ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আউট অফ প্রিন্ট : পর্ব ৪


    পৃথ্বী বসু (August 3, 2024)
     

    মায়াময় এক অট্টহাসি

    বয়স যত বাড়ে, জীবনের দার্শনিক প্রশ্নগুলো মনের মধ্যে ভিড় করে আসতে থাকে। আমারও হয়। অনেক গভীর রাতে যখন নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার সময়, তখন নিজেকে প্রশ্ন করি, কবিতা লিখে কি কোনওদিন পন্টিয়াক গাড়ি চেয়েছি? চাইনি তো! কী চেয়েছি তাহলে? স্পষ্ট উত্তর পাই না। ছেলেবেলায় মনে হত, সারাজীবন শুধু কবিতা নিয়েই কাটিয়ে দিতে পারব। এই অল্প কয়েক বছরে সেটুকুও বোধহয় পারিনি। একটা অদ্ভুত ঘুরে মরা শুধু চারপাশে জাল বিছিয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। কবিতার ভূত কবে যে মাথায় চাপল, আজ সেই মুহূর্তটা খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে খুব। যদি সম্ভব হয়, মুছে দেব। ফুটবল মাঠ আর পাড়ার রক যেভাবে নিয়ে যাচ্ছিল অনন্ত উচ্ছৃঙ্খলতার দিকে, যেতাম নাহয়! খুব কিছু ক্ষতি হত কি! এতটা অতৃপ্তি, ভালো-না-লাগা, অকারণ নিঃসঙ্গতা পোকার মতো মাথার চারদিকে ঘুরপাক খেত না হয়তো। অবশ্য কী যে ঠিক ঘটত, তা জোর দিয়ে বলতে পারি না। তবে, ভেবে যদি দেখি, কমও তো কিছু দিল না কবিতা! এখনও অজানা কোনও কবির দু-একটা আশ্চর্য লাইন পড়ে যে-উত্তেজনা টের পাই মনের ভেতরে, কই, তা তো অন্য কোথাও পাই না! উৎপলকুমার বসু যেমন বিশ্বাস করতেন যে, আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই একটা র নার্ভ আছে, এবং খাঁটি শিল্প তা স্পর্শ করবেই— ভাল কবিতা পড়লে আমিও সেটা টের পাই।


    মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে যে-রাস্তাটা রমানাথ মজুমদার স্ট্রিটের দিকে ঢুকছে, তার কোনার একটা দোকানে এক সময়ে ১০ টাকায় প্রচুর কবিতার বই পাওয়া যেত। এখনও যায় নিশ্চয়ই, বেশিদিন আগের কথা তো নয়। পাশ দিয়ে যখনই যেতাম, তাকাতাম। আসলে যে-বয়সে লেখালিখি করতে এসেছি, তখন অধিকাংশ ভাল কবিতার বইগুলোই আর বাজারে পাওয়া যায় না। আশায় থাকতাম, যদি পুরনো কিনতে পারি। যাই হোক, অনেক কবিতাবই-ই কিনেছিলাম সেখান থেকে, তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার সব ক-টাই আবার ওই ধরনের দোকানে চলে গেছে। অর্থাৎ বেচে দিয়েছি। জমিয়ে রাখার যে-বদভ্যাস আমাদের মজ্জাগত, আমার তা নেই। ফলে নির্মম হতে এত সাত-পাঁচ ভাবতে হয়নি কখনও। ওই যে বইগুলো কিনতাম আর বেচতাম বিরক্তিতে, তাতে হঠাৎই বাধা পড়ল একদিন। চল্লিশ পাতার একটা কবিতার বই আমায় অবাক করে দিল। কাব্যগ্রন্থের নাম ‘মায়াময় এক অট্টহাসি’, কবির নাম পারমিতা। শুধুই পারমিতা। কে এই কবি? নাম শুনিনি কখনও। বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় সে-বই নিয়ে সঙ্গে যাই, তাদেরও মুগ্ধ করি। আমিই যে এর আবিষ্কারক!

    বইটি প্রকাশিত হয়েছিল অবভাস প্রকাশনী থেকে, যে-প্রকাশনী কবিতার বই করার জন্য তেমন জনপ্রিয় ছিল না কখনও। প্রচ্ছদ করেছিলেন দেবব্রত ঘোষ। দাম পঁচিশ টাকা। অথচ এই বই কবে নাগাদ প্রকাশিত হয়েছিল, কোথাও সে-তথ্য লেখা নেই। অনেক পরে জেনেছি, এই কবির পদবী দাশ। এবং এই একটাই কবিতার বই রেখে, নিজেকে তিনি বহুদিন সরিয়ে নিয়েছেন কবিতাজগৎ থেকে।


    ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘তোমার হাসি আমার ভালো লাগে’। এই ‘হাসি’ই যদি ‘অট্টহাসি’ হত, তত ভাল লাগত কি! চিরকাল হাসি-র মধ্যে যে-লাবণ্য, যে-প্রেম, যে-স্নিগ্ধতা আমরা খুঁজে পেয়েছি— অট্টহাসিকে সেই মর্যাদা দিতে পারিনি। অট্টহাসি যেন দুয়োরানি। তার অতটা ব্যক্তিত্ব নেই। সে কিঞ্চিৎ তুচ্ছ, এলেবেলে। কিন্তু পারমিতা তাঁর এই বইতে এমন এক অট্টহাসি তুলে ধরলেন, যা অট্টহাসি হলেও মায়াময়। কেমন সেই অট্টহাসি? ফণীশ্বরনাথ রেণু লিখেছিলেন, চোখে জল নিয়ে দূরে আলোর দিকে তাকালে সেগুলোকে সূর্যমুখী ফুল বলে মনে হয়। অর্থাৎ এক অনুভূতির মধ্যে থেকে অন্য অনুভূতির দিকে সরে যাওয়া। আমরাও যদি এ-বইয়ের কবিতাগুলোর দিকে তাকাই, অট্টহাসি নয়, টের পাব এক ব্যথার আবহ। ছোট-ছোট সব কবিতা। যেমন ধরা যাক, এই লেখাটা—

    প্রেম থেকে প্রেমে গেছি

    মাথা নীচু করে,
    উথাল ঘাসের মাঝে পাতালে গেছি—
    রোদ দেখে মুগ্ধ হয়েছে কাকশিশু
    আর এক থেকে অন্যমনস্কতায়
    চলে গেছি আমি।

    কিংবা,

    এমন নিপুণ এসে দাঁড়িয়েছে

    বাদল তরফদার, এমন নিপুণ
    এসে দাঁড়িয়েছে সে তার পৈতৃক
    রিকশ্‌র পাশে যে সহস্রপক্ষকাল বাদে যেন
    সদর দরজা পেরিয়ে
    পোষাকের আরও আরও বাইরে
    সে প্রিয় অঙ্গ দুলিয়েছে
    আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে।
    মেহগনি বনে সে কাঠের বাকল ভরে,
    আঁধার আমার জেনে
    হুটোপাটি করেছে খুব। খুব।

    বোঝাই যাচ্ছে, প্রচলিত হাসি-র যে ধারণা, পারমিতা তাকে ব্যঙ্গ করতে চেয়েছেন। যে-অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে তিনি তাঁর এই শব্দস্রোতকে টেনে বের করেছেন, সেখানে আলগা হাসির কোনও আদিখ্যেতা নেই। দীর্ঘদিন কৃত্রিম হাসতে-হাসতে, মানুষ এক সময়ে হাসির ওজন ভুলে যায়। তাঁর অনুভূতিতে জং পড়ে। ভেতরে রিনরিন করে বেজে চলে যে-করুণ রাগ, তাকে ঢাকার জন্যই এই ‘অট্টহাসি’। অথচ তা কি কোনও আনন্দ থেকে উৎসারিত? নয় যেহেতু, তা-ই ‘মায়াময়’।

    এই বইয়ের সমস্ত কবিতাই প্রকরণগত ভাবে একটু আলাদা। সাধারণত কবিতার শিরোনাম থাকে বা থাকে না। কিন্তু এখানে কবি প্রতি কবিতার প্রথম লাইনকেই শিরোনামের মতো ব্যবহার করেছেন। দেখে মনে হয় শিরোনাম, কিন্তু পড়লে বোঝা যায়, কোনও কবিতারই কোনও শিরোনাম নেই। কবিতাগুলোকে টানা পড়তে হবে শুরু থেকেই। এরকম কবিতাও আছে এ-বইতে, পাতার ওপরে এবং নীচে দু-বার ছাপা। প্রথম পাঠে ধাক্কা খেয়েছিলাম, কিন্তু পরে মনে হয়েছে ওভাবে সাজানো ছাড়া ওই কবিতার আর কোনও উপায় ছিল না। কবিতাটা একেবারেই ছোট—

    এই সেই নির্বান্ধবপুরী
    যার মায়ায়
    বারবার
    আমার কুসুম ভেঙ্গে গেছে

    একটা সাদা পাতার ওপরে-নীচে দু’বার এই অংশ ছাপার ফলে হল যেটা, নির্বান্ধবপুরীর শূন্যতাটা যেন ধাঁ করে চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠল। এত ছক-ভাঙা অথচ অবশ্যম্ভাবী কবিতা-শরীর অনেকদিন সেভাবে চোখে পড়ে না আর।


    পারমিতা দাশ এখন আর কবিতা লেখেন কি না আমার জানা নেই। কয়েকদিন আগে অগ্রজ কবি সার্থক রায়চৌধুরী পাঠালেন পারমিতা-র আরও কিছু কবিতা। ‘বাহিরওয়ালি’ নামের সেই কবিতা-সিরিজও ছাপা হয়েছিল ২০১০ সাল নাগাদ। চোদ্দো বছর পেরিয়ে এসেছি। বাংলা বাজারে এত যে কবিতাবই সকাল-বিকাল পুনর্মুদ্রিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, কেউ কি একবার এই কৃশকায় কাব্যগ্রন্থটির দিকে ফিরে তাকাবেন না?

    এই বইয়ের গোড়ায় দেওয়া ছিল এক বিধিসম্মত সতর্কীকরণ, ‘মায়াময় এক অট্টহাসি কোন কাব্যগ্রন্থ নয়। এটি একটি ধর্মগ্রন্থ। শুধুমাত্র বিপদে পড়লেই এটি খুলে বসবেন। অযথা নাড়াচাড়া করবেন না।’ আমি চাই বাংলা কবিতার আরও ঘোর বিপদ আসুক সামনে— যাতে একদিন, সেটা যবেই হোক না কেন, এই ঘোলাজলের বাজারে ঠিক খোঁজ পড়বে এই মায়াভরা কবিতাগ্রন্থটির…   

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook