলতেন, একটি কপিতে কোথায় গলদ রয়েছে। মনে আছে, একবার তখনও প্রেস থেকে কাগজ আমরা হাতে পাইনি, ফাইনাল কারেকশনের জন্য নন্দীদার কাছে পাঠানো হয়েছে শুধু। উনি এয়ারপোর্ট থেকে আসতে-আসতে সমস্তটা কী অসম্ভব দক্ষতায় দেখে দিয়েছিলেন। চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন ভুলগুলো। সম্পাদকের এই নিষ্ঠা কল্পনাতীত। দ্রুত গতির পাঠক, দ্রুত গতির লেখক এবং দ্রুত গতির সম্পাদক— সবটা মিলিয়ে ছিলেন প্রীতীশ নন্দী। যদি কেউ একদিনের জন্যও ওঁর সঙ্গে কাজ করে থাকে, ভুলতে পারবে না। সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ না থাকলেও, প্রীতীশদা কমিউনিকেট করতে পারতেন চমৎকার! ওটাই ওঁর সবচেয়ে বড় সাফল্যের চাবিকাঠি।
থিয়েটার ছেড়ে দিয়ে যখন মুম্বই চলে গেলাম একদিন, তখনও ভাবিনি ক্যামেরাই আমার প্রধান বন্ধু হয়ে থাকবে বাকি জীবন। থিয়েটার ব্যাকস্টেজে চলে গেলেও অবশ্য নাটকীয়তা আমার ছবিতে থেকেই গেছিল। এখন বলতে লজ্জাই করে, সে-সময়ে মুম্বই শহরে আমি চিত্র-সাংবাদিকতায় সবচেয়ে বেশি মাইনে পেতাম। ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’-তে এসে সেটা আরও বাড়ে। ১৯৮৫ সালে যখন কংগ্রেসের ১০০ বছর পূর্ণ হয়, তখন আমি কিছু ছবি তুলে উইকলি-তে নিয়ে গেছিলাম। নিখিলের সঙ্গে ওই আমার প্রথম আলাপ। কিন্তু সেবার দেরি করে ফেলেছিলাম সামান্য। নিখিল জানিয়েছিল, আর তিনদিন আগে আসতে পারলে আমার ছবিগুলো ছাপা হতে পারত। ততদিনে ওদের পত্রিকা ছাপতে চলে গেছে। যাই হোক, আমার ফোন নম্বর দিয়ে চলে এসেছিলাম।
আমি তখন আমার কাকার সঙ্গে শহর মূল শহর থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে থাকি। নিজেদের টেলিফোনও নেই। পাশের বাড়িতে একটা ফোন ছিল। নিখিলের সঙ্গে দেখা করে আসার চার-পাঁচদিন পরে আমার কাছে সেই ফোনে একটা ফোন আসে। ফোন ধরে দেখি, অ্যাসাইনমেন্টের অনুরোধ নিয়ে একজন মহিলা ফোন করেছেন। রাজকমল স্টুডিয়োতে কুন্দন শাহ একটা সিরিয়াল করছেন। শুটের ছবি তুলতে হবে। চলে গেলাম ছবি তুলতে। তুললামও। সাদা-কালো ছবি সব। ছবি যে ছাপা হবে, নাম যাবে কী করে? তখনও যে আমি ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’-তে ঢুকিনি, চাকরি করি ‘গুজরাট সমাচার’-এ। নিখিল বুদ্ধি দিয়েছিল। ও বলেছিল, পলাশের ‘পল’ আর ভৌমিকের ‘মিক’ মিলিয়ে ‘মিক পল’ নাম থাক। কারোর বোঝার ক্ষমতা থাকবে না, ওসব কার ছবি। আমার তোলা ছবি দেখে প্রীতীশদা বলেছিলেন, নিখিলের সঙ্গে ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’-র সঙ্গে কিছু ট্রায়াল অ্যাসাইনমেন্টে থাকতে। আমার মনে হয়, সেগুলো বেশ সফলভাবেই করেছিলাম আমি। মনে আছে, ১৯৮৬ সালের শরৎকালের একদিন, আমি অবশেষে ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’-র সদস্যপদ পেলাম।
বস্তুত, একটা লেখা যথেষ্ট নয় প্রীতীশ নন্দী আর ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’-র অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্য। দু-তিনটি ঘটনা মনে পড়ে খুব বিস্তারিতভাবে। যেমন, আমার বাবা ১৯৮৭ সালের জুলাইতে চলে গেলেন। আমি খবর পেয়েছিলাম সেদিন বিকেলে। তখনকার দিনে তড়িঘড়ি ফ্লাইটে টিকিট পাওয়া সহজ কথা ছিল না। অথচ প্রীতীশ নন্দী পরের দিন সকালেই আমার কলকাতার টিকিটের বন্দোবস্ত করে দিলেন। ঠিক তার পরের দিন, একটা হাতে লেখা চিঠি এসে পৌঁছল আমাদের বাড়িতে। প্রীতীশ সেই চিঠি লিখেছিলেন আমার মা ও পরিবারের উদ্দেশে। এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার, গভীর রাতে, মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে, প্রায় ১০০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে এসে পৌঁছেছিলেন আমাদের বাড়িতে, সেই চিঠি পৌঁছে দিতে। প্রীতীশদা নির্দেশ দিয়েছিলেন, যতদিন সম্ভব আমি যেন মায়ের সঙ্গে থাকি। এমনই ছিলেন প্রীতীশ নন্দী।
প্রীতীশদা আমার কাজ এত পছন্দ করেছিলেন, আমাকে পুরোদমে উৎসাহ দিয়েছিলেন, লেখার জন্য। বলতেন, ‘ভেবো না, তুমি ভাল স্টোরিটেলার। তুমি লেখো, আমি দেখব তোমার কপি।’ এটা আমার কাছে এতটাই উদ্দীপক ছিল যে, বড়-ছোট-মাঝারি নানা লেখা আমি লিখেছি উইকলি-র জন্য। বেশিরভাগই আমার বাইলাইন ছাড়া গিয়েছিল। তাতে কিচ্ছু যায় আসে না যদিও!
যখনই গোপনে আমাকে চেম্বারে ডাকতেন, বুঝতাম, কিছু না কিছু ‘স্কুপ’ আছেই। একদিন বিকেলে ডেকে একটা ভাঁজ করা চিরকুট ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। তাতে লেখা ছিল— প্রতীক্ষা, সাড়ে ছ’টা। আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ‘যতক্ষণ বলব, ততক্ষণ ছবি তুলে যাবে। আর সেটা করতে হবে বিন্দুমাত্র বাড়াবাড়ি না করে।’ সেই সাক্ষাৎকার ছিল খোদ অমিতাভ বচ্চনের! দেখেছিলাম, কীভাবে স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন সেই সাক্ষাৎকারে ভেঙে পড়েছিলেন, চোখের জল তাঁর বাধ মানছিল না। তখন সদ্য বোফর্স ঘটেছে। কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন বিরোধী দলের মধ্যে তখন অমিতাভের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে নানাবিধ। তিনি প্রায় অসহায়ের মতো বলেছিলেন সেদিন, ‘হেল্প মি প্রীতীশ, প্লিজ হেল্প মাই ফ্রেন্ড!’
অমিতাভ বচ্চনের বাংলো থেকে বেরনোর সময়ে প্রীতীশদা ওঁর মারুতি জিপসি-র ব্যাকসিটে বসালেন ওঁর চালককে, আমি বসলাম ওঁর পাশে। সে-রাতে দেখেছিলাম, প্রীতীশদা কতটা দক্ষ চালক! প্রায় মোটর রেস কারের মতো চালাচ্ছিলেন গাড়ি। গাড়ি চালাতে-চালাতেই আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী মনে হয়, চোখের জলটা সত্যিকারের?’ আমার ভেতরের অভিনেতা তখন জেগে ওঠে। ‘না,’ আমি উত্তর দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ। ‘সত্যি?’ প্রীতীশদা আবার জিজ্ঞেস করলেন। ‘হ্যাঁ’, আমি বললাম, ‘উনি সত্যিই ভাল অভিনেতা, তবে আপনার বন্ধু যেহেতু, আপনি ওঁকে সাহায্য করতেই পারেন।’ এমন কত কথা মনে পড়ে!
আমি ঠিক ওঁর প্রয়াণের আগের দিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট সোশ্যাল মিডিয়া সাংবাদিকদের ব্যান হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলতে ওঁকে মেসেজ করেছিলাম। যে-কোনও ব্যানেরই বিরুদ্ধে ছিলেন প্রীতীশদা। মেসেজ করতে গিয়েই খেয়াল করলাম, আমার নিউ ইয়ারের শুভেচ্ছাটাও উনি দেখেননি। বিস্মিত হলাম। আরও বিস্মিত হলাম ফ্রান্সিস ডিসা-র ফোন আসায়। ফ্রান্সিস আর আমি এক সময়ে কাজ করতাম প্রীতীশদার সঙ্গে। ও ছিল গ্রাফিক্স আর্টিস্ট। ও আমায় ফোনে জিজ্ঞাসা করে, প্রীতীশদার চলে যাওয়ার খবরটা সত্যি কি না! তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুরনো কলিগদের ফোনে ওঁর মৃত্যুসংবাদ পেলাম।
ওঁর মুম্বইয়ের অফিস আমার অফিস থেকে অল্প দূরত্বেই ছিল। পাঁচ-ছ’বছর আগে শেষ ওঁর সঙ্গে আড্ডা মারতে গিয়েছিলাম। এক কাপ চায়ের সঙ্গে সেই আড্ডা জমেওছিল, স্বল্প সময়ের জন্য হলেও। বলেছিলেন, ‘যখন খুশি চলে আসবে, চা খেয়ে যাবে। আর যোগাযোগ রেখো।’
যোগাযোগ রেখেছিলাম, তবে ফোন মারফত। মনে আছে, গত বছর হঠাৎই ইনস্টাগ্রামে আমার একটি ছবি দেখে আমাকে যোগাযোগ করেছিলেন। একপাল ফ্লেমিংগো উড়ে যাচ্ছে, ক্যাপশনে লেখা, ‘ফ্রিডম’। খুব পছন্দ হয়েছিল ছবিটা ওঁর। আমার থেকে ওটার প্রিন্ট চেয়েছিলেন। কারিগরি অসুবিধের কারণে ওঁকে সফট কপিই পাঠিয়েছিলাম সেই ছবির। প্রিন্ট আর দেওয়া হয়নি। ভাবলেই আফশোস হয়। বেঁচে থাকলে ওঁর ৭৯ বছর বয়স হত আজ। ওঁর সব সহকর্মীই বোধহয় ওঁকে মিস করবে।
ভাল থাকবেন প্রীতীশদা, শুভ জন্মদিন!