তাহাদের কথা
ফরাসি ছবিটা তার চলন-সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে ১৯৬৩ সালকে, কিন্তু তা বলে ছবিটাকে পিরিয়ড-পিস হিসেবে উপস্থিত করার কোনও দায়ই পরিচালক নেননি, তিনি শুধু এক নারীকে কেন্দ্রে রাখতে চেয়েছেন, যার নিজ শরীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই। সেই সময়ে ফ্রান্সে গর্ভপাত বেআইনি, যে করবে এবং যে তাকে সাহায্য করবে, সকলের জেল হবে। আমাদের নায়িকা ২৩ বছরের একটি মেয়ে, পড়াশোনায় অত্যন্ত ভাল, সাহিত্যের ক্লাসে আলাদা করে তাকে চিনে নেওয়া যায়, কিন্তু সে মাঝে মাঝেই বান্ধবীদের সঙ্গে পানশালায় যায়, ছেলেদের সঙ্গে নাচে, তাকে কিছুটা স্খলিত-চরিত্র হিসেবেই হোস্টেলের কিছু মেয়ে চেনে। সে একটি ছেলের সঙ্গে একদিনের মাত্র যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে, গর্ভবতী হয়ে পড়ে। ছবিটি অবশ্য সেসব ঘটনা দেখায় না, মেয়েটির গর্ভিণী হওয়ার পর থেকে ছবি শুরু হয়, এবং সমগ্র ছবিজুড়ে সে প্রাণপণ চেষ্টা করে গর্ভপাতের কোনও সহায়তা পাওয়ার। কোত্থাও পায় না। ডাক্তাররা শোনামাত্র তাকে বিদায় করে দেয়, একজন ইচ্ছে করে এমন একটা ওষুধ দেয় যা ভ্রুণকে আরও শক্তিশালী করে। এক সময়ে মেয়েটি একটি উলের কাঁটা বা ওই গোছের একটা সরু ধারালো জিনিস গোপনাঙ্গে ঢুকিয়ে নিজে গর্ভপাতের চেষ্টা করে, তাতেও কিছু হয় না। যে-ছেলেটি এর জন্য সহ-দায়ী, সে মেয়েটিকে বলে, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি একটা কিছু সমাধান করে ফেলবে। যেন সমাধান করার দায় শুধুমাত্র মেয়েটির, একেবারেই তার নয়। মেয়েটির বন্ধুরা, যারা তাকে ভালবাসে এবং সমীহ করে, তারা অবস্থা দেখে তাকে পরিত্যাগ করে। একবার মেয়েটি এক সহপাঠী ছেলেকে বলে, সে তো অনেক মেয়ের সঙ্গে মেশামিশি করে, কাউকে কি চেনে, যে গর্ভপাত করিয়েছে। ছেলেটি উলটে এই মেয়েটির সঙ্গে যৌনতা করতে চায়, কারণ, এই মুহূর্তে গর্ভিণী থাকলে তো যৌনতায় আর নতুন কোনও ভয় নেই। পরে অবশ্য সেই ছেলেটি একজন মেয়েকে নিয়ে আসে, সেই মেয়েটি নায়িকাকে পাঠায় একজন মহিলার কাছে, যে বেআইনিভাবে গর্ভপাত ঘটায়।
ক্যামেরা গোটা ছবিটা (‘হ্যাপেনিং’, চিত্রনাট্য: অড্রে দিওয়ান, মার্সিয়া রোমানো, অ্যান বিরেস্ট, পরিচালনা: অড্রে দিওয়ান, ২০২১) জুড়ে প্রায় আক্ষরিকভাবে তাকিয়ে থাকে শুধুমাত্র নায়িকার দিকে। ফ্রেমে আঁটো করে ধরা তার মুখ তাকে আমাদের ঘনিষ্ঠ করে তোলে, একইসঙ্গে তাকে বন্দি করে দেয়। অন্য চরিত্রদের কিছুটা ঝাপসা দেখা যায়, তা নায়িকার বেদনা ও ভয়কে আরও স্পষ্ট করে। কিন্তু মেয়েটি তীব্র অহং-সম্পন্না, সে কারও কাছে করুণাভিক্ষা করে না, কারও কাছে হত্যে দেয় না, কেঁদে পড়ে না। সহপাঠী যখন তার গর্ভিণী অবস্থার সুবিধে নেওয়ার চেষ্টা করে, মেয়েটি তক্ষুনি বেরিয়ে আসে। যখন বেআইনি সমাধানের খোঁজ দেওয়া মেয়েটি বলে এত টাকা লাগবে কাজটা করতে, আর সেই টাকা সে ধার দিতে পারে, নায়িকা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারপর নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে টাকা জোগাড় করে। তার সন্তানের বাবা যখন তাকে অপমান করে, সে ওই মুহূর্তে, রাত্রে, রাস্তায় বেরিয়ে নিজের হোস্টেলের দিকে রওনা দেয়। এমনকী যখন মহিলাকৃত গর্ভপাতের প্রথম প্রয়াস ব্যর্থ হয় এবং মহিলা বলে দ্বিতীয় চেষ্টা করতে গেলে তার ফল ভয়ানক হতে পারে, মেয়েটি তক্ষুনি ঝুঁকি নিয়ে সেই চেষ্টায় রাজি হয়, হাহাকার করে না। গোটা ছবিতে সে কাঁদলে একা ঘরে কাঁদে, কিন্তু প্রকাশ্যে একবারের জন্যও মাথা নত করে না। না, ভুল হল, দু’বার সে যাচনা করে, একবার ক্ষমা ও একবার সাহায্য। প্রথমবার, যখন তাকে সাহিত্যের ক্লাসে প্রশ্ন করা হয় এবং সে উত্তর দিতে পারে না। এই টানা উদ্বেগে সে যে নিজের কাজকে অবহেলা করেছে, সাধনা থেকে চ্যুত হয়েছে, সেই লজ্জা তাকে আক্রমণ করে। আর দ্বিতীয়বার, যখন বাথরুমে তার গর্ভপাত হয়েছে, সে হোস্টেলের আরেকটি মেয়েকে কাতরভাবে বলে কাঁচি দিয়ে নাভিগ্রন্থি কেটে দিতে। কিন্তু তার ভেতরের ইস্পাত বোঝা যায়, যখন সে এক অচেনা লোককে বলে, তার বন্ধুরা যতই মুখে যৌনতাবিরোধী হোক, সক্কলে এই পানশালায় এসে একটি জিনিসই চায়। আর এক সময়ে সে এক ডাক্তারকে বলে, যদি সন্তান এসে তার জীবনটাকে (মানে, জীবনের স্বপ্নকে) কেড়ে নেয়, তবে সেই সন্তানকে সে ভালবাসতে পারবে না। মাতৃত্ব সে চায়, কিন্তু তার আগে রাখে নিজত্বকে। অধ্যাপক যখন তাকে বলেন, সে খুব ভাল পড়াতে পারবে, মেয়েটি বলে, সে লেখিকা হতে চায়। বোঝা যায়, সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার ও নিবেদনের রাজ্য সে কাউকে তছনছ করতে দিতে চায় না, অনাগত সন্তানকেও না।
ক্যামেরা নায়িকাকে নাছোড় অনুসরণ করে, তাই আমরা তার মুখের ভাঁজ পড়তে পারি। তার পড়ায় মনোযোগ, তার বেড়ে যাওয়া খিদে, তার প্রকাণ্ড ত্রাস, চোয়াল-চাপা প্রতিজ্ঞা, কিছুই আমাদের অজানা থাকে না। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নায়িকার বুক-ধড়ফড়ে ভয়টা আমাদের ওপরেও চেপে বসে। ছবিটা একটা থ্রিলারের মতো আমাদের আঁকড়ে ধরে থাকে, আমরা নায়িকার সমান আকুলতায় সমাধান খুঁজি। এই ধরনের ছবি যেমন সংলাপে পুরুষবিরোধিতা একটু চেঁচিয়ে প্রচার করতে চায়, এই ছবি তা করে না, কিন্তু মেয়েটির তীব্র আত্মসম্মান ও প্রবল জেদ সত্ত্বেও তার মাথা কুটে মরা এই সমাজের নিষ্ঠুরতাকে প্রতি মুহূর্তে প্রকট করে। তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু বলে, তোকে কোনওভাবে সাহায্য করতে পারব না, জেলে যেতে পারব না, আর নায়িকা নিজে তার মা-বাবাকে কিছুতেই বলে উঠতে পারে না তার জীবনের এই সর্বাধিক বিপদের কথা, এই দুই কথা ও নীরবতা দিয়ে বোনা থাকে সমাজের অনড় শেকল ও তার ফাঁসে এক দমঠাস ছটফটের কাহিনি। এবং মেয়েটির কাছে একবারের জন্যও আমরা শুনি না তার গর্ভস্থ সন্তানের প্রতি এতটুকু স্নেহ জন্মানোর আখ্যান। গোটা ছবিতে একবারও সে এই অনাগত সন্তানকে বিপদ ছাড়া কিছুই মনে করে না, এমন প্রখর একমুখী তার ধ্যান: পড়াশোনা করা, ভাল ফল করা, বিস্তৃত জীবনে অংশ নেওয়া ও সাহিত্যে নিমজ্জিত থাকা। সাধারণত ভ্রুণের প্রতি নতুন মা’র এক অব্যাখ্যাত মমতা চিত্রিত হয়, কিন্তু এই ছবি তার ইঙ্গিতমাত্র দেয় না। ভ্রুণ-ধ্বংস সম্পর্কে ন্যূনতম অপরাধবোধ নায়িকার মনে জাগে না। বরং যারা তাকে তা করতে দিচ্ছে না, নায়িকার মরিয়া উপায়-সন্ধানের কাহিনি তাদেরই অবিমিশ্র অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। সেদিক থেকে এই ছবি মাতৃত্বের মহিমার চেনা ফাঁদ পূর্ণ এড়িয়ে, খর ও চোখে-চোখ।
ছবিটা যৌন কামনার কথাও বলে। মেয়েটির এক বান্ধবী বালিশের সঙ্গে সঙ্গম করে তাদের দেখায়, আরেক বান্ধবী এক সময়ে অনুতপ্ত হয়ে মেয়েটির কাছে এসে বলে, তারও সম্পর্ক হয়েছিল, সে ভাগ্যক্রমে গর্ভবতী হয়নি। মেয়েটি এক দমকলকর্মীর সঙ্গে পানশালা থেকে বেরিয়ে গিয়ে সঙ্গম করে, তার গর্ভপাত নিয়ে চূড়ান্ত অশান্তি সত্ত্বেও (বা তা ভুলে থাকার জোরালো উপায় হিসেবেই) যৌনতা দিব্যি উপভোগ করে। তার সাহিত্যানুরাগই হয়তো তাকে মুক্তমনা করেছে, সে ওই রক্ষণশীল সমাজে বড় হয়েও যৌনতাকে পাপ মনে করে না, যা তার সহপাঠীরা প্রায় সব্বাই করে, বা মুখে অন্তত তা-ই বলে। নায়িকা হিসেবে অসহায় পবিত্র নারীর বদলে অ-জনপ্রিয়, প্রতিভাময়ী, একরোখা ও মনের-ধার-না-ধারা যৌনতাপ্রিয় (আগন্তুকের সঙ্গে যৌনতায় স্বচ্ছন্দ) মেয়েকে বেছে নেওয়াও পরিচালকের কৃতিত্ব, এবং অবশ্যই যে লেখিকার বই থেকে এই সিনেমা হয়েছে, সেই অ্যানি আর্নো-ও অভিনন্দনযোগ্য। ছবিটি নায়িকার পক্ষে সমবেদনার কুড়োনোর জন্য তাকে সহজে পছন্দসই করে তোলে না, তা এই ভেনিসে স্বর্ণসিংহপ্রাপ্ত ছবির জোরের জায়গা।
ভারতে এ-বছর দুটো ছবি নারীর কথা বলতে চেষ্টা করেছে। ‘স্ত্রী ২’ (চিত্রনাট্য: নীরেন ভাট, পরিচালনা: অমর কৌশিক, ২০২৪) হিন্দি ছবিটা নিজেকে বলে নারীবাদী, কিন্তু ‘স্ত্রী’ ছবিতে নারীর কথা চমৎকার ভাবে বলে বোধহয় পরিচালকের প্রাণশক্তি ফুরিয়ে গেছে, তাই নতুন এই হরর-কমেডিতে ছবিটা শুধু স্পেশাল এফেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্কন্ধকাটা কেমন করে আসবে-যাবে, আক্রমণ করবে, তার ধড় ও মুন্ডু কেমন দেখতে হবে (হ্যাঁ, মুন্ডু আছে, শুধু ধড়ে জোড়া নেই) এবং শেষ মারামারিটা কেমন হবে, তা নিয়েই ছবি ভাবিত। যদিও কন্ধকাটা ধরে নিয়ে যায় শুধু আধুনিক মেয়েদের (যারা সিগারেট খায় ও রাতবিরেতে মেসেজ করে ও মুখ টিপে-টিপে হাসে) এবং একটা দৃশ্যে কন্ধকাটার সম্মোহনে পুরুষদের ‘চোখ’ বদলে যায় আর তারা গঞ্জের মেয়েদের ঘরবন্দি করে দেয়, কিন্তু এই সরলসোজা দু-একটা ইতিউতি ছাড়া আর কিছুই উল্লেখযোগ্য নেই। হাসাবার চেষ্টা আছে প্রচুর, কিন্তু সেসব স্ল্যাপস্টিকে এবং চট-হাততালি তোলা সংলাপে নারীবাদ নেই, শুধু বক্স-অফিস-তৃষ্ণা রনরন করছে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মালয়লম ছবি ‘আট্যম’ (চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: আনন্দ একর্শি, ২০২৩) খুবই ভাল, যেখানে নাটকের দলের একটি মেয়েকে ঘুমন্ত অবস্থায় দলেরই কেউ একজন মর্দন করেছে, মেয়েটি জেগে উঠতেই সে পালিয়ে গেছে, এ-কথা শোনার পর একজনকে ভিলেন ঠাউরে তাকে নাটকের দল থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাকি পুরুষেরা, কিন্তু যেই না সেই ভিলেনের সাহায্যে দলের একটা ইউরোপ ট্যুরের কথা ওঠে আর তার সঙ্গে অভাবিত আর্থিক লাভেরও সম্ভাবনা দেখা যায়, সকলেই ধীরে-ধীরে আগের সিদ্ধান্ত বাতিল করে তার শাস্তির বিপক্ষে যায়। এর ওপর যখন মেয়েটি বলে, সে নিশ্চিত নয় কে এ কাজ করেছিল, ঘুম থেকে উঠে ভাল দেখতে পায়নি, তখন সকলেই অতি আশ্বস্ত হয়ে মেয়েটিকেই বিভিন্ন দোষারোপ করতে থাকে চেনা গৎ-এ (সবার সঙ্গে বসে মদ খেলে, এরকম পোশাক পরে ছেলেদের সামনে ঘুরলে ইত্যাদি)। কারও মনে এই প্রশ্ন জাগে না, যদি ধরেও নেওয়া যায় ওই লোকটা সে-কাজ করেনি, তাহলে করেছেটা কে? তাই ছবির শেষে দেখা যায়, মেয়েটি নিজে নাটকের দল খুলে এই নিয়েই নাটক লিখেছে ও পরিচালনা করেছে, এবং সেখানে নিগ্রহকারী যখন বলে, আমি মুখোশ খুলছি, তুমি দ্যাখো আমি কে, মেযেটি বলে, তার দরকার নেই, আমার কাছে তোমরা (দলের পুরুষেরা) সকলেই অপরাধী। ছবি জুড়ে সক্কলের অভিনয় প্রবল ভাল এবং চিত্রনাট্য নিখুঁত। এই ছবিতেও মেয়েটি একটা সময়ের পর অবৈধ সম্পর্কের কথা স্বীকার করতে ডরায় না এবং সেই কাপুরুষ লোভী প্রেমিকের স্বরূপ চিনে তাকে ত্যাগ করতেও মুহূর্তেক থতমত খায় না। ছবিটা থ্রিলারের মতোই ‘কে করেছে’-র উত্তেজনা ধরে রাখে, কিন্তু এখানে মেয়েটির বেদনা কেন্দ্রে থাকে না (মেয়েটি পর্দায় খুব বেশিক্ষণ নেইও, বারোজন পুরুষ তাকে নিযে আলোচনা ও তর্কাতর্কি করছে, ছবি জুড়ে আমরা তা-ই দেখি), পুংতন্ত্রের বিভিন্ন ধাস্টামির নিপুণ ও বহুস্তর উন্মোচন এই ছবির মূল সুর, এর আবেদন মূলত মস্তিষ্কের কাছে, হৃদয়ের কাছে নয়। যদিও গোড়ায় মেয়েটি এই নিগ্রহের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চায়নি কেচ্ছার ভয়ে, কিন্তু পরে তার চরিত্রের জোর বোঝা যায়, যখন প্রেমিক বারে বারে প্ররোচিত করলেও সে বলে, মিথ্যে কথা বলে সে নালিশটাকে দৃঢ় করে তুলবে না, যা সত্যি তা-ই বলবে। সবার সামনে তার বিবাহিত প্রেমিক যখন তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে, সে তখন সমস্তটা বলে দিতে এতটুকু দ্বিধা করে না। এবং গোটা অভিজ্ঞতা ঢেলে সে তৈরি করে আরেকটা নাটক, শিল্প, যেমন ‘হ্যাপেনিং’ ছবিতেও, আমরা আন্দাজ করতে পারি, নায়িকা হয়তো এই ঘটনা নিয়েই লিখবে তার প্রথম নভেল।