ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • এক আশ্চর্য ‘ওয়াকওভার’


    সোহম দাস (November 22, 2024)
     

    এই মাত্র কয়েক দিন আগে, এ-মাসের শুরুতেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের গণনা যেদিন হচ্ছে, শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেল, ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার রাষ্ট্রপতি হয়ে ফিরছেন। অতিমারি-আবহে ঘটা আগের বারের নির্বাচনে এই ট্রাম্পকে হারিয়েই জো বিডেন যখন রাষ্ট্রনেতা হলেন, সে-সময়ে যেরকম উচ্ছ্বাস ও স্বস্তি দেখা গিয়েছিল গণতন্ত্রপ্রেমীদের মধ্যে, মাত্র চার বছর বাদেই পাশার দান উলটে দিয়ে ট্রাম্পের এমন প্রত্যাবর্তন নিয়ে সেই একই মাত্রায় গেল-গেল হাহাকার ওঠার কথা ছিল, অদ্ভুতভাবে সেসব কিছুই দেখা যায়নি। সারা বিশ্বজুড়েই দক্ষিণপন্থী শক্তি যেখানে প্রবল প্রতাপে ফিরে আসছে, তার বিরুদ্ধে ছোট-বড় প্রতিরোধও গড়ে উঠছে নিয়মমাফিক, তেমন এক সময়ে বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে আবারও ‘অগণতন্ত্রী’ এক নায়কের ফিরে আসা নিয়ে সাধারণ মহলে এই নির্লিপ্তি খানিক বেমানানই ঠেকে।

    গত চার বছরে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বা ফিলিস্তিনে ইজরায়েলের গণহত্যালীলার ঘটনায় মার্কিন বিদেশনীতির যে-ন্যক্কারজনক ভূমিকা, তাতে অতি-দক্ষিণপন্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এসে তার চেয়ে আর বেশি কী খারাপ করবেন, এ-নিয়ে আদ্যোপান্ত ভেবে সময় নষ্ট করতে আর বোধহয় রাজি নয় তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি-কৌতূহলী জনতা— যাঁদের একটা বড়ো অংশই বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কথা শুনে-শুনে এখন ক্লান্ত।  

    ১৯৭০-এ লাতিন আমেরিকার চিলিতে যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়, সে-নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় আসেন সালভাদর আয়েন্দে। সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ চিলির প্রতিষ্ঠাতা ও আজীবন সদস্য সালভাদর আয়েন্দে পেশায় ডাক্তার ছিলেন, চল্লিশ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনও হয়েছেন মন্ত্রী, কখনও-বা ডেপুটি, কখনও-বা সেনেটর, আর বরাবর ভরসা রেখেছেন মার্ক্সবাদ ও গণতন্ত্রে। প্রশাসক হিসেবে রেকর্ডও মোটামুটি উজ্জ্বল। ১৯৩৮ সালে পেদ্রো আগুইর সের্দার নেতৃত্বাধীন বামপন্থী জোট ‘পপুলার ফ্রন্ট’ যখন ক্ষমতায় এল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে সালভাদর আয়েন্দের কয়েকটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ছিল কারখানার শ্রমিকদের জন্য কর্মী নিরাপত্তা আইন, বিধবা ভাতা বাড়ানো, স্কুলপড়ুয়াদের জন্য ফ্রি লাঞ্চ প্রোগ্রাম, মাতৃত্বকালীন পরিষেবার উন্নতি। এমনকী, পাঁচের দশকে সেনেটর থাকাকালীন তাঁরই সদিচ্ছায় চিলিতে চালু হল ন্যাশনাল হেল্‌থ সার্ভিস— দুই আমেরিকা জুড়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার এমন পরিকল্পনা এই প্রথম।

    গঠনমূলক কাজকর্মের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পরেও। ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই কয়েকটি বড়সড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আয়েন্দে— তাম্র-উত্তোলন ও ব্যাঙ্কিংয়ের মতো বৃহৎ শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য-পরিষেবাও সম্পূর্ণভাবে সরকারের অধীনে এল, স্কুলপড়ুয়াদের জন্য তো বটেই, চিলির অনগ্রসর এলাকায় বিনামূল্যে দুধ বিতরণের পরিকল্পনা করলেন। ভূমি সংস্কার পূর্বতন ফ্রেই-সরকারের সময়েই শুরু হয়েছিল, আয়েন্দে এসে তাকে আরও পূর্ণতা দিলেন। মাপুচে জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের জন্য চালু হল সরকারি বৃত্তি। নতুন করে কর্মসংস্থানও হল, এক বছরের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার পড়ে গেল ১৪ শতাংশ, ওদিকে গড় মজুরি বাড়ল প্রায় ২২ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে কৃষি-সংস্কার ও অশিক্ষা দূরীকরণের দিকেও নজর দিয়েছিল তাঁর প্রশাসন। রাজনৈতিক বন্দিমুক্তিও ক্রমশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলছিল তাঁকে।

    রাষ্ট্রপতি সালভাদর আয়েন্দে

    এহেন অগ্রগতি অবশ্য ভাল চোখে দেখেনি উত্তরের ক্ষমতাধর দূর-প্রতিবেশী। ১৯৭০-এ রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে আরও তিনবার— ১৯৫২, ১৯৫৮ এবং ১৯৬৪ সালে— রাষ্ট্রপতি পদের জন্য লড়েছিলেন আয়েন্দে। চূড়ান্ত সাফল্য সেই সময়ে আসেনি, তবে সিআইএ-র ‘অপছন্দের পাত্র তালিকা’য় জায়গা পাকা হয়ে গিয়েছে। ’৬৪ সালে তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির এডুয়ার্ডো ফ্রেই— পরবর্তীকালে নথিপত্র ঘেঁটে জানা গিয়েছে, ’৬২ থেকে ’৬৪-র মধ্যে এডুয়ার্ডো ফ্রেইয়ের নির্বাচনী প্রচারে সিআইএ মোট খরচ করেছিল ছাব্বিশ লক্ষ ডলার, আর আয়েন্দে-বিরোধী প্রচারে সে-ভাগটা কিঞ্চিৎ বেশি, তিরিশ লক্ষ ডলার। অবশ্য শুধু চিলিই কেন, বিশ্বের এখানে-ওখানে সিআইএ-র পেছনপাকামি ততদিনে ওই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতোই আকাশ ছুঁয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৩ সালে ইরানে মোহামেদ মোসাদেঘের সরকার পড়ে গেল, ক্ষমতায় এল শাহ। ঠিক পরের বছরই গুয়াতেমালায় জেকোবো আরবেঞ্জ উৎখাত হলেন, প্রতিষ্ঠিত হল সেনাবাহিনির একনায়কত্ব। ১৯৬১ সালে বেলজিয়ান-সিআইএ ষড়যন্ত্রে খুন হলেন কঙ্গোর নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, আফ্রিকার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের অবিসংবাদী নেতা, প্যাট্রিস লুমুম্বা, সে-জায়গায় ক্ষমতায় এলেন একনায়ক মোবুতু। এডুয়ার্ডো ফ্রেইয়ের ক্ষমতায় আসার বছরেই সিআইএ-পুষ্ট সেনা অভ্যুত্থান ক্ষমতাচ্যুত করল ব্রাজিলের বামপন্থী রাষ্ট্রপতি জোয়াও গুলার্টকে, সেখানেও প্রতিষ্ঠিত হল সেনাশাসন। আর, ১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সুকার্নোর উৎখাত এবং তৎপরবর্তী সুহার্তোর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট-নিধনযজ্ঞে ভরপুর মদত। ওই মেঘ-মন্দ্রিত বিজয়রথের চাকায় কাঁটা ফুটেছিল কেবল দুই প্রান্তের দুই ছোট্ট দেশে— কিউবা আর ভিয়েতনাম।

    তিন-তিনবার হারের পরও চতুর্থবারে পপুলার ইউনিটির হয়ে জিতে গিয়ে বামপন্থী আয়েন্দের ক্ষমতায় চলে আসা, অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, সেই কাঁটার ভয় স্বাভাবিকভাবেই আরও একটু বাড়িয়ে দিল। যদিও, সালভাদর আয়েন্দে কোনও মাও সে তুং বা হো-চি-মিন বা ফিদেল কাস্ত্রো-চে গেভারা ছিলেন না, গণতান্ত্রিক নির্বাচনেই আস্থা রাখতেন বরাবর। চিলিতেও গণতন্ত্রের ইতিহাস দীর্ঘ, ফলে মার্কিনবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের ‘আশঙ্কাও’ তেমন ছিল না। রাষ্ট্রপ্রতি আয়েন্দে বরং অনেক বেশি চিন্তিত ছিলেন গঠনমূলক সংস্কারের মতো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে।

    অগাস্তো পিনোচে

    কিন্তু, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি! তার উপর শপথগ্রহণের সময়েই আয়েন্দে সোজাসুজি বলে দিয়েছিলেন, ‘আমরা সমাজতন্ত্রের দিকে এগোচ্ছি, কারণ, মানুষই আমাদের বেছে নিয়েছেন। যে-ধনতন্ত্র এক ভয়াবহ অসাম্যের সমাজ তৈরি করেছে, মানুষ সেই সমাজকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন।’ ওদিকে, কাস্ত্রোর কিউবার সঙ্গেও চিলির সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে। লাতিন আমেরিকার সব দেশে যেখানে মার্কিন-মদতপুষ্ট সেনা একনায়কত্ব চলছে, এতদিনকার মার্কিনপন্থী চিলি আজ সমাজতান্ত্রিক হয়ে গিয়ে কিনা যোগ দিল ‘নন-অ্যালাইন্ড মুভমেন্টে’। রিচার্ড নিক্সন-হেনরি কিসিংগারদের কাছে ‘বিপজ্জনক’ হয়ে উঠতে এর চেয়ে বেশি অজুহাতের প্রয়োজন ছিল না। অতএব, আবারও শুরু হল বিরোধীপক্ষকে অস্ত্র-মন্ত্র সরবরাহের চিরাচরিত পরিকল্পনা, নিখুঁতভাবে সাজানো হল চৌষট্টি খোপের বোর্ড।

    ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩— সেনাপ্রধান অগাস্তো পিনোচের নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানে যতটা না বেসামাল হল আয়েন্দে-প্রশাসন, তার চেয়েও বেশি হকচকিয়ে গেল সাধারণ মানুষ। নির্বাচিত সরকার এই হঠাৎ-আক্রমণকে সামলাতে পারেনি, রাষ্ট্রপতিকে ভোট দিয়ে জেতানোর ‘অপরাধে’ নির্বিচার অত্যাচারের শিকার হল হাজার হাজার সাধারণ মানুষও। রাষ্ট্রপতি ভবনের দখল সেনার হাতে যাওয়ার কিছু আগে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে শেষবারের মতো করমর্দন করলেন সালভাদর আয়েন্দে, সেফ প্যাসেজের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন হেলায়, শেষ, নিভৃত অবসরের সময়ে হাতে নাকি ধরা ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর পাঠানো উপহার, একটা একে-৪৭ রাইফেল।

    সে-অস্ত্রটা নিজের ওপরেই ব্যবহার করেন বলে জানা গিয়েছিল নানা সূত্রে।

    অগাস্তো পিনোচেকে মদত দিয়ে যে আসলে নিজেদেরও বিপদ ডেকে আনছে আমেরিকা, তা অবশ্য সেই মুহূর্তে বুঝতে পারেনি তারা। বুঝতে পারবে, যখন ১৯৭৬ সালে খোদ ওয়াশিংটন ডিসিতেই দেশের গোয়েন্দা দফতরকে বুদ্ধু বানিয়ে, পিনোচে শাসনের কঠোর সমালোচক, আয়েন্দে-ঘনিষ্ঠ ওরল্যান্ডো ল্যাটেলিয়ার এবং তাঁর সেক্রেটারি রনি মফিটের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটাবে পিনোচের ‘চিলিয়ান সিক্রেট পুলিশ’ নামক ঘাতকবাহিনির সংগঠন ‘অপারেশন কন্ডর’-এর সন্ত্রাসীরা। আরও হাড়ে-হাড়ে টের পাবে বছর পঁচিশ পরে, যখন তদন্তে উঠে আসবে, মার্কিন দেশে আল কায়দার জালবিস্তারের পিছনেও রয়েছে কন্ডরের পুরনো মাথারা। সে-ইতিহাস অবশ্য এখানে আলোচ্য নয়।

    লাল দুনিয়াকে টেক্কা দিতে পশ্চিমা দুনিয়া আন্তর্জাতিক খেয়োখেয়ি লাগাতে ব্যস্ত— তাতে অন্যান্য আয়োজন যে থেমে ছিল, এমন নয়। ১৯৭৪ সালেই পশ্চিম জার্মানিতে ফুটবল বিশ্বকাপ। পিনোচের ক্ষমতাদখল যখন সম্পূর্ণ, বিশ্বকাপের চূড়ান্ত বাছাবাছিরও শেষ পর্যায় আগত। অভ্যুত্থানের দিন পনেরো পরেই চিলির ফুটবল দলের খেলা কোয়ালিফায়ারের প্লে-অফে। আর, সে-খেলা পড়বি তো পড়, খোদ মস্কোয়। প্রতিপক্ষ, সোভিয়েত ইউনিয়ন।

    আয়েন্দের উৎখাত নিয়ে তখন বিশ্ব-রাজনীতি সরগরম। সমাজতান্ত্রিক সরকারের এমন অন্যায়-উচ্ছেদ মোটেই ভালো চোখে দেখেনি ব্রেজনেভের সোভিয়েত। চিলি সরকারও শুরুতে চায়নি, ‘জাতশত্রু’দের দেশে নিজেদের দল পাঠাতে। কিন্তু, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দায় কেই-বা এড়াতে পারে! তার উপর ভাবমূর্তির প্রশ্ন— সেদিক থেকে ফুটবলের মতো বিশ্বজনীন খেলা যে মোক্ষম অস্ত্র হতে পারে, সে-ব্যাপারটা ফ্যাসিবাদী একনায়কদের থেকে কেই-বা ভাল বোঝে! বেনিতো মুসোলিনি থেকে সাতের দশকেরই আর্জেন্তিনার হোর্গে রাফায়েল ভিদেলা, সকলেই বিশ্বকাপ আয়োজন করে (এবং, জিতে) তা প্রমাণ করেছিলেন।

    আয়েন্দের সঙ্গে ফুটবলার কার্লোস ক্যাসেলি

    সোভিয়েতে দল খেলতে গেল ঠিকই, তবে সরকারি তরফে পরিষ্কার বলে দেওয়া হল, তাদের পরিবারের উপর নজর রাখবে সেনা, অতএব, সোভিয়েতে গিয়ে বেশি দুঃসাহস দেখিও না, কপালে অশেষ দুর্গতি আছে। আয়েন্দে-ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন লেফট উইঙ্গার লিওনার্দো ভেলিজ আর ফরোয়ার্ড কার্লোস ক্যাসেলি, নজরবন্দির মাত্রাটা স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের উপরই থাকল বেশি। লিওনার্দো ভেলিজ জানিয়েছিলেন, দেশের পরিস্থিতি কেমন, সে-খবর জানতে মস্কোতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল চিলির এক কমিউনিস্ট বিপ্লবীর যুবক-পুত্র। সে তখন প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। ভেলিজ তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, এই মুহূর্তে চিলিতে ফেরার কথা ভুলে যাও। সামান্য লাল-যোগও বড়ো বিপদ ডেকে আনবে।

    এখন, চিলির সঙ্গে সোভিয়েতের এমন বে-আক্কেলে ইন্টার-কনফেডারেশন প্লে-অফটাও একরকম গাণিতিক সমাপতন। আগের বারের (১৯৭০) চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ব্রাজিল এবং আয়োজক হিসেবে পশ্চিম জার্মানি, দুই দেশই ছিল, যাকে বলে ‘অটোমেটিক চয়েস’। ব্রাজিল যে কনফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত, সেই কনমেবলের হাতে ছিল সাড়ে তিনখানা স্লট— ব্রাজিল আগেই যোগ্যতা অর্জন করে ফেলায় ন’টি দলের লড়াই ছিল বাকি আড়াই স্লটের জন্য। অন্যদিকে, পশ্চিম জার্মানি যে কনফেডারেশনের সদস্য, সেই উয়েফার হাতে সাড়ে নয়খানা স্লট— সেখানেও, পশ্চিম জার্মানি ব্যতিরেকে লড়াই বাকি সাড়ে আট স্লটের জন্য।

    কনমেবলের ন’টি দলকে ভাগ করা হয়েছিল তিনটি গ্রুপে। নিয়ম অনুযায়ী, গ্রুপ ১ ও ২-এর বিজয়ীরা সরাসরি বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারবে, গ্রুপ ৩-এর বিজয়ীকে খেলতে হবে উয়েফার গ্রুপ ৯-এর বিজয়ীর সঙ্গে। গ্রুপ ৩-এ চিলির সঙ্গে ছিল পেরু আর ভেনেজুয়েলা। ভেনেজুয়েলা শেষ পর্যন্ত নাম প্রত্যাহার করে নেয়। পেরু আর চিলির মধ্যে দুলেগ মিলিয়ে ২-২ স্কোর দাঁড়ালে উরুগুয়ের মন্টিভিডিওতে দুই দলের প্লে-অফে চিলি পেরুকে ২-১ ফলাফলে হারায়। উয়েফার বাছাই পর্বে ছিল বত্রিশটি দল। আজব দলবিন্যাসের জেরে তিনটি দলকে নিয়ে গ্রুপ হয়েছিল চারটি, ওদিকে বাকি কুড়িটি দল ভাগ হয়েছিল পাঁচটি গ্রুপে। গ্রুপ ১ থেকে ৮-এর বিজয়ীরা সরাসরি বিশ্বকাপের গ্রুপে জায়গা পাবে। স্কটল্যান্ড-বুলগেরিয়ার মতো খানিক কমজোরি দলও যেখানে দিব্যি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে টুর্নামেন্টের টিকিট পেয়ে গেল, সেখানে প্লে-অফের চক্করে পড়তে হল ইউরোপীয় ফুটবলের অন্যতম শক্তি সোভিয়েতকে। গ্রুপ ৯-এ অন্য দুই দল ছিল ফ্রান্স আর রিপাবলিক অফ আয়ারল্যান্ড। প্যারিসে ফ্রান্সের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে হারলেও বাকি তিনখানা ম্যাচেই জয় পেয়েছিল সোভিয়েত।

    ইউরোপীয় ফুটবলে লেনিনের দেশ তখনও ঈর্ষা করার মতো শক্তি। যদিও, পাঁচ-ছয়ের দশকের সে-সোনালি সময় তারা ফেলে এসেছে, ১৯৫৬-র অলিম্পিক সোনা আর ১৯৬০-এর ইউরো কাপের পর আর কোনও বড় পুরস্কার তাদের ঝুলিতে আসেনি, ফুটবল আইকন লেভ ইয়াসিনও অবসর নিয়েছেন বছর কয়েক আগে, কিন্তু ভাল খেলার ধারাবাহিকতা তাদের নষ্ট হয়নি। আগের বছরেই ইউরো কাপের ফাইনাল খেলেছে তারা। দলে আছেন গত ইউরোর ‘টিম অফ দ্য টুর্নামেন্টে’ জায়গা পাওয়া গোলকিপার ইয়েভেন রুদাকভ ও রাইট-ব্যাক রেভাজ জজুয়াসভিলি। দলের অধিনায়ক সিএসকেএ মস্কো ক্লাবের অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার ভ্লাদিমির কাপ্লিচনি। ফরোয়ার্ড লাইনের দুই ভরসা, জোরিয়া লুহান্সক ক্লাবের ভ্লাদিমির ওনিশেঙ্কো এবং ডায়নামো কিয়েভ ক্লাবের তরুণ ইউক্রেনিয়ান তারকা ওলেগ ব্লখিন, যিনি ১৯৭৫ সালে জিতবেন ব্যালঁ দ’ওর।

    ফুটবলীয় দক্ষতার দিক থেকে চিলিও অবশ্য খুব পিছিয়ে ছিল না। ফরোয়ার্ড লাইনে ভেলিজ আর ক্যাসেলি ছাড়া ছিলেন সের্জিও আহুমাদা— তিনজনেই তখন খেলেন সান্তিয়াগোর বিখ্যাত কোলো-কোলো ক্লাবে। মাত্র আড়াই মাস আগেই মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট কোপা লিবের্তেদরেসের ফাইনাল খেলেছে ক্লাব, সে-ফাইনালে দলকে অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন স্বয়ং সালভাদর আয়েন্দে। কোলো-কোলোর ম্যানেজার লুইস অ্যালামস তখন জাতীয় দলেরও কোচ, ফলে খেলোয়াড়দের সঙ্গে বোঝাপড়াও ভাল। সেন্ট্রাল ডিফেন্স সামলানোর জন্য ছিল এলিয়াস ফিগুয়েরোয়া-আলবের্তো কুইনতিনো জুটি। ফিগুয়েরোয়া তখন ব্রাজিলের ইন্তারনাশিওনাল ক্লাবে খেলছেন, তার আগে খেলতেন উরুগুয়ের বিখ্যাত পেনারল ক্লাবে, যে-ক্লাব ছেড়ে আসার দিন কেঁদেছিলেন ভক্তরা। গোলের নীচে দাঁড়াবেন হুয়ান অলিভারেস, যিনি ১৯৬৬ বিশ্বকাপে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন।

    মস্কোর সেন্ট্রাল লেনিন স্টেডিয়ামে (এখন যার নাম বদলে করা হয়েছে লুঝনিকি স্টেডিয়াম) ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথম লেগের ম্যাচ। ঝামেলা এড়াতে সোভিয়েত প্রশাসন স্টেডিয়ামে সংবাদমাধ্যমের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। গ্যালারিজুড়ে পঁচাত্তর হাজার সোভিয়েত সমর্থক। ঘরে-বাইরে কোণঠাসা চিলি দলের বিরুদ্ধে লালবাহিনীর জয় একপ্রকার নিশ্চিত। কিন্তু, ঘটল অন্য কিছু। গোটা ম্যাচজুড়ে ওলেগ ব্লখিনকে প্রায় পকেটে পুরে ফেললেন এলিয়াস ফিগুয়েরোয়া, কুইনতিনোকে সঙ্গে নিয়ে সোভিয়েত ফরোয়ার্ড লাইনের ক্রসগুলো আটকে দিলেন হেলায়। আহুমাদা একটা গোলমুখী শট নিলেন, সেটা পোস্টে লেগে ফিরল। সব হিসাব গুলিয়ে দিয়ে, ম্যাচের ফলাফল দাঁড়াল ০-০। দ্বিতীয় লেগে স্বাভাবিকভাবেই ‘অ্যাডভান্টেজ চিলি’।

    ফিরতি লেগ মাসদুয়েক বাদে, ২১ নভেম্বর। খেলা হবে সান্তিয়াগোর এস্তাদিও নাশিওনাল বা ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে। ওই মাসেই আয়েন্দের স্মরণে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে সোভিয়েত। এদিকে, সেনা-অভ্যুত্থানের পর পরই সান্তিয়াগোর স্টেডিয়ামগুলো হয়ে উঠেছে পিনোচে সরকারের পেশি-প্রদর্শন কেন্দ্র। চিলি স্টেডিয়ামে আটক হয়েছিলেন চোদ্দ হাজার বন্দি, গ্রেপ্তারের পর পরই সেখানে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল প্রখ্যাত বামপন্থী কবি, নাট্যকার ও সংগীতশিল্পী ভিক্টর হারাকে। ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে বন্দির সংখ্যা ছুঁয়েছে তিরিশ হাজার। মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অজানা কোথাও নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের, তারপর আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না তাঁদের।

    সেনার দখলে ন্যাশনাল স্টেডিয়াম

    দ্বিতীয় লেগের সময়ে ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে বন্দি রয়েছেন সাত হাজার মানুষ। অমন এক বধ্যভূমিতে খেলতে আপত্তি জানাল সোভিয়েত ফুটবল ফেডারেশন। ফিফার কাছে তারা প্রস্তাব রাখল, চিলি নয়, অন্য কোনও নিরপেক্ষ দেশে খেলা হোক দ্বিতীয় লেগ। ফিফার সভাপতি পদে তখন ব্রিটেনের স্যার স্ট্যানলি রাউস, যিনি বর্ণবৈষম্যে অভিযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকাকে ফিফায় ফিরিয়ে এনে ইতিমধ্যেই আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশের কাছেই অপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এহেন প্রশাসক মানবতা বা নৈতিকতার মতো কোনও ‘কুযুক্তি’র বিশেষ ধার ধারবেন, এমনটা আশাও ছিল না। নেহাত নিয়মরক্ষার তাগিদে এক প্রতিনিধিদলকে পাঠাতে চাইলেন চিলির অবস্থা খতিয়ে দেখতে। সোভিয়েতপন্থী পূর্ব জার্মানির ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হেলমুট রিডল আর হাঙ্গেরির স্যান্ডর বার্কস যেতে রাজি হলেন না, পরিবর্তে পাঠানো হল ফিফার জেনারেল-সেক্রেটারি হেলমুট ক্যাসার আর ব্রাজিলের আবিলিও দে আলমিদাকে। তাঁরা নাম-কা-ওয়াস্তে খানিক স্টেডিয়াম ঘুরলেন, মাঠ দেখলেন, বন্দিদেরও একটু-আধটু দেখলেন, এবং রিপোর্টে জানিয়ে দিলেন— অবস্থা একদম স্বাভাবিক, ম্যাচ না হওয়ার কিছু নেই।

    ফিফার এরকম আচরণে সোভিয়েত কর্তাব্যক্তিরা রেগে আগুন। ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে খেলার তো প্রশ্নই নেই, চিলির অন্য শহরে ম্যাচ আয়োজন করার আবছা প্রস্তাবও পত্রপাঠ খারিজ করে দিলেন তাঁরা। তাঁদের স্পষ্ট কথা—  চিলিতে ম্যাচ খেলতে যাওয়া অসম্ভব। প্রত্যুত্তরে ফিফার হুমকি, ম্যাচ না খেললে চিলিকে ওয়াকওভার দেওয়া হবে। সঙ্গে জরিমানা তো আছেই! বিশ্বমঞ্চ থেকে ছিটকে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে স্তালিনের দেশ সেদিন ঘোষণা করেছিল— যে-স্টেডিয়ামে চিলির গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের রক্ত ঝরেছে, সেখানে আমাদের খেলোয়াড়রা খেলতে যেতে পারেন না।

    শেষ পর্যন্ত, রুদাকভ-ব্লখিনদের পা পড়েনি চিলির রক্তাক্ত স্টেডিয়ামে। ২১ নভেম্বরের ওই ম্যাচে হাতে-গোনা দর্শকদের সামনে সেদিন খেলতে নেমেছিল একটিই দল— অদ্ভুতভাবে, সে-দলেরও জার্সির রঙ ছিল লাল। কিক-অফের পর ১৭ সেকেন্ড নিজেদের মধ্যে বল দেওয়া-নেওয়া, তারপর ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস্কো ভালদেসের ফাঁকা গোলে গোল। ৩০ সেকেন্ডের মাথায় বাজল রেফারির বাঁশি। ফলাফল চিলির পক্ষে ২-০।

    বিশ্বকাপে চিলির গ্রুপে পড়েছিল দুই জার্মানি আর অস্ট্রেলিয়া। পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে ০-১ হার আর বাকি দুই ম্যাচে ড্র-এর ফলে গ্রুপ পর্বের বেশি এগোতে পারেনি চিলি। ওদিকে, বাকি দশকজুড়ে, কী ইউরো, কী বিশ্বকাপ, যোগ্যতা অর্জন করতেই নাকানিচোবানি খেল সোভিয়েত ফুটবল। ’৭৬ ইউরো, ’৭৮ বিশ্বকাপ বা ’৮০ ইউরো, সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের কোনও দলকে আর দেখা যাচ্ছে না। আরও এগারো বছর পর যে আর কোনওখানেই অস্তিত্ব থাকবে না তার, সে-কথা অবশ্য বোঝা যায়নি তখন।

    এখন, যে-মানবতার রাজনীতিকে রক্ষা করতে সোভিয়েত ওই ম্যাচে খেলতে যেতে অস্বীকার করল, তার চেয়ে অন্যরকম কিছু ভেবে তারা যদি ওই ম্যাচ খেলত, এবং শেষপর্যন্ত জিতে যেত— প্রথম লেগের হতাশাজনক ড্র-এর পরেও যা কিনা যথেষ্ট সম্ভব ছিল – সেক্ষেত্রে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবারও এক ‘ফ্যাসিবাদের মাটিতে সাম্যবাদের জয়’-এর নাটকীয় ভাষ্য তৈরি হতে পারত। মোক্ষম প্রতিশোধ নেওয়া যেত পিনোচে-শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে। ধারালো বার্তা পাঠানো যেত নেপথ্য প্রতিপক্ষের শ্বেতভবনেও। চলমান ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তপ্ত আবহে সে-ঘটনারও কূটনৈতিক তাৎপর্য হত সুতীব্র।

    এক কথায়, ফুটবলকে ব্যবহার করে পরাশক্তি হিসেবে আরও একবার নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ অবশ্যই সোভিয়েতের সামনে ছিল। সংখ্যাগুরুর তৃতীয় বিশ্বে তখন আমেরিকার ভাবমূর্তির যা হাল, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সোভিয়েত সফল হলে নিশ্চিতভাবে নৈতিক সমর্থন তাদের দিকেই থাকত।

    তারপরেও, বিশ্বকাপ খেলার মোহ দূরে রেখে সোভিয়েত দলের এই না-যাওয়া, ফিফার বদান্যতায় চিলির সুবর্ণ ওয়াকওভার, কোনওদিক থেকেই ফ্যাসিবাদের জয় ঘোষণা করেনি। অগাস্তো পিনোচে বা ফিফা-প্রচারযন্ত্রের ‘সবকিছু স্বাভাবিক’ প্রমাণের অসাধু চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল, ইতিহাস শেষপর্যন্ত তাদের পক্ষে থাকেনি।

    লিওনার্দো ভেলিজ পরবর্তীকালে বলেছিলেন, ‘স্বৈরাচারী মিলিটারি জুন্টা আমাদের কেবল ব্যবহার করেছিল। নিজেকে সেদিন কলের পুতুল মনে হচ্ছিল।’

    ম্যাচটা না খেলে সোভিয়েত প্রমাণ করেছিল, কিছু লড়াই মাঠে না নেমেও জেতা যায়।

    ছবি সৌজন্যে : লেখক

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook