কয়েকদিন টানা গুমোট গরমের পর হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নেমেছে। ফক্কা উঠে এসির সুইচটা বন্ধ করে জানালাগুলো খুলে দিল। দীর্ঘদিন ঠান্ডার দেশে থেকে অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। গরম একেবারেই সহ্য হচ্ছে না। দেশে ফিরেছে মাত্র তিন দিন হল, এর মধ্যেই সারা গায়ে লাল লাল র্যাশ বেরিয়ে গেছে। এসি থেকে বেরোলেই যেন সারা শরীর চিড়বিড় করছে। তবুও মাটি থেকে গরম ভাপের সঙ্গে উঠে আসা ঝিমধরা গন্ধটা বেশ লাগছিল। কেমন যেন ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
সামনের কার্নিসে বৃষ্টিভেজা দুটো কাক বসে ঠোঁট দিয়ে একে অপরের পালক খুঁটছিল। জানালা খুলতে একটা কাক ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক চোখে তাকাল। ছক্কার মনে হল, কাকটা খুব বিরক্ত হয়েছে।
সামনে বসাকদের বাড়ি থেকে অস্পষ্ট গানের সুর ভেসে আসছে, ‘দূর দ্বীপবাসিনি, চিনি তোমারে চিনি’।
মেয়ের গলা, হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটা লাইনই বার বার গাইছে। হারাধন বসাকের ছোটমেয়ে কি? মাথায় ছিট আছে বলে শ্বশুরবাড়ির লোকরা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
কত বছর আগের কথা, অথচ দৃশ্যটা আজও যেন চোখের সামনে ভাসছে।
সামনের ছোট্ট বাগানটাতে আগাছার মধ্যে একটা সাইকাস আর কয়েকটা পাতাবাহার। দু-একটা রুগ্ন চেহারার গোলাপও আছে, গোড়া মোটা, এলোমেলো ডালপালা, অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। বাবা বসিয়েছিল। বৃষ্টিভেজা পাতাগুলো চকচক করছে।
এমন বৃষ্টিবাদলার দিনে ফক্কার কেমন যেন মন খারাপ করে। ধূসর স্মৃতিরা মনের পর্দায় হেঁটে চলে বেড়ায়, বিস্মরণের মিহি ধুলোর আস্তরণের উপর তাদের লঘু পায়ের ছাপ, ছায়া-ছায়া, অস্পষ্ট, কেমন অচেনা ঘুম-ঘুম চিত্রকল্প, ধরতে গেলেই ফস্ করে মিলিয়ে যায়।
একটু আগে, বহুদিন আগের এমনই এক বাদলা দিনের কথা মনে এসেছিল। মুষলধারে বৃষ্টি, রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের মধ্যে কানকোয় ভর দিয়ে স্রোতের উলটো দিকে যাচ্ছিল একটা কইমাছ। হয়তো আশপাশের কোনও পুকুর থেকে উঠে এসেছিল। পিঠের দিকটা কালচে, পেটের দিকটা একদম হলুদ। ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেন, সেদিন স্কুল থেকে একা ফিরছিল ফক্কা। ছাতা ফেলে পিঠে বইয়ের ব্যাগ সামলে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সেই মাছের পেছনে ছোটাছুটি, ধরতে গেলেই পিছলে লাফিয়ে পড়ছিল। ওরও জেদ চেপে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে সেটাকে তালুবন্দি করে বাড়িতে এনেছিল বটে, কিন্তু কানকো আর দাঁড়ার কাঁটায় হাত কেটে ফালাফালা হয়ে গিয়েছিল। সে এক বিশ্রী রক্তারক্তি কাণ্ড। ঘটনাটা মনে পড়তে ফক্কা নিজের হাতখানা চোখের সামনে মেলে ধরে দেখতে লাগল। না! ক্ষতটা যে কবে মিলিয়ে গেছে, খেয়ালই করেনি। অথচ এতদিন পরেও মনে তার দাগ রয়ে গেছে।
অনন্তকাকু হাসতে হাসতে বলেছিল, বাহ্! তুই তো বেশ বাহাদুর ছেলে! হাত কেটে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে দেখেও মাছটাকে ছাড়িসনি! এই লেগে থাকাটাই আসল, বুঝলি? অন্যদের কাছে হয়তো এটা খুবই তুচ্ছ ব্যাপার, নিছকই একটা কইমাছ, বাজারে খুব সামান্য দাম দিলেই পাওয়া যেত। কিন্তু এই যে তুই ওটাকে ধরতে পারলি, এই পারাটা মোটেই তুচ্ছ নয়। ওটা তো শুধু একটা মাছ নয়, তোর হার না মানার স্মারক, আস্ত একটা ট্রফি!
অনন্তকাকুর কথা মনে পড়লে আজও মনটা বড় বিষণ্ণ হয়ে যায়। বাবার মাসতুতো ভাই অনন্তকাকু ভারী মজার মানুষ ছিল। খড়্গপুর আইআইটি-তে পড়ত। ছুটিছাটায় প্রায়ই ওদের বাঁকুড়ার কোয়ার্টারে চলে আসত। হাসি-গান-গল্পে সবাইকে মাতিয়ে রাখত। ফক্কা-ছক্কা সারাক্ষণ তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকত।
অমন আমুদে মানুষটা, রাতারাতি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সে সময়ে তাঁর মাথায় কী যে রাজনীতির ভূত চেপেছিল, সবকিছু ছেড়েছুড়ে সেসব নিয়েই মেতে উঠেছিল। সে এক উত্তাল সময়; পুলিশের ভয়ে অনন্তকাকু মাঝে মাঝে ফক্কাদের কোয়ার্টারে এসে দু-চারদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকত। সদর হাসপাতালের নামী ডাক্তারের কোয়ার্টারটাকে অনন্তকাকু হয়তো নিরাপদ আশ্রয় ভাবত।
বাবা ওঁকে অনেক বুঝিয়েছিল, কিন্তু কাজ হয়নি। একদিন অনন্তকাকু হেসে বলেছিল, একটাই তো জীবন বড়দা, সেটা তোমাদের মতো একঘেয়ে ছকে নাই বা বাঁধলাম!
ওঁর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা ভারী অদ্ভুত। অসম্ভব মাতৃভক্ত অনন্তকাকু এক শীতের রাতে গোপনে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
রাঙাঠাকুমা খুশি হয়ে মাঝরাতে ছেলের জন্যে খিচুড়ি চাপিয়েছিলেন। আর সেটাই কাল হয়েছিল। গোপন চরেরা মাঝরাতে রান্নাঘরে আলো জ্বলতে দেখে হয়তো ওঁর উপস্থিতি আঁচ করেছিল। সে রাতে পুলিশ পরিচয়ে কারা যেন বাড়ি ঢুকে বিনা ওয়ারেন্টে ওকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর আর খোঁজ মেলেনি মানুষটার। পুলিশ রেকর্ডেও সে রাতে এমন কোনও মানুষের অ্যারেস্ট হওয়ার উল্লেখ ছিল না। উপরন্তু পুলিশমহল থেকে জানানো হয়েছিল, তাঁরা নাকি সে রাতে ওরকম কোনও অপারেশানই করেনি!
ফক্কা হয়তো একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ পায়ের শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখল, দরজার সামনে গম্ভীর মুখে উজানি দাঁড়িয়ে। চোখে চোখ পড়তেই সে মুখ নামিয়ে নিল। ফক্কা আড়চোখে দেখল, উজানি যেন সামান্য মোটা হয়েছে। চেহারায় বেশ একটা গিন্নিবান্নি ভাব। এ যেন কিশোরবেলায় দেখা সেই উচ্ছ্বল তন্বী নয়, স্বভাবগম্ভীর অন্য কেউ, সম্পূর্ণ অচেনা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবার পর উজানি মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি চা খাবি, অনীশ?’
গত তিন দিনে এই প্রথম উজানি সরাসরি ওর সামনে এসে দাঁড়াল। এর আগে যতবারই মুখোমুখি হয়েছে, ও সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছে। ফক্কার মনে হল, উজানি যেন ঠিক চায়ের কথা বলতে আসেনি। অথচ এই মুহূর্তে ওর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা কিছু বলতে চাওয়া মোটেই সহ্য হচ্ছিল না ফক্কার। ও কার্নিসে খুনসুটি করতে থাকা কাক-যুগলের দিকে তাকিয়ে খুব নিরাসক্ত গলায় বলল, ‘না।’
২
অনেকদিন আগে, ফক্কা তখন হায়ার সেকেন্ডারি পড়ে, বাবার ডাক্তারির বইপত্রের মধ্যে অনন্তকাকুর নাম লেখা দুটো বই আবিষ্কার করেছিল। টলস্টয়-এর ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’। অনন্তকাকু হয়তো ভুল করে ফেলে গিয়েছিল। সাহিত্যের বইয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রের নাম দেখে প্রথমটায় খুব অবাক হয়েছিল ফক্কা। প্রবল কৌতূহলে বই দুটো নেড়েচেড়ে দেখবার সময়ে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর মধ্যে থেকে একটা ভাঁজ করা পুরনো হলদেটে কাগজের টুকরো টুপ করে খসে পড়েছিল।
ফক্কা খুলে দেখেছিল, সেটা আসলে একটা এক-লাইনের চিঠি। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘ক্ষুধাদীর্ণ মানুষের কষ্ট হয়তো তুচ্ছ নয়, কিন্তু অপ্রেমে, অবহেলায়, তিলে তিলে মৃত্যুর যন্ত্রণাও কিছু কম নয় জেনো। জানি না, কবে তোমার সেদিকে তাকাবার ফুরসত হবে, তবুও অপেক্ষায় থাকব’।
সম্বোধনহীন চিঠি, নীচে কারও নামও ছিল না। তবুও সেই অদেখা শবরীর কথা ভেবে ভারী কষ্ট হয়েছিল ফক্কার।
চিঠিটা ও যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। খুব মনখারাপ হলে মাঝে মাঝে খুলে পড়ত। ‘অপেক্ষায় থাকব’— দুটি মাত্র শব্দ, অথচ পড়লে প্রতিবারই বুকের মধ্যে যেন রক্ত চলকে উঠত। কে সেই মানবী, যে অপ্রেমে, অবহেলায় মরতে মরতেও অপেক্ষা করার অঙ্গীকার করে! আজও কি সে একজন হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া মানুষের জন্যে অপেক্ষায় আছে? বড় জানতে ইচ্ছা করে ফক্কার।
আজ রঞ্জুদের ওখানে যাওয়ার কথা ছিল। রঞ্জু নিজে এসে বার বার করে বলে গিয়েছিল। ওরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে একটা গানের ব্যান্ড খুলেছে। বিকেলে নাকি তাদের নিয়ে একটা ঘরোয়া জলসা হওয়ার কথা। আজকাল ইউরোপ-আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন পালা-পার্বণে এ দেশ থেকে শিল্পী-সাহিত্যিকদের পারফর্ম করার জন্যে মোটা দক্ষিণা দিয়ে নিয়ে যায়। রঞ্জুর খুব ইচ্ছা, ফক্কা এবার ফিরে গিয়ে ওদের ব্যান্ড সম্পর্কে ও দেশে পরিচিত মহলে একটু সুপারিশ করুক।
এমনিতেই ওদের মতলব শুনে ফক্কা বিরক্ত হয়েছিল। নেহাত ছোটবেলার বন্ধু বলে মুখের উপর না বলতে পারেনি। কিন্তু দুপুরে খাওয়ার পর ফেসবুকে রঞ্জুর পোস্ট দেখে মাথা গরম হয়ে গেল। ওকে ট্যাগ করে ব্যান্ডের সদস্যদের অবিলম্বে পাসপোর্ট করার পরামর্শ দিয়েছে। ও একপ্রকার ধরেই নিয়েছে, ফক্কার সুপারিশে এবার পুজোর সময় ওরা আমেরিকা যাচ্ছে।
অথচ মাত্র মাস ছয়েক হল, ফক্কা হিউস্টন থেকে নিউ ইয়র্কে এসেছে। এত বড় শহর, তার ওপর প্রবল কাজের চাপ, সব মিলিয়ে এখনও সেভাবে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি।
ফোনে সে-কথা বলতে রঞ্জু রাগ দেখিয়ে খটাস করে ফোনটা কেটে দিল। বাড়িতে থাকতে ভাল না লাগলেও এরপর আর রঞ্জুদের ওখানে যাওয়া চলে না।
দুপুরে খাওয়ার পর বইয়ের র্যাক থেকে মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ বইটাতে চোখ বোলাতে বোলাতে ফক্কা ভাবছিল, একই বিষয়, অথচ দুজনের বক্তব্যে কত ফারাক। মির্চা এলিয়াদের ‘লা নুই বেঙ্গলি’-তে এমন সব ঘটনার উল্লেখ আছে, যা মৈত্রেয়ী দেবীর লেখায় অনুপস্থিত! তিনি কি সচেতনভাবে কিছু কিছু ঘটনা আড়াল করতে চেয়েছিলেন?
সন্ধেবেলা যখন ফক্কার ঘুম ভাঙল, দেখল ‘ন হন্যতে’টা একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে, খোলা মলাটখানা ফ্যানের হাওয়ায় ফড়ফড় করে উড়ছে।
শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল। মাথাটা বেশ ধরে আছে। বিছানা ছেড়ে উঠে আয়নায় দেখল, চোখ দুটো ফোলা-ফোলা এবং লাল। এ সময়ে, এক কাপ চা পেলে বেশ হত। কিন্তু উজানিকে ডাকতে ইচ্ছে হল না।
আসলে ফক্কার জীবনে উজানি যেন অনেকটা গলায় বিঁধে থাকা কাঁটার মতো, এতদিনেও খচখচানিটা গেল না।
হায়ার সেকেন্ডারি পড়ার সময়ে একই কোচিংয়ে পড়বার সুবাদে উজানির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ফক্কার। তেমন কিছু সুন্দরী নয়, তবে একটা আলগা চটক ছিল চেহারায়। খুব সুন্দর গুছিয়ে কথা বলত সে, একদম নাটকের সংলাপের মতো নিখুঁত উচ্চারণ এবং কাটা-কাটা শব্দ।
কিছুদিন যাওয়ার পর ফক্কা টের পাচ্ছিল, ধীরে ধীরে খুচরো বন্ধুত্বের আগল ডিঙিয়ে উজানির ওপর যেন একটা অন্যরকম টান তৈরি হচ্ছে। হয়তো সেটা উজানির মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। তখন ছুতোয়নাতায় উজানি প্রায়ই ফক্কাদের বাড়িতে এসে হাজির হত। মায়ের সঙ্গেও বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল।
সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় একটু হাত ধরাধরি, গাঢ় ছোঁয়াছুঁয়ি… সে বড় সুখের সময় ছিল।
পরীক্ষা মিটে যাওয়ার পর গ্রীষ্মের এক ঝিমধরা দুপুরে উজানি একটা বই ফেরত দিতে এসেছিল। নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় বই, না দিলেও কিছু ক্ষতি ছিল না; তবু কেন যে এসেছিল! সেই নির্জন দুপুরে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ওকে আচমকা জড়িয়ে ধরে উজানি বলেছিল, ‘তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না অনীশ!’
উজানির সেই বলার মধ্যে সমর্পণের এমন এক ব্যঞ্জনা ছিল যে, তারপর কয়েক রাত ভাল করে ঘুমোতে পারেনি ফক্কা। আজও চোখ বন্ধ করলে ও যেন উজানির সেই তপ্ত নিঃশ্বাসের গন্ধ পায়।
পরক্ষণেই সন্দেহ হয়, সত্যিই কি ঘটেছিল ঘটনাটা? নাকি এটা কোনও ধূসর অতীতের একক স্বপ্নকল্প?
৩
বাড়িটা ক্রমশ ফক্কার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। অথচ এখনও অন্তত দিন চারেক কাটাতে হবে এখানে। এসেই যখন পড়েছে, মায়ের শ্রাদ্ধটা না মিটিয়ে চলে যাওয়াটা মোটেই ভাল দেখাবে না। বিশেষ করে দীর্ঘ সাত বছর বাদে ওই উপলক্ষ্যেই যখন দেশে ফেরা।
মায়ের শ্রাদ্ধের এখনও দিন তিনেক বাকি। এসব শ্রাদ্ধশান্তিতে একেবারেই বিশ্বাস নেই ফক্কার। তবু কেন যে এল, নিজেও ঠিক জানে না! মা নেই, শুধু তাঁর স্মৃতির টানেই কি? নাকি অন্য কোনও আকর্ষণ তাকে পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে ছুটিয়ে নিয়ে এল? নিজেকে বার বার শুধিয়েও সে উত্তর পায়নি।
শ্রাদ্ধের উদ্যোগ-আয়োজন অবশ্য ছক্কা আগেই সেরে রেখেছিল। ফক্কা শেষ পর্যন্ত আসবে কি না, সে ব্যাপারে হয়তো ওর মনে সন্দেহ ছিল। মা বেঁচে থাকতে তাঁর হাজার অনুনয়েও যে ছেলে একবারের জন্যেও এল না, তাঁর মৃত্যুতে সে যে আসবে, এমনটা কে-ই বা আশা করে!
সত্যি বলতে কী, মায়ের মৃত্যু-সংবাদটা পাওয়ার পর এভাবে চলে আসার সিদ্ধান্তটা ওর নিজের কাছেই বেশ অস্বাভাবিক লেগেছে।
এবার বাড়ি ফেরার পর থেকেই ছক্কার মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করছে ফক্কা। ছক্কা যেন সেই আগের মতো হাসিখুশি মানুষটা নেই। সারাক্ষণ গম্ভীর, আনমনা। একমাত্র ভাই যে এতদিন পরে দেশে এল, তার জন্যে বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস নেই। নিজের চাকরি, প্রাইভেট প্র্যাক্টিস, এসবের মধ্যে ডুবে আছে। রাতের দিকে খাওয়ার টেবিলে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে যেন প্রাণ নেই। শ্রাদ্ধে কাকে কাকে বলা হবে, বাবা-মা যেহেতু নেই, তাই পৈতৃক সম্পত্তির কী হবে, ফক্কার নিজের কোনও পরিকল্পনা আছে কি না, এসবই আলোচ্য বিষয়। উজানির দিকে যদিও ফক্কা সোজাসুজি তাকায় না, তবু মনে হয়েছে, সেও যেন ঠিক ছন্দে নেই!
হালকা জ্বর এসেছে বলে সন্ধেবেলা আধা অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে ছিল ফক্কা। ছক্কা বলে গেল সামান্য ফ্লু, দু-এক দিনেই সেরে যাবে।
হঠাৎ খটাস করে ঘরের আলোটা জ্বলে উঠতে ও চমকে উঠল। তাকিয়ে দেখল, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উজানি সামনে দাঁড়িয়ে।
জ্যাকারান্ডা রঙের হাত-কাটা ম্যাক্সির উপরে একটা হাউসকোট চাপানো, প্রসাধনহীন মুখ, ফোলা ফোলা চোখদুটো দেখলেই বোঝা যায়, দুপুরে টেনে ঘুমিয়েছে।
ওর দিকে তাকিয়ে কুণ্ঠিতভাবে হাসল উজানি।
ফক্কা চোখ নামিয়ে নিল। এতদিন পরে, এভাবে উজানি ওর ঘরে আসাতে একটু যেন অস্বস্তিও হল।
চায়ের কাপটা এগিয়ে ধরে উজানি বেশ দ্বিধার সঙ্গে বলল, ‘এখানে একটু বসি?’
ফক্কা আলগোছে ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিল, কিন্তু কোনও উত্তর দিল না।
উজানি ইতস্তত করতে করতে চেয়ারটা খাটের সামনে টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসল। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে, অনীশ।’
এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর চোখের দিকে সোজাসুজি চাইল ফক্কা। উজানি যেন আগের চাইতে সুন্দর হয়েছে। মুখখানা বেশ ঢলঢলে, গভীর প্রশস্ত চোখদুটো আগের মতোই মায়াবতী, অথচ বিষণ্ণ। হিরের নাকছাবিতে আলো ঠিকরোচ্ছে।
আচ্ছা, আগে কি উজানি নাকছাবি পরত? মনে করতে না পেরে মুখ নিচু করে চুপচাপ চায়ে মন দিল।
উজানি উসখুস করতে করতে আবার বলল, ‘তুই কি আমার সঙ্গে কথা বলবি না ঠিক করেছিস?’
ফক্কা এবারও কোনও উত্তর দিল না। চায়ের কাপটা নিঃশব্দে নামিয়ে রাখল। তারপর খবরের কাগজখানা টেনে নিচ্ছে দেখে উজানি মিনতিভরা কণ্ঠে বলল, ‘তুই আমার সঙ্গে কেন এমন করছিস অনীশ?’
ফক্কা দেখল, উজানির চোখদুটো জলে ভরে উঠেছে। ওর হঠাৎ মনে হল, ঘরের মধ্যেটা বড় বেশি গুমোট লাগছে, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি উঠে জানলাগুলো খুলে দিল। তারপর খবরের কাগজটা কোলের ওপর নিয়ে ঝাপসা অক্ষরের ওপর চোখ বোলাতে লাগল।
একটু আগে গাড়ি বেরোবার আওয়াজ পেয়েছে। তার মানে ছক্কা বেরিয়েছে। সন্ধের দিকে ও একটা ক্লিনিকে বসে, ফিরতে ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা হয়ে যায়। বন্ধুদের কাছে শুনেছে, ডাক্তার হিসেবে ছক্কার পসার ভাল। তার ওপরে বর্ষা-বাদলার মরসুম। পেডিট্রিশিয়ানদের চেম্বারে এ সময়ে ভিড় উপচে পড়ে। ডাক্তারদের পক্ষে তাই অশৌচ পালনের ছুটি নেওয়া কঠিন।
অবশ্য সেই অর্থে অশৌচ বলতে যা বোঝায়, দু’ভাইয়ের কেউই তা মানছে না। বাড়িতে মাছ-মাংস উঠছে না, এই যা!
যে গুরুদেবের কাছে মা দীক্ষা নিয়েছিল, তাঁর আশ্রমেই শ্রাদ্ধশান্তি হবে বলে ঠিক হয়েছে। অল্প কয়েকজন নিকটাত্মীয় এবং অনাথ আশ্রমের কিছু শিশুদের ডাকা হবে। আশ্রমের পক্ষ থেকেই যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেবে। ফক্কা পৌঁছবার আগেই ছক্কা গুরুদেবের আশ্রমে গিয়ে কথাবার্তা পাকা করে এসেছে।
হঠাৎ ফক্কার মনে হল, উজানি যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
আবার ওর সেই পুরনো দিনগুলো মনে পড়ে গেল। ওদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে করতেই একসময়ে ছক্কার সঙ্গে উজানির আলাপ হয়েছিল। ওরা পিঠোপিঠি দু’ভাই ছিল অনেকটা বন্ধুর মতো। মাত্র বছর দুয়েকের বড় ছক্কাকে সে কখনও ‘দাদা’ ডাকেনি।
ছক্কা তখন মেডিকেল কলেজে, সেকেন্ড ইয়ার।
হায়ার সেকেন্ডারির পর ফক্কা যখন কানপুর আই আই টি-তে চলে গেল, তখন উজানি ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল।
আজকাল এসব কথা মনে পড়লেই ফক্কার কেমন যেন হাসি পায়। কীসব ছেলেমানুষির দিন গেছে!
প্রথম প্রথম নিয়ম করে ফোন করত উজানি। কত আবেগ, কত অভিমান ফোনের ও-প্রান্তে, ফক্কার ইচ্ছে হত, আরেকবার জয়েন্ট দিয়ে ছক্কার মতো মেডিকেলটা চেষ্টা করবে। এ ছাড়া তো কলকাতায় ফেরার উপায় নেই!
অবশ্য বছর খানেক পর ক্যাম্পাস পরিবর্তন করার সুযোগ ছিল। কানপুর থেকে খড়গপুর। কিন্তু ততদিনে ফক্কা টের পেতে শুরু করেছিল, ওদের কথার মধ্যে যেন বেশি বেশি করে ছক্কা ঢুকে পড়ছে। সে সময়টা খুব কষ্টে কেটেছে ফক্কার। পর পর দুটো সিমেস্টারে সাপ্লি খাওয়ার পর অনন্তকাকুর মতো উধাও হয়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছিল।
স্বাভাবিক কারণেই সে বাড়িতে আসা-যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের মাঝামাঝি খবর পেয়েছিল, ছক্কার সঙ্গে উজানির বিয়ে পাকা হয়ে গেছে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত ওদের বিয়েতে আসতে হয়েছিল। তবে সেই আসাটা ছিল একেবারে অতিথির মতো। পাছে উজানির মুখোমুখি হতে হয়, এই ভয়ে বেশির ভাগ সময় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বাইরে বাইরে কাটিয়ে বৌভাতের পরের দিনই আবার হস্টেলে ফিরে গিয়েছিল।
বিষয়টা যে ছক্কার নজর এড়ায়নি, তা টের পেয়েছিল এয়ারপোর্টে গিয়ে। ওরা দুজন ওকে সি-অফ করতে গিয়েছিল।
ফক্কা সিকিয়োরিটি এনক্লোজারে ঢুকতে যাবে, এমন সময় ছক্কা বলেছিল, ‘কীরে, তুই ওর সঙ্গে কথা বলছিস না কেন? তোরা তো এক সময় খুব বন্ধু ছিলিস, তাই না?’
পাছে ফক্কা বেফাঁস কিছু বলে ফেলে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে উজানি বলেছিল, ‘আমি কিন্তু তোকে ঠাকুরপো-টাকুরপো বলতে পারব না অনীশ। তুইও ইচ্ছা হলে আমাকে আগের মতো নাম ধরে ডাকতে পারিস। তুমি কী বল?’
শেষের প্রশ্নটা ছিল ছক্কার উদ্দেশে। ও কোনও উত্তর দেয়নি, হেসেছিল শুধু।
৪
কান্না থামিয়ে উজানি বলল, ‘অনীশ, আমি মানছি, তোর প্রতি আমি হয়তো কিছুটা অবিচার করেছি, তাই বলে আমাকে এত বড় শাস্তি দিবি? এমন তো কতই হয়!’
ফক্কা দেখল, উজানির চোখের কোণগুলো তখনও ভিজে চকচক করছে, মুখখানা জলে ডোবা মানুষের মতো ফ্যাকাশে।
হঠাৎ ফক্কা নিজের অজান্তেই যেন কেমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠল। কর্কশ গলায় বলল, ‘বাহ্! কতই যদি হয়, তাহলে এত বছর বাদে এ নাটক কেন?’
‘নাটক? কী বলছিস তুই? তুই কি জানিস, তোর জন্যে আমাকে কত মূল্য দিতে হয়েছে?’
‘মানে?’
‘অনীশ, তোকে আমি বরাবরই খুব বুদ্ধিমান ভাবতাম। কিন্তু তুই যে এত বোকা, তা তো জানতাম না!’
ফক্কা নাটুকে গলায় হো হো করে হেসে উঠল। তারপর তীব্র শ্লেষ মেশানো স্বরে বলল, ‘আমি কিন্তু জানতাম, আমি বরাবরই খুব বোকা। সেই জন্যে কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পর পর দুটো সিমেস্টারে সাপ্লি খেয়েছিলাম!’
উজানি কয়েক মুহূর্ত মুখ নিচু করে কী যেন ভাবল। তারপর মিনতিভরা গলায় বলল, ‘আচ্ছা অনীশ, ভালবাসার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু আমরা যে বন্ধু ছিলাম, এ কথাটা কি তুই অস্বীকার করিস?’
‘কেন? ভালবাসার কথাটা ছেড়ে দেব কেন? তুই একতরফা শিবির বদল করেছিস বলেই কি আমার ভালবাসাটা মিথ্যে হয়ে যায়?’
উজানি একটু চুপ করে রইল। তারপর উদ্যত ফণিনীর মতো গ্রীবা তুলে বলল, ‘ভালবাসা? তোর মুখে অন্তত এ কথাটা মানায় না অনীশ। যদি ভালইবাসতিস আমাকে, তাহলে এমন বিড়ম্বনায় ফেলে আমার জীবনটা দুর্বিষহ করে তুললি কেন?’
ফক্কা খুব অবাক হয়ে উজানির দিকে চাইল। ওর চোখে তখনও জল টলটল করছে। ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপছে।
অবাক গলায় বলল, ‘কী বলছিস তুই? তোকে বিড়ম্বনা থেকে বাঁচাতেই তো আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছি। মা বেঁচে থাকতে অত সাধাসাধি করার পরেও একবারের জন্যে দেশে আসিনি।’
‘সবাইকে তুই খুব বোকা ভাবিস, তাই না অনীশ?’
‘মানে?’
‘মানে খুব সোজা। তুই যে কেন আমার বিয়ের সময় পালিয়ে পালিয়ে থেকে বৌভাতের পরদিনই তড়িঘড়ি হস্টেলে ফিরে গেলি, কোন অভিমানে হাজার ডাকাডাকিতেও দেশে এলি না, তুই কি ভাবিস, সে কথা কেউ বোঝেনি?’
ফক্কা চুপ করে উজানির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
উজানি কান্নাভেজা গলায় বলে চলল, ‘মা’র ধারণা হয়েছিল, আমি তাঁর দুটো ছেলেকেই পর করে দিয়েছি। তিনি সে কথা প্রকাশ্যে বলতেনও। তার চাইতেও যন্ত্রণার হল অবনীশের ব্যবহার। ও আজও সন্দেহ করে, আমি আসলে এখনও ওর মধ্যে নাকি তোকেই খুঁজি।’
কথা বলতে বলতে উজানি আচমকা ফক্কার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ‘তুই আমাকে নিয়ে চল, অনীশ… না হলে আমি বাঁচব না।’
ফক্কা বাধা দিল না। উজানি ওকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ফক্কা টের পেল, উজানির চোখের জলে ওর বুক ভিজে উঠছে।
কিছুটা শান্ত হলে ফক্কা উজানিকে সরিয়ে দিল। তারপর উদাস গলায় বলল, ‘উজানি, আমি দুটো অসমাপ্ত প্রেমের গল্প জানি, শুনবি?’
উজানি জবাব দিল না।
ফক্কা বলল, ‘আমার এক সহপাঠী ছিল, তুহীন। আমরা তীর্থপতিতে একসঙ্গে পড়তাম। ওর বাবা ছিলেন দিনমজুর, মা অন্যের বাড়িতে বাসন মাজতেন। তবুও অসম্ভব আত্মসম্মানবোধ আর জেদ ছিল ওর মধ্যে। প্রেসিডেন্সিতে কেমিস্ট্রি পড়বার সময় পারমিতা নামে খুব বড়লোকের মেয়ে ওর প্রেমে পড়েছিল। একবার আমার সেই সহপাঠীর মা জ্বরের জন্যে কয়েকদিন কাজে যেতে পারছিলেন না। কিন্তু সেই দায়িত্বশীলা মহিলা বিনা নোটিশে কামাই করা অনুচিত মনে করে ওকে পাঠিয়েছিলেন মনিবদের বাড়িতে খবর দিতে। খবরটা শুনে বাড়ির গৃহকর্ত্রী ভয়ঙ্কর চটে গিয়ে নানা কুকথা বলতে লাগলেন। শেষে রেগেমেগে বললেন, মা আসতে পারেনি, সে খবর জেনে আমি কী করব? মা যখন আসতে পারেনি, তুই বরং বাসি বাসনগুলো মেজে দিয়ে যা! মাসের শেষে আমি তো আর ঝিয়ের মাইনে থেকে টাকা কেটে নিতে পারব না! অগত্যা বিনা বাক্যব্যয়ে ও সেই বাসনের ডাঁই নিয়ে কলতলায় মাজতে বসে গিয়েছিল আমার মেধাবী বন্ধুটি। মায়ের চিৎকার শুনে দোতলা থেকে পারমিতা নেমে এসে দেখে ওদেরই বাড়ির দু’দিনের জমানো এঁটো বাসনের ডাঁই নিয়ে যে মাজতে বসেছে, সে আর কেউ নয়, তুহীন।
আসলে আমার বন্ধুটি জানত না যে ওটা পারমিতাদের বাড়ি। পারমিতাও জানত না, ওদের ঠিকে কাজের মহিলাটিই আসলে তুহীনের মা। পারমিতা এখন বেঙ্গালুরুতে, একটা নামী কলেজে পড়ায়। বিয়ে করেনি, এখনও সে আমার তুহীনের জন্যে অপেক্ষা করে আছে। তুহীন হিঙ্গলগঞ্জের ওদিকে একটা স্কুলের টিচার, সঙ্গে নানা সোশ্যাল-ওয়ার্কও করে। পারমিতার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে মাঝে মাঝে কথা হয়। তুহীন একবার ডাকলেই পারমিতা চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে হিঙ্গলগঞ্জের ওই অজ পাড়াগাঁয়ে যেতে একপায়ে খাড়া, অথচ…’
উজানি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এ গল্প আমাকে শোনাচ্ছিস কেন?’
ফক্কা খুব নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘কেন শোনাচ্ছি, জানি না। আসলে ভালবাসার কথা তুললি বলেই হয়তো। তবে আমার দ্বিতীয় গল্পটা কিন্তু আরও ইন্টারেস্টিং।’
কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল ফক্কা। তারপর টেবিলের ওপর রাখা চামড়ার পার্স খুলে এক টুকরো বিবর্ণ ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে যাওয়া কাগজের টুকরো বের করে উজানির হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা আমি অনন্তকাকুর বইয়ের মধ্যে পেয়েছিলাম। আমার জীবনে পড়া শ্রেষ্ঠ প্রেমপত্র। কে তাঁকে এ চিঠি লিখেছিলেন জানি না, কিন্তু তোর মধ্যে আমি বরাবর সেই অদেখা মানবীকে কল্পনা করতাম। আজ বুঝেছি, তুই আমার সেই মানসী নোস, ছিলি না কোনকালেও!’
কাঁপা কাঁপা হাতে ফক্কার দেয়া ছেঁড়া কাগজের টুকরোটা নিয়ে উজানি চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। ওর মনে হল, সামনের মানুষটা যেন বড়ই অচেনা।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র