ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৪৯


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (November 11, 2024)
     

    ঝিনি বা সুগন্ধা

    ক্রমাগত হোঁচট খেতে-খেতে, অবশেষে ঝিনি এসে থামল গুরুজির দোরগোড়ায়। চল্লিশ-পার-করা ঝিনি তখনও খুঁজে চলেছে; কী খুঁজতে পারে সে! কেনই-বা এই খোঁজ! ঝিনি জানে না। সে শুধু জানে, মন ভরেনি; মন ভরেনি তার; অটুটযৌবন ঝিনি— এখনও সে ঋতুমতী; দুর্জয় রাগ তার সমস্ত শরীরে; যদিও সমস্ত সংগ্রহ হারাতে-হারাতে দু’মুঠোয় এখন শুধু, তার নিজেরই দশটা আঙুল; কখনও যা থাবার মতো হিংস্র, কখনও-বা প্রশ্নচিহ্নে উদ্ধত— কেন? কেন? কেন? এক নির্লজ্জ উদাসীনতায় নিজেকে আপাদমস্তক মুড়ে রাখা ঝিনি। জীবনের কাছে কিছুই প্রাপ্য নয় তার। সে শুধু ভাবে যে, এ-জীবন প্রাপ্তি হয়ে আসুক; নিভৃতে বিনিময় করুক শান্তি আর মুগ্ধতা। কিন্তু কীভাবে যে সম্ভব, সেটাই তো জানে না ঝিনি। প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদে কোনও আক্ষেপ নেই; পাগলা গারদে দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুতেও সন্তাপ জাগেনি তার মনে; একে-একে পেরিয়েছে রূপমুগ্ধ পুরুষের স্রোত; অসংখ্য ক্ষততেও দহনের চিহ্ন জেগে নেই। না সে ফিরে পেতে চায় তার সেই কৈশোর, না চায় আবার কোনও সংসার। ঝিনি তবে ঠিক কী চায়! কাকে চায়! কেন তার এত ছিটকে যাওয়া! অথচ সে পালাতে চায়নি কখনও।

    কথাকলি নাচ মেয়েরা তো শেখে না। কিন্তু ঝিনি তো চায় শুধু ওই নাচটাই শিখতে; কারণ সে পৌঁছে যেতে চায় সেই একজন গুরুজির কাছেই, অন্তত কলকাতায় যিনি এই নাচের একমাত্র গুরু। ছোটবেলায় ওঁর যে নাচ ঝিনি দেখেছিল, সেটা ঠিক কস্ট্যুম-পরা কথাকলি নয়। নিজের কম্পোজিশনে উনি নেচেছিলেন। কথাকলি আঙ্গিকে ‘দেবদত্ত’, ‘সিদ্ধার্থ’ এবং সেই হাঁসটা— এই  তিনটে রোলই একসঙ্গে করে। মা বলেছিলেন যে, তাকেই নাকি বলে একক অভিনয়। ধপধপে গায়ের রঙে, বাসন্তী-হলুদ ধুতি পরা সেই মানুষটি যেন আলো হয়ে জেগেছিলেন ঝিনির মনে। অনেক বছর পরে, ঝিনি তাঁকে আবার দেখতে পেল, তার নাচের ফাইনাল পরীক্ষার দিন। পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করে ফাইনাল পরীক্ষার দিন, তিনিই মূল পরীক্ষক; পরীক্ষা শেষ হলে, নিজের ফোন নম্বর দিয়ে, আলাদা করে ঝিনিকে ডেকে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু, ঝিনি যে শুধু সেই ফোন নম্বরটিই হারিয়ে ফেলেছিল তাই নয়, সে তো হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকেও। ক্রমাগত বাড়ি বদল হওয়া মানেই চিহ্ন বদল হওয়াও। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু দরকারি জিনিস। ঝিনিও তাই ভেবেছিল যে, গুরুজির নম্বর লেখা ডায়েরিটাও নিশ্চয়ই হারিয়েই গেছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেটি যে শুধু পাওয়া গেল তাই নয়, প্রায় পনেরো বছর পরে ওই নম্বরটা ঘোরাতেই ঝিনি শুনতে পেল গুরুজিরই স্বর। আশ্বস্ত হয়ে ঝিনি ভাবল যে, যাক এত কিছু  বদলে গিয়ে এমনকী চুকেবুকে সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও, গুরুজি আজও ওই একই নম্বরে।

    ঝিনি জানে যে, গুরুজির তাকে মনে নেই; কিন্তু টেলিফোনে কথা বলবার পর, এটাই ঝিনির মনে হল যে, গুরুজিও যেন আগ্রহী তার সঙ্গে দেখা করার জন্য; তা না হলে কি আর দিন এবং সময় নির্দেশ করে আসতে বলতেন তাকে! ওঁদের ডান্স সেন্টারের কাছাকাছিই আরও যে একটা একতলা ফ্ল্যাট, সেখানেই গুরুজি স্পেশাল ক্লাস নেন প্রতিদিন সকালে; ছোট্ট একফালি বারান্দা পেরিয়ে তিনটে বড়-বড় ঘর; তিন ঘরে তিনটে দেওয়ালজোড়া আয়না ছাড়া আর কোনওই আসবাব নেই; নেই দেওয়ালে টাঙানো কোনও ফোটো বা দেবদেবীর ছবিও। ধূপ-ধুনো-নটরাজের মূর্তি বা ঘুঙুর ছাড়াই একটা নাচ শেখানোর স্পেস। পাশে একটা সাইড-টেবিলে নিজের ঝোলাখানি রেখে, একটা হাঁটুর ওপর অন্য হাঁটুটা তুলে তিনি বসে আছেন, একেবারে এক সাধারণ মানুষের মতো; হালকা দোহারা চেহারা; চোখদুটো ভরে আছে স্নেহ এবং বুদ্ধির প্রাখর্যে; অনেককাল বাদে, কাউকে দেখে প্রণাম করতে ইচ্ছে হল ঝিনির। দু’একটা কথার পরেই বললেন, ‘দেখি, নাচ দেখি তোমার!’ ঝিনিকে উনি আগেই বলে নিয়েছিলেন যে, তার নাচ এবং দেহ এখনও নাচের উপযোগী কি না— এ দেখে তবেই শেখাবেন। সার্টিফিকেট কোর্সে ফার্স্ট ক্লাস পেলেও সেসব কিছুই তার মনে পড়ল না; বিষ্ণু দে-র একটা ছোট কবিতার সঙ্গে তার নিজেরই একটা কম্পোজিশন ঝিনি নেচে দেখাল; তিন মিনিটও লাগল না; গুরুজি বললেন, ‘বসো।’ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কতদিনের মধ্যে স্টেজ চাও?’

    ‘শুধু আপনার কাছেই শিখতে চাই; আপনার হাত ধরে নাচের সঙ্গে সময় কাটাতে চাই।’

    ‘মূল্য কিন্তু অনেক! আমার পারিশ্রমিক এবং তোমার অধ্যাবসায়।’

    ‘আমি প্রস্তুত! চাকরি করি তো, নিজের আয় আছে; তাই পারব বুঝেই এসেছি।’

    ‘চাকরিও তো চাপ! সেই চাপ সামলে, রেওয়াজের সময় পাবে?’

    ঝিনিকে মাথা নীচু করে থাকতে দেখে, নিজেই বলতে লাগলেন, ‘প্রাইভেট ক্লাসে, তিনজনের বেশি শেখাই না; ফলে কাউকে-না-কাউকে বাদ করেই তোমাকে নেব; কারণ নাচ তোমার দেহে জড়িয়ে আছে, ন্যাচারাল… পরিশ্রমটা হয়তো আনন্দেরই মনে হবে; তার ওপর তুমি তো এসেছও একটু পরিণত বয়সেই; ফলে নাচ যে তুমি ভালবাসো, সে-বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু আমার শুধু ভয়, ওই মাঝপথে দম ফুরিয়ে যাওয়ার; ওই অসম্পূর্ণতা বড় বেশি কষ্ট দেয় আমাকে।’

    দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে, তাঁর নির্ধারিত পারিশ্রমিকটি গুরুজির পায়ের ওপর রেখে ঝিনি বলল, ‘আপনার ক্লাসে এসে অনুশীলন করবার এই সুযোগটুকু শুধু দয়া করে দিন; ফিরিয়ে দেবেন না আমাকে।’ ঝিনির মাথায় হাত ঠেকিয়ে গুরুজি বললেন, ‘একদিনে কিছুই শেখা হবে না; তুমি তাই সপ্তাহে দু’দিন করেই এসো; শরীরে সইলে, তখন নাহয় চার দিন করে দেব, ওই একই পারিশ্রমিকে।’ এই প্রথম ঝিনির মনে হল যে, সত্যিই যেন প্রাপ্তি হয়ে এল এ-জীবন ।


    এখনও ঝিনি জানে না যে, এই অমানুষিক পরিশ্রম করে কেন যে সে নাচ শিখতে এল! বিশেষত এমন এক গুরুর কাছে, যিনি জানেনই না যে অধ্যাবসায়ের বিকল্প আর কিছু আছে বলে; ঝিনি এটাও বুঝতে পারেনি যে, স্টেজে পারফর্ম করতে সে আগ্রহী নয় জেনেও গুরুজিই বা কেন তাকে নিয়ে ওই পরিমাণ দুরমুশ করে চলেন! ঝিনি শুধু এটাই জানে যে, গুরুজির এই ক্লাসটাই একমাত্র, যা তাকে পৌঁছে দেয় একটু-একটু করে এমন এক তেপান্তরের শেষে, যেখান দিয়ে বয়ে চলেছে মস্ত একটা নদী; আর নদীপাড়ের জঙ্গলটা ভরে থাকে অদ্ভুত এক সবুজ রঙের আলোয়। প্রতিটি ক্লাসের পর ওই নদীতে নেমেই ঝিনি স্নান সারে, উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে থাকে গাছের ছায়ায়; তারপরে ধীরে-ধীরে সে পথ হারায় ওই জঙ্গলের ভেতর। জঙ্গলের মধ্যে এই হারিয়ে যাওয়াটাকেই আঁকড়ে ধরে থাকে ঝিনি; আর দুঃখ পায় যখন সে দেখে যে, নিজের অজান্তেই কখন যেন আবার সে ফিরে এসেছে তার এই নিজের আস্তানায়। ঝিনির মনে হয় যে, তার এই আস্তানাটাই একটা মস্ত ছল; তার কাছে তাই আসল জীবন হল, পথ হারিয়ে ওই জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোটাই।

    গুরুজি বললেন যে, তিন রকম উদ্দেশ্য নিয়ে ছাত্ররা তাঁর কাছে আসে; যারা চায় ‘পরিবেশন’ মানে পারফরমেন্স, নাচের সঙ্গে-সঙ্গে তারা আবার আরও অনেক কিছুই শেখে; তাদের কাছে নাচ একটা আঙ্গিকমাত্র, যা তাদের ডিসপ্লেতে কাজে লাগে; এদের কাছে তাঁর নামটাও এক ডিসপ্লে-বোর্ড। আরও একদল ছাত্র আসে যারা শুধু তাঁর কাছেই শেখে; নাচ-সংক্রান্ত যাবতীয় যত খুঁটিনাটি; এদের লক্ষ্য শুধু তাঁকেই অনুসরণ করা; কিন্তু নিজেদের অজান্তেই সেই অনুসরণটাই কখন যে অনুকরণ হয়ে যায়, তা তারা বুঝতেও পারে না। এই গোত্রের ছাত্ররা ভাল টিচার হবে কিন্তু সাড়া-জাগানো পারফর্মার হতে পারবে না কোনওদিনই। এদের নাচ তাই আটকে থাকে নিবেদনে; যেটা আসলে এক ধরনের আলস্য; গুরু যতটা দেবেন, ব্লটিঙের মতোই তা শুষে নেবে, কিন্তু নতুন কোনও চ্যালেঞ্জ ফিরিয়ে দেবে না তাঁকে। আর হাতে গোনা সেই কয়েকজনকে পেয়েছেন, যাদের নাচ দেখে মনে হয়, সমর্পণ; কে গুরু, বা কী তার পরম্পরা, সেসব তো ভুলে গেছেই, এমনকী নাচের সময়ে তারা ভুলে যায় নিজেকেও; সমস্ত শিক্ষা ছাপিয়ে তাদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে এমন এক সত্তা, যেটা তার একেবারেই নিজস্ব; গুরু হয়েও মুগ্ধতা জাগে, তাদের নাচে সেই স্বকীয়তা দেখে! ঝিনি যে এতসব বুঝতে পারে, তা নয়; শুধু এটুকু ভেবেই সে ভয় পায়— তাকেও কি এভাবেই মেপে চলেছেন গুরুজি!

    ঝিনি ভাবতেও পারেনি যে ‘নাচ’ এই দুটো মাত্র শব্দে কেমন সব কিছু ধরা আছে। ধরা আছে ইচ্ছেমতো জীবন গড়ার ম্যাজিক। গুরুজি সেদিন শেখাচ্ছিলেন, রাজা নলের সাজানো বাগান দেখে, দময়ন্তীর মুগ্ধতা। সে যে কী মজা! শহুরে একটা ফ্ল্যাটের, একতলার ঘরে ঝিনি যেন ছুটে-ছুটে ছবি আঁকছে; ছোটবেলায় যেমন সে ছবি আঁকত কখনও মেঝেতে, কখনও দেওয়ালে, কখনও-বা বাবার বিছানায় রাখা তাকিয়ায়, কখনও আবার খালি গায়ে বসে থাকা বাবার লম্বা পিঠে। ঠিক সেইভাবে ঝিনি তার শরীরের ভঙ্গিমায়, অভিব্যক্তিতে, আঙুলের মুদ্রায়, পায়ের তালে, নিজেই হয়ে যাচ্ছে কত কিছু! জলের ঢেউ, আকাশে ওড়া মরাল, সরোবরের পানকৌড়ি, গাছ থেকে ঝুলে আসা সাপ, ঘাস-পাতা, বড় গাছ, ছোট গাছ, পাহাড়-পর্বত; ঠিক যেন সেই চাই-কী/নাই-কী’র দেশ; আবার থেকে-থেকেই বদলে গিয়ে একইসঙ্গে হয়ে উঠছে সেই মুগ্ধ দময়ন্তী! তবে ঝিনির এই ঘোর, একেবারে দুম করেই ভেঙে যায় গুরুজির বকুনিতে; তালের কারসাজি ধরতে না পেরে বা তীক্ষ্ণ মনোযোগেও সামান্য বেখেয়াল হলেই কুরুক্ষেত্র বাধাবেন গুরুজি; এরকম যে কতবার হয়েছে! মাত্রায়-মাত্রায় বেড়ে গিয়ে, দুই তাল যে কখন সাত মাত্রা এবং সেই সাত মাত্রা আবার কমতে-কমতে কখন যে পাঁচ হয়ে গেছে, ধরতেই পারেনি ঝিনি; গুরুজি ঠিক বোঝেন যে, কোনটা ঝিনি তখনও বুঝতে পারেনি, আর কোনখানে মনোযোগের অভাব হল তার! গুরুজির চিৎকার শুনে ঝিনির মনে পড়ে, ‘careless’ বলে বাবার সেই ধমক। এক-একদিন তো পুরো ক্লাসটাই চলে যায়, থুতনি আর গলার মাঝখানে হাফ ইঞ্চি ফাঁক রাখার দরাদরিতে। ঝিনি বুঝতে পারে যে, স্বর্গ-মর্ত্য এবং পাতালকে কেন একসঙ্গে যুক্ত করে দেখে এই নাচ! রাগে কাঁপতে-কাঁপতে গুরুজি বলতে থাকেন, আমাকেই দ্যাখো, শুধু আমাকে।’ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেও, ঝিনি তাকিয়ে থাকে তাঁরই দিকে এক গভীর আস্থায়।

    শহুরে একটা ফ্ল্যাটের, একতলার ঘরে ঝিনি যেন ছুটে-ছুটে ছবি আঁকছে; ছোটবেলায় যেমন সে ছবি আঁকত কখনও মেঝেতে, কখনও দেওয়ালে, কখনও-বা বাবার বিছানায় রাখা তাকিয়ায়, কখনও আবার খালি গায়ে বসে থাকা বাবার লম্বা পিঠে। ঠিক সেইভাবে ঝিনি তার শরীরের ভঙ্গিমায়, অভিব্যক্তিতে, আঙুলের মুদ্রায়, পায়ের তালে, নিজেই হয়ে যাচ্ছে কত কিছু!


    খুব অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ হয়েছিল এক পাঞ্জাবী সাধুবাবার সঙ্গে। শিষ্যরা তাঁকে গুরুজি বলত। ঝিনিকে ডেকে একদিন তিনি জানতে চাইলেন, ‘তুমি কেন আমাকে গুরুজি বলো না!’

    ‘মহারাজজি বলতেই ভাল লাগে, তাই।’

    ‘কবে দীক্ষা নেবে?’

    ‘দীক্ষা নিলে কী হয় মহারাজজি!’

    ‘মঞ্জিল এবং মন্দির দুই-ই লাভ হবে; শান্তি পাবে।’

    ‘আমার প্রথম গুরু আমার বাবা; তারপরে অনেক কষ্টে পৌঁছতে পেরেছি, আমার নৃত্যগুরুর কাছে; আমার তো আর কিছুই চাইবার নেই মহারাজজি!’

    সেদিন আর কথা বাড়াননি মহারাজজি। তবে, কুম্ভমেলা দেখার আকর্ষণে ঝিনি যখন রাজি হয়ে গেল, তাঁর আখড়ায় গিয়ে দিন দশেক থাকবার প্রস্তাবে, খুব খুশি হয়েই তিনি বললেন, ওখানে গিয়ে সাধুদের সামনে নাচবে তো! ঝিনির মনে হল, ওই নাচই তাকে সুরক্ষা দিল। নাহলে, তিনি হয়তো অন্য কিছু বলতেন! গুরুজির কাছে অনুশীলন করতে-করতে সে বুঝেছে যে, এই দেহ হল, একটা অসম্পূর্ণ puzzle; খাপে-খাপে এঁটে দেবার পরেও যা লাগে, তা হল সুষমা; আর লাগে শক্তি। মহারাজজি বুদ্ধিমান মানুষ; সেইজন্যেই নাচের উঠোনে এসেই নিজের রাশ টেনে রাখলেন; ঝিনির মতো কেউ কি আর কুম্ভে গিয়ে নেচেছে! কুম্ভমেলার কোনও আখড়ায় কি আর অদীক্ষিত কোনও মেয়ের নাচের সঙ্গতে মাইকে বেজেছে, ‘চির সখা হে ছেড়ো না, মোরে ছেড়ো না’?

    নাচের অনুষ্ঠান হয়ে যাবার পর, সে-রাতের আরতি শেষ করে মহারাজজি একা বসেছিলেন, তাঁর তাবুর সামনে খোলা আকাশের নীচে; দূর থেকে ভেসে আসছে শিপ্রা নদীর বাতাস; দামাল জ্যোৎস্নায় ভরে আছে আকাশের নীচে বিছিয়ে থাকা মেলার বসতি; অত রাতেও চাঁদের আলোয় পথ খুঁজে উড়ে বেড়াচ্ছে দু’একটা সাদাডানা টিট্টিভ, যেগুলো বক বা পানকৌড়ি নয়; ঝিনির ইচ্ছে হচ্ছে বিরাট একটা ক্যানভাসে, রাতের এই মোহময় রূপটা এঁকে রাখতে। মহারাজজি ডেকে পাঠালেন ঝিনিকে। একটা নীচু টুল টেনে নিয়ে, ঝিনি তাঁর সামনে গিয়ে বসতেই তিনি বললেন, ‘তাল— এই শব্দের অর্থ জানো?’ একটু ভেবে নিয়ে, তাঁর দিকে তাকিয়ে ঝিনি বলল, ‘তা-তা-থেই; মানে স্বর্গ-মর্ত্য এবং পাতাল।’

    ‘সে তো নির্দেশ; নাচের বিস্তার; কিন্তু অর্থ বোঝা গেল কি?’

    ‘আপনিই বলুন, আমি শিখে নিই।’

    ‘তাণ্ডবের ‘তা’ আর লাস্যের ‘ল’, এই মিলে হল তাল— ভারসাম্য।’

    ‘এ-জীবনে ভুলব না আপনার শেখানো এই তাল-রহস্য; ভারসাম্য।’

    ‘ঠিক তাই! কিন্তু এই ভারসাম্য আসে যে একটিমাত্র পথে, তা হল, পুরুষ ও প্রকৃতির মিলন; বাস্তবজীবনে এই মিলন না হলে, তোমার নাচেও তো তা প্রতিফলিত হবে না।’

    ‘এই জন্যই তো নাচ শিখছি, যাতে বাস্তবকে তৈরি করে নিতে পারি— নবরস, মুদ্রা, অভিনয় আর ভঙ্গিমার মধ্যে দিয়ে; বাস্তব সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেগুলি মুগ্ধতা, আসক্তি, সংঘর্ষ, আঘাত, বেদনা বা অপমান সেগুলোই তো এই অনুশীলনের ক্ষেত্রে অধ্যাবসায়- ক্লান্তি- অবসাদ এবং ব্যর্থতা; একইসঙ্গে আক্ষেপও যে, এই এত অনুশীলনেই কিছুই কিন্তু হল না।’

    ‘শরীরে-শরীর ছুঁইয়ে যে আলিঙ্গন এবং মিলন, সেটাই আসল মুক্তি; তার থেকে বেশি আনন্দ আর কিছুতেই নেই; সেটাই সমস্ত সৃষ্টির উৎস; সন্তানের থেকে বড় সৃষ্টি আর কিছুই নয়।’  

    ‘এসব তো আমি পার হয়ে এসেছি মহারাজজি! সুখের ঘাটতি হয়নি তেমন; কিন্তু আনন্দ! আসঙ্গরমণেও তো তা পাইনি, যা পেয়েছি এই নাচের মধ্যে দিয়ে।’

    ‘সেই যথার্থ পুরুষটি হয়তো আসেইনি তোমার জীবনে! বা এলেও উপেক্ষা করছ তুমি!’

    ‘মহারাজজি, সবিনয়ে এটুকুই বলতে চাই আপনাকে যে, সব শরীরও কিন্তু এক নয় যে, যার-তার উৎসুক আলিঙ্গনে ধরা দেবে; নাচ যেমন প্রকারভেদে ধ্রুপদী, শরীর এবং মনও ঠিক ওইরকমই ধ্রুপদী। প্রবল তৃষ্ণাতেও তারা তাই পান করতে পারে না নর্দমার জল।’

    এতখানি ঔদ্ধত্য উনি আগে কখনও দেখেছেন কি? বিশেষত কোনও মেয়ের ব্যবহারে! এবং একইসঙ্গে এই প্রত্যাখ্যান! তাঁর আকর্ষণীয় পৌরুষ, বাগ্মিতা, শিষ্যদের আনুগত্যের জাহির— সব কিছুকে তুচ্ছ করে উঠে দাঁড়াল ঝিনি। সে আসলে তুচ্ছ করতে পারল, তাবৎ পুরুষদের মধ্যে দিয়ে তার জীবনে আসা সেইসব প্রেমের প্রতি তার নিজের কাতরতাও; তার মনে পড়ল, নটী তরঙ্গিনীকে দেখে ঋষিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গ কেমন বলেছিলেন, ‘আনন্দ তোমার নয়নে, আনন্দ তোমার চরণে’; আর প্রেমের সেই উদ্ভাসটুকু বুঝেই, নিজের সেই ছলাকলাময় নটীজীবন ভুলে, হাঁটতে-হাঁটতে, কোথায় যেন চলে গিয়েছিল তরঙ্গিনী! ঝিনির মনে পড়ল, গুরুজি কত অনায়াসে বলেন, ‘আমাকেই দ্যাখো, শুধু আমাকে!’   


    এক প্রবল মাস্তানি শরীরে নিয়ে ফিরে এল ঝিনি; এবং আবার সে এসে দাঁড়াল, গুরুজীর ক্লাসে।

    আমি ঝিনি বা সুগন্ধা আমি এমন একজন মেয়ে, যাকে দেখে অনেকেই আকর্ষণ বোধ করে; কিন্তু বলবার মতো তেমন কিছুই হয়ে উঠিনি আমি মন দিয়ে একটা চাকরি করা ছাড়া আর কীই-বা করলাম! আর কিছুটা ভয় পেলাম; কিছুটা হোঁচট; আর কয়েকবার হড়কা বানে ভেসে গিয়ে মরতেমরতেও আবার বেঁচে উঠলাম মাঝেমাঝে ভাবি যে, ঠিক কাউকেই কি আঁকড়ে ধরেছি আসক্তিতে! কোনও মানুষকে দেখেই কি মনে হয়েছে যে, একে আমার চাইই চাই! কেবল মনে পড়ে, মুনেশ্বরের কথা; অফিসে তার কাজ ছিল চাজল আর খাবার এনে দেওয়া; অবসরের দিন সে বলেছিল, ‘অল্পেও যেমন চলে, তেমন একইরকম চলে অনেকে বেশিতেও; আবার একেবারে কিছু না হলেও আমার চলে যায়যাবার সময়ে তাকে বলে যাওয়া মুনেশ্বরের এই কথাটা নিয়ে অনেক ভেবেছে ঝিনি; বিশেষতচলেকথাটা; এই শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অমোঘ গতি একইসঙ্গে যা চল এবং অচল; আর ঠিক এইখানেই থেমে আছে ঝিনি তার চলাচল যেন বন্ধ হয়ে আছে; থমকে আছে এক বদ্ধ জলায়

    নটরাজের সক্ষমতার বর্ণনা করেছিলেন গুরুজি; নন্দীর তালবাদ্যের সঙ্গতে নাচতে-নাচতে, তাঁর পা থেকে ঘুঙুরজোড়া খুলে গেলে, নিজের বাঁপায়ের ভরে দেহ রেখে, ডান পায়ের পাতাটি তুলে, ওই ঘুঙুরটিই আবার অনায়াসে পরেও নিলেন পায়ে; ফলে নন্দীরও তালভঙ্গ হল না; চেয়ারে বসেই ডান পা’টি তুলে চমৎকার দেখিয়েছিলেন এর পরেই অবশ্য বলেছিলেন যে, ওই সক্ষমতা ক্বচিৎ দেখা যায়; হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেই তা থাকে সেজন্যই চূড়া, কোমর এবং পায়ের গোছে সবসময়ে শক্ত বাঁধন দিতে হয় বলেছিলেন যে শরীরের ভারসাম্য কিন্তু সুষমায় থাকে না; থাকে ধারণেশক্ত বাঁধন শক্তিকেই ধরে থাকে

    আমার রূপ, সৌন্দর্য, আকর্ষণ— এসবের মধ্যে যেটার অভাব ছিল, সেটাই যুক্ত করে দিলেন গুরুজি; তা হল মন মহারাজজির বলা সেইতালথেকে সূত্রটুকু নিয়ে ভারসাম্যে এল আমার দেহ এবং মন ফলে, আমি এই জীবন দিয়েই বুঝলাম যে, পৌরুষ হল আমার দেহ আর প্রকৃতি হল মন

    সব ক্লেদ ধুয়ে গিয়ে বনান্তের সবুজ যেন বলে উঠল— ‘আমাকেই দেখো এই নাও আলো!

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook