ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৪৩


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (September 28, 2024)
     

    রণেন

    বিয়ে একটা হল বটে রণেনের। পিতৃদায়, কালাশৌচ বা রমিতার বাবার আপত্তি— কোনও কিছুই আর মানলেন না তরুলতা। যথেষ্ট গোপনীয়তা বজায় রেখে, নিজের দুই মেয়ে, গুরুদেব ধরণীধর পণ্ডিত, কুলপুরোহিত এবং নাপিত ফকিরের সাহায্য নিয়ে রমিতাকেই বউ করে ঘরে তুললেন তিনি। বিয়ে হল মেজো মেয়ের বাড়ি মাঝদিয়া থেকে। মেজো জামাইটি খুবই ভারসহা এবং একেবারেই গেরস্ত-পোষা মানুষ। ইলার এই বিয়ে তরুলতার শ্বশুরমশায়ই দিয়ে গিয়েছিলেন। যোগাযোগ হয়েছিল হরশঙ্করের সূত্রে। মেসে থাকবার সময়ে, আমহার্স্ট স্ট্রিট পোস্ট অফিসের যে-পোস্টমাস্টারটি হরুকে খুব সাহায্য করতেন, মেজো জামাই তাঁরই ছেলে। একটি সন্তান নিয়ে বিপত্নীক; সে-কারণেই কুরূপা মেজো মেয়ে ইলার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অমন এক রূপবান ছেলের। মোটা টাকা পণ এবং সন্তান-সহ ওই দোজবরের সঙ্গে ইলাকে জুতে দিতে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন তরঙ্গনাথ। পরে সবই মেনে নিয়েছিলেন এবং মেজো জামাইয়ের আগের পক্ষের ছেলে কোনওদিন জানতেও পারেনি যে, এটা তার নিজের মামার বাড়ি নয়। পরে আরও চারটি সন্তান হয় ইলার। পোস্ট-অফিসের পাকা চাকরি এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্বামী পেয়ে, মন জুগিয়ে সংসার সামলেছে ইলা। ‘ক্যালকেশিয়ান’ ছোট জামাইটি, রণেনকে যেমন প্রকাশ্যেই কটূক্তি করেন, মেজো জামাইয়ের ব্যবহারে তেমনটা কক্ষনো প্রকাশ পায়নি। রমিতাকে দেখে খুবই আদর করেছিলেন তিনি। বিয়ে করে বউ নিয়ে খোকা ফিরে এল সোদপুরে। শুরু হল আর এক জীবন। সংসারের চাবির গোছাটি রমিতার আঁচলে বেঁধে দিয়ে, একেবারে নির্ভার হয়ে গেলেন তরুলতা।

    রণেন আর রমিতা একেবারে ভেসে গেল আনন্দে। চেনা পাড়ার পথে-পথে বেড়িয়ে, অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে, মধ্যরাত অবধি বাঁশি আর গানে মেতে থেকে যেন এক নতুন জোয়ার এল রণেনের জীবনে। রণেন মেতে উঠল নিত্যনতুন ছবি আঁকায়; এমনকী কাজের খোঁজেও বেরোতে লাগল রনু। তারই মধ্যে চলতে লাগল, পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে নাটক আর মণিমেলা। হঠাৎ করে কিছু ইলাস্ট্রেশনের কাজ এসে যাওয়ায়, সেসব জমা দিতেই টাকা পেল রনু। তার সেই প্রথম রোজগারের টাকায় দুটো সাইকেল কেনা হল। রনুর পাশে, লেডিস সাইকেলে মিতা। মিতার স্বভাবগুণে সেসব মেনেও নিলেন গুরুজনেরা। তরুলতা ভাবতেন যে, মিতাই হয়তো পারবে রনুকে চাকরিতে পাঠাতে। তরুলতা জানতেন যে, খোকা কেন ‘বোম্বাই’ ছেড়ে চলে আসে। খুব বড় আঘাত সে পেয়েছিল ললিতার কাছে। সম্পন্ন এবং শিক্ষিত ঘরের ওড়িয়া মেয়ে ললিতা; কটকেই আলাপ খোকার সঙ্গে। ওর সঙ্গেই সে পড়তে যেতে চেয়েছিল, কলাভবনে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে; ললিতা চলে গেলেও খোকার যাওয়া হল না। তার ওপরে ভবিষ্যতে রোজগারের উপায় হবে, তাকে পড়তে হল কমারশিয়াল আর্ট; এ তার কোনওদিন ভাল লাগেনি। তরুলতা লক্ষ করেছিলেন যে ভারি মিল হয়েছিল দুটিতে; কিন্তু দুজনে দু’দিকে ছিটকে পড়ায় বিচ্ছেদ হয়ে গেল রনু আর ললিতার। বেশ কয়েক বছর পরে খোকার সঙ্গে আবার তার দেখা হল, বোম্বাইতে। তখন সে বিবাহিত এবং মস্ত এক বিজ্ঞান-গবেষক গুজরাতির বউও; কিন্তু একেবারেই সুখী হয়নি ললিতা; খোকার কাছে সব শুনে তরঙ্গনাথ রাজিও হয়েছিলেন, ললিতা ডিভোর্স নিয়ে এলেই খোকার সঙ্গে তার বিয়ে দেবার। দুজনে মিলে ঠিকও তো করে ফেলেছিল নিজেদের রুটিরুজির; বোম্বেতে থেকেই কীভাবে শুরু করবে, ডিজাইনিং ফার্ম। দুজনে মিলে লেগে পড়েছিল গুজরাত, উড়িষ্যা এবং বাংলার গ্রামীণ-নকশা উদ্ধারের কাজেই। এর মধ্যে হঠাৎই খোকা জানতে পারে যে, ললিতা সন্তানসম্ভবা; এই মিথ্যাচার মেনে নিতে না পারায়, রাগে উন্মাদ খোকা সেদিনই ফেরার টিকিট কাটে। বহু কষ্টে ছেলেকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনেন তরঙ্গনাথ এবং তরুলতা। সেই থেকেই ছেলেকে আর কোনও রকম জোরাজুরি করেননি তরুলতা। মিতার সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর থেকেই,  প্রায় বছর-দশেক পর আবার যেন সেই খোকাকে ফিরে পেয়েছিলেন তাঁরা।

    তবে বিয়ের পর রমিতার হাল দেখে তরুলতার বুক যেন ফেটে যেত। তাঁর সধবাবেলার শাড়িগুলি পরলেও ব্লাউজ পাবে কোথা থেকে! শ্বশুরের বড়-বড় পাঞ্জাবি কেটে নিজের মাপের ব্লাউজ বানিয়ে নিত মিতা; কোনও কিছু নিয়েই যেন অভিযোগ নেই তার। অত বড় সরকারি চাকুরে তরঙ্গনাথের একমাত্র ছেলের বউ হিসেবে কত না আদর পাওয়ার কথা ছিল! সেখানে সে এল দুঃখের ভার বইতে; তরুলতা মনে-মনে ভাবেন, যতদিন এই ছেলেমানুষি থাকে, ততদিনই ভাল। ঘোর কেটে গেলেই তো সংসারটাই উড়ে-পুড়ে যাবে। চাকরি না করে, শুধুই ছবি এঁকে যে কী করে দাঁড়াতে হয় তরুলতার জানা নেই। তাঁর মনে পড়ে, তরঙ্গনাথের কত না ইচ্ছে ছিল যে, ছেলে পাশ করলেই তাকে প্যারিসে পাঠাবার! খোকার আর্ট কলেজে, প্যারিস-ফেরত প্রিন্সিপাল বসন্ত গাঙ্গুলিও তো তেমনই ভেবে রেখেছিলেন। কিন্তু খোকা তো কোনওদিনই সে-স্বপ্ন দেখেনি। হয় মাঠে-ঘাটে-বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো, নয়তো ঘরে বসে দিনরাত এক করে ছবি আঁকা। অবসর নেবার আগেই তো খোকার এই স্টুডিওঘরটা বানিয়ে দিলেন তরঙ্গনাথ। কটক থেকে গাড়ি চালিয়ে একাই চলে আসত খোকা; কীভাবে যে খোকা দিনের পর দিন একা-একা থাকতে পারে, সেটা একমাত্র সে-ই জানে। তরুলতার মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে এই ভেবে যে, খোকা পুরোপুরি স্বাভাবিক তো! শ্মশান থেকে মড়ার খুলি কুড়িয়ে এনে সাজিয়ে রেখেছে। তার আঁকা ছবিগুলোতেও কেমন যেন ভূতুড়ে ভাব! অথচ ঠাকুরদেবতা বা গাছপালার ছবিগুলো আবার একেবারে অন্যরকম। স্বভাবেও সে বিচিত্র। রেগে গেলে আর রক্ষে নেই; পরক্ষণেই শান্ত হয়ে কত আদর করবে! তরুলতা এও লক্ষ করেছেন যে, রনু আর মিতার মধ্যে ভাব বেশ ঘন হলেও, মিতা যেন একটু ভয়ও পায় খোকাকে। বিশেষত তার বাপের বাড়ির কথা উঠলেই। চাপা স্বভাবের মিতা চুপ করে  থাকলেও মনে-মনে কি আর গুমরোয় না! রাধাকান্তকে ডাকা ছাড়া আর কীই-বা করার আছে তরুলতার!


    পাড়ার ইশকুলে চাকরি নেওয়ার জন্য প্রায় যেচে প্রস্তাব এল, রমিতার কাছে। রণেনের তো মাথায় হাত! রমিতা এবং তরুলতার আগ্রহে তা মেনেও নিল রণেন। তরঙ্গনাথের অনেক দান আছে এই ইশকুলে। ট্রাস্টিবোর্ডেও তো আমৃত্যু নাম ছিল তরঙ্গনাথের। হরশঙ্করের বড় ছেলে মারফত এই প্রস্তাব আসায়, এক কথায় তা যে মেনে নিলেন তরুলতা, সেও তো এই এক যুক্তিতেই। বিড়বিড় করে বললেনও বোধ হয় যে, ‘সবই তাঁর আশীর্বাদ’। রণেনেরও কাজ আসত লাগল, প্রকাশক এবং পত্রপত্রিকার সম্পাদকদের কাছ থেকে। টাকা সামান্য হলেও নিয়মিত কাজ পাওয়া যাবে। রমিতার কাজে খুশি হয়ে ইশকুল থেকেই তাকে বিএড পড়তে পাঠানো হল, সবেতন ছুটি মঞ্জুর করে। কলকাতার হস্টেলে থেকে পড়তে হবে। নিজের থেকে টাকা বার করে তাকে ভর্তি করে দিয়ে এল রণেন। কিন্তু মিতা কাছে না থাকায় তার মেজাজ গেল বিগড়ে। অনিয়মিত হয়ে যেতে লাগল ফরমায়েশের কাজগুলো। রণেন বুঝতেই চায় না যে, এই সামান্য কাজের জন্যেও কত লোক যে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে! এসব কাজ তো আর কোনওরকমে টিকিয়ে রাখা যায় না; নিয়মিত জোগান এবং বাতিল করতে-করতেই এগোতে হয়। মিতার কিছু টাকা লাগবে জেনেই, রং-তুলি কেনা স্থগিত রেখে সে পাঠিয়েও দেয় মানিঅর্ডার করে। নিজের ছবি আঁকার সময় হচ্ছে না ভেবে, মাঝে মাঝেই ঝিমিয়েও পড়ে অবসাদে। দাঁতে দাঁত কামড়ে স্থির হয়ে সাংসারিক সব কাজ একমাত্র যিনি করে চলেন, তিনি হলেন তরুলতা।

    ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বিএড পাশ করে আসতেই ইশকুলে তার প্রোমোশন হল। মাস গেলে নিয়মিত টাকা আসায় সংসারের অভাবও যেন একটু হলেও বাগে এল। তরুলতা কাকে দিয়ে যেন দুখানা নতুন শাড়ি, ছাতা এবং জুতো আনিয়ে উপহার দিলেন মিতাকে। রণেন তাকে বানিয়ে দিল একটা চামড়ার ব্যাগ। মিতা অবাক হয়ে দেখল যে, নিজের কাজ ফেলে, রণেন ক্রমশই মেতে উঠছে মিতাকে নিয়ে। রাতের পর রাত জেগে-জেগে বানিয়ে ফেলছে আরও কত কী! মিতাকে কী করে বেশ স্টাইলিস্ট এবং ডিগনিফায়েড লাগবে! তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে,  রণেনের পরিচালনায় পাড়ার নাটক, মণিমেলা এবং বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র বানাবার নানা পরিকল্পনা। রণেন এবার মশগুল হয়ে গেল, কী ধরনের ক্র্যাফট আইটেম শেখানো হবে সেসবের পরিকল্পনায়। কারো কোনও কথায় যেন ভ্রূক্ষেপই নেই তার। অদ্ভুত এবং বিচিত্র তার মনের গতি।

    হঠাৎই রণেনের মাথায় চাপল যে, মিতার শরীর ভাল রাখতে রোজ একটা করে ডিম খাওয়া দরকার। কার কাছ থেকে বুদ্ধি নিয়ে পাঁচটা রোডাইল্যান্ড মুরগি এবং একটা মোরগও কিনে ফেলল রণেন। বাড়ির সামনের জমিটা ফাঁকা থাকায় নিজের সাঙ্গোপাঙ্গোদের জুটিয়ে বাঁশ দিয়ে একখানা ঘরও বানিয়ে ফেলল সে। তরঙ্গনাথের খুড়তুতো ভাই নাকি এক সময়ে তাদের কাছে এতই উপকার পেয়েছেন যে, তিনি কোনও আপত্তিই করবেন না, অনুমতি না নিয়ে ওই মুরগির ঘর করলেও। প্রথমদিকে ভালই চলল সব। মিতা আর রনু দুজনে মিলে শুরু করে দিল মুরগির দেখভাল; সেই তালেই চলল, মুরগিদের নামকরণ— তাদের নিয়ে ফটোসেশন এবং বিস্তারিত পরিকল্পনা বনাম গপ্প। যেই না ডিম পাড়া শুরু হল, অন্যদের টনক নড়ল। সেই কাকাও আপত্তি জানাতে এলেন। রণেন তো রেগে কাঁই। মিতাই কথাবার্তা বলে ছ-মাসের সময়ে চেয়ে নিল, খুড়শ্বশুরের কাছে। তবে ছ-মাস আর অপেক্ষা করতে হল না; তার আগেই একদিন ভোরে উঠেই দেখা গেল যে, মোরগসমেত সব ক’টা মুরগিও লোপাট। পড়ে আছে কিছু রক্তমাখা পালক। বিমর্ষ রণেন আবার গুটিয়ে ঢুকে গেল তার নিজস্ব গর্তে। সেই সুন্দর করে বানানো বাহারি খাঁচাসমেত জমিটা বিক্রিও হয়ে গেল তড়িঘড়ি। যিনি কিনলেন, তিনি আবার রণেনেরই আর এক জ্ঞাতিভাই। রণেনের বানানো সেই খাঁচাখানার ওপর শেড লাগিয়ে ঘরমতো করে, ভাড়াও দিয়ে দিলেন একটি গরিব পরিবারকে। মুরগির বদলে দিব্যি সেখানে নড়েচড়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল মানুষেরা। ইতিমধ্যে মিতার বাবা প্রস্তাব দিলেন, মুরগি-পালনে সময় নষ্ট না করে দিল্লির সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউটে গিয়ে এমএড পড়বার। মিতাও নিমরাজি দেখে আবার চটল রণেন। রণেন বুঝতে পারল যে, বাবার সঙ্গে বিরোধ করে চলে এলেও দিল্লির বাপের বাড়িতেই তার মন পড়ে আছে। পাড়ার ইশকুলে জানাতে তাঁরাও খুবই অসন্তোষ দেখালেন। ছুটি মঞ্জুর করলেও আগের মতো তা আর সবেতন হল না। মিতা অবশ্য ফুল স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে চলে গেল দিল্লির সেই নামকরা প্রতিষ্ঠানে।

    ইতিমধ্যে মিতার বাবা প্রস্তাব দিলেন, মুরগি-পালনে সময় নষ্ট না করে দিল্লির সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউটে গিয়ে এমএড পড়বার। মিতাও নিমরাজি দেখে আবার চটল রণেন। রণেন বুঝতে পারল যে, বাবার সঙ্গে বিরোধ করে চলে এলেও দিল্লির বাপের বাড়িতেই তার মন পড়ে আছে। পাড়ার ইশকুলে জানাতে তাঁরাও খুবই অসন্তোষ দেখালেন।

    রণেন এবার যেন জেগে উঠল নিজেকে চিত্রী বলে প্রতিষ্ঠিত করবার। নতুন সব আঁকা নিয়ে চলে গেল কটক। প্রদর্শনী হল, কাগজে নাম বেরোল, প্রশংসাও হল; কিন্তু ছবি বিক্রি হল মাত্র দুটো। বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে, আবার সে ডুবে গেল নিজের হতাশায়। তার এখন সারাদিন ঘুম পায়। ভীষণ একা লাগে। থেকে-থেকেই নীচে যায়। লেটারবক্সে মিতার কোনও চিঠি এসেছে কি না দেখতে। ওটাই যেন এখন তার একমাত্র কাজ। তরুলতা ভাবেন, কী করে যে এত চিঠি ওরা দুজনেই লিখে যেতে পারে! এক-একদিনে তিন-চারটে করে চিঠি? রণেন বুঝতে পারে যে, হস্টেলে থাকলেও ওই একই শহরে তো মিতার বাবা-মাও থাকেন। সপ্তাহান্তে নিয়মিত ভাই-বোনেদের কাছে যেতে পেয়ে মিতাও যেন কিছুটা খুশি। দিল্লি যাওয়ার বা সোদপুরে আসবার খরচ জোগাড় করে, হুট বলতে ছুট না যেতে পারে রণেন, না রণেনের কাছে চলে আসতে পারে মিতা। ফলে বিরহের সঙ্গে বেড়ে উঠতে থাকে বিরক্তি; আর অপেক্ষার বদলে অবসাদ।

    তবে এরই মধ্যে তার এক মাস্টারমশাইয়ের আগ্রহে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে একটা চাকরি পেল রণেন। প্রবল উৎসাহে যোগও দিল। মেতেও উঠল নানা পরিকল্পনায়। এমন এক সংবাদে তো মিতা এবং মিতার বাবা দুজনেই খুব খুশি; মাইনেপত্তরও ভালই। শুধু প্রমাদ গুনলেন তরুলতা। কারণ তিনি জানেন যে, চাকরিটা খুব সহজে পেলেও তা টিকিয়ে রাখা কতখানি শক্ত রণেনের পক্ষে। যাই হোক, মন্দের ভাল ধরে নিয়ে, দু-হাত জড়ো করে ‘নমোঃ-নমোঃ’ বলে কপালে ঠেকালেন তরুলতা।

    *
    আমি রণেন। আমাকে চরম স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আমার বাবা। পড়া শেষ না করে তাঁকে চাকরি নিতে হয়েছিল বলে, আমাকে কখনও কোনও রকম চাপ দেননি রোজগার করতে হবে বলে। সেজন্যই হয়তো আমি তেমন চাপ নিতে শিখিনি। যখন যেটা ভাল লেগেছে, সেটাই করেছি। ফলে সব কাজেই একটা চূড়ান্ত পারদর্শিতা তৈরি হয়েছে; যা দেখে লোকে বলেছে যে, শুধু ওটা নিয়ে থাকলেই অনেকের ভাত মারা যাবে; আর মুশকিলটাও ওখানেই। কোনও একটা কিছু নিয়ে পড়ে থাকতে পারি না; বজ্জাতদের মন জুগিয়ে মিষ্টি করে হাসতে পারি না। আমার আঁকা নিয়ে কথা না বলে, লেখায় ক’টা বানান ভুল হয় বললেও গায়ে লাগে না। কিন্তু আমার আঁকা নিয়ে, সততা নিয়ে বা রমিতাকে ভালবাসা নিয়ে কথা বললেই মাথা যেন গরম হয়ে যায়। আমার শ্বশুরমশাইও সেই দলেই পড়েন। গুণের কদর করেন অর্থমূল্যে। কোন ধরনের ছবি এঁকে দু’পয়সা হবে সেটাও উনি বুঝিয়ে ছাড়েন। বলতে চান যে, বাজার না বুঝলে, শিল্প কীসের! ঘরের মধ্যে যখন ছবিগুলো মাথায় আসে, তখন কি মনে থাকা সম্ভব যে কারা এই ছবি কিনবে?

    আঁকিয়েদের জগৎটাও যেন বড় দ্রুত অচেনা হয়ে যাচ্ছে দেশভাগের ফলে, রাশি-রাশি উদ্বাস্তু মানুষের চাপে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে, কাকে ধরে কে কোন কাজটা পেয়ে যাবে তাই কোয়ালিটির থেকেও বড় হয়ে উঠছে দারিদ্র্য রায়সাহেবের ছেলে বলে আমি যেন বিরাট সম্পত্তির মালিক আবার উদ্বাস্তু নয় বলেই আমার কোনওই অভাব নেই চারিদিকে যে দল বাঁধাবাঁধি চলছে, তার কোনও একটাতে ঢুকে পড়তে না পারলেই বাতিল দলছুটদের একটাই গন্তব্য বিদেশে পালানো এটা আশঙ্কা করেই হয়তো, বাবা আমাকে প্যারিসে পাঠাতে চেয়েছিলেন আমি বুঝিয়েছিলাম যে, সেখানে তো আরও-আরও গরিব শিল্পীরাও আছে বলেছিলাম, আজকে যাঁদের প্রতিষ্ঠিত বলে ধরা হচ্ছে, জীবৎকালে তাঁরা তো খেতে পেতেন না অনেকেই! আঁকার গুণগত মানের সঙ্গে গরিববড়লোকের যে কী সম্পর্ক, এটা আমার মাথায় ঢোকে না

    সকলেরই মনে হয় যে, ইচ্ছে করলেই আমি নাকি অনেক কিছুই করতে পারি করছিও তো অনেক কিছু কতটুকু ঘুমোই! হ্যাঁ, অনেক কিছু করতে পারলেও আসলে করে খাওয়ার বুদ্ধিটা খাটাই না তাই আমার কাজগুলোকে অকাজ এবং বেহিসেবি খেয়াল বলে মনে হয়

    অবনীন্দ্রনাথের প্রদর্শনী হল, এশিয়াটিক সোসাইটিতে কী যে ভাল লাগল! অনেক দিন পরে কারোর আঁকা দেখে মনে হল, এই তো! ঠিক জায়গায় এসেই পৌঁছেছি

    রমিতাকে আজ তিনখানা চিঠি পোস্ট করলেও, রাতে বাড়ি ফিরেই আবার লিখতে বসলাম

    মিতা,                                                                      ১৭//১৯৫৩

    তুমি ওদিকে কাঁদো-কাঁদো হয়ে পরীক্ষা দিয়ে মরছ, আর আমি এদিকে অবনী ঠাকুরের ছবির exhibition দেখে ফিরলাম। কী যে ভাল লাগল, তা আর কী বলব! ভদ্রলোকের আঁকাগুলো দেখে একটা খুব উপকার হয়েছে, অনেক রকম ছবির মধ্যে বেশ কিছু ভাল mask আঁকা। (মনে হয় আমার দেখেই আঁকা! কী বলো?) এর আগে আগে কোনও exhibition দেখেই এত ভাল লাগেনি। ঠিক মনে হয়নি আঃ! এবার এই ছবিগুলো দেখে মনে হল, আহা রে! আর সেই সঙ্গে এও মনে হল যে আমিও Artist এবং আমিও ভালই আঁকি। এত ভাল লাগল কেন জানো? দেখলাম যে এগুলো সব ‘ছবি’, যেখানে কোনও stunt নেই। আবার মনে হল যে আমিও ছবি আঁকি। আর ভালই আঁকি, কারণ আমার আঁকাতেও কোনো stunt-বাজি নেই।

    বুঝলে?

    এই থাক আদর রণেন 

    লিখতে লিখতেই বৃষ্টি এল। গঙ্গার ওপর ভেসে থাকা চাঁদের ছায়াটা কখন যে উবে গেছে, লক্ষই করিনি! কে জানে, কোন ফাঁক গলে ঘরে এসে পড়েছে একটা গাঢ় সবুজ আলো। অনেকদিন হল ইজেলটাতে কোনও ক্যানভাস আঁটা নেই। সাদা মেঝের ওপরেই কি গড়িয়ে পড়ছে কিছু! তেলের মতো, ঘন তরল! ওটাই বা কী! জলের নীচে ডুবে থাকা একটা স্কাল! উলটে গিয়ে আমার কাছাকাছি এসে স্থির হল। ভিক্ষাপাত্রের মতো যেন কিছু চাইছে। কী চাইছে? কার পাত্র ওটা! অত সবুজ শ্যাওলা কী করে জমল? কতকাল ডুবে আছে? এই গাঢ় সবুজ রঙেই কি আলোর সংকেত? নাকি তলিয়ে যাবার আগে, এই শেষবার হাত পেতে দাঁড়ানো একেবারে ভিখিরির মতো! আমার মাথাটাই যেন দুটো টুকরোয় ভাঙা! একটা আধভাঙা খুলিই তো ভিক্ষাপাত্র হয়ে আমাকেই বলছে, দাও… এই একবার অন্তত ভরে দাও আমাকে! তারপর দুজনেই ডুবে থাকি শ্যাওলা-রঙা ওই সবুজ আলোর গভীরে!

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook