হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি, রোহিঙ্গা, মেইতি, কুকি, চাকমা। নিছক কিছু শব্দ। যথার্থ কানে হয়তো-বা খানিক শ্রুতিমধুরও, অথচ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা থেকে শুরু করে ইতিহাসের গভীর পর্যন্ত খুঁড়ে দেখলে পৃথিবীর যে-কোনও প্রান্তের যে-কোনও সংবেদনশীল প্রাণকে সন্ত্রস্ত করে তোলার তাৎপর্য পুষে রাখে ঠিক এই শব্দগুলিই। এই শব্দগুলির অভিঘাতেই অসহ্য অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে আসাও আজকের দিনে আর অস্বাভাবিক কিছু নয়। সন্ত্রাসের তীব্রতা প্রতিদিন ফুলেফেঁপে উঠছে চুপিসারে, প্রকাশ্যে। দ্রুত সংক্রামিত করছে আমাদের চারপাশ। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস শিথিল হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও আর খারিজ করা যাচ্ছে না। দেশ, প্রতিবেশের পরিস্থিতি ইদানীং এমনই।
কাঠুয়া, হাথরস ও আরও অনেক সমধর্মী ঘটনার পরেও বাংলাদেশে আবু সাঈদ, হরিয়ানায় পরিযায়ী শ্রমিক সাবির মল্লিক আর কলকাতায় আর জি করের হত্যাকে সংস্কৃতি আটকাতে পারেনি! ঘা এখনও দগদগে, তারই মধ্যে নৃশংসতার মাপকাঠিতে আগেরটিকে পিছনে ফেলে দিয়ে আরও কিছু ঘটনা হয়ে উঠছে আরও বেশি অতুলনীয়, অভূতপূর্ব।
তোফাজ্জল হোসেন। একজন ভবঘুরে, প্রেমে ব্যর্থ, মানসিক অসংলগ্ন, অনাথ এক মানুষ কিছুদিন আগেও বেঁচে ছিলেন। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যান। ফজলুল হক হলের ছাত্ররা তখন মাঠে খেলছিলেন। খেলার পর কয়েকজন শিক্ষার্থী বললেন, তাঁদের মোবাইল চুরি হয়েছে। তোফাজ্জলকে ঘিরে ধরে ছাত্ররা। শুরু হয় অতুলনীয়, অভূতপূর্ব সেই ব্যবহার, যে-ব্যবহার প্রায় আমাদের গা সওয়া হয়ে এসেছে। তোফাজ্জলকে ছাত্ররা কোনওরকম প্রমাণ ছাড়াই মারতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, তাঁর ফুফাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়াকে ফোনে বলেন, ‘তোফাজ্জল চুরি করতে এসে ধরা পড়েছেন, এখন ৩৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ জবাবে আসমা আক্তারের অনুরোধ ছিল, ‘তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন, তাঁকে আপনারা মাইরেন না। সন্দেহ হলে থানা-পুলিশের কাছে দিয়ে দিন।’ খিদে পেটে তোফাজ্জল একটু খাবার চেয়েছিলেন। ছাত্ররা তাঁকে ভাত-সবজি-মাছও খাওয়ায়। খাওয়া শেষ করে ভান ছাড়াই তোফাজ্জল বলেছিলেন, ‘আপনাদের এখানে খাবারের স্বাদ খুব ভাল।’ ভাতের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই সহজ স্বীকারোক্তি ছাত্রদের মধ্যে ন্যূনতম কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি।
হত্যার আগে দফায়-দফায় নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল আর জি কর হাসপাতালে। এখানেও দফায়-দফায় পিটিয়ে তোফাজ্জলকে মেরে ফেলতে অনেকটা সময় নেয় ছাত্ররা। কারণ কি শুধুই মোবাইল! মোবাইলের মনিটরে আমার মতো পর্যাপ্ত খাবারে পেটভর্তি প্রিভিললেজ্ড মানুষেরা আচমকা খেয়ালে সুইগি থেকে ফ্রায়ড রাইস অর্ডার করে থাকেন। মোবাইলে আজকের যুবক-যুবতীরা ক্রাইম থ্রিলার ওয়েব সিরিজে রাশি-রাশি নারকীয় সব হত্যা কত সহজে হজম করে নিয়ে নতুন মানসিকতায় নিজেদেরকে গড়ে তুলছেন রাতের পর রাত। হরর ফিকশন আর আজকের বাস্তবতার অন্তর্বর্তী ফারাক প্রতিদিন কি কমে আসছে! ছাত্র মানে তো শিক্ষার্থী! জানা নেই, ছোট বয়সে তাদের মধ্যে কেউ কি কখনও উচ্চারণ করেছিলেন, ‘…তুমি বলেছিলে, ধরণীতে সবে সমান পুত্রবৎ… তুমি চাহ নাই ধর্মের নামে গ্লানিকর হানাহানি, তলোয়ার তুমি দাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী… ক্ষমা করো হজরত।’
উৎসব মণ্ডল। মুখ ফসকে ‘মহম্মদ’ সম্পর্কে এমন কিছু বলে ফেলেছিলেন, যা এই সময়ে বাংলাদেশে বলা ঠিক নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পিটিয়ে থেঁতলে প্রায় মেরেই ফেলেছিল, শেষমেষ কোনওরকমে বেঁচে গিয়েছেন। খুব কম সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির সমাপতন এখানেই কিন্তু শেষ নয়।
বজবজ ই এস আই হাসপাতাল। রাতের ডিউটি শেষ করে পোশাক বদলাবার সময়ে কোনও একজন নার্স মেঝেতে কাগজ পড়ে থাকতে দেখেন। লাল কালিতে লেখা চিঠি। তাতে ঠিক এমনটাই লেখা—
‘আমার নাম সেখ সাহানুর
আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি
আমি তোমাকে পোথোম দেখাতেই ভালো সোফ লিছি
I LOVE YOU
আইডিটা আমার
ইন্সটা আইডি = LX SAHANUR
ফেসবুক আইডি = sk sahanur
রাজি থাকলে SMS কোরবে’
সঙ্গে-সঙ্গে শোরগোল পড়ে যায় হাসপাতালে। সুপার থেকে সকলকে ফোন করে ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়। মহেশতলা থানার পুলিশ আসে। চিঠিটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। প্রেম নিবেদন করার অপরাধে সাহানুরকে পাকড়াও করতে জরুরি তৎপরতায় মহেশতলা থানার পুলিশ ছানবিন শুরু করে। নার্সদের দল মহেশতলা থানায় গিয়ে সেখ সাহানুরের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেন। পুলিশ জানতে পারে, ভর্তি থাকা এক রোগীর সন্তানের নাম সেখ সাহানুর। সে গ্রেফতার হয়। জেরার মুখে পুলিশকে জানায়, সে লেখাপড়া শেখেনি। নার্সকে দেখে তার ভালো লেগেছিল। বন্ধুকে দিয়ে চিঠিটি লিখিয়েছে কারণ নার্সকে সরাসরি চিঠি দেওয়ার সাহস সে পায়নি। পুলিশ শেখ সাহানুরের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা রুজু করেছে। সাহানুরের বয়স চোদ্দো এবং সে মুসলমান। অতএব তার সঙ্গে ইসলামিক জঙ্গি দলের যোগ থাকতেই পারে!
বছর আট আগে তোফাজ্জল বাবাকে হারিয়েছিলেন। তিন বছরের মধ্যে মাকে। কাছের বলতে তখন দাদা। তিনিও গত বছর ক্যান্সারে মারা যান। একমাত্র প্রেম, সেটিও টিকল না। পর পর এতগুলো আঘাত সামলে উঠতে পারেননি তোফাজ্জল। মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেন। বন্ধ করে দেন পড়াশোনাও। রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। ভবঘুরের জীবন। চেয়েচিন্তে দু’মুঠো খাবার, জোগাড় হলে খেতেন, না হলে নয়। গেস্টরুমে যখন তাকে মারা হচ্ছিল, সেই বেধড়ক মারার দৃশ্যের যখন ছবি তোলা হচ্ছিল, ভিডিও করা হচ্ছিল জানালার বাইরে থেকে, তোফাজ্জল বার বার বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তিনি চোর নন, শুধু একটু খাবার চান।
যে-মেয়েটিকে তোফাজ্জল ভালোবেসেছিলেন, তাঁর বিয়ে হয়েছিল অন্য কোথাও। তোফাজ্জলের মতো প্রান্তিক আহত প্রেমিকের মন আর চোদ্দো বছরের নাবালক সাহানুরের প্রথম প্রেম! চিন্তা হয়, এই সহজ পবিত্র মানবিক লেনদেনগুলি অন্তর থেকে অনুভব করার মন কি ক্রমে হারিয়ে ফেলছি আমরা, না কি আমাদের মনন দিনের পর দিন আরও বেশি ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে! প্রেম সে হোক না গালিব, জীবনানন্দ, বেঠোফেন বা তোফাজ্জলের! প্রেম, সে তো প্রেমই। মিলেনার জন্য কাফকার লেখা চিঠির সে-কাব্য সাহানুরের চিঠিতে নেই। কিন্তু প্রেম-নিবেদন দু’ক্ষেত্রেই শতভাগ খাঁটি!
আরও চিন্তা হয়, হালের মাটি কামড়ে বসে থাকা উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক বিভাজনে আগাগোড়া আক্রান্ত এই পৃথিবীতে প্রেম, সহানুভূতি, একে অপরের সঙ্গে শর্তহীন যোগাযোগ, আদৌ অবশিষ্ট আছে কি না! শুধু জানি, আমাদেরই মধ্যে এখনও অনেক মানুষ আছেন, তাঁরা হিন্দু বলতে কেবল গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনস বা সাবির মল্লিকের হত্যাকারীদের বোঝেন না। খ্রিস্টান বলতে বোঝেন না, শুধুমাত্র জিওর্দানো ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার কারিগরদের। মুসলমান কথাটা কানে এলে, প্রতিশোধস্পৃহায় হিংসায় উন্মাদ তাঁরা হয়ে ওঠেন না কেবলমাত্র জামাত, ওয়াহাবি ছাত্রলিগ বা এ কে ফর্টিসেভেনের চেনা চেহারাটার কথা মাথায় এনে। বরং তাঁরা নিস্তেজ হয়ে পড়েন ইদানীংকালে, মানুষের প্রতি মানুষের পৈশাচিক নৃশংসতায়। ভাষা হারিয়ে ফেলে, হতবাক আমারই মতো তাঁরা দেখছেন, আসলে মানুষই মানুষকে মেরে ফেলছে ঠান্ডা মাথায়, আচমকা পরিকল্পনায়, ক্রোধে, উল্লাসে, বুক বাজিয়ে গর্বের সঙ্গে, নতুন স্টাইলে, কারণে, অভূতপূর্ব সব অজুহাতে।
সন্দেহ নেই, হত্যাকারীর এই মন দেশ-কালের পরিস্থিতি, সামাজিক সম্পর্কের, রাষ্ট্রীয় এজেন্ডার, এলিটগোষ্ঠীর সচেতন নির্মাণ। তবুও হত্যাকারী এই মানুষগুলির মনস্তত্ত্বের খুঁটিনাটি বুঝতে আমি অক্ষম, ভীষণভাবে অসহায়। এমন একটা কিছু আগামীতে আবারও ঘটে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনায় সন্ত্রস্ত হই, চোখে জলও আসে। সেই জল দুঃখের, কষ্টের হলেও তার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে নিছক নিবিড় এক ভয়।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র