ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বাংলার নিজস্ব ‘ফাদার’


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (December 30, 2024)
     

    শুধু যে ‘নিকটে দেখা’ তাই নয়; বহু বছর ধরে দেখা এবং সেই সঙ্গে আমার নিজেরও ক্রমে বড় হয়ে ওঠা। ফলে, ফাদার দ্যতিয়েন সম্পর্কে ভীষণ একটা অধিকারবোধই কাজ করে; তেমনই জেগে ওঠে আরও এক মনোভাব যে, তিনি আমার বাপের বাড়ির লোক এবং ইশকুলবেলার সঙ্গী। ১৯৭০ সালের কালো চুলের স্কুটারে চাপা এক ফাদার একেবারে মাতিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। আমার বয়স তখন ১৩। 

    ‘সন্দেশ’ ছাড়াও আরও যে পত্রিকায় আমাদের কুচি-কুচি লেখা বেরত, তা হল ফাদারের ‘আলাপ’ পত্রিকা। ওই লেখা সংগ্রহের সূত্রেই আমাদের ইশকুলে তাঁর আসা এবং আমার মা- প্রধান শিক্ষিকা  অণিমা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গভীর সখ্য; এবং ক্রমে আমাদের বাড়ির এক আত্মজন হয়ে ওঠাও। ফলে, নিকটে পেয়ে দেখেছি যে, সর্ব বিষয়ে তাঁর কিছু বক্তব্য আছে। আর সেসব তিনি বলে চলেন অনর্গল বাংলায়। আর ভালবাসতেন তুলনা দিয়ে বোঝাতে; যেমন কফি হল ভায়োলিন- খারাপ বানালেও পান করা যায়; অন্যদিকে, চা কিন্তু হারমোনিয়ম— বেসুর হলেই কড়া তেতো। দুরন্ত মেধার সঙ্গে কৌতুক মিশে গেলে যা হয়, অচিরেই তিনি প্রিয় হয়ে ওঠেন সকলের। নিজেকে দেখিয়ে বলতেন, ‘আমি ফরসা নই- অ্যালবিনোস, যাকে সবাই সাদা খরগোশ বলে।’ 

    কথা বলতেন অনর্গল বাংলায়

    ভাগ্যিস ছোট ছিলাম, সেজন্যই দায় ছিল না বোঝার যে তিনি কে! তাছাড়া সে সময় আড্ডাপ্রিয় শিক্ষিত বাঙালি বাড়িতে বেশ কিছু উদ্ভট লোকের আসাযাওয়া তো লেগেই থাকতো; ইশকুল বা বাড়ি, কোথাওই অ্যাপয়েন্টমেন্টের বালাই ছিল না। বালাই ছিল না অতিরিক্ত যত্নআত্তি বা খাতির দেখানোর। ভালবাসার বন্ধনটা খুব অনায়াস ছিল বলেই ফাদার ছিলেন আমাদের সকলের বন্ধু- বিশেষত আমাদের দুই বোনের। 

    কিন্তু এমন এক প্রিয় মানুষও একদিন হারিয়ে গেলেন, ১৯৭৫ সালের পর। তেলিপাড়া, ডাফ ইশকুল, বাগবাজার, শ্যামবাজার, হাতিবাগান- কোথাও আর দেখা গেল না, স্কুটারে চড়ে ঘুরে বেড়ানো সেই ফাদারকে। বন্ধ হয়ে গেল, ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরনো ‘রোজনামচা’ বা ‘ডায়েরির ছেঁড়াপাতা’-র মতো সব লেখা।

    আবার তাঁর নাম শুনলাম, ২০১০ সালে, বাংলা অকাদেমি প্রদত্ত ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ প্রাপক হিসেবে ফাদার পল দ্যতিয়েনের নাম ঘোষণায়। শুনলাম, চিন্তাবিদ চিন্ময় গুহ তাঁকে নাকি খুঁজে পেয়েছেন ব্রাসেলসে। চিন্ময়ের ফরাসি সংযোগই ফাদারকে আবার ফিরিয়ে আনল, বাংলার মাটিতে। সশরীরে উপস্থিত থেকে পুরস্কার নিতে না পারলেও, ফাদার এলেন ২০১১-এ। এক শতাব্দীতে হারিয়ে গিয়ে ফিরে এলেন নতুন শতাব্দীতে। 

    এই হিসেবটাতেই যেন ঘোর লেগে যেত আমার। সে যে কী অদ্ভুত দেখা হওয়া! মাঝখানের কয়েকটা দশক, একেবারে নিঃশব্দে, হরণ করে নিয়েছে চলেফিরে বেড়ানো সময়টাকে। বৃদ্ধ ফাদারের সামনে আমিও তো তখন পঞ্চাশ পার করা এবং পোড়খাওয়া এক অভিজ্ঞ রমণী; আর আমাদের সেই প্রাণবন্ত, উৎসব-মুখর মা অসাব্যস্ত অবস্থায় একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায়। সময় যে কী নিষ্ঠুর, সেদিন তা বুঝেছিলাম। বর্তমানকে ক্রমাগত গ্রাস করতে-করতে ফুলে-ফেঁপে ওঠে যে অতীত, তার কতটুকুই বা রক্ষা করতে পারে স্মৃতি! তবে আগামী দিনগুলো যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে, তাই আবার আমরা পরস্পরে ভাব জমাই, নিজের স্বভাব ও স্বপ্ন অনুযায়ী। ফলে অচিরেই আবার ঘরে-বাইরে এক হয়ে গেলেন ফাদার।  উত্তর কলকাতা হারিয়ে গেলেও, দূরত্ব মুছে গেল চিত্রবাণী চার্চ এবং আমার আনোয়ার শাহ রোডের আস্তানার মধ্যে। ১৯৭৫ সালে উপস্থিত ছিলেন আমার বিয়েতে; এবার ২০১১-২০১৬- এই বছর পাঁচেকের মধ্যেই তাঁকে যে কতভাবে পেলাম! মায়ের শ্রাদ্ধ-কাজে, নাতিবাবুর নামকরণে, আমার বই উদ্বোধনে, অন্তরা সাইকিয়াট্রিক সেন্টারে আমার কাজ দেখতে যাওয়ায়, কলেজের রবীন্দ্রদিবসে এবং খড়দার এপাড়া-ওপাড়া ও গঙ্গার ধার চষে, শেষে আমাদের গৃহদেবতা রাধাকান্ত জীউ-র মন্দিরে বসে আরতি দেখায়। আমার মেয়েকে দেখে খুব শান্তি পেয়ে বলেছিলেন যে, ‘আবার সেই থ্রি- জেনারেশন’; প্রথম জীবনে ঠাকুমা-মা এবং আমরা দুই বোন; দ্বিতীয় পর্বে, মা-আমি এবং মেয়ে; আর শেষ পর্বে আমি-মেয়ে এবং নাতি।  

    বার-বার এদেশে এসেছেন এবং একরকম বাধ্য হয়েই মেয়াদ শেষে যখন তাঁকে বেলজিয়াম ফিরে যেতে হত, কী যে বিমর্ষ হয়ে পড়তেন! বলতেন, আমি যে ‘বিদেশি’! ফিরে গিয়েই তোড়জোড় করতেন অল্প সময়ের ব্যবধানে আবার কলকাতায় ফিরে আসার। শুধু কি আসা! সেই ১৯৭৫ সালে কলকাতা ছাড়ার পর প্রায় তিরিশ বছর আর বাংলা শোনেননি, লেখেননি বা পড়েননি; বলা তো দূরস্থান। কিন্তু কলকাতায় এসেই হইহই করে কোমর বেঁধে আবার শুরু করে দিলেন বাংলায় লেখা এবং সেগুলি প্রকাশের তোড়জোড়। নতুন করে ছাপা হতে শুরু হল তাঁর কিছু পুরনো বই; একই সঙ্গে হাত দিলেন নতুন লেখায়। সেসব লেখা দু-মলাটে বন্দি হয়ে ছাপার অক্ষরে হাতে এল, ‘আটপৌরে দিনপঞ্জি’, ‘সাদাসিধে খসড়া’ এবং ‘লালপেড়ে গল্পাবলী’ নামে। জীবদ্দশায় সেসব বই হাতে নিয়ে, নেড়েচেড়ে তিনি যে দেখে যেতে পারলেন, এটাই বড় আনন্দের!

    ‘ফাদারদা’ বা ‘ফাদারবাবু’ বদলে হয়ে গেলেন ‘ফাদার দ্যতিয়েন’

    আর ছুটে বেড়াতে লাগলেন তাঁর প্রিয় সব জায়গায়। একদিকে যেমন প্রত্যন্তে থাকা ‘বাসন্তী’ থেকে, শ্রীরামপুর চুঁচড়ো বা শান্তিনিকেতন, অন্যদিকে তেমনই উত্তর কলকাতার অলিগলি হাতড়েও প্রিয় পার্ক স্ট্রিট এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। 

    তবে ইনি যেন এক অন্য ফাদার। স্কুটি চড়ে চষে বেড়ানো সেই ‘ফাদারদা’ বা ‘ফাদারবাবু’ বদলে হয়ে গেছেন ‘ফাদার দ্যতিয়েন’। তবে, বদলায়নি তাঁর সেই চির-যুবার প্রাণশক্তি আর কয়েকটি পুরনো অভ্যাস। বুকপকেটে রাখা নোটবুকে ক্রমাগত টুকে রাখা নতুন-নতুন শব্দ এবং পাশপকেটে রাখা আর একটা নোটবুকে লিখে রাখা- দেখা করা ও সভাসমিতিতে যাওয়ার সময় ও দিন; তাঁর ভাষায় ‘এজেন্ডা’। বদলায়নি জিভের স্বাদ- লুচি, রসোগোল্লা আর পাকা আমের কাতরতা। বদলায়নি চিরকুট বের করে, সেটি দেখে-দেখে গাওয়া- ‘নাম রেখেছি বনলতা’ গানটি। আর বদলায়নি রবি ঠাকুরের গানের স্পর্শ পাওয়ার আকুলতা। 

    সেই ১৯৭৫ সালে কলকাতা ছাড়ার পর প্রায় তিরিশ বছর আর বাংলা শোনেননি, লেখেননি বা পড়েননি; বলা তো দূরস্থান। কিন্তু কলকাতায় এসেই হইহই করে কোমর বেঁধে আবার শুরু করে দিলেন বাংলায় লেখা এবং সেগুলি প্রকাশের তোড়জোড়। নতুন করে ছাপা হতে শুরু হল তাঁর কিছু পুরনো বই; একই সঙ্গে হাত দিলেন নতুন লেখায়।

    তবে যে একটি ব্যাপার তাঁকে কাতর করে দিচ্ছিল, তা হল, তাঁর সমসাময়িক বেশিরভাগের মানুষেরই মারা যাওয়ার খবর। বলতেন, ‘যাকেই খুঁজতে যাই, শুনি যে মরে গেছে… সব্বাই মরে গেছে।’

    নানা সময় খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখে বুঝতে পেরেছিলাম যে তাঁর ‘এজেন্ডা’ প্রধানত দু’টি; একটি হল নিয়ত প্রার্থনা। আর দ্বিতীয়টি হল, শেষদিন অবধি বাংলা ভাষার চর্চায় নিজেকে সঁপে দেওয়া। জীবনসায়াহ্নে এসে একটাই যে প্রার্থনা তিনি নিজের জন্য করেছিলেন। তা হল, তাঁর মৃত্যুর পর যেন গাওয়া হয়, ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা’- এই গানটি। এই গানের মধ্য দিয়েই যেমন শ্বাসবায়ুকে অনুভব করেছিলেন, তেমনই তা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছিলেন এই গান শুনতে-শুনতেই। 

    এক ২০ অক্টোবর তাঁর কাছ থেকে আসা শেষ মেল এল ; আরও অনেকের সঙ্গে আমাকেও ফরওয়ার্ড করা। তিনি জানিয়েছেন, “The Lord sent me to earth to paint a picture. Every day I add a line. I refresh a colour… and one morning getting out of bed, I realise that the picture is completed… not a single line to be added, not one colour to be refreshed. The Lord can come and take me up at this very moment. I will not ask three seconds for preparation: I will follow, without luggage at the first signal.”

    Article about Father Detienne
    ফাদার দ্যতিয়েন, লেখকের সঙ্গে

    মৃত্যু যখন প্রায় হাত ধরে বসে আছে , তাঁর মেল থেকেই অন্য একজনের অনুরোধ এল, ওই গানটি যেন বাংলায় পাঠ করে, সেই অডিওটি তাঁকে মেল করা হয়। অডিওটির সঙ্গে  বাংলায় আরও দু-লাইন লিখলাম, আমার মায়ের দেহাবসানের জন্য ফাদারের সেই অলৌকিক প্রার্থনা-দৃশ্যটি স্মরণ করে-

    ‘ঈশ্বর আছেন কি না জানি না; কিন্তু আমাদের সংসারে আপনিই ঈশ্বরপ্রেরিত।’ 

    চোখের পাতা ভিজে উঠছে তবু লিখলাম, 

    ‘ঈশ্বর সাড়া দিন আপনার প্রার্থনায়; মুক্তি হোক এই মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে।’

    উত্তরে আবার অনুরোধ এল, অন্য একজনের নামচিহ্নে, বাংলায় লেখা ওই মেলটি যদি তর্জমা করে পাঠাই; কারণ আমার মেলটি তাঁর চোখের ওপর তুলে ধরতেই, দু-চোখ দিয়ে নাকি জল গড়িয়ে পড়েছিল ফাদারের।

    এর ক-দিন পরেই চলে গেলেন ফাদার; আমাদের তারিখ অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর, ২০১৬। রেখে গেলেন ‘দ্যতিয়েনী গদ্য’, ‘দ্যতিয়েনী মজলিস’, দ্যতিয়েনী ‘সন্ন্যাস’…; আর শেষ নিঃশ্বাস অবধি নিয়ে গেলেন, নিজের আত্মাস্বরূপ আত্মস্থ করে নেওয়া সেই গান-

    ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা…

    বাংলা ভাষাই কি ছিল তাঁর সেই ঈশ্বর, যাঁকে সহজভাবে বলতে ভালবাসতেন, ‘ভগবান’!

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook