তিনের দশকের শেষ দিক। ঔপনিবেশিক ভারতে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধীরে-ধীরে বাঁক নিচ্ছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে, দালি-লোরকা-পিকাসোর দেশে গৃহযুদ্ধ বেঁধে গিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদের দপ্তর ইউরোপে সেয়ানে-সেয়ানে ঘোর খেয়োখেয়ি দেখে অতি-আশাবাদীও ভাবতে বাধ্য হচ্ছে, আরেকটা যুদ্ধ বুঝি লেগেই গেল! অত বড় চীন দেশটাকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে পুঁচকে জাপান। বাংলায় বসে এ-মহাবিশৃঙ্খলার খবর ঠিকই রাখেন বিশ্ব-আদৃত আশি-ছুঁইছুঁই কবি। সাহিত্যসাধনা আপন নিয়মে অব্যাহত, ভাষার খেয়াল নিয়ে কাজ করছেন, থেকে-থেকে মেতে ওঠেন রং-তুলি নিয়ে, বিশ্বভারতী নিয়েও চিন্তার শেষ নেই। এর মধ্যেই জাতীয় মহাসভা থেকে স্নেহের সুভাষকে বার করে দিল বাঙালি-বিরোধী দক্ষিণপন্থীদের লবি, মহাত্মাজিও তাতে মদত দিলেন দেখে তাঁকে সরাসরি চিঠি লিখলেন, সুভাষকে ফেরানো হোক। এদিকে, ব্রিটিশ কারাগারগুলো ভরে গিয়েছে এক ঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ-তরুণীর ভিড়ে, তাদের মুক্তির জন্যও শুরু হল আন্দোলন— মহাত্মাজি, অ্যান্ড্রুজ সাহেব, নাতি সৌম্যের (সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর) সঙ্গে জুড়ে গেলেন তিনিও। কখনও-কখনও নিমন্ত্রণ আসে উত্তরের পাহাড় থেকে। কালিম্পং কিংবা মংপু। জীবনভর বহু দেশ ঘুরে আপাতত মংপুই তাঁর জীবন-সায়াহ্নের শিশির বিন্দু— ও-ডাকটি তাই আর উপেক্ষা করতে ইচ্ছে করে না।
সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের বড় কন্যা মৈত্রেয়ী দেবীর সাহিত্য-রচনা-প্রতিভা তখনও অবধি কবিতার আশেপাশেই ঘুরঘুর করে। ১৯৩০ সালে, সে-মেয়ের ষোলো বছর বয়সে, বেরিয়ে গিয়েছিল প্রথম কাব্যগ্রন্থ, নাম ‘উদিতা’; প্রকাশ করেছিল চক্রবর্তী-চ্যাটার্জির মতো প্রতিষ্ঠান। সুরেন্দ্রনাথের অনুরোধে সে-বইয়ের মুখবন্ধও লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যদিও কড়া সমালোচনা থাকার কারণে দীর্ঘ মুখবন্ধটির সে-অংশটুকু বাদ দিয়ে প্রথমদিকের প্রশংসা-সমৃদ্ধ অংশটিকেই ‘আশংসিকা’ নাম দিয়ে বইয়ে ছাপা হয়। ১৯৩৮ সালে বেরোয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটি, নাম ‘চিত্ত-ছায়া’, প্রকাশক মিত্র-ঘোষ।
সে-যুগে বাংলা কবিতায় যে-ধরনের রচনাশৈলী শুরু হয়েছিল, মৈত্রেয়ী দেবীর কবিতা তার ধার-কাছ দিয়েও যায়নি। সংস্কৃত-পণ্ডিতের মেয়ে হওয়ার কারণে আধুনিক কাব্যচর্চা তাঁর কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি, তার উপর একরকম পারিবারিক সূত্রেই তৈরি হয়েছিল আকণ্ঠ রবীন্দ্র-মুগ্ধতা (পরবর্তীকালে, সে-কথা অবশ্য স্বীকারও করেছেন)। ১৯৪৩ সালে ডিএম লাইব্রেরি থেকে ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ের প্রকাশ তাঁর জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। প্রথমত, কবিতার সীমাবদ্ধতা ছেড়ে বেরিয়ে তিনি হাত দিলেন গদ্যে, প্রকাশভঙ্গির বিশিষ্টতায় নির্মলকুমারী মহলানবিশ-রাণী চন্দ প্রমুখ ব্যক্তিত্বদের লেখনীর পাশে পাশেই নির্দিষ্ট হয়ে গেল তাঁর স্থান। দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্র-সখ্যের ধারাভাষ্যকার হিসেবে নিজস্ব এক ‘কমফোর্ট জোন’ পেয়ে গেলেন তিনি, যে-বুদ্বুদের মধ্যেই মোটামুটি আবর্তিত হবে তাঁর পরবর্তী সাহিত্যজীবন। তবে এ-দুইয়ের চেয়েও যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা তাঁর রবীন্দ্র-চেতনার স্বকীয় সংশ্লেষ।
ঘরোয়া আলাপচারিতা কীভাবে বিশ্ব-দর্শন হয়ে দাঁড়ায়, তার সার্থক রোজনামচা ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’। ঘটনা-বৃত্তান্ত যেভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন মৈত্রেয়ী দেবী, তাতে শুধু তাঁকে ‘ব্যাসদেবের গণেশ’-মার্কা কোনও অনুলেখক ভাবলে অবশ্য ভুল হবে। এখানেই ওই পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লেষের প্রশ্ন। সমকালীন ঘটনাকে আশি-ছুঁইছুঁই রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দেখছিলেন, পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের মৈত্রেয়ীর পক্ষে সেভাবে দেখা সম্ভব ছিল না। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ যে-মন নিয়ে জাপানিদের ফুল সাজানোর সারল্যের প্রশংসা করেন, সেই মনেই আবার জাপানি কবি নোগুচিকে লেখা চিঠিতে চীন-আক্রমণের প্রশ্নে ধিক্কার দেন, বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় ওই ‘লোকোত্তর’ মনটাকে বুঝতে চাওয়ার একটা সৎ চেষ্টা থেকেই অমন সহজ গদ্যে ভরে উঠেছিল মৈত্রেয়ীর প্রথম গদ্যবই।
মংপু-পর্ব থেকেই দেখা যাচ্ছে, মৈত্রেয়ীর কর্ম-পরিসরও ধীরে-ধীরে প্রশস্ত হচ্ছে। কলকাতার সংস্কৃতিজগতের সান্নিধ্যে যে-মেয়ের বড় হওয়া, মংপুর নির্জনতা তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠত; সে-অবস্থা থেকেও মুক্তির মন্ত্র তাঁকে দিয়ে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথই। মৈত্রেয়ীরা এক সময়ে মংপুতে গড়ে তুলছেন ‘রবীন্দ্র-স্মৃতি শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্র’, সংগঠনের ছাতার তলায় এসে জড়ো হচ্ছেন পাহাড়ি মানুষজন, তাঁদের মধ্যে মিশে যাচ্ছেন অজ্ঞাত রবীন্দ্রনাথ। ১৯৫১ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা নিবন্ধের সংকলন নিয়ে বেরোচ্ছে ‘কবি সার্বভৌম’— এই ঘরানার দ্বিতীয় বই। ১৯৫৫ সালে মৈত্রেয়ী দেবীর স্বামী, মংপুর কুইনাইন নিষ্কাশন প্রকল্পের বড়কর্তা, রসায়নবিদ মনোমোহন সেন অবসর নিয়ে চলে এলেন কলকাতায়, আর সে-বছরই সুইৎজারল্যান্ডের লোজানে বামপন্থী সংগঠন উইমেন’স ইন্টারন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশন আয়োজিত বিশ্ব মাতৃ সম্মেলনে যোগ দিতে গেলেন মৈত্রেয়ী দেবী। সম্মেলন-শেষে আমন্ত্রণ পেলেন সোভিয়েত যাওয়ার। সঙ্গীদের তালিকায় অরুণা মুন্সী, মণিকুন্তলা সেন, লেক গার্লস স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রী সুষমা সেনগুপ্ত। জোসেফ স্তালিনের জমানা ততদিনে শেষ হয়েছে, মহাযুদ্ধ-পরবর্তী পুঁজিপতি দুনিয়ায় সোভিয়েত সম্পর্কে উড়ে বেড়ায় হরেক কিসিমের ‘হরর স্টোরি’, যার সম্মোহন থেকে মুক্ত ছিলেন না মৈত্রেয়ী দেবী নিজেও— সেই মানুষই কিনা সোভিয়েতের বিপুল কর্মযজ্ঞ দেখে ফিরে এসে, গুরুর অনুসরণেই লিখে ফেললেন ‘মহা সোভিয়েট’, রবীন্দ্র-অনুরাগী ভেরা নভিকোভাকে নিঃস্বার্থ সাহায্য করলেন রবীন্দ্র-সাহিত্যের রুশ অনুবাদের কাজে।
১৯৬৩ সালের শেষ দিক। ততদিনে রবীন্দ্র-শতবর্ষ উদযাপন হয়ে গিয়েছে, মৈত্রেয়ী দেবী আরও একবার রাশিয়ায় ঘুরে এসেছেন। এদিকে, ভারতীয় ভূখণ্ডে কমিউনিস্ট-বিদ্বেষের মাত্রাটা আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে গায়ে-গায়েই ঘটে গিয়েছে চীন-ভারত যুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টিরও ভাঙব-ভাঙব অবস্থা। ২৭ ডিসেম্বর কাশ্মীরের শ্রীনগরে হজরৎবাল মসজিদে সংরক্ষিত হজরতের দাড়ির অংশ চুরি গিয়েছে বলে শোরগোল উঠল। দিন আষ্টেক বাদে সে-চুল খুঁজেও পাওয়া গেল দিব্যি। কোথায় পাওয়া গেল বা কীভাবে পাওয়া গেল, সে-কথা কেউ জানে না— হারানো রত্ন ফিরে এসেছে, অতএব, উত্তেজনা থিতিয়ে এল সহজেই।
নিয়মমাফিক ধরপাকড় চললেও সাম্প্রদায়িক হানাহানির যে-আশঙ্কা ছিল, তেমন কোনও ঘটনা কাশ্মীরে ঘটেনি, সে-ঘটনা ঘটল দেড় হাজার মাইল দূরের খুলনায়। নতুন বছর শুরুর সপ্তাহেই (৩ জানুয়ারি ১৯৬৪) সংখ্যালঘু বাঙালি হিন্দুরা আক্রান্ত হলেন, তাঁদের বাঁচাতে গিয়ে পার পেলেন না তাঁদের মুসলমান বন্ধুরাও— আমীর হুসেন, কাজী রউফ, এমদাদ খাঁ-র মতো কয়েকটি অকিঞ্চিৎকর শহিদ-নাম ঠাঁই পেয়ে গেল উপমহাদেশের সম্প্রীতি-আখ্যানের পাতায়। খুলনাই শুধু নয়, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালি, যশোর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, পূর্ব পাকিস্তানের একাধিক বড় শহরেই আক্রমণের পুনরাবৃত্তি। আক্রমণের খবর কলকাতায় এসে পৌঁছল ৯ জানুয়ারি— যত না খবর, তার চেয়ে বেশি গুজব। আমীর হুসেনদের আত্মত্যাগের খবর অবশ্য ছড়ানোর প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। এমন একটা গুজবের কথা মৈত্রেয়ী দেবী লিখছেন তাঁর ‘এত রক্ত কেন?’ বইতে:
‘১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে একদিন গড়িয়াহাটার মোড়ে গাড়ি আটকেছে, হঠাৎ দেখা একজন পরিচিতা মহিলার সঙ্গে। তিনি উচ্চশিক্ষিতা এবং কমিউনিস্ট বাড়ির মেয়ে তো বটেই, নিজেও কমিউনিস্ট। তিনি গাড়ির মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে বললেন— ‘আজকের খবর শুনেছেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে ট্রেন এসেছে, তা রক্তে ভাসছে, (ধরেই নেওয়া হয়েছে তা মানুষের রক্ত) আরমাছের ঝুড়ি খুলে দেখা গেছে শুধু মানুষের মাথা, মাছ নেই, ঝুড়ি ঝুড়ি মানুষের মাথা।’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম এরকম ভাবে নিজেদের অপরাধের চিহ্ন পাঠাবে কেন, কি লাভ?’
ঠিক পরদিনই, অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি, আক্রমণের শিকার হলেন সংখ্যালঘু মুসলমান মানুষজন। ’৪৬-এর ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর বাস্তবতা এক্ষেত্রে তুলনীয় নয়, কারণ, আক্রমণ পুরোটাই একতরফা ভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। বেহালায় এক মুসলমান দর্জির খুন হওয়ার খবর এল। দমদমে এক কাপড় ব্যবসায়ী মাপে কম দেওয়ায় তাঁকে ধরে উত্তম-মধ্যম দিল ‘গর্বিত হিন্দু’ জনতা, কলকাতার পাড়ায়-পাড়ায় চালু হয়ে গেল গণধোলাইয়ের নতুন প্রতিশব্দ, ‘দমদম দাওয়াই’। বালিগঞ্জ, রাজাবাজারের বস্তি এলাকায় রাতবিরেতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে বীরপুঙ্গবরা, পেট্রোল-ভেজানো কাপড়ের পুঁটুলি ছুড়ে মারার সময়ে স্লোগান তুলছে ‘বন্দেমাতরম’।
একদিন চেনা রাজমিস্ত্রি করিমকে মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর বালিগঞ্জের বাড়ির দরজা থেকে দেখলেন, ঘাসবাগান বস্তি আক্রমণ হয়েছে শুনে লাঠি নিয়ে দৌড়ে যেতে; কিছু পরেই দেখলেন তার নাতিকে, কচি গলায় ‘নানা কোথায়, নানা কোথায়?’ বলতে-বলতে ভয়চোখে ছুটছে সে। শিশুটির কথা ভেবে আবারও ফিরছেন কবিতায়— ‘ছোট্ট ছেলেটি দেখছি গলির পাশে—/আবছা দৃষ্টি কাঁপছে অজানা ত্রাসে/মৃত্যুর চেয়ে দণ্ড এ মৃত্যুর/করাল শঙ্কা আরো বেশি নিষ্ঠুর।’ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তখন জাতীয় কংগ্রেসের প্রফুল্লচন্দ্র সেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হল তাঁর পুলিশ-প্রশাসন। কলকাতা ছাড়াও নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনার পকেটে পকেটে মুসলমান-পীড়ন চললও অবাধে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারীলাল নন্দার কড়া পদক্ষেপে ১৫ জানুয়ারিতে সংঘর্ষ থামার আগে অবধি শুধু কলকাতাতেই, সরকারি হিসাব মতে, নিহতের সংখ্যা ছুঁয়ে ফেলল একশো।
পুলিশ-প্রশাসনের চেয়েও চূড়ান্ত অপদার্থতার পরিচয় দিয়েছিল এ-বঙ্গের প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমকুল। মৈত্রেয়ী দেবী বা গার্গী চক্রবর্তী (ইতিহাসবিদ; স্বাধীনতা সংগ্রামী ও অধ্যাপক শান্তিময় রায় এবং সাহিত্যিক সাবিত্রী রায়ের কন্যা), এমন অনেকের লেখাতেই পাচ্ছি, সে-সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের ‘সংবাদ’, ‘আজাদ’, ‘ইত্তেফাক’ বা ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’ এ-ধরনের সংবেদনশীল খবর পরিবেশনে যে-দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়েছিল, তার সিকিভাগও এদিককার ‘কাগুজে বাঘ’-রা রাখেনি; উলটে গুলজারীলাল নন্দার উদ্যোগকে হেয় করে ছাপা হয়েছে ‘কলিকাতাকে শায়েস্তা করার জন্যই কেন্দ্রীয় নেতাদের মহানগরে পদার্পণ’-এর মতো শিরোনাম। সঙ্গে মাসিক পত্রিকায় সাম্প্রদায়িক গল্প-কাহিনি ছাপিয়ে তারা যেন মজা লুটতে ব্যস্ত। ‘এত রক্ত কেন?’-তে মৈত্রেয়ী দেবী তো নামোল্লেখ না করেও প্রায় সরাসরিই বাংলার দুই প্রখ্যাত ঔপন্যাসিককে আক্রমণ করেছেন, মুসলিম-দ্বেষে দুষ্ট গল্প-রচনার অভিযোগে। এই দুজনের একজন ‘মহামানব কেনারাম ও ক’ গল্পের গল্পকার বনফুল, আরেকজন ‘লাল কেল্লা’ উপন্যাস-রচয়িতা প্রমথনাথ বিশী। ‘মহামানব কেনারাম ও ক’-এর জবাব হিসেবে মৈত্রেয়ী দেবী নিজেও আরেকটি গল্প লেখেন, যেটি হীরেন বসুর ‘দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
প্রতিরোধ অবশ্য থেমে ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানদের মতোই এপারেও বিপন্ন প্রতিবেশীদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে দাঙ্গাকারীদের টার্গেট হয়ে গেলেন অনেকেই। গার্গী চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণায় (Coming Out of Partition: Refugee Women of Bengal বইয়ের ‘The 1964 Calcutta Riots Through the Eyes of a Teenager’ অধ্যায়) উঠে আসছে, ১০ জানুয়ারির রাতে তাঁদের গড়ফা রোডের বাড়িতে আশেপাশের বিবেকনগর কলোনি, শহিদনগর কলোনি, আরফান কলোনির মুসলমান মানুষজন এসে আশ্রয় নিচ্ছেন, আর ১১ তারিখ সকালেই রাস্তার মোড়ে পোস্টার পড়ছে— ‘মহম্মদ শান্তি রায়ের গর্দান চাই’। দরজায় বোমা মেরেও বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মুসলমান-দরদ দেখালে বিপদ আছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেক্টর ত্রিগুণাচরণ সেনের হস্তক্ষেপে সে-যাত্রা তাঁরা উদ্ধার পাচ্ছেন।
এহেন ব্যক্তি-উদ্যোগ তো ছিলই, সঙ্গে জুড়েছিল বৌদ্ধিক সমাজের নানা পেশার মানুষজনের সামাজিক উদ্যোগ। গুলজারীলাল নন্দার ডাকা সভায় মৈত্রেয়ী দেবী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন চিন্মোহন সেহানবীশ, উমা সেহানবীশ, সত্যেন মৈত্র, রেণু চক্রবর্তী-সহ আরও অনেকে। সকলকে এক ছাতার তলায় আনার জন্য একটি সাধারণ পরিষদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। যা ভাবা, সেই কাজ। মনোমোহন সেন ও অমিয় গুপ্তের সঙ্গে মিলে লিখে ফেললেন স্মারকলিপি— সম্প্রীতি প্রচারের ইস্তেহার। তাতে প্রথম সই করলেন রবীন্দ্রভারতীর তৎকালীন উপাচার্য হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিতীয় সত্যজিৎ রায়। প্রস্তাবিত প্ল্যাটফর্মটির নাম ঠিক হয়েছিল, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ’, ইংরাজিতে ‘Council for Promotion of Communal Harmony’, সংক্ষেপে CPCH। কংগ্রেসি, কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, এমন নানা মতাদর্শের মানুষজনকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল এ-সংগঠন, কিন্তু উদ্দেশ্য রাজনৈতিক সংকটের মোকাবিলা— সাধারণ সম্পাদিকা মৈত্রেয়ী দেবী তাই শুরুতেই স্পষ্ট করে দিলেন, পরিষদ ‘নির্দলীয়’ হলেও তিনি ‘রাজনৈতিক’।
নারায়ণ চৌধুরীর লেখা (‘নবজাতক’ পত্রিকার নবম বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘মিলন সাধনা’ কলামে প্রকাশিত ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদের ইতিহাস’) থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৬৪-র ৩০ জানুয়ারি পরিষদের আনুষ্ঠানিক সূচনা, তবে প্রথম প্রকাশ্য সভা বসেছিল ৩ মার্চ (এই মাসেই ওড়িশার রাউরকেলাতেও খুলনার প্রতিশোধ নিতে মুসলিম-পীড়ন শুরু হয়), প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের ভবনের দোতলার হলঘরে। সভাপতি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিধুভূষণ মল্লিক। বক্তৃতা দিয়েছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, স্বামী রঙ্গনাথনন্দ, জাস্টিস সাদত আবুল মাসুদ, সতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা। যদিও, এর দু’দিন আগে, ১ মার্চ, মহাবোধি সোসাইটি হলে একটা ছোটো জনসভা হয়, যেখানে মৈত্রেয়ী দেবী ছাড়াও ছিলেন ট্রেড ইউনিয়নের নেত্রী মৈত্রেয়ী বসু, অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু, অধ্যাপক আবু সয়ীদ আইয়ুব, জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ। ৩ মার্চের পরের সভা বসেছিল ১২ এপ্রিল ১৯৬৪, পরিষদের দপ্তরে। ঠিকানা— ১৩/১, পাম এভিনিউ, কলিকাতা ১৯। পরের মাস থেকে (১৩৭১-এর জ্যৈষ্ঠ) মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর সম্পাদিত দ্বিমাসিক ছোটো পত্রিকা ‘নবজাতক’ প্রকাশ করা শুরু করেন, সে-পত্রিকারও ঠিকানা ছিল এই পাম এভিনিউতে।
উপনিবেশ-উচ্ছিষ্ট কলকাতায় তখন নতুন করে শুরু হয়েছে উদ্বাস্তু-স্রোত, ওদিকে ‘আধা-সামন্ততান্ত্রিক’ গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে তলে-তলে আয়োজন চলছে অগ্নি-সংযোগের। এমন অবস্থায় বিভিন্নভাবে সক্রিয় থেকেছে পরিষদ। যুক্ত হয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর কলকাতার তাবড় বুদ্ধিজীবী-মহল— অন্নদাশঙ্কর রায়, গৌরী আইয়ুব, সতীশচন্দ্র দাশগুপ্ত, গোপাল হালদার, পান্নালাল দাসগুপ্ত, সমর বাগচী, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, কে নন!
‘নবজাতক’ পত্রিকা ক্রমে হয়ে উঠছিল পরিষদের মুখপত্র। দুই বাংলার চিন্তাশীল মানুষদের লেখা ছাপা হচ্ছে। হীরেন বসুর ‘দর্পণ’, পান্নালাল দাসগুপ্তের ‘কম্পাস’, সমর সেনের ‘Now’-‘Frontier’-এর পাশাপাশিই তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই পত্রিকা। অন্যান্য পত্র-পত্রিকাতেও নিয়মিত লিখছেন মৈত্রেয়ী দেবী। দিল্লি থেকে নিখিল চক্রবর্তী-সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘Mainstream Weekly’-তে ১৯৬৪-র ১ আগস্ট প্রকাশিত হল তাঁর লেখা ‘Writers Run Riot’ নামের একটি নিবন্ধ, বছরভর লেখা তাঁর বাংলা প্রবন্ধের একটি সংকলন প্রকাশ করল মনীষা গ্রন্থালয়, সোজাসাপ্টা নাম দিলেন বইটির, ‘উনিশ শ চৌষট্টি সাল’।
দুই বাংলার রাজনীতি ক্রমশ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে যাচ্ছিল। বাংলা কংগ্রেস আর সিপিআই (এম) মিলেজুলে যুক্তফ্রন্ট গড়ল, সে-ফ্রন্টও পড়ে গেল। দু’বছর পরে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট। ওদিকে উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়ির নাম রাতারাতি শিরোনামে। পুলিশি বর্বরতার ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ছেন সমবয়সি মৈত্রেয়ী দেবী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে সভা করতে গেলে হুমকি ফোন আসছে শিক্ষাবিদ অম্লান দত্তের উপস্থিতিকে উপলক্ষ্য করে, সভা করার অনুমতি দিতে পারছেন না ভীত উপাচার্য হেমবাবু। ওদিকে প্রকাশনার কাজও বন্ধ নেই। নবজাতক প্রেস থেকে বেরোল দুখানি বই। গান্ধী-শতবর্ষ উপলক্ষ্যে, ১৯৭০ সালের মে মাসে বেরোল ‘গান্ধী-দর্শন’, আর ওই বছরেরই আগস্ট মাসে পূর্ব পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকদের লেখা নিয়ে বেরোল ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রবন্ধ সংগ্রহ’; দুটিরই সম্পাদনা করলেন মৈত্রেয়ী দেবী। পরিষদের নীতি মেনেই এ-বইদুটিতে এসে মিলল বিচিত্র মতাদর্শের প্রগতিবাদী সুর।
ওদিকে, ১৯৭০-এর ৩০ ডিসেম্বর, মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেই হেমবাবুর পরে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য গোপালচন্দ্র সেনকে সন্ধের অন্ধকারে ছুরি মেরে হত্যা করছে অজানা (কিংবা জানা) আততায়ী, তিনদিন পরে ওখানেই প্রতিবাদ-সভা করছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ, জোর গলায় প্রতিবাদ জানাচ্ছেন বছর ছাপ্পান্নর প্রবীণা।
১৯৭১। মার্চ। ঢাকায় সুপরিকল্পিত হত্যালীলা চালাল পাকিস্তান সরকার। শরণার্থীদের স্রোত এবার ঢেউয়ে পরিণত হল। ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ’-এর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িয়ে গেল স্বাধীন বাংলাদেশের দাবি। ইতিমধ্যে মুজিবনগরের ঘোষণা হয়েছে, রেডিয়ো বাংলাদেশ চালু হয়েছে, প্রায় প্রতিদিন কলকাতা উপচে পড়ে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের ভিড়ে। পাকিস্তান সরকারের তীব্র দমন-পীড়নকে উপেক্ষা করেই গড়ে উঠছে সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রতিরোধ। চট্টগ্রাম-জাতক মৈত্রেয়ী সে-ডাক এড়ান কী করে! বর্ডারে-বর্ডারে ক্যাম্প— জিপ গাড়িতে সেসব ক্যাম্পে ঘুরে বেড়ান, বেশিরভাগ সময়েই সঙ্গী গৌরী আইয়ুব। ‘Council for Promotion of Communal Harmony’ লেখা ব্যানার দেখে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সাধু ব্যঙ্গ করেন। বালিগঞ্জের বাড়ি-লাগোয়া স্কুলবাড়িতেও দিব্যি গজিয়ে উঠল একটা আশ্রয়শিবির, সেখানে এলেন জহির রায়হান, এলেন বিলায়েত হোসেন। নবজাতকের প্রেস থেকে পত্রিকার পাশাপাশি ছাপা হচ্ছে আওয়ামী লিগের ইস্তেহারও। বাড়ির বসার ঘরে সন্ধেবেলা প্রায়ই বসে কবিতা-পাঠের মনোরম আসর। এর মধ্যেই ছুটকো-ছাটকা ঘটনা ঘটে যায়। জহির রায়হানের ফিল্ম চুরি হয়ে গেল। ক্যাম্পে ঘোরার সময়ে খবর এল, বয়রা ক্যাম্পের অমন উজ্জ্বল দিলীপ বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে দাঙ্গাবাজদের হাতে নিহত হয়েছে। উদ্বাস্তু-ঢেউয়ে নুড়ি-পাথরের মতো ছিটকে এসে পড়ছিল ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা একলা, অনাথ, নামগোত্রহীন। কল্যাণীর ক্যাম্পে তাদের নিয়ে আশ্রম গড়ে তুললেন মৈত্রেয়ী দেবী, নাম দিলেন ‘খেলাঘর’। মোটামুটি এই সময়েই সংগঠন হিসেবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়, এমনটাই ধারণা। তবে, এক সময়ে দুর্গাপুর থেকে প্রকাশিত ‘জলপ্রপাত’ পত্রিকার ১৯৮৯ সালের ‘মৈত্রেয়ী দেবী সংখ্যা’-য় এই সংস্থা সম্পর্কে লেখা আছে— ‘একটি মুদ্রিত ফর্ম পূর্ণ করে সাধারণ মানুষও এর সদস্য হতে পারেন। বার্ষিক চাঁদা মাত্র ৬ টাকা।’ লেখার ভাষা থেকে পরিষ্কার, এ-সংগঠন সম্ভবত তখনও, অর্থাৎ, আটের দশকেও সক্রিয় ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ থামল ’৭১-এর ডিসেম্বরে। সরকারি নির্দেশে ’৭২ সালে ‘খেলাঘর’-এর শিশুদের নিয়ে ঢাকায় চলে গেলেন মৈত্রেয়ী দেবী। পরে, ফিরে এসে এখানকার শিশুদের জন্য মধ্যমগ্রামের কাছে বাদুতে জমি কিনে শুরু হল খেলাঘর আশ্রম, সালটা ১৯৭৩। ছিমছাম গ্রাম্য পরিবেশে গড়ে উঠল শিশুদের আবাস, বাঁধানো হল উন্মুক্ত পড়াশোনার প্রাঙ্গণ, সঙ্গে বাগান, চাষবাসের আয়োজন— ভাবনায় অবিকল সেই শান্তিনিকেতন। সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথকে ছাড়তে চাননি, রবীন্দ্রনাথকে ভাঙিয়ে খ্যাতি কি না, প্রশ্নের উত্তরে অকপটে স্বীকার করতেন, ‘উনি ছাড়া আমার খ্যাতি কী করে হবে!’ মৈত্রী-রক্ষায় তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম কিংবা খেলাঘর গড়ে তোলা, সবই যেন ওই স্বীকারোক্তিটির স্পর্ধাতেই ভাস্বর।
ছবি সৌজন্যে : লেখক