রাশিয়ার এক হাসপাতালের বেসমেন্টে বাস করা এক আদুরে বেড়ালের ওজন বাড়তে-বাড়তে ১৭ কেজি! মার্জার-রসিকদের চর্চা এই সংবাদকে পৌঁছে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মহিমায়। খবরের নাদুস-নুদুস নায়কের নাম ‘ক্রোশিক’। এই রাশিয়ান নামের অর্থ নাকি পাঁউরুটির গুঁড়ো। মূলত পাঁউরুটির গুঁড়ো ভক্ষণ করেই ‘ক্রোশিক’ এখন বিশ্বের সবচেয়ে দৈত্যাকার পাঁচ বেড়ালের একটি। তার ইংরেজি নাম হয়েছে ‘মনস্টার ক্যাট’। এই দানব মার্জারের একমাত্র গুণ, নিরবচ্ছিন্ন আলস্য। জাগ্রত অবস্থায় সে ক্রমাগত ভক্ষণ করে পাঁউরুটির গুঁড়ো। এবং সেই পরিশ্রমের ক্লান্তি ঘন-ঘন ডেকে আনে তার ঘোর নিদ্রা। দিন দশেক হল, ক্রোশিকের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। ফলে, তার ওজন নাকি কমছে, সম্পাদিত হয়েছে তার আলস্যের বহর, নিদ্রার বাড়াবাড়ি। মার্জারচর্চায় খ্যাতনামারা অনেকেই বলছেন, ক্রোশিককে দেখলে মনে পড়ে যায় বিখ্যাত মার্কিন কার্টুনিস্ট জিম ডেভিসের সৃজন, বিশ্ববিখ্যাত বেড়াল গারফিল্ডকে। তবে গারফিল্ড মোটেও অলস নয়। বরং মেদ, মেধা এবং মেজাজ— এই তিনের সমন্বয়ে গারফিল্ড অনবদ্য। এ-কথা ঠিক, সুকুমার রায়ের ম্যাজিক-রিয়েল বেড়ালের মতো ক্রোশিক বা গারফিল্ড, কেউই চোখের সামনে হঠাৎ রুমাল থেকে বেড়াল হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু টি এস এলিয়টের বিশ্ববিখ্যাত মার্জারগুচ্ছের মতো ক্রোশিক এবং গারফিল্ড বেশ ‘প্র্যাকটিকাল ক্যাট্স’। বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মাটিতে পা-ফেলা বিচক্ষণ বেড়াল!
কেউ-কেউ এতটাই বিচক্ষণ, এমনকী প্রজ্ঞাবান, কিংবা গূঢ় দার্শনিক— এলিয়ট তাদের অগাসটাস বা প্লেটো নামে ডাকতেও দ্বিধা করেন না। এবং কোনও-কোনও বেড়ালিনী এলিয়টের চোখে হয়ে ওঠে লন্ডনের ইলেকট্রা! গ্রিক পুরাণের ইলেকট্রা, রাজা আগামেমনন এবং রানি ক্লাইমেনেস্ট্রার কন্যা— লন্ডনের একটি বেড়ালকে পিতার প্রেমে পড়া ইলেকট্রা-রূপেও ভাবতে পারেন এলিয়ট। একটি বেড়ালের মধ্যে চকিতে অনুভব করেন বাপ-মেয়ের ইনসেস্ট বা অবৈধ সম্পর্ক! যা রুমালের বেড়াল হয়ে যাওয়ার চেয়েও ভয়ংকর। কিন্তু মার্জার সংসার ও সমাজে বাপে-মেয়েতে তো মিলন কিছু অস্বাভাবিকও নয়। সুতরাং বেড়ালের নাম ইলেকট্রা হতেই পারে সর্বার্থে সার্থক নাম! তবে বেড়ালকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দুম করে একটা নাম দিয়ে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়। অনেক ভেবেচিন্তে বেড়ালের নামকরণ করাই সমাজ-সংসারের পক্ষে মঙ্গলকর। এবং বেড়ালদেরও মানমর্যাদা তাতে রক্ষা হয়। ‘দ্য নেমিং অফ ক্যাটস’ কবিতায় এই সার কথাটি বেশ বুঝিয়ে বলেছেন এলিয়ট:
‘The Naming of Cats is a different matter,
It isn’t just one of your holiday games;
You may think at first I’m as mad as a hatter,
When I tell you a cat must have three different names.’
এই শেষ কথাটাই সার কথা। প্রতিটি বেড়ালের অন্তত তিনটে নাম থাকা উচিত। কিন্তু এই প্রসঙ্গে সবচেয়ে মননযোগ্য বার্তাটই হল প্রতিটি পুরুষ এবং মহিলা মার্জারকে তিনটি পৃথক নামের মর্যাদা দান করেছেন এই প্রবল ব্রিটিশ কবি গালে-জিভ-দেওয়া অবিমিশ্র ব্রিটিশ হিউমারে:
‘Some for the gentlemen, some for the dames,
All of them sensible everyday names.’
তবে বেড়ালের নামকরণের ব্যাপারে একটা কথা মনে রাখতেই হবে। তা হল, মার্জার-মর্যাদা। বেড়ালের মন ও মেজাজ বোঝা সম্ভব নয়। বেড়ালের যাপন ও জীবন, বোধ ও দর্শন— এসব তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ব্যাপার নয়। গভীর অভিনিবেশ, গূঢ় অনুধাবন অতীব প্রয়োজনীয় বেড়ালের চালচলন বুঝতে। এবং তবেই হবে বেড়ালের নামগুলি বেশ মানানসই। নামটি হওয়া চাই বিশেষ। আবার নামটি হওয়া চাই ‘পারটিকুলার’ এবং ‘পিকিউলিয়ার’। এবং একইসঙ্গে ‘ডিগনিফায়েড’, যাকে বলে অভিজাত। নামে যেন ফুটে ওঠে মর্যাদা। এই ধরনের নাম না হলে কী করে বেড়াল সমাজ-সংসারে লেজটি উঁচু করে চলবে? কিংবা গোঁফে তা দিয়ে ফুটিয়ে তুলবে তার অহং ও প্রতাপ? কিংবা অন্তরে পুষে রাখবে মার্জার-অহমিকা?
‘Else how can he keep up his tail perpendicular,
Or spread out his whiskers, or cherish his pride?’
এবার তাঁর অনন্য মার্জার কাব্যে বেড়ালের নামকরণের প্রগাঢ় সমস্যা প্রসঙ্গে শেষ কথাটি বলছেন এলিয়ট। বার্তাটা এই: কোনও মানুষের পক্ষেই কোনও বেড়ালকে তার চরিত্রানুসারে সঠিক নামটি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি বেড়ালের সঠিক নামের বীজটি রোপিত আছে প্রতিটি বেড়ালের নিজস্ব মগ্নতা ও ধ্যানের মধ্যে। যখন দেখবেন একটি বেড়াল ডুব দিয়েছে গভীর ধ্যানের মধ্যে, জানবেন তখন সেই বেড়াল তার মননের গভীরে রোপিত তার সঠিক নামের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে:
‘The reason I tell you, is always the same
His mind is engaged in rapt contemplation
Of the thought, of the thought, of the thought of his name:
His ineffable effable
Effanineffable
Deep and inscutable singular Name’
বেড়ালের এই গভীর এবং রহস্যময় ‘সিঙ্গুলার’ নামটি মানববোধ ও প্রজ্ঞার বাইরেই থেকে গেছে চিরকাল। মার্জার-মননের পাতাল-ছায়ায় আবৃত বেড়ালের সেই রহস্যঘন ‘সিঙ্গুলার’ নাম!
টি এস এলিয়টের একটি বেড়ালিনী আছে। বেশ কয়েক বছর তো হয়ে গেল সেই মহিলার সঙ্গে ঘর করা। কিন্তু কতটুকুই-বা জ্ঞানগম্যি হয়েছে কবির এই মহিলাটির মনপ্রাণ সম্বন্ধে? তবে মনে-মনে তাকে ভাবেন কবি। কবিতার শুরুতেই এলিয়ট বলছেন, I have a Gambie cat in mind. একটি আস্ত কবিতা লিখেছেন তাকে নিয়ে। কবিতার নাম দেখে বেড়ালিনীর খুশি হওয়ার কথা নয়। কবিতার নাম, ‘দ্য ওল্ড গাম্বি ক্যাট’। বুড়ি গাম্বি বেড়ালিনীর নামটি জব্বর: জেনিঅ্যানিডটস। বেড়ালিনীর সর্বাঙ্গে একইসঙ্গে বাঘের ডোরা, চিতার গোল-গোল ছাপ। সারাদিন বসে থাকে সে সিঁড়িতে। কিংবা পাপোশে। এবং এই যে সারাদিন সিঁড়িতে কিংবা পাপোশে, দ্যাটস ওয়াট মেক্স আ গাম্বি ক্যাট, বললেন এলিয়ট।
কিন্তু এটাই সব নয়। এটা হল মহিলার সকালবেলার চরিত্র। ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। ঘুমে আচ্ছন্ন এক অলস বুড়ি, সিড়িঁতে কিংবা পাপোশে। কিন্তু যেই-না মানুষের দাপাদাপি কমল আর রাত বাড়ল, অমনি মহিলাটি ধরল অন্য রূপ। যেন নবজন্ম হল তার। দিনের বেলায় মহিলার যে-রূপ ছিল লুকানো, সেই রূপ সেজেগুজে, নতুন একটা স্কার্ট পরে, এল বেরিয়ে। তার চোখে শিকারির সন্ধান।
‘And when all the family’s in bed and asleep,
She tucks up her skirts to the basement to creep.’
মহিলার চোখে ফুটে উঠেছে খোঁজ। কীসের খোঁজ? ইঁদুরের। সে অভিজ্ঞ মহিলা। সব জানে ইঁদুরের গতিবিধি। নিঃশব্দে সে নেমে যায় প্রতি রাতে বাড়ির পাতালঘরে। তারপর ঠিক খুঁজে বের করে ইঁদুরদের। ভারি অভদ্র ইঁদুরের দল। ব্যবহার একেবারে ভাল নয়। কিন্তু গাম্বি ক্যাট যেন ওদের সংগীত শিক্ষিকা। কিংবা শেখাচ্ছে ওদের কুরুশ বোনা। হাত দিয়ে সেলাই শিক্ষা। ওরা সবাই দাঁড়ায় একসঙ্গে। তারপর ওদের সব্বাইকে কী সুন্দর স্বাদু খাদ্যে পরিণত করে। সত্যি গুণি মহিলা গাম্বি বেড়াল।
‘She makes them a moral-cake of bread and dried peas,
And a beautiful fry of lean bacon and cheese.’
কে বলবে এই বুড়ি দিনের বেলা বসে আছে বসে আছে বসে আছে আর ঢুলছে!
সারাদিন অলস ঘুমে আচ্ছন্ন গাম্বি, রাত্তির হলেই নতুন জন্ম হয় তার। সে বেরিয়ে পড়ে বেয়াদপ, অসভ্য, কোনও নিয়ম-না-মানা ছোটলোক আরশোলাগুলোকে সায়েস্তা করতে। ওদের বাগে আনা কি সহজ ব্যাপার? মহিলা রাতের বেলায় নতুন শক্তি নিয়ে যেন জন্মায়। আর তৈরি করে আরশোলাদের ডিসিপ্লিন্ড বয়-স্কাউটস! তারপর ওদের একসঙ্গে চটকে বানায় ‘beatles tattoo’!
সত্যি বলব! ওল্ড গাম্বি ক্যাট্সদের থ্রি চিয়ার্স। এইরকম মহিলারাই সংসারের সব ভার বহন করে নির্ভরযোগ্য আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে। ‘Old Gumbie Cats on whom well-ordered household depend.’
পরের কবিতাটি, ‘দ্য রাম টাম টাগার’ চলনে-বলনে-তেজস্বীতায়, ঠমকে-দমকে-ঝংকারে এলিয়টের মার্জার মহাকাব্য, এমন বললেও অত্যুক্তি হবে না। বেড়াল নিয়ে এমন লেখা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। হবে নাই-বা কেন? কোন বেড়ালের বিষয় এই কাব্য, সেটা পড়ুন। প্রথম পংক্তিতেই সেই ঘোষণা:
‘The Rum Tum Tugger is a curious cat.’
যে-সে বেড়াল নয় রাম টাম টাগার। তার নামের আগে ‘দ্য’ বসে। কেন সে ‘কিউরিয়াস ক্যাট’ বা অদ্ভুত বেড়াল? কেননা, তাকে একটা বাড়িতে রাখো, সে বলবে, তার পছন্দ ফ্ল্যাট। তখন তুমি তাকে একটা ফ্ল্যাট দাও, সে চাইবে বাড়ি। তাকে একটা নেংটি দাও, সে চাইবে ধেড়ে ইঁদুর। তাকে দাও একটা ধেড়ে ইঁদুর, সে তাড়া করে ছুটবে নেংটির পিছনে।
‘If you put him in a house he would much prefer a flat,
If you put him in a flat then he would rather have a house,
If you set him on a mouse then he only wants a rat,
If you set him on a rat then he’d rather chase mouse.’
সত্যি কথাটা হল, রাম টাম টাগার ভয়ানক ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর, একঘেয়ে একটা বেড়াল। এলিয়টের ভাষায়: ‘দ্য রাম টাম টাগার ইজ আ টেরিবল বোর’। কীরকম জানেন? ওকে ঘরে ঢুকতে দিন, ও তক্ষুনি বাইরে যেতে চাইবে। আর সমস্ত দরজার ভুল দিকে চলে যায়। আর যেই-না বাড়ি এল, অমনি তার বাইরে ঘুরে আসার প্রয়োজন। এইজন্য বলতেই হচ্ছে, দ্য রাম টাম টাগার ইজ আ কিউরিয়াস বিস্ট!
আর সব থেকে খারাপ ব্যাপারটা হল, এই অদ্ভুত বেড়ালটা আদর ভালবাসে না:
‘The Rum Tum Tugger doesn’t care for a cuddle’
কিন্তু যেই-না কেউ বলল সেলাই করতে, অমনি এই অদ্ভুত বেড়াল ঝাঁপিয়ে পড়বে কোলে। কেন জানেন? আমি জানি কেন, বলছেন এলিয়ট: ‘For there’s nothing he enjoys like a horrible muddle.’ ওই যে সেলাইয়ের সময়ে কোলে উঠে সব তালগোল পাকিয়ে দিল, সেটাই সব থেকে পছন্দ ওই অদ্ভুত বেড়ালটার। অদ্ভুত এই বেড়াল লণ্ডভণ্ডের প্রেমিক!
টি এস এলিয়টের মার্জার দর্শনে যে-কবিতাটি সরণি প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছে, সেই কবিতার অবিস্মরণীয় নাম, ‘গ্রাউলটাইগার্স লাস্ট স্ট্যান্ড’। শুরুতেই বেড়ালটার শক্তি, কর্কশ প্রাবল্য এবং ষণ্ডামির দামামা:
‘Growltiger was a Bravo cat, who travelled on a barge;
In fact he was the roughest cat that ever roamed at large.’
বেড়ালটা ম্যাড শয়তান। জলদস্যুর মতো জাহাজে ঘুরে বেড়ায়, দেশে-দেশে রেখে যায় তার শয়তানির চিহ্ন ও ত্রাস। তার প্রাবল্যের পরিধি শরীর-মনে ধরায় কম্পন:
‘From Gravesend to Oxford he pursued his evil aims,
Rejoicing in his title of ‘The terror of the Thames’’
সত্যিই সে হয়ে উঠেছিল টেমস নদীর ত্রাস। দূর থেকে ভেসে আসছে তার বজরা, এই দৃশ্য দেখলেই শুরু হয়ে যেত বুক ধড়ফড়। এই শয়তান বেড়ালটার ভয়াবহ চেহারা এবং ব্যবহারের অনন্য বর্ণনা দিয়েছেন এলিয়ট চারটি লাইনে :
‘His manners and appearance did not calculate to please;
His coat was torn and seedy, he was baggy at the knees;
One ear was somewhat missing, no need to tell you why,
And he scowled upon a hostile world from one forbidding eye.’
ভেবে দেখুন ব্যাপারটা। যেমন বেড়ালটার ব্যবহার, তেমন কদাকার তাকে দেখতে, এতটুকু খুশি হওয়ার জায়গা নেই। তার পরনের কোটটা ছেঁড়া এবং নোংরা। অর্থাৎ, বেড়ালটার সারা অঙ্গ নোংরা এবং ক্ষতবিক্ষত। এবং হাঁটুর কাছটা বিকট ‘ব্যাগি’। একটা কান প্রায় নেই বললেই চলে। কেন কানকাটা, বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই। একটা চোখও তার নষ্ট। কিন্তু অবশিষ্ট একটি চোখ দিয়ে সে যেন সমস্ত প্রতিকূল পৃথিবীটার দিকে সর্বক্ষণ রেগেমেগে কটমট করে তাকিয়ে। ওই একটা চোখ সব্বাইকে সর্বদা বলত, তফাত যাও।
কিন্তু একদিন এই কানকাটা একচক্ষু শয়তান বেড়ালটাকেই এক চাঁদনি রাতে ঘিরে ফেলল মোঙ্গোলিয়ান বেড়ালের বাহিনী। তাদের কাছ থেকে পালাবার রাস্তা খুঁজে পায়নি এই মারাত্মক মার্জার। সে ক্ষতবিক্ষত হল চাঁদনি রাতের নরম রোম্যান্টিক আলোয় টেমসের ওপর। এবং রটে গেল মুহূর্তে সেই আনন্দবার্তা ভিকটোরিয়া ডক থেকে ব্যাংকক পর্যন্ত!
‘Oh there was joy in wapping when the news flew through the land;
At Maidenhead and Henley there was dancing on the strand.
Rats were roasted whole at Brentford and Victoria Dock
And a day of celebration was commended in Bangkok.’
গ্রাউলটাইগার বেড়ালটার মৃত্যুসংবাদে আনন্দে নাচতে-নাচতে সারা বিশ্বজুড়ে বেড়ালরা আস্ত ইঁদুরের রোস্ট খেতে লাগল! ভাবা যায়, কেমন গরিমাময় ছিল সেই মার্জার উদযাপন!
আরও অনেকের বেড়ালের কথা লিখেছেন এলিয়ট তাঁর একটির পর একটি মার্জারমগ্ন কাব্যে। আমাদের কবি জয় গোস্বামী সম্ভবত পৃথিবীর বেড়ালপ্রেমীদের একজন। তাঁর বাড়িতে বেড়ালদের আদর-কদর-যত্ন এবং প্রশ্রয় নিজের চোখে দেখেছি। হয়তো জয় গোস্বামীর একটি নিজস্ব মার্জার-দর্শনও গড়ে উঠেছে। হয়তো তিনি বেড়াল নিয়ে লিখেছেনও কখনও-সখনও। হয়তো তাঁর কবিতায় মানুষের মধ্যেও লীলায়িত হয়েছে বেড়ালের গুণ ও দোষ। মানুষের চরিত্রে ভেসেছে মার্জার-ভাবের সাম্পান। কিন্তু মার্জার-মহাকাব্য তিনি লিখেছেন বা কখনও লিখবেন বলে ভেবেছেন, মনে হয় না আমার। নোবেলজয়ী ব্রিটিশ কবি সেই কাজটি অভিনিবেশ এবং উৎসাহে সাঙ্গ করে গেছেন। বিহ্বল করে এলিয়টের মার্জারব্যাপ্তি এবং গভীরতা। কত রকমের বেড়াল নিয়ে, তাদের স্বভাবচরিত্র নিয়ে, তাদের নিষ্ঠুরতা, ভদ্রতা, ইন্টেলেকচুয়াল গভীরতা, স্কলারলি মগ্নতা, তাদের দার্শনিক দর্শিতা, তাদের রোম্যান্টিক প্রবণতা, তাদের সাংসারিক গোছানেপনা, সব কিছু নিয়ে রচনা করেছেন এলিয়ট তাঁর মার্জিত মার্জারকাব্য। এলিয়টের বেড়ালবিশ্ব তুলনাহীন, এ-কথা বলতে আমার এতটুকু কুণ্ঠা নেই। এলিয়টের অনন্য বেড়াল-অন্বয়, মানগোজেরি আর রামপেল্টিজার জুটির কথা ভাবুন, প্রায় সুচিত্রা-উত্তম! ‘দে হ্যাড অ্যান এক্সটেনসিভ রেপুটেশন’ জানাচ্ছেন এলিয়ট। এবং তারা পরস্পরের মধ্যে এক হয়ে যেত কখনও-কখনও! ‘Now which was which cat!’ লিখছেন এলিয়ট। আর এলিয়টের ‘মিস্টার মিস্টোফেলিস’, ভোলা কি যায় তাকে? মিস্টার মিস্টোফেলিস কিন্তু পৃথিবীর সব শহরেই আছে। এবং সবাই বেড়াল নয়। কিন্তু তাদের আমরা তেমন চিনতে পারছি না, যেমন চিনেছেন এলিয়ট :
‘He holds all the patent monopolies
For performing awrprizing illusions
And creating eccentric confusions
The greatest magicians have something to learn,
From Mr. Mistoffeleas’ conjuring turn.’
এলিয়টের মার্জারবিশ্বে আরও এক বিড়ালের দেখা পাবেন, যাকে এলিয়ট নিজে বলেছেন ‘দ্য মিস্ট্রি ক্যাট’ এবং যার নাম দিয়েছেন ‘ম্যাকাভিটি’। ম্যাকাভিটি নামটা যে ম্যাকিয়াভেলি থেকে এসেছে, বলে দিতে হবে কি? এলিয়ট নাম-রহস্য খোলসা করেছেন এই ভাষায় : এই বেড়াল হল ‘দ্য মাস্টার ক্রিমিনাল হু ক্যান ডিফাই দ্য ল’। তবে জবাব নেই ‘থিয়েটার ক্যাট’ ‘গাস’-এর। তবে ‘গাস’-এর ভাল নাম ‘অ্যাসপারাগাস’ কিন্তু ‘ইট ইজ সাচ আ ফাস টু প্রনাউন্স অ্যাসপারাগাস’! তাই শুধু ‘গাস’। এবং সে থিয়েটারেই থাকে। কলকাতাতেও নিশ্চয় ‘থিয়েটার ক্যাট’-এর অভাব নেই, কিন্তু তাদের কোনও এলিয়ট নেই! আর ‘বাসসটোকার জোন্স— দ্য ক্যাট অ্যাবাউট টাউন’। এই বেড়ালকে আমরা চিনি। কলকাতার রাস্তাঘাটে কত না দেখছি! কিন্তু তাদের আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য চাই এলিয়টের মতো একজন মার্জার দার্শনিক। আরও হরেক রকমের বেড়ালের দেখা পাওয়া যাবে এলিয়টের মার্জার মহাকাব্যে। কিন্তু আমাকে সবথেকে আনন্দ দিয়েছে এলিয়টের ‘জেলিকল ক্যাটস’। ‘দ্য সং অফ দ্য জেলিকলস’ অসামান্য কবিতাও বটে :
‘Jellicle cats are black and white,
Jellicle cats are rather small;
Jellicle cats are merry and bright,
And pleasant to hear when they caterwaul.
Jellicle cats have cheerful faces,
Jellicle cats have bright black eyes;
They like to practice their airs and graves
And wait for the Jellicle moon to rise.’
আমাকে যা সবথেকে মুগ্ধ করেছে এলিয়টের মার্জার মহাকাব্যে, তা হল, এলিয়টের অব্যর্থ অমোঘ শব্দচয়ন। মার্জার-চলনের মতোই কী অনায়াস নিঃশব্দে ঘটে যাচ্ছে এই শব্দের লীলা!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র