বছরটা ২০১৫। পুজোতে পাহাড়ে গিয়ে দিনকয় কাটিয়ে আসার বন্দোবস্ত বহুকাল ধরে বহাল রেখেছি। সেবার পুজোয় ঠিক করলাম দারিংবাড়ি যাব। আমি আর এক বন্ধু। পুরুষ বন্ধু। কিন্তু প্রেমিক নয়। দুই বন্ধু একসঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছি, অতএব আলাদা ঘর নেওয়ার প্রশ্নই নেই। কে বলেছে প্রশ্ন নেই? বুকিং-এর জন্য সরকারি বাংলোতে চেষ্টা করতেই, ওঁরা জানতে চাইলেন বন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী! বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাদের প্রশ্নের উত্তরে জানালাম, না, আমাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক নেই। বুকিং নাকচ করে দেওয়া হল তৎক্ষণাৎ। ইতিমধ্যে আমাদের ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আমরা পরামর্শ করে ঠিক করলাম, এবার বন্ধু ফোন করবে। ও বলবে, ওর প্রেমিকাকে নিয়ে থাকার জন্য একটি ডাবল বেডরুম চাইছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের একতরফা শোনার পর ফোন কেটে বন্ধু জানাল, বিবাহিত দম্পতি ছাড়া হোটেল রুম ভাড়া দেন না তারা। সমলিঙ্গের দম্পতির ক্ষেত্রে তাদের কী নিয়ম, জিজ্ঞেস করতেই ফোন রেখে দেয় হোটেল-পক্ষ। ট্রেনের টিকিট ক্যানসেল করে, আবার তৎকালে এনজেপি-র টিকিট করে, আদি-অনন্ত সেই টংলু (সান্দাকফুর পথে ছোট্ট জনপদ)-তে ফুন্টসো-র ব্যারাকে কোনওভাবে নিজেদের গুঁজে দিলাম আমরা।
ঘটনাটা ভুলিনি এখনও। কারণ সচেতনভাবে অনুভব করা আরও ঘটনাবলি, ঘটনাটাকে ভুলতে দেয়নি। এর মাঝেই মেরাট শহরে এক বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন হোম স্টে-তে অবিবাহিত যুগলের থাকার নিয়ম নিয়ে যে নতুন শোধনবাদী, সুচিন্তিত বক্তব্য চোখে পড়ল— তাতে খুব একটা অবাক হইনি আর। আমাদের এই প্রাচীন সভ্যতার শিবঠাকুরের আপন দেশে, দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা ‘স্পেস’ বলতে এখনও শুধুই মহাকাশ বোঝেন। অথচ এই ‘স্পেস’, ব্যক্তিস্বাধীনতা, অন্যের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি যথোচিত সম্মান বজায় রাখা— ইত্যাদি রাশভারী বিষয় নিয়ে কত অ্যাক্টিভিস্ট গলা ফাটিয়েছেন, কত রিসার্চার জার্নালে ছয়লাপ করেছেন, কত ঘরে বিছানা পালটে গেছে…আরও না-জানি কত কত। কিন্তু ‘ঘর হইতে বাহিরে দুই পা ফেলিয়া’ দেখলাম, আদতে একটা বাবল বা ইউটোপিয়ান পৃথিবীতে থাকার ফলস্বরূপ, এমনটাই সত্যি— তা আমরা কেউ কেউ ভেবেছি।
আরও পড়ুন : বাবা-ছেলে, স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গে মদ্যপান, ট্যাবু কমছে কলকাতায়?
কিন্তু আদৌ কি পেয়েছি? আর-একটা ছোট ঘটনা! এমফিল-এর ফাইনাল সাবমিশনের সময় ঘাড় গুঁজে যখন লিখছি, তখন বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের বাড়াবাড়ি হওয়ায় আমি আবার সেই ‘স্পেস’ খুঁজতে গিয়ে, নাসা-য় যোগাযোগ না করে, দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী-দামি হোম স্টে-তে, কয়েকদিন বইপত্তর, লেখালিখি, ল্যাপটপ-সহ একা থাকব— এই বাসনায়, বুকিং-এর জন্য ফোন করি। আমার আধার ইত্যাদি ডিটেইল নিয়েও, আমায় প্রায় একদিন আঁধারে রেখে ওরা নানা স্তরে কথা চালাচালি করে জানিয়ে দেন, ‘একা মহিলা’-কে (আমার ১৮ তার অনেক বছর আগে পেরিয়েছে) বিনা কারণে থাকতে দেওয়ার রিস্ক তাঁরা নিতে পারবেন না। আমি জানাই, আমার পড়াশোনা ইত্যাদির জন্য আমার খানিক নির্জনতা প্রয়োজন। যেহেতু আমার পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে কলকাতা বা শান্তিনিকেতনে বেশ কিছু প্রমোদভবন নেই, তাই এই পথ নিচ্ছি। নিয়ম মেনে। কিন্তু তখনও তাঁরা প্রমাণ চেয়ে বসেন, একা ঘরে আমি পড়াশোনা করছি— তার প্রমাণ কী। দরজা খুলে প্রমাণ দেব, এমন মনের অবস্থা ছিল না, তাই সেসব নাকচ করে দিই।
কিন্তু মুশকিল হল, মেরাটের এই সুনির্দিষ্ট সংস্থার আবাসনের নিয়ম-রক্ষকরা প্রমাণ চেয়েছেন, যুগলে প্রমাণ দিতে হবে, তারা সত্যিই একে অপরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ। নিয়ম জারি করার পরেও উপায় বাতলাননি এঁরা।
প্রেমের প্রামাণ্যস্বরূপ কী কী চাওয়া যেতে পারে? মহকুমা শাসক, কর্পোরেশন বা লোকাল থানা (বলিউডের দুষ্টু পুলিশকাকু হলে এতে মুশকিল) বা গ্রাম পঞ্চায়েত ইত্যাদির দস্তখত করা চিঠি। অথবা সরকারি কোনও প্রমাণপত্র, যা লাইনে দাঁড়িয়ে, ফর্ম ফিল-আপ করে জোগাড় করতে হবে। তাহলে যতবার প্রেমের মানুষটি বদলাবে, ততবার এই কাগজ বানিয়ে কাগজ দেখাতেই হবে?
আরে মশাই, না না। এখনও বুঝছেন না। এই ঋষি-মুনি-সংস্কিতির দেশে কর্তারা বহুকাল ধরে বিয়ের আগে ছেলে-মেয়ের (সমলিঙ্গ প্রেম-এদের কাছে অসুখ) ঘনিষ্ঠতাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস করে চলেছে। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ‘অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড’-এর কথা, যারা ভ্যালেন্টাইনস ডে-র কয়েকদিন আগে থেকে রড-বেলচা নিয়ে পার্কে, অলিতে-গলিতে, লেকের পারে ঘুরে বেড়ায়। আর বাড়াবাড়িটাও যাতে সুললিত হয়, তার জন্য খুন-এর আগেই তো ‘অনার’ সেঁটে দেওয়া হয়েছে।
অর্থাৎ, লজ্জা। কার লজ্জা? দেশের, দশের, সভ্যতার। সেই সভ্যতায় বিশেষ জাতিভুক্ত হওয়ার কারণে এখনও পুড়ে মরতে হয়, নিজের বাড়িতে গরুর মাংস রাখার কারণে গণপ্রহারে মরতে হয়, কন্যাসন্তান জন্মালে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়, সেই সুসভ্য দেশে বিবাহ নামক সম্পত্তি সংরক্ষণ ও সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় না গিয়ে, তার আগেই পুং রেণু, স্ত্রী রেণুর কাছাকাছি আসার চেষ্টা করলে, তাকে আটকাতে নানাবিধ উপায় নিতে হয় বইকি। আপনার অবস্থান থেকে শুরু করে আপনি কী ভাবছেন— তারও রেকর্ড জমা হচ্ছে কারও কাছে।
একটু ভাবুন এই সুযোগে। আপনার সরকার ও সরকার অনুগত এই ক্যাপিটালিস্ট সংস্থাগুলি আদতে খুবই মহান। স্পেস নিয়ে আপন জগৎ বানানোর অভ্যেস বড় বাজে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে গাদাগাদি করতে থাকতে হবে মশাই। অভ্যেস করুন। অভ্যেস পাল্টানোর অভ্যেস করুন। একটু এদিক-ওদিক হলে সমস্যা নেই। শুধরে দেওয়ার জন্য সরকার ও তার অনুগত দাসেরা তো আছেই।