ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নীলা-নীলাব্জ : পর্ব ৭


    অনুপম রায় (October 15, 2024)
     

    বয়স

    শহরের নামকরা একটি ক্লিনিক। ডাক্তার দেখিয়ে বেরচ্ছিল নীলা। হঠাৎ পেছন থেকে, ‘আরে, ক্লিনিকে এসেছিলে না কি?’ নীলা ঘুরে দেখে মানুষের একটা জটলা ভেঙে নীলাব্জ এগিয়ে আসছে। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলে, ‘তুমি এখানে গুলতানি মারছ না আমাকে ফলো করছ?’

    নীলাব্জ : না, না, ফলো কেন করব! এই আমার দুজন স্কুলের বন্ধু মেডিকাল রিপ্রেজেন্টেটিভ। ওদের সঙ্গে একটু…

    নীলা : সব মিথ্যে কথা। তুমি বরং রাজনীতি জয়েন করো। স্ট্রেট ফেসে মিথ্যে বলার স্কিলটা কাজে লাগবে।

    নীলাব্জ : আরে রেগে যাচ্ছ কেন? তোমাকে এরকম কালো-কালো লাগছে কেন? আর হাতেই বা কী হয়েছে? 

    নীলা : তোমার কী?

    নীলাব্জ : আমার কিছুই না। এরকম ট্যান হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ তাই… আরে, আরে, চললে কোথায়? ওষুধ কিনতে?

    নীলা হন হন করে হাঁটতে থাকে। ‘এত প্রশ্ন কোরো না তো! ভাল্লাগে না!’

    নীলাব্জ পিছু নেয়। ‘সমুদ্রে গেছিলে?’

    নীলা : হ্যাঁ, মন্দারমণি। গত সপ্তাহে জন্মদিন ছিল। গিয়ে কাদাগোলা জলে স্নান করে গায়ে ইনফেকশন নিয়ে ফিরেছি।

    নীলাব্জ : ও বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে! দেখেছ, একদম খেয়ালই ছিল না।

    নীলা : থ্যাংক ইউ।

    নীলাব্জ : মন্দারমণিটা একদম ভোগে চলে গেছে।

    নীলা : বালি আর নেই, শুধু কাদা। কাঁকড়া খেয়ে পেট খারাপ হল আর জলকেলি করে গায়ে স্কিন ডিজিজ। (কম্পাউন্ডারকে) দাদা, এই মলম আর এই কী যেন…

    ওরা ওষুধের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওষুধ কেনা হয়ে গেলে নীলা কেটে পড়ার তাল করে।

    নীলাব্জ : আধঘণ্টা আড্ডা দিয়ে যাও।

    নীলা : তোমার খালি আড্ডা। আড্ডা দিয়ে-দিয়ে বাঙালি জাতিটাই ভোগে চলে গেল।

    নীলাব্জ : এটা অনেক দিন ধরেই শুনছি কিন্তু যায়নি এখনও ভোগে। চলো না।

    নীলা : আধঘণ্টা শুধু! মনে থাকে যেন। আমি টাইমার চালু করলাম।

    নীলাব্জ হাসে। ওরা পাশেই একটা ক্যাফেতে বসে। একটা চা আর দুটো কাপ অর্ডার করে। ওয়ান বাই টু কায়দায় হাফ কাপ করে চা হাতে আড্ডা শুরু হয়। দুজনেই মনে করে এই ক্যাফেগুলো অতিরিক্ত দাম নেয় সব কিছুর।

    নীলাব্জ : কত বয়স হল তোমার?

    নীলা : তা জেনে তোমার কী?

    নীলাব্জ : কেন? বয়স বলতে চাও না কেন? বললে কী হয়?

    নীলা : এটা আমার ব্যাপার। আমি তোমাকে বলতে চাই না। বসেই ঝগড়া শুরু করে দিলে?

    নীলাব্জ : না, এই বয়স লুকানোটা কি মেয়েদের ব্যাপার, না কি ছেলেরাও করে, এটা নিয়ে একটা গবেষণা করব পরে।

    নীলা : কাজ না থাকলে মানুষের এই হয়। তোমার বয়স কত?

    নীলাব্জ : একুশ।

    নীলা : দামড়া একটা হুমদো লোক বলছে একুশ। লজ্জা করে না তোমার?

    নীলাব্জ : আরে, আমি আমার মনের বয়স বললাম।

    নীলা : একুশ বছরের মন তোমার পছন্দের? একুশ বছরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে?

    নীলাব্জ : অবশ্যই। আমি যৌবনকে আরাধনা করি। যত বয়স হয় শুধু বদ বুদ্ধি বাড়ে আর ভাল কাজ করার ইচ্ছেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তুমি চাও না ফিরে যেতে একুশে?

    নীলা : কী যে বলো! ষোলো, একুশ ফিরে তাকালেই শুধু নিজের ভুলগুলো দেখতে পাই। একদম বড়-বড় ব্লান্ডার। যত বয়স হয়েছে, একটু-একটু করে বুঝতে পেরেছি। ওই বয়সে আসলে বুদ্ধিই থাকে না। সব কিছুতেই চমক লাগে, নতুন লাগে। সব কিছুতেই একটা বিস্ময়! আর যা কিছু চকচক করে, সেটা ভাল লেগে যায়। বুঝতে সময় লাগে কোন জিনিসটা খাঁটি আর কোনটা জালি।

    নীলাব্জ : যেমন?

    নীলা : গান, সিনেমা, নাটক, নভেল— সব কিছুতে চমক থাকলে তবেই সেটা ভাল লাগে। বাইরের মোড়কটা বড্ড টানে ওই বয়সে। আমার মনে আছে একটা নাটক দেখতে গেছিলাম, সেখানে অভিনেতা যেই কাঁচা গালাগাল দিচ্ছে তখন হাততালি দিয়ে উঠছিলাম। এখন বুঝতে পারি আসলে নাটকটায় কিস্যু ছিল না। নতুন কিছু বলার ছিল না। টিপিকাল ন্যাকা একটা আদর্শ বেচা নাটক। কিন্তু ওই বয়সে আমি দু’বার দেখতে গেছিলাম। কেন যে ভাল লেগেছিল কে জানে! গালাগালের জন্য নাকি ওই বস্তাপচা, ন্যাকা আদর্শ জীবনে প্রথমবার শুনলাম তাই জন্য।

    নীলাব্জ : এটা কিন্তু শুধু বয়সের ব্যাপার নয়। নব্বই পয়সার দর্শক বলে একটা কথা আছে জানো তো? অর্থাৎ অগভীর শ্রোতা, দর্শক। এটা কিন্তু সব বয়সেই পাওয়া যাবে। ওই হাততালিগুলো পাওয়ার জন্য অনেক কিছু তৈরি হয়।

    নীলা : আমি বোঝাতে হয়তো ভুল করছি। আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি। একজন শিল্পীর গান খুব শুনতাম অল্প বয়সে। একাধিক অনুষ্ঠানে গেছি কিন্তু গান শুনতে ঠিক নয়। গান ছাড়া মঞ্চে আর যা করতেন সেগুলো দেখতে বা শুনতে। সেই আকর্ষণে। একটু লাফালে বা তীর্যক কিছু কথা বললে হাততালি দিতাম। বেসিক্যালি একটা ফেক হিরোগিরি দেখতে। এই বয়সে সেগুলো আর ভাল লাগে না। বুঝতে পারি, গানগুলো আসলে বেশ খাজা। কিন্তু তখন খুব ভাল লাগত।

    নীলাব্জ : দ্যাখো এখানেও বয়সের কী দোষ বলো? একটা শোম্যানশিপ তোমাকে আকৃষ্ট করেছিল।

    নীলা : হ্যাঁ, বাইরের মোড়কটা। গানটা হয়তো নয়।

    নীলাব্জ : ওরকম ভাবে আলাদা করা যায় না। তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। পপুলার কালচারে সংগীতও কিন্তু একটা স্টাইল স্টেটমেন্ট। সেখানে শিল্পী কীভাবে হাঁটে, দাঁড়ায়, কথা বলে— সব কিছু মিলে তার সংগীত। তার ছেঁড়া জিনস একটা স্টেটমেন্ট, তার সেক্সুয়ালিটি একটা স্টেটমেন্ট, এই সব মিলেমিশে…

    নীলা : দামড়া একটা হুমদো লোক বলছে একুশ। লজ্জা করে না তোমার?

    নীলাব্জ : আরে, আমি আমার মনের বয়স বললাম।

    নীলা : একুশ বছরের মন তোমার পছন্দের? একুশ বছরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে?

    নীলাব্জ : অবশ্যই। আমি যৌবনকে আরাধনা করি। যত বয়স হয় শুধু বদ বুদ্ধি বাড়ে আর ভাল কাজ করার ইচ্ছেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তুমি চাও না ফিরে যেতে একুশে?

    নীলা : আমি মানি না। সে শিল্পী তার গানের জন্য। তার গানটাই আসল, বাকি সব কিছু ডাইভার্শন। অর্থাৎ পাতি গানগুলো বিক্রি করার একটা কায়দা মাত্র। আর যুবসমাজ ওগুলো দেখেই ভাবে, বাহ! কী দারুণ!

    নীলাব্জ : সে তো বিবেকানন্দর গেরুয়া পোশাক, মাথায় পাগড়ি সবই একটা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। শার্ট-প্যান্ট পরেও শিকাগো যাওয়া যেত, ওই একই কথা বলা যেত। কিন্তু ওই গেরুয়া ধারণ করে বললে, ওই একই কথার শক্তি দশ গুণ বেড়ে যায়। ওই ইমেজ দেখেই ৯০% পাবলিক ফ্ল্যাট। গান্ধীজির লাঠি আর ধুতিতেই অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। এবং এটা যুবসমাজের ব্যাপার নয়, সব বয়সের হাজার-হাজার মানুষ প্রভাবিত হয়। ফটোগ্রাফের বিশাল ক্ষমতা।

    নীলা : ইমেজ বলতে মনে পড়ল, আমারই চে গেভারা আঁকা একটা কালো টি-শার্ট ছিল। সেই পরে রোজ কলেজ যেতাম। প্রচুর মিছিল-ফিছিলে হাঁটাহাঁটি করতাম। পয়সাওয়ালা লোক দেখলে মনে-মনে অপমান করতাম। হালকা একটু বামঘেঁষা ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে বিপ্লবও চেয়েছি। সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছি। ধনীর টাকা লুট করে গরিবদের দিয়ে দিতে চেয়েছি কিন্তু যেদিন এমএনসি-তে চাকরিটা বাগালাম, সব ফুস। চে গেভারা কলেজ ক্যাম্পাসেই ভাল। যেই নিজের ব্যাঙ্কে অল্প-অল্প করে জমতে শুরু করল, তখন সব কিছু পালটে গেল। যে-আম্বানিকে, নারায়ণমূর্তিকে গালি দিতাম কলেজে, চাকরিতে ঢুকে তাদের কোম্পানিরই শেয়ার কিনলাম। রিলায়েন্স, ইনফোসিস কীভাবে ব্যবসা করছে আমার তাতে ঘণ্টার মাথা, দিনের শেষে আমাকে ১২% CAGR দিচ্ছে তো? আমি এখন বিপ্লব চাই না। কষ্ট করে যা জমাচ্ছি, যা করে খাচ্ছি তা কেন নষ্ট করতে দেব? আমার এখন কিছু আছে, তাই হারানোর ভয়ও আছে। অল্প বয়সে এই বুদ্ধিটুকুই ছিল না। ঈর্ষা ছিল ধনীদের প্রতি। বুঝতে পারি, আমি ডান-বাম কিছুই নই। ওই যৌবনেই ওসব স্লোগান-ফোগান মানায়।  

    নীলাব্জ : না, না, না! তুমি আবার ভুল করছ! এটা যৌবনের ব্যাপার নয়। কত লোক বুড়ো বয়সেও লালচে সকালের স্বপ্ন দেখছে।

    নীলা : বেশির ভাগ মানুষই দেখছে না। এত মানুষ বিপ্লব চাইলে এতদিনে হয়ে যেত। কেউ চাই না আমরা বিপ্লব। আমরা তো সবাই সিস্টেমের পার্ট। সিস্টেম খসে গেলে যাও-বা জুটছিল, তাও না জুটতে পারে। একটু বয়স হলেই মানুষ সেটা বুঝতে পারে। লালের গ্ল্যামারটা টি-শার্টের লেখাতেই ভাল লাগে, আসল গ্ল্যামার কিন্তু তিরিশ তলার ফ্ল্যাটে।

    নীলাব্জ : অল্প বয়সে মনটা কাঁচা থাকে নীলা। খুব সহজেই সেই কাদার মতো মনে অনেক কিছু দাগ ফেলে যায়। বয়স হলে মানুষ গাম্বাট হয়। অনমনীয় হয়ে যায়। চিরাচরিত হেঁটে যাওয়া পথে বিশ্বাস করতে শুরু করে। কিন্তু তাহলে তো নতুন কিছু হবে না।

    নীলা : অল্প বয়সে আমরা বড্ড বেশি ভুল করি।

    নীলাব্জ : তোমার ভুলে এত প্রবলেম কেন? কে বলেছে আমাদের সব ঠিক করতে হবে? ভুল না করলে ঠিকটা বুঝব কী করে? আর ভুল করাটা খারাপ ভাবছ কেন? কিছু তো একটা করছে। ঢুলু ঢুলু চোখে, বসে-বসে বড়-বড় বাতেলা তো মারছে না। অক্ষমতা দিয়ে নিজের সব কিছু মুড়ে তো রাখছে না! আমার তো সেটাই ভাল লাগে, একটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাব। হোক না দু’তিনটে ভুল!

    নীলা : ভুলের হয়ে তুমি এখন ওকালতি করছ। আমি একবার বলেছিলাম না, তুমি হলে ধর্ষকের পক্ষের উকিল। যা কিছু করে তুমি ধর্ষককে বাঁচাবে।

    নীলাব্জ : আরে, আমার ক্লায়েন্ট, মানে যৌবনের ঘাড়ে ভুলের সব বোঝা চাপিয়ে তুমি পালিয়ে যাবে, তা কী করে হয়? ভুল কি বয়স্ক মানুষ করে না? সব ভুল কি যৌবনের?

    নীলা : সব কেন হতে যাবে? তবে অনেক! অনেক ভুল হয় যৌবনে। আমি ওই লোকটাকে কী করে ভালবেসেছিলাম আমি জানি না। ব্লান্ডার! ব্লান্ডার! অল্প বয়সে জগৎ না চেনার ব্লান্ডার।

    নীলাব্জ : আমি বলছিলাম…

    নীলা : থাক! তোমাকে আর বেশি বলতে হবে না। আমার এই বয়স, এই ম্যাচিউরিটি ভাল লাগে। তুমি কচি সেজে থাকো আর ভুল করতে থাকো। আমি চললাম।

    নীলাব্জ আর কিছু বলে না। মৃদু হেসে বিদায় জানায়।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook