তুমি সারাক্ষণ পাশে বসে আছো, বন্ধু সূর্য।
যেন আশুধু লোর পাহারাকুকুর, জিভ বুলিয়ে দাও আমার শুভ্র শয্যায়;
তোমার সোনালী চুলে ডুবে গেছে আমার হাতের পাতা,
ক্লান্ত, অশক্ত এই আমার হাত।
(উৎসর্গ)
১৯২২ সালে আধুনিক সাহিত্যের বিশ্ববারান্দায় যেসব তুমুল আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটেছিল— ভার্জিনিয়া উলফের ‘জেকবস রুম’ প্রকাশ, মার্সেল প্রুস্তের মৃত্যু, ফেব্রুয়ারিতে বেরোচ্ছে জয়েসের ‘ইউলিসিস’, অক্টোবরে ‘ক্রাইটেরিয়ন’-এ এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর আত্মপ্রকাশ ইত্যাদি। তুলনায় কম আলোচিত সে-বছর সাহিত্যে নোবেল পাওয়া স্প্যানিশ নাট্যকার হাসিন্তো বেনাভেন্তে। এ-লেখা বেনাভেন্তেকে নিয়ে নয়। উনি নিতান্তই অনুষঙ্গ। কারণ ওই নোবেলজয়ীকে নিয়ে আলোচনার আগে ‘সমকালীন স্পেনীয় সাহিত্য’ নামে ১৬ পাতার একটা লেখা বেরিয়েছিল এলিয়ট সম্পাদিত ওই ‘ক্রাইটেরিয়ন’-এই। ঘটনা হল, সেখানে হুয়ান রামোন হিমেনেথকে নিয়ে বেশ বিশদেই আলোচনা করা হয়েছিল। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক বাংলায় সে-লেখা নিয়ে বা হিমেনেথকে নিয়ে সেদিন খুব একটা চর্চা হয়নি। বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ বা পরিচয় গোষ্ঠীর ‘ক্রাইটেরিয়ন’-এর অন্যান্য লেখা নিয়ে যে-মাত্রায় উৎসাহ থাকত, তাতে এই নীরবতা একটু আশ্চর্যেরই। আবার যেহেতু প্রাথমিক পর্বে স্প্যানিশ থেকে তেমন একটা অনুবাদ বাংলায় হয়নি, তাই হিমেনেথ অনুবাদক দেবীপ্রসাদবাবুর আন্দাজ, এর কারণ “সম্ভবত ভাষা ব্যবধানে বা দেশের অনতিপ্রত্যক্ষতাবশে”।
হিমেনেথের সাথে বাঙালির আলাপের প্রধান কারণ রবীন্দ্রনাথ। পৃথিবী জুড়ে রবীন্দ্রজ্বর যখন কাটতে আরম্ভ করেছে, এরকম সময় তাঁর রবীন্দ্র অনুবাদে মন দেওয়া। এই নিয়ে শিশিরকুমার দাশ ও শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় চমৎকার বই লিখেছেন “শ্বাশ্বত মৌচাক: রবীন্দ্রনাথ ও স্পেন”। কিন্তু সে-কথায় আসার আগে ব্যক্তি হিমেনেথের সঙ্গে পরিচয় পাওয়া দরকার।
হিমেনেথ বেশ সচ্ছল পরিবারের ছেলে। বাবা ছিলেন সুরাব্যবসায়ী। ছোটবেলা থেকেই চারুকলা, লেখালেখি এসবে মন ছিল। স্নায়ুর সমস্যা ও মানসিক অবসাদে ভুগেছেন দীর্ঘদিন।
ছোটবেলা জেসুইট বিদ্যালয় পুয়ের্তো দে সান্তা মারিয়া এবং পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার জন্য সেভিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। জন্মস্থান ছিল স্পেনের আন্দালুসিয়ার মোগের গ্রাম। সেই মোগের-এর সৌন্দর্য ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখায় বারবার- “চরাচরের গাঢ় বিজনতা যেন তপ্ত হয়ে আছে;/গলা টিপে কন্ঠরোধ করেছে কে স্তব্ধতার।” (মোগের প্রভাত) কিংবা “পাহাড়ি রাস্তায় চাঁদ হেলাফেলা করে ছুঁড়ে দেয়/ রজতের অখন্ডবলয়। মঞ্জরিত হয়ে ওঠে উন্মাদ তারকা,/ছাইয়ের রচিত দ্রাক্ষাবন।” (মোগের রজনী)
প্রথম পর্যায়ে স্পেনের মোর্দেনিস্মো আন্দোলনে তিনি পরিচিত নাম। তাঁর যখন সাত বছর বয়স, ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত হয় রুবেন দারিও-র লেখা- ‘নীল’ (আজুল)। দারিও-র মতে তাঁর আগের সমকালীন লাতিন আমেরিকার কাব্যে দুটো ধারাই ছিল প্রধান- হোসে হোয়াকিন ওলমেদোর ‘কান্তো আ জুনিন’-এর মতো স্বাধীনতার বিজয় গাথা বা আন্দ্রে বেলোর কৃষিকাজ সম্পর্কিত পেলব রোমান্টিক কবিতাই ছিল স্প্যানিশ সাহিত্যের ভবিতব্য। সেখানে দারিও এলেন দেবদূতের মতো ঝোড়ো শক্তিতে। ফরাসি কবিদের সঙ্গে পরিচয়ের প্রভাবে তাঁর কবিতায় এল আধুনিক বয়ান। ‘আজুল’ বা তার পরবর্তী কাব্যগ্রন্থে তাই পার্নাসিয়ান, সিম্বলিজম বা ইমপ্রেশনিজম-এর প্রভাব স্পষ্ট। শরীরী প্রেমের এমন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উদযাপন, কল্পনাদৃপ্ত দৃশ্যকল্পের সমাহার যেন লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে একটা নতুন যুগের সূচনা করল।
হিমেনেথ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ততদিনে দারিও-র সাহিত্যের দরবারে খুব নামডাক। উনিশ বছর বয়সে দারিও-র আমন্ত্রণে মাদ্রিদে গিয়ে অন্যান্য কবিদের সঙ্গে হিমেনেথ-এর আলাপ হল। সেখানেই এক এক করে তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। এর মধ্যে হিমেনেথের লেখা ‘আলমাস দে বিয়োলেতা’ (ফিরোজা আত্মা)-এর নামকরণ করেন দারিও স্বয়ং। মাদ্রিদ তখন কবিদের শহর। পত্রিকা, সম্মেলন, আড্ডা চলছে চুটিয়ে। রাজনৈতিকভাবেও সে এক অশান্ত সময়। ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব, জার্মান এবং ইতালিয়ানদের নিজের নিজের রাষ্ট্র একত্রীভবনের আকাঙ্ক্ষা এবং সর্বোপরি কার্ল মার্ক্সের কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশ— সব মিলিয়ে ১৮৪৮-এ ইউরোপ জুড়েই রাজনীতি অত্যন্ত সক্রিয়। এর আঁচ এসে লেগেছিল স্পেনে। রানি দ্বিতীয় ইসাবেলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছিল এমনিতেই। এর মধ্যেই প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সমর্থনে ১৮৬৮-তে এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটল। ইসাবেলা ফ্রান্সে পালিয়ে বাঁচলেন। রাজতন্ত্রের পতনে স্পেনে কম সময়ের জন্য হলেও আবার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। ১৮৬৯-এ এক সংবিধান গৃহীত হল, চেষ্টা করা হল প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। কিন্তু তা অচিরেই বিফল হল, যখন আবার রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হল। ১৯৭৬-এ দেখা গেল এই রক্ষণশীল সরকার আবার চার্চকে সন্তুষ্ট করার কাজে উঠে পড়ে লেগে গেছে; শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক ছাঁটাই। এখানেই শুরু ইনস্তিতুশিয়ন লিব্র দে এনসেনিয়ানসা-র। এক বিকল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সেখান থেকে জন্ম ‘রেসিদেনথিয়া দে এস্তুদিয়ান্তেস’ এর। এই প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই ছিল রাজনৈতিক। স্পেনের বুদ্ধিজীবীরা চাইছিলেন শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। বহু বুদ্ধিজীবী এই প্রতিষ্ঠানের ফসল। ১৮৯৮-এর যুদ্ধে যখন আমেরিকার কাছে হেরে কিউবা, প্যুয়ের্তো রিকো ও ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জর মতো উপনিবেশগুলো স্পেনের হাতছাড়া হল, তখন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অন্তঃশূন্যতা জনসাধারণের কাছে আরও প্রকট হল। এই যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে এক নতুন কবি প্রজন্মের জন্ম হল, স্প্যানিশ সাহিত্যে তাঁদের ’৯৮-এর প্রজন্ম’ বলা হয়। এদের প্রায় সবাই ছিলেন ইনস্তিতুশিয়ন এর ছাত্র। সালতামামী বিচার করলে এদের উন্মেষ কালের সমসাময়িক ছিলেন হিমেনেথ। ১৯৯৮ সালে কাগজে তাঁর প্রথম কবিতা ছাপছে, দু’বছর পর দারিও-র আমন্ত্রণে তিনি মাদ্রিদ যাবেন। এখানে লক্ষণীয়, সমসাময়িক হয়েও তিনি নিজের রাস্তা নির্বাচন করছেন। প্রাথমিকভাবে রুবেন দারিও-র সহকারী হিসেবে, যেখানে আন্তোনিও মাচাদোর মতন কবিও একসঙ্গে মোর্দেনিস্মোর ভেলায় পাড়ি জমান। কিছুদিন পর মাচাদো এবং হিমেনেথ দু’জনেই দারিও-র প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসেন। এর কিছু বছর পরেই স্প্যানিশ সাহিত্যে আসবেন লোরকা, আলবার্তি, গুলিয়েঁ, সালিনাসের মতো বলিষ্ঠ কবিরা। যাঁদের নিয়ে প্রবল চর্চা হবে বিশ্ব জুড়ে। এঁদের অনেকেই পরিচিত ছিলেন ’২৭-এর প্রজন্ম’ নামে। বাংলাতেও সে চর্চার ঢেউ এসে লেগেছিল, অন্তত লোরকা তো প্রবলভাবেই বাংলায় চর্চিত। হিমেনেথ এই দুই প্রজন্মের কোনওটাতেই প্রত্যক্ষভাবে ছিলেন না। কিন্তু না থেকেও সেতুবন্ধের কাজ করেছিলেন অবশ্যই।
১৯০১-এ তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য ফ্রান্সের এক স্যনাটোরিয়ামে যান, দু’বছর পর মাদ্রিদে ফেরেন, সেখানে বছর দুয়েক থেকে আবার জন্মস্থান মোগের-এ চলে যান। কিন্তু পৈতৃক ভিটেয় না উঠে আলাদা জায়গায় বাস করেন প্রায় সাত বছর। তারপর আবার ফেরেন মাদ্রিদে। রবীন্দ্রনাথ যে বছর নোবেল পান, সে বছরই আলাপ হচ্ছে তাঁর ভবিষ্যৎ স্ত্রী জেনোবিয়া কাম্প্রুবি আয়মার এর সঙ্গে। কোথায়? সেই ‘রেসিদেনথিয়া দে এস্তুদিয়ান্তেস’ -এই। জুলাই মাসে রেসিদেনথিয়া-র এক বক্তৃতার শুনে জেনোবিয়া বাড়ি ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিলেন হিমেনেথের মাদ্রিদের প্রতিবেশী বাইন দম্পতি। মার্কিনি। জেনোবিয়াও তাই। প্রথম আলাপেই হিমেনেথ প্রেমে পড়ে গেলেন।
কোর্টশিপের পর্বটি বাঙালিদের কাছে বিশেষত চিত্তাকর্ষক। প্রাথমিকভাবে হিমেনেথ জেনোবিয়াকে নিয়ে যেসব কবিতা লিখলেন, তাতে রুবেন দারিও-র কাছে হওয়া শিক্ষানবিশির ছাপ স্পষ্ট। সেইসব শরীরী বর্ণনা জেনোবিয়াকে টানে না। বাইরে থেকে সপ্রতিভ হলেও আসলে অন্তর্মুখী কবিতার খোঁজে থাকেন জেনোবিয়া। সে বছর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সুবাদেই রবীন্দ্রনাথ অনুবাদে হাত দেন তিনি। হিমেনেথকে জিজ্ঞেস করেন, সে কাজে তিনি সঙ্গ দেবেন কি না। ইতিমধ্যে হিমেনেথ স্পেনের কবিসমাজে বেশ সমাদৃত। পরের বছরই বেরবে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কাজ, ‘প্লাতেরো ও আমি’। হিমেনেথ জেনোবিয়ার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য সুযোগের খোঁজে ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ আরও কাছে আনল দু’জনকে। শুধু তাই নয়, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে গিয়ে হিমেনেথের কাব্যভাষাও বদলাতে থাকে। ১৯১৫-তে শেষমেশ মাদ্রিদেই জেনোবিয়া বিয়েতে সম্মতি দেন। পরের বছরই কবি দম্পতি যাত্রা করেন আমেরিকায়। সেখানেই নিউ ইয়র্কের সেন্ট স্টিফেন গির্জায় বিয়ে হয় তাঁদের। এই হিমেনেথ জেনোবিয়ার সাথে পরিচয়ের তেতাল্লিশ বছর পর নোবেল পুরস্কার পাবেন, তাঁর মৃত্যুর দু’বছর আগে। রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাপ্তির সময় নিশ্চয়ই জানতেন না আরেক হবু নোবেলজয়ীর জীবনে অজ্ঞাতসারে তিনি ঘটকের কাজ করেছিলেন সেদিন।
২০০৩-এ লেখা মেগ ওয়লিটজারের উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন বা সেই উপন্যাস থেকে ২০১৭ সালে নির্মিত সিনেমা ‘দ্য ওয়াইফ’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মনে পড়বে, এক নোবেলজয়ী লেখকের নেপথ্যেচারী সাহিত্যিক স্ত্রী-এর কথা। পুরুষতন্ত্রের নির্মম শিকার সেই স্ত্রী’র কথা কেন জানি না মনে পড়ে জেনোবিয়ার কথা ভেবে। এই দম্পতি একসঙ্গে অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ২২টা বই। ১৯১৮ থেকে ১৯২১-এর মধ্যে জেনোবিয়া অন্তত ১১টা চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর অন্তরঙ্গদের। এর মধ্যে অন্তত ছ’টা রবীন্দ্রনাথকে উদ্দ্যেশ্য করে লেখা, বাকিগুলো রথীন্দ্রনাথ, পিয়ার্সন ও অ্যান্ড্রুজকে উদ্দেশ্য করে লেখা। সেসব চিঠিতে তিনি রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর রচনার খুঁটিনাটি জানতে চাইছেন। ‘ডাকঘর’-এর বিশ্বজনীন আবেদন ও বিশ্বযুদ্ধে এর আন্তর্জাতিক খ্যাতির কথা বহুল প্রচলিত। হিটলারের শাসনে ওয়ারশ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেই মঞ্চস্থ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’। নিজে জার্মান হয়েও ইহুদি ডাক্তার জানুস করজ্যাক তাঁর অনাথ আশ্রমের ১৯২টি শিশুকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন। তা নিয়ে নারায়ন সান্যালের বই আছে– ‘মৃত্যোর্মা অমৃতম’। পোল্যান্ডেও হিটলারের কাছে আত্ম সমর্পণের আগের রাতে রেডিওতে পাঠ হয়েছিল এই ডাকঘর নাটক। তুলনায় কম আলোচিত মঞ্চ ইতিহাসের বয়ান পাওয়া যায় জেনোবিয়ার লেখা চিঠিতে। গেরেরো মেন্দোয়া কোম্পানি মাদ্রিদে ডাকঘর মঞ্চস্থ করেন। তার বর্ণনা ছিল এতে। সে উপস্থাপনা বিপুল সমাদৃত হয়। তার আগে জেনোবিয়ার প্রশ্নের পাহাড়— “দইওয়ালার হাঁকের কি কোনও বিশেষ সুর আছে? চৌকিদারের? সুধার আনা ফুলের ভেতর কী কী ফুল? রবীন্দ্রনাথের সব বইয়ের বোলপুর সংস্করণ কি পাঠানো যায় তাঁদের ঠিকানায়?…”
হিমেনেথ রবীন্দ্রনাথকে নিজে কিছু লেখেননি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লিখেছেন বিস্তর। বহু লেখায় রবীন্দ্রপ্রভাবও স্পষ্ট। তাঁর অনুবাদ এতই সাবলীল ছিল যে ‘পাহারোস পের্দিদোস’ (রবীন্দ্রনাথের ‘স্ট্রে বার্ডস‘ এর অনুবাদ) কে অনেক পাঠকই নাকি ভেবেছিল হিমেনেথের স্বকীয় রচনা।
১৯৩৬-এ তিনি দ্বিতীয়বার সস্ত্রীক আমেরিকা যান। এবার নিছক ভ্রমণের জন্য নয়, বরং স্পেনের গৃহযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে। সেখানে তিনি ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্প্যানিশ সাহিত্যের অধ্যাপনার কাজ নেন। ১৯৫২-য় জেনোবিয়া ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, যে বছর তিনি নোবেল পুরস্কার পান সে বছরই জেনোবিয়ার মৃত্যু ঘটে। আরও দু’বছর পর ভগ্ন হৃদয়ে, ভগ্ন মনে হিমেনেথ মারা যান প্যুয়ের্তো রিকোয় নিজের বাড়িতে।
হিমেনেথ প্রাথমিকভাবে আড়ালে থাকলেও বাংলায় তাঁর মূল আত্মপ্রকাশ ধীরে ধীরে প্রকট হয়। ‘শ্বাশ্বত মৌচাক’-এর কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি, এছাড়াও যে অপরিহার্য বই থেকে এ লেখার যাবতীয় অনুবাদ নেওয়া হয়েছে, তার নাম ‘শিকড়ের ডানা: হুয়ান রামোন হিমেনেথের কবিতা’। সাতের দশকের উত্তাল সময়ে যখন ইংরেজির বাইরে সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক নজর নতুন বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বলয়ের খোঁজ করছে — মানববাবু অনুবাদ করছেন লাতিন আমেরিকা, মৃণাল সেন খুঁজে পাচ্ছেন থার্ড সিনেমা, তখনই এ বইয়ের প্রকাশ, ১৯৭৩ সালে। একই দশকে অদ্ভুতভাবে শঙ্খ ঘোষও তুলে নিচ্ছেন তাঁর নির্জন তরবারি। নিকোলাস গ্যিয়েন, আন্তোনিও মাচাদো, পাবলো নেরুদা, আর্তুরো প্লাজা এর সাথে অনূদিত হচ্ছেন হিমেনেথ। অন্যান্য চোখ ধাঁধানো সমকালীন স্প্যানিশ কবি, সাহিত্যিক, পরিচালকদের ভিড়ে শঙ্খবাবু নীরবে সেরে ফেলেছিলেন হিমেনেথের অ্যাসেসমেন্ট। হিমেনেথের কবিতাগুলোর স্থান পায় শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থে কবির শিরোনামে। সেসব কবিতার শিরোনামই তাদের শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন।
শঙ্খবাবু সেই অনুবাদগুলোর নাম দিয়েছিলেন— স্ফুলিঙ্গ।