সম্প্রতি মেট্রো স্টেশনে একটি মেয়ে তার প্রেমিকের ঠোঁটে চুমু খাওয়ায় গেল গেল রব উঠেছে। ধর্মগুরুর লোলচর্ম, শিরা-ওঠা, লাখো ভক্তের লালাসিক্ত, বিনা পরিশ্রমে জোটানো পরমান্নের গ্রাস মুখে তোলার ‘কাজে’ ব্যবহৃত, স্বমেহনের মহান বরাভয় মুদ্রায় প্রকম্পিত হাতে চুমু খায়নি মেয়েটি। কোনও রাজনৈতিক নেতার চটি, নিউ-কাট, বা শিকার করা বাঘের মাথা ঠেসে ধরা যোধপুর-শোভিত পায়েও চুমু খায়নি সে। চুমু খাওয়ার পর ভিয়েতনাম, বলিভিয়া, কঙ্গো অথবা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, ছত্তিসগড়ে পুলিশ-মিলিটারির বেয়নেটে লেগে থাকা রক্তে তার ঠোঁট লাল হয়ে যাওয়ার কোনও খবর মেলেনি অদ্যাবধি। অতএব, সে বেয়নেটে চুমু খেয়ে ইদানীং দেশভক্তির পরাকাষ্ঠাস্বরূপ– অর্থাৎ কিনা, নতুন কোনও সোশ্যালিজম-বিনাশী মেট্রো-দেবীরূপে অধিষ্ঠিত- তাও না। সে কি ক্যাথলিক বিশ্ব পরিক্রমায় উদভ্রান্ত পোপের ন্যায় প্রতিটি ভূগর্ভস্থ স্টেশনে– পড়ুন লিবারেশন থিওলজিস্টদের দ্বারা তৈরি উপদ্রুত, দ্রুততর, দ্রুততম ইনসার্জেন্স ঘটিয়ে চলা অঞ্চলে– ঝাঁ করে প্লেন থেকে নেমে রেড কার্পেটে চুমু খাওয়ার বদলে আগে থেকেই স্ট্র্যাটেজিকালি প্লেস্ড প্রেমিকের ওষ্ঠাধর চিবিয়ে-চুষে রাজনৈতিক অবস্থানের বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেছে? কই, না তো! এটি আদতে ভূগর্ভ স্টেশন, শুধু গর্ভস্থ হলে কোন সন্তান কেমন ব্যূহ-ভেদের কূট-কৌশল শিখে তলা ফাঁসানো গুটি সাজানোর পরিকল্পনা আঁটছে ওই চুমুর আবডালে, সেই দুঃস্বপ্ন অনেককেই বিনিদ্র রজনীর ঘর্মাক্ত উৎকণ্ঠায় ঠেসে ধরত। চুমু খাওয়ার সময় কি আঙুলে আঙুল, কার্নিশে কার্নিশ… না, মানে জিভে জিভ, কালো গাড়ির ভেতর আর-একটি কালো গাড়ি, সরি, একটি শরীরের ভেতর আরও একটি শরীর জড়িয়ে-জাপটে একাকার হয়ে ছিল? ক্লিম্টের ছবিতে যেমন, তেমনই কি প্রতিটি স্বেদবিন্দু ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত রং কাঁচিয়ে সুপারনোভার মতো ফেটে পড়েছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে দম-আটকানো কাঁটাতারের বিরুদ্ধতার ভেতরে ফ্যাকাশে এল গ্রেকো আলোর তলায়? মেট্রোর আলোগুলো পাল্টানো দরকার, একেই ভাইরাল ভিডিও-য় ভাল ভাল জিনিসগুলো প্রায় কিছুই দেখা যায় না, তার ওপর ছবি তোলার উপযুক্ত বিচ্ছুরণ নেই কোথাও! প্রযুক্তিগত উন্নতি ছাড়া বাঙালির উন্নয়ন অসম্ভব!
তবে বাঙালির কান ওটুকুতেই লজ্জায় লাল। সর্বসমক্ষে চুমু খাচ্ছে ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে, ‘‘হাম তুম এক কামরে মেঁ’’ হলে হামির সীমা পেরিয়ে… ‘‘তোমাকে আর-এক হাতা ভাত দেই, ল্যা… মানে ইসে, মানে লাবড়াটা কেমন হয়েছে বললে না তো– ভিডিওটা সেভ করে রেখো, রাতে আর একবার দেখব।’’ বেহায়াপনার গল্প ওখানেই শুরু, ওখানেই এঁটো হাতে চটকাচটকি। অথচ, ছেলেমেয়ে দু’টি কাউকে ছুরি মারেনি, পকেট কাটছে না, ঘুষও খায়নি। তবু বাঙালি লজ্জিত।
ফুটপাথের শিশুর হাত বাড়ায় দুটো ভাতের জন্য– সংখ্যাটা কোভিড অতিমারীর পর ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী। কই, সে পরিসংখ্যান ভাইরাল হয়েছে? দেশে নিরন্নের সংখ্যা যত বাড়ছে, হোটেল-রেস্তোঁরায় একরাশ গিলে, গেলার আগে থালা-বাটি সাজিয়ে, উন্নত বক্ষ বাগিয়ে– বেশিরভাগেরই ক্লি‘ভেজ’ নয়, একেবারে ক্লি‘ননভেজ’– ডেঁয়ো পিমড়ে টাইপের নিতম্ব উঁচিয়ে সেলফির বানে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন নিরুদ্বিগ্ন কোঁৎকাকুল। এক-একটাকে তিনটে বাঘে খেয়ে শেষ করতে পারবে না মশাই! নাঃ, লজ্জা করবে কেন? বেনারসি, সাফারি স্যুট পড়ে রাতে ঘুমতে যায়।
‘নেইবারস্ এনভি ওনার্স প্রাইড’ শুনে বড় হওয়া জাত, চাকরি পেয়েই গোগ্রাসে কনজিউম করতে লেগেছে। ব্যাগ, ছাতা, জুতো, জামা, ঘটি, বাটি, ফোন, টিভি, গাড়ি, বাড়ি, তারপর আর-একটা বাড়ি, তারপর আরও একটা… না মশাই লজ্জা নেই। মোটে নেই। ফুটপাথ জুড়ে কোটি কোটি লোক কখনও সন্তান আঁকড়ে একবুক বন্যা ঠেলে উঁচু রোয়াক খুঁজছে, কখনও রাস্তার কলে লাইন দিচ্ছে সকাল থেকে রাত একফোঁটা পানীয় জলের জন্য। জিজ্ঞেস করুন, এতগুলো বাড়ি দিয়ে কী হবে– হয় দাঁত কেলিয়ে, নয়তো অযথা গম্ভীর গলায় বলবে ‘‘সিকিউরিটি দাদা, একটু ইনভেস্টমেন্ট…।’’ যে-দেশে সরকারি হিসেবে রোজ সাড়ে চার হাজার বাচ্চা অপুষ্টিজনিত কারণে মারা যায়, সে-দেশে তিনটে বাসস্থান না থাকলে নিরাপত্তাহীনতায় উতলা হন চুমুতে লজ্জিত বাঙালি।
কিছুকাল আগে দিল্লির রাস্তায় খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে এক রিকশাওলার তিন সন্তান ঘাস খেয়ে মরে গেল। নিরাপত্তা নিবি? কোনও সরকারি হাসপাতালে যথেষ্ট বেড নেই। গরিবের বাচ্চার চিকিৎসা হয় না– অথচ ব্রিচ ক্যান্ডির দুটো ফ্লোর নাকি এক অভিনেতার নামে সম্বৎসর বুকড্ থাকে। লোকে বুক ফুলিয়ে বলেও ‘‘অমুকের পয়সা দেখেছ?’’ লজ্জা হবে কেন? এ তো ভারি গর্বের বিষয়। চুমু তো আর খাচ্ছে না! বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিয়ের আয়োজন হয় ব্যবসায়ীর সন্তানের। সেরকমটাই হওয়া উচিত। মেনে নিলাম– তারা লুকিয়ে কালীঘাটে এসে মালা-বদল পশ্চাৎ ডায়মন্ড হারবারের হোটেলে পালানোর চেষ্টা করলে সরকারের ঘর থেকে অনেক বেশি খরচা হত। তাই বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউকেটাদের বুলবুলির লড়াই আর খ্যামটার আয়োজন?
প্রায়ই খবরের কাগজে দেখি মরদেহ বহনকারী গাড়ি ভাড়া করতে অক্ষম বাক্তিরা সন্তান, বাপ-মা অথবা স্ত্রী-র মৃতদেহ বয়ে চলেছে বহু মাইল পথ– অথচ কার যেন বাড়ির ছ’তলা কেবল গাড়ি রাখার জন্যই বরাদ্দ। লজ্জা হবে কেন? চুমু তো আর খায় না ছ’তলা জুড়ে! বলে দেখুন একবার দেশের বার্ষিক বাজেটে সামরিক খাতে দুই শতাংশ এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা-বাসস্থান খাতে বাহাত্তর শতাংশ খরচের দাবি জানিয়ে পথে নামা হোক– দেখবেন চুমুতে লজ্জা পাওয়ারা কেমন আঁতকে ওঠে! পাকিস্তান আক্রমণ করবে, চিন গিলে খাবে, তাইওয়ান বোম মারবে ইত্যাদি আতঙ্কের ফিরিস্তি চলবে একটানা। জিজ্ঞেস করুন ওকে বা ওর ইমিডিয়েট ফ্যামিলি মেম্বারদের, একজনকেও পাকিস্তানি ফৌজের কেউ ইন দ্য রিসেন্ট পাস্ট গুলি চালিয়ে খুন করেছে কি না, দেখবেন সোজা চলে গেল ‘‘মুসলমানদের বিশ্বাস নেই’’ ইত্যাদি প্রিয় প্রসঙ্গে– ‘‘ওরা ইসে খায়!’’ বোঝো! গরুকে ছোলা খাওয়াচ্ছে, বাঁদর পুজো করছে, বেড়াল জাপ্টে সন্তানসম্ভবা হতে চাইছে, কাক ডাকলে গোঙাচ্ছে ‘‘তখনই বলেছিলাম হাইলি সাসপিশাস’’– মানে জিরাফ, টেরোড্যাকটাইল আর ম্যাকাও ছাড়া সমস্ত প্রাণীর সামনে নকুলদানা-বাতাসা উড়িয়ে, সিন্নি চটকে, সিঁদুর লেবড়ে গড়াগড়ি দিতে লজ্জা হয় না, শুধু চুমু খেলে দোষ! সম্প্রতি বলতে শুরু করেছে ‘‘জাকির হুসেন কিন্তু গরু খেতেন না।’’ অ্যাজ ইফ তিন বছর বয়স থেকে একটানা রেওয়াজ নয়, ‘ভাল মুসলমান’, বা ‘প্রায় হিন্দু’ হওয়ার লক্ষে গোমাংস পরিত্যাগই ওঁর সাফল্যের কারণ– ‘কায়া প্রকাশনী’ এবং ‘হায় গো ভার্জিন-এর, ‘পোZনো সুচিত্রা’ ছাড়া অবশ্যই। তবে এসব বলতেও লজ্জা যে খুব একটা হয়-টয় তা অবিশ্যি… একশো চল্লিশ কোটির দেশে যেকালে আশি কোটি স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না, সেখানে ফার্স্ট-সেকেন্ড হলে ফোঁটা-তিলক কেটে, লাড্ডু খাইয়ে, ব্যান্ডপার্টি বাজিয়ে নাচ দেখে তাজ্জব লাগে। ‘কম্পিটিশনই তো হল না’ বলেও কোনও লাভ নেই– যারা পারল না, তারা মানুষ নয়। যারা সাদা হওয়ার ক্রিম মাখার পরও কালো, তারা মানুষ নয়। যারা আমেরিকা-ইউরোপে সিটিজেনশিপ জুটিয়ে এদেশের মানুষকে বিদেশিদের হাত থেকে নিরাপদ রাখার বটিকা গেলাতে পারেনি, তারা মানুষ নয়। যারা ক্যানসারের রোগীদের গোমূত্র গেলানোয় বিশ্বাস করে না, তারা মানুষ নয়।
আদতে নিরাপত্তাই ইস্যু। ওদের নিপাট-নিকোনো ঘর ভাঙার ভয়টাই যাবতীয় লজ্জাবোধের অছিলা। আদরের পাবলিক ডিসপ্লে নিয়ে সংকোচ। দায়িত্ব নেব না-মূলক স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান গ্রহণ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান নিয়ে লজ্জিত হব না– হলে মোমবাতির খরচ বেড়ে যাবে। এটা রণকৌশল। গোটা লজ্জাবোধটাকেই মধ্যবিত্তের যৌন-ন্যাকামোর পরিসরে বেঁধে ফেল। ঘরের মেয়ের শরীর ঢাকব এমনভাবে যাতে দেখে মনে হয় পিরামিড ভেদ করে মমি বেরিয়েছে। অথচ নোরা ফতেহি, সানি লিওনি, মিয়া খলিফা-সহ সমস্ত পর্নস্টার– মানে, যাদের উলঙ্গ ছবি-ভিডিওতে আমার হার্ড-ড্রাইভ পরিপূর্ণ– তারা সাহসী। যৌনকর্মীরা নোংরা, কারণ তারা শরীর বেচে খায়– এবং তাদের কাজের দাবিকে সমর্থন করলে সমস্ত গরিব মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে হয়তো একদিন শামিল হতে হবে– থাক বাবা, অত বখেরায় কাজ নেই!
বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের চাইতে কম্যুনিজম ফেইল করেছে বলা সহজ– কারণ ‘‘তুমি কম্যুনিজম-মার্ক্সিজম নিয়ে পড়াশোনা করেছ?’’ ইত্যাদি প্রশ্নের জবাবে হনুমান চালিশা টাইপের উমদা কিতাবের বাতাস খেতে খেতে বলে দেওয়া যায় ‘‘ওসব ফেইল করেছে যখন, তখন আর পড়ে কী হবে?’’
অর্থাৎ, জীবনে অশিক্ষাজনিত লজ্জার স্থান নেই। তবে পাশাপাশি একটানা আউড়ে যাওয়া দরকার যে, সিনেমার নায়ক-নায়িকারা শরীর দেখালে–বেচলে– ক্ষতি নেই। আর অত হাজার কোটির ব্যবসা নিয়ে বাঙালি ঠিক কী বলবে, বা কোন অবস্থান গ্রহণ করলে অমিতাভ বচ্চন ছেলের বিয়েতে এমনকী, ‘‘আপনাকে ডাকলেম না মশাই’’ চিঠিটুকু অন্তত পাঠাবে, তা লোয়ার ডিভিশন ক্লার্করা ভেবে উঠতে পারেনি।
অতএব, মোবাইল হাতে লেনি রিফেনশ্ঠালের মতো নতুন ন্যুবার খোঁজ চলছে– স্বাভাবিক নামক আদি মানুষের আদর, প্রজনন, যৌনতার নমুনা সংগ্রহে নেমেছে ক্লেদজীবী নৃতাত্ত্বিকের দল। রাস্তায় বৃদ্ধ বাপ-মা’কে বসিয়ে উধাও সন্তানরা লজ্জা-ঘৃণার ঊর্ধ্বে উঠে বাড়ি ফিরে নিজেদের উলঙ্গ করে সেলফি তুলে লাইক-শেয়ারের অপেক্ষা করবে আর মেট্রোয় চুমু খাওয়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে ‘‘হাতে পেলে বেহায়াপনা ছুটিয়ে দেওয়ার’’ ছক কষবে তালিবানদের মতো। চাবুক কষাবে, নাক-কান কেটে নেবে, অ্যাসিড মারবে মুখে– সম্মান রক্ষার নামে বোনের মুণ্ডচ্ছেদ করবে ভাইরা, রাস্তায় ঢেলে বিক্রি হবে রূপ কানোয়ারের ছবি, বোরখার জয়গানে মুখর হবে আগামী প্রজন্ম, মেয়েদের শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে ধর্মের দোহাই পেড়ে। নাহলে বেত, চপচপ স্কোয়ারে মার্কিন ডেমোক্রেসি ফেরি করতে আসা ফড়েদের উপস্থিতিতে ঠান্ডা মাথায় খুন।
নাঃ, লজ্জা হবে না। বরং বহুতল আবাসনগুলোয় বিধর্মীদের বাড়ি বিক্রি বা ঘর ভাড়া দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হবে। প্রত্যেকটা ‘ফ্ল্যাট’ এক-একটি ইন্ডিয়া। স্বচ্ছ ভারতীয় গ্রামের বাইরে বড় গাছ থেকে হালকা বাতাসে মৃদুমন্দ দুলবে দুই দলিত কিশোরীর ফাঁস-দেওয়া দেহ– সাফাই অভিযান চলছে, চলবে। ঠিক যেমন রামমন্দিরে দলিত এবং নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রবেশাধিকার নেই, ঠিক তেমনই এই ফ্ল্যাটবাসীদের জীবনে ‘বহিরাগত’দের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
ওই দু’টি মানুষ মেট্রো স্টেশনে চুমু খেয়ে এই আঁটসাঁট ধাঁচাটিতে ফাটল ধরিয়েছে। নড়বড়ে করে দিয়েছে বিশ্বাসের ঠুনকো, ফাঁপা স্তম্ভগুলিকে– স্রেফ একটি চুমুতেই।
খাক। আরও চুমু খাক সকলে। আগুন ধরিয়ে দিক শরীরে, মগজে।