ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ: পর্ব ৩৫


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (August 3, 2024)
     

    ভূতেশ – সাত

    বাপ-মায়ের কাছেই দুই মেয়ে নিয়ে সুপ্রভা ছিল। পুজোর পরে শ্বশুরমশাইয়ের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়ে জানতে পারি যে তার নিজের সংসার সোদপুরে ফিরতে চায় সুপ্রভা। প্রয়োজনে প্রভার নিধিকাকারাও এবারও রাজি আছেন তার সঙ্গে যেতে। এর ক’দিন পরেই সুপ্রভার যে চিঠি এসেছে তাতে সে লিখেছে,

    শ্রীচরণেষু স্বামী,                                                           

    কনক আর যূথিকা দুজনেই ভাল আছে। ওদের নিয়ে তেমন ঝঞ্ঝাট নেই। যূথিকে পেট ভরে খাইয়ে দিলেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুম ভাঙলেই হাত-পা নেড়ে খেলতে থাকে। একেবারেই কোল-চেনা হয়নি। কনক হাতে-পায়ে একটু দুরন্ত হলেও কথা শোনে। স্লেট-খড়ি দিয়ে বসিয়ে দিলেই নিজের মনে আঁক কাটে। দুজনেরই কোনও বায়না নেই। আমিও এখন সব কিছু সামলাতে শিখে গেছি। আমার সই ‘তুলসী-মালা’ বলেছে বরের কাছে না হোক, শ্বশুরঘরে গিয়ে থাকলে তবেই তো বাপের ঘরেও আদর বাড়ে। নিধিকাকাদের সঙ্গে দুই মেয়ে নিয়ে আমি সোদপুরের বাড়িতে ফিরে যেতে চাই। বড়ঠাকুরঝিরও তা-ই ইচ্ছে।  

    তুমি কিন্তু না কোরো না। ওখানেই মানি অর্ডার করে টাকা পাঠিয়ো।

    হামি নিয়ো

    ইতি

    তোমার মন্টুসোনা  

    তারিখ-বিহীন প্রভার চিঠিটা পড়ে ভূতেশের মনে পড়ে গেল, একবারই প্রভাকে ওই নামে ডেকে, থুতনি ধরে আদর করেছিল সে। আর কী আশ্চর্য যে, প্রভা সেটা ঠিক মনেও রেখেছে! আরও অবাক হল, বড়খুকির ইচ্ছের কথাটা প্রভার চিঠিতে জানতে পেরে; তাকে লেখার আগেই যে বড়খুকির সঙ্গে চিঠিচাপাটি সেরে রেখেছে প্রভা, সেটাও পরিষ্কার হয়ে গেল ভূতেশের কাছে। মিরাটে নিজের কোয়ার্টারে একা ঘরে বসে, দুটো চিঠিরই সম্মতিসূচক আলাদা-আলাদা উত্তর দিয়ে, খামে বন্ধ করে ঠিকানা লিখে রাখল ভূতেশ। সকালের ডাকে দিয়ে দিলে, দিন সাতেকের মধ্যেই তা পৌঁছে যাবে মালদার ইংলিশবাজারে। ভূতেশের পক্ষে ছুটি নিয়ে কোথাও যাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব। এদিকে দুশ্চিন্তাও তো তার মাথা ছাড়ছে না এই ভেবে যে, একা নিধিকাকার দায়িত্বে দুজন মেয়েলোক এবং তিনটে বাচ্চা অতটা পথ ট্রেনে করে যাবে কোন ভরসায়! বিপদ কি আর জানান দিয়ে আসে? ভূতেশ তাই শ্বশুরমশাইকে বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছে যাতে তিনি নিজে অন্তত সঙ্গে যান। দিন পাঁচেক বাদে শ্বশুরমশাইয়ের চিঠি আসায় ভূতেশ একটু স্বস্তি পেল। প্রভা যে এবার তার নিজের সংসার বুঝে নিতে চলেছে, এই ব্যাপারটায় ভূতেশ বেশ আশ্বস্তই হল। তবে, ভূতেশদের ওই পাঁচভূতের বাড়ির যা পরিবেশ, তাতে সে টিকতে পারলে হয়! মায়ের চিঠিতে ভূতেশ জেনেছে যে, বড়খুকিকে কোণঠাসা করতে ইদানীং নাকি মেজোগিন্নি আর ছোটখুকি এক হয়ে হাতে-হাত মিলিয়েছে; তার ফলে ছোটখুকির সেই বেহায়া-বর বিপিনও অবরেসবরে এসে ওই বাড়িতে রাতে থাকার ব্যাপারটাও আবার ম্যানেজ করে ফেলেছে। তাদের ছেলেপুলের সংখ্যাও তো প্রভার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে সমানে; ছোটখুকির বড়ছেলে গুপীর কোলে এখন আরও দুই মেয়ে, যারা একেবারেই কনক এবং যূথিরই প্রায় সমবয়সি। তা ছাড়াও প্রভা ওই বাড়িতে থাকলে বড়খুকির হাতই যে শুধু শক্ত হবে তা-ই নয়, ভূতেশের কাছেও নিয়মিত খবরাখবরও যাবে ওখান থেকে। কিন্তু প্রভার পরিস্থিতি যে কী দাঁড়াবে কে জানে! এখন একমাত্র ভরসা প্রভার ওই নিধিকাকা আর কাকিমা; ভূতেশের আরেকটা ভয়ের কারণ ছোটখুকির ছেলে গুপী। লেখাপড়ায় একেবারেই মন নেই। কার্তিক ঠাকুরের মতো চেহারায় বাপের স্বভাব না পেয়ে বসে ওই ছেলে! ওর পাল্লায় পড়ে নিধিকাকার সরল ছেলেটা না একেবারে বখাটে হয়ে যায়! এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী! মিরাট না দিল্লি! কোথায় যে তার পোস্টিং হবে এখনও জানা যায়নি। ফলে, মিরাটে তার নামে কোয়ার্টার থাকলেও সরকারি নির্দেশে প্রায়ই তাকে দিল্লিতে গিয়ে আর্মি মেসেও দিন কাটাতে হয়। সংসার এবং চাকরি, দুটো নিয়েই জেরবার হয়ে চলেছে ভূতেশ। প্রভার ওই সরল হাসিটুকুই শুধু যা একটু শান্তি দেয়। অমলিন মনের, নিঃসংকোচ এই বাপ-সোহাগী মেয়েটার কথা ভেবে ভূতেশ মাঝে মাঝে কেঁপে যায়। সে নিজে কি অতটা সরল না সৎ, যে প্রভার মতো একটা মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে পেল! প্রভা ধরতে না পারলেও ভূতেশ তো নিজে জানে যে, একাধিক নারী-সংসর্গে তার কেমন দ্বিধাহীন রুচি! বিশেষত এই চাকরিতে মেয়ের অভাব হয় না; মালি, আরদালি, সহিস এরা ধরেই নেয় যে, মর্জি হলে এদের ঘরের মেয়ে-বউদের তো ভোগ করবে বাবুরাই; তারা জানে যে ‘সাহেব’ শব্দটায় সাদা বা কালো চামড়ার ভেদ নেই; ওটা একটা পদ। তা ছাড়াও, যে কোনও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নারীর জোগান সবচেয়ে বেশি; আর তা চলে নির্বিচারে।        

    তবে যুদ্ধ লেগে যাওয়ায় পরিস্থিতি এমনই বদলে গেল যে, ভূতেশকে আর কোনও সিদ্ধান্তই নিতে হল না। প্রভার বাবা নিজে আবার সোদপুরে গিয়ে সকলকে নিয়ে এলেন মালদায়।


    ভূতেশের অনুরোধে শ্বশুরমশাই নিজে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন প্রভাদের। প্রভার কাছে এটা একটা মস্ত জোর; বেয়াইমশাইকে খুবই আদরযত্ন করলেন ভূতেশের মা-বাবা; বড়খুকিও সাধ্যমতো আপ্যায়নে ত্রুটি রাখল না কোনও; তবে নিধিকাকার পরিবার আপাতত মালদা ফিরছে না, এ-কথা জেনেই চাপা রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মেজোবউ এবং ছোটখুকি; গুপী ওদিকে চেষ্টায় ছিল প্রভার বাবার সঙ্গে মালদা পাড়ি দেবার; বড়খুকিই বুদ্ধি করে তাকে আটকাল। বড়খুকির নির্দেশমতো দুই মেয়ে এবং নিধিকাকার বউকে নিয়ে প্রভা ঢুকে এল ভূতেশের বড় ঘরটায়; যার লাগোয়া দালানের ওপর টালির চালের চিলতে ঘরটায় ব্যবস্থা হল নিধিকাকাদের থাকবার। ওই ‘চালা-বাইরেঘর’টায় যে গুপী থাকত, সেটা বোঝা গেল ঘরে ঢুকেই; কারণ ঘরময় বিড়ির গন্ধ আর এ-কোণ ও-কোণ জুড়ে শুধু ঝুলে থাকা দড়ি। ঘরটা পরিষ্কার করা হলেও দড়িগুলো নাকি ছোটখুকিই খুলতে বারণ করেছে, দু’দিন পরেই তো আবার টাঙাতে হবে ভেবে। ভাবলেশহীন মুখে ওই ঘরে ঢুকে, সঙ্গের বাক্স-প্যাঁটরাগুলো এক কোণে নামিয়ে রাখল নিধিকাকা; তারপরেই তক্তপোশের ওপর তোশক-মাদুর বিছানো, রোদে দেওয়া বিছানাটা পেয়েই টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল নিধুকাকা। গুপী এসে ডেকে নিয়ে গেল তার ছেলে পবিত্র বা ‘পবা’কে।         

    মেজোবউ আর ছোটখুকি টেরিয়ে-টেরিয়ে দেখতে লাগল নিধিকাকার বউয়ের তৎপরতা; দুই মেয়ের স্নান, খাওয়া, ঘুম পাড়ানো এবং ঘর গুছোনো— নিমেষে সব সেরে ফেলল নিধিকাকিমা। প্রভার কাজ হল শাশুড়ি আর বড়খুকির সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে-ফাঁকে ছোটটাকে একটু দুধ খাওয়ানো। সন্ধে লাগার আগেই কাপড় ছেড়ে, চুল বেঁধে, ডালায় ফুল সাজিয়ে কৃপানাথকে প্রদীপ দেখিয়ে এল প্রভা; পিছন-পিছন কনকও চলল তার মায়ের আঁচল ধরে; এমন সুন্দর এক ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন প্রভার শাশুড়িমা। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে, জোরে-জোরেই স্বগতোক্তি করলেন, ‘এমনই সব রেখো ঠাকুর।’ মন্দির থেকে ঘরে এসে প্রভা দেখল যে, নিধিকাকা তার ওই ছোট্ট ঘরখানার তক্তপোশে বসে নিত্য, গুপী আর পবাকে হাতের লেখা মকশো করাচ্ছে; নিধিকাকিমা ওই ঘরেরই মেঝেয় বসে, এক ঝুড়ি কলমি শাক ছাড়াচ্ছে; আজ দুপুরে স্নানের সময়ে পুকুরপাড় থেকে ওগুলো প্রভাই তুলেছে; আর ঝুড়িতে করে তুলেছে কিছু চিতি কাঁকড়াও; নিধিকাকিমা সেগুলো উনোনের মরা আঁচে বসিয়ে রেখে ঝাল-ঝাল চচ্চড়ি করেছিল। শাকগুলো কালকে রান্না হবে। সন্ধে হলে ছোটখুকি তার দুই মেয়েকে দু’পাশে শুইয়ে নিজের ঘরের বিছানায় গড়াগড়ি পাড়ে; রাতের খাবার দেবার সময় হলে তবেই রান্নাঘরে ঢোকে সে; বিরজাবালা ঠিক আগের মতোই বাবা-মায়ের ঘরে বসে মহাভারত পড়ে শোনায়; আর অন্যদিকে একখানা কাচা কাপড় পরে মেজবউ একটু পাড়া বেড়িয়ে আসে; রোজই তার ঝুলিতে তাই নিত্যনতুন ঘোঁটের গল্প। ভূতেশের টেবিল-চেয়ারে না বসে, একটা জলচৌকির ওপর খাম, পোস্ট কার্ড আর কাঠ-পেনসিল নিয়ে গুছিয়ে বসে প্রভা; মেঝেতে মাদুর পেতে বসলে লিখতে সুবিধে হয়; রাতে শোবার আগে বিছানাটাও ধামসে যায় না। মায়ের দেখাদেখি কনকও স্লেট-খড়ি নিয়ে বসে যায় আঁক কাটতে। প্রভার বাবা তাকে যে একগোছা খাম-পোস্টকার্ড কিনে দিয়ে গেছেন, তা থেকে কয়েকটা নিয়ে চিঠি লিখতে বসে প্রভা; তার বরকে একদিন অন্তর নিয়ম করে চিঠি লিখলেও, বাবা-মা এবং তার সই তুলসী-মালাকে কিন্তু চিঠি লেখে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। তার নামে ডাকে চিঠি আসা দেখে মুখ টিপে ব্যঙ্গের হাসি হাসে ছোটঠাকুরঝি আর মেজোবউ; আগে-আগে গুপীকে দিয়ে আঠা খুলিয়ে, চিঠিগুলো তারা পড়ত; গুপী আবার তা জুড়ে দিত নিপুণ করে। বড়ঠাকুরঝির চোখে পড়ে যাওয়ায়, আপাতত সেসব বন্ধ হয়েছে। পিওন এসে, সবার সব চিঠিই এখন বাবার হাতে দিয়ে যায়। ভূতেশকে তার বাবার লেখা ওই প্রস্তাবটা প্রভা জানল, তাকে লেখা তার বরের  চিঠিতেই। 

                                        18th Oct,1918                                                                                                   Officer’s Quarter

    Meerut-Uttar Pradesh

    ধর্মপত্নী প্রভা,   

    তোমাদের কুশল সংবাদ তোমার বাবার চিঠিতেও পেলাম। তবে তাঁর ইচ্ছে যে আমাদের বাড়ির হাতায় একখানা ঘর ভাড়া দেখে দিলে, নিধিকাকা তাঁর পরিবার নিয়ে সেখানে সসম্মানে থাকতে পারেন; আমি আপত্তি করিনি; লিখেছি যে ঘর না-পাওয়া অবধি আত্মীয়র এক সংসারেই তাঁরা থাকুন। নিশানাথকে ঘর দেখতে বলেছি। এ-ও বলেছি যে, ওই ভাড়ার টাকাটা কিন্তু আমিই দেব; তাঁরা আমাদের অতিথি; কাজের লোক নন। তবে গুপীকে আর ওই ঘরে ঢোকাব না; কারণ তার বাবা বিপিন তখন ওই ঘরটিতেই নিজের অধিকার ফলাবে। এ-ব্যাপারে তুমিও শক্ত থেকো; ভেবো না যে, তাকে আমি শাস্তি দিচ্ছি। বাবা-মা এবং বড়খুকি সকলেই এ-বিষয়ে সহমত হয়েছেন। গুপীর আচরণ সুবিধের নয় এবং উৎপাত বিশেষ। সব বিষয়ে সজাগ থেকো।  

    বড়খুকির কাছে একটু লেখাপড়াও কোরো। চিঠিতে বানান ভুল হলে আমার খুব বিরক্ত লাগে।

    ইতি
    তোমার বর

    ভূতেশ 

    নিশানাথের দেখে দেওয়া এক টুকরো দালানসমেত ঘরখানা একেবারে এ-বাড়ির লাগোয়া। বাগানের ভেতর দিয়েই যাতায়াত করা যায়। বড়ঠাকুরঝির সাহায্যে নিধিকাকিমা সব বেশ গুছিয়ে-গাছিয়েও নিয়েছে। রাতে চলে আসে প্রভার কাছে থাকতে; হাতে-হাতে সব গুছিয়ে দিয়ে একটু বেলায় আবার চলে যায় নিজের সংসারে। নিশানাথের সাহায্যে শুধু ভাড়া ঘর নয়, গুপীর ইস্কুলে ওই একই ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেছে পবাও; শেয়ালদা কোর্টচত্বরে নিধিকাকার জন্যেও কী একটা কাজ দেখে দিয়েছে সে। কিন্তু বাড়ির ভেতরের গোলমাল যে-কে সেই। আদৌ সেসব কোনও দিন মিটবে কি না ভূতেশ তা নিজেও জানে না। একটু যা আশার আলো ভূতেশ দেখতে পায়, তা ওই বড়বউয়ের ছেলে নিত্যকে ঘিরে। দুরন্ত মেধাবী না হলেও, সভ্য-ভদ্র এবং বাধ্য হয়েছে সে। প্রভার কাছে যথেষ্ট আদরযত্ন পায় বলে  ‘ছোটকাকিমা’ বলতে সে অজ্ঞান।  

    অফিসের একটা কাজে হঠাৎ করে ইছাপুর আসবার সুযোগ ঘটে যাওয়ায়, ভূতেশ খুব খুশি। অনেকদিন ছুটিছাটা নেয়নি বলে সাহেব একেবারে এক মাসের ছুটি মঞ্জুর করে দিয়েছেন। ট্রেন থেকে নেমে পবা, নিত্য আর গুপীর জন্য কিছু ‘ইংরেজি রিডার’ বই এবং বাড়ির জন্য এক হাঁড়ি রসগোল্লা কিনল ভূতেশ। রসগোল্লা কিনতে হাওড়া থেকে ঘোড়ার গাড়ি চেপে ভূতেশ বাগবাজারে এল নবীন ময়রার দোকানে। শুধু স্বাদ নয়, এই দোকানের ইতিহাসটাও তাকে খুব নাড়া দেয়। উচ্চ কায়স্থঘরের গরিবের ছেলে নবীন, পেটের দায়ে তাড়া খেতে-খেতে মিষ্টি বানিয়ে এমন দোকান খুলে বসল যে, তাক লেগে গেল সাহেবদেরও; পুডিং-কাস্টার্ড ফেলে তারা এখন এই দোকানেরই রসগোল্লার দোর ধরেছে। গরম রসগোল্লায় তাদের পেটের ব্যামোর নিরসন তো হলই, সেই সঙ্গে নতুন এক স্বাদ এবং তার লাগল জিভে। বাপের দিক দিয়ে তারা ছিল চিনি ব্যবসায়ী; তাই জাতে ময়রা না হয়েও এ-ব্যবসায় নামতে পরিবারের জাত গেল; নিন্দে করে তারা বলল যে, ‘জাত খুইয়ে ময়রা হয়েছেন নবীন’। অথচ তার দোকানের নাম ছড়িয়ে পড়ল নবীন ময়রা হিসেবেই। অবশ্য নবীনের বউ ক্ষীরোদমণি ছিলেন ‘ভোলা ময়রার নাতনি’। নবীনের ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র অবশ্য এই ব্যবসাকে আরও রমরমিয়ে তুলেছে। ভূতেশের খুব ইচ্ছে এই কৃষ্ণচন্দ্র নামের ব্যবসায়ীটির সঙ্গে একবার দেখা করবার। সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা না দিয়েও, দেশি জিনিসের আধুনিকীকরণেই এঁর আসল এলেম।   

    বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই ভূতেশের মনটা একেবারে যেন খিঁচড়ে গেল। কোথায় তার অফিসার্স কোয়ার্টার আর প্রভা এবং দুই মেয়েকে নিয়ে নিবিড় সংসার, আর কোথায় এই নিজের বাড়ি! বড়দের সংখ্যা না বাড়লেও ছোটদের মাথা গুনলেই সাতজন! যা আনবে সকলের জন্য সমান ভাবে আনতে হবে; না হলেই মুখ হাঁড়ি আর গজগজ। এইজন্যেই হয়তো কারোর ওপর কোনও টানই গড়ে উঠল না ভূতেশের। জীবনটাকে টানতে-টানতে সম্পন্নতার দিকে নিয়ে যাওয়াই যেন তার একমাত্র কাজ। তবে এই প্রথম তার ভার কিছুটা হলেও লাঘব করেছে প্রভার ওই নিধিকাকা এবং কাকিমা। ওঁরা আছেন বলেই প্রভার চেহারায় একটু হলেও লাবণ্য ঝরছে। প্রভার কথা মনে পড়তেই আবার বিস্বাদ লাগল তার; কারণ এই একমাস তো তাদের বিছানায় ওই দুটো মেয়েও থাকবে। প্রভাকে না খুঁজে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে, নিজের ঘরে এল ভূতেশ; একেবারে একরকম করেই তা গোছানো; বাড়তি বলতে শুধু একটা জলচৌকি; যার একপাশে রাখা স্লেট-খড়ি। ঘরের নির্জনতাটুকু পেয়েই খুব নিবিড় আরাম হল ভূতেশের। দালানের দিকে গুপীর ফাঁকা ঘরটাও ঝকঝকে পরিষ্কার। সেখানেই তক্তপোশে কনক আর যূথিকাকে ঘুম পাড়িয়ে তাদের গায়ে বাতাস করছে নিধিকাকিমা। দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিয়ে, ঘরের দিকে আসতেই ভূতেশ দেখল যে, এক গ্লাস চিনির-পানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রভা। খুব অল্প সময়ের জন্য আদর বিনিময় হল পরস্পরের চোখে; ভূতেশের হাতে গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়েই প্রভা চলে  গেল। কে বলবে যে এখন সে দুই সন্তানের মা!   

    কোথা দিয়ে যে দুটো সপ্তাহ কেটে গেল, ভূতেশ তা নিজেও জানে না; তবে ইতিমধ্যে দু-দুটো কঠিন কাজ সেরে ফেলল ভূতেশ। একটা হল বাড়ির জমিতে উঁচু পাঁচিল গেঁথে একটা সীমানা দাগিয়ে ফেলল সে; বাউন্ডারি ওয়ালটা গেঁথে দিতেই বাড়িটাকে এখন বেশ বাগানবাড়ি বলেই মনে হচ্ছে; সেইসঙ্গে, চালা-বাইরে ঘরটা সংস্কার না করে, তার নিজের ওই ঘর-লাগোয়া বারান্দায় আর একখানা বাড়তি দরজা ফুটিয়ে, সুন্দর একটা ‘অ্যান্টি রুম’ বানাল ভূতেশ। সে যখন বাড়ি আসবে, এটাই হবে তার দুই মেয়ের ঘর; ফলে তার আর প্রভার বিছানায় কোনও গ্যাঞ্জামের আপদ থাকবে না। দ্বিতীয় কাজটা আরও শক্ত; দু’খানা শাড়ি কিনে, নিশি আর হরুর বউদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আসা; বিশেষত হরুর সঙ্গে দেখা করে বাক্যবিনিময় করা! তবে সে-পর্বও বেশ সাবলীলভাবেই সমাধা করল ভূতেশ। কিন্তু হরুর বউকে দেখার পর থেকে কেবলই তার মনে পড়ছিল হরু, জয়নারায়ণ আর বিরজাবালার মধ্যে সেই নিবিড় বন্ধুত্বের কথা। এমন বন্ধুত্ব তার জীবনে না ঘটলেও, সে অন্তত আন্দাজ করতে পারে যে মনের মিলের বিচ্ছুরণ কত দীপ্তি দেয় মানুষকে। হয়তো স্বপ্নও দেখায় উড়ে যাওয়ার।     


    মিরাটে ফিরে দিনকতক যেতে-না-যেতেই, মা এবং বড়খুকির চিঠিতে ভূতেশ জানল যে প্রভা আবার সন্তানসম্ভবা; কিন্তু সে এবার আর বাপের বাড়ি যেতে চায় না। প্রভার চিঠি আসার আগেই মেজোবউয়ের চিঠি এল এই মর্মে যে, ছোটখুকিও গর্ভবতী। ‘দুই-বিয়োনি’ নাকি এক বাড়িতে থাকতে নেই; তাই প্রভাকে যেন অবিলম্বে বাপের বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করে ভূতেশ। গর্ভাবস্থার প্রথা মেনে ছোটখুকি যেহেতু তার বাপের বাড়িতেই আছে, তাই তার তো আর ঠাঁইনাড়া হবার প্রশ্নই ওঠে না। এ-ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভূতেশ অপেক্ষা করতে লাগল প্রভা এবং তার শ্বশুরমশাইয়ের কাছ থেকে আসা চিঠিগুলির জন্য।    

    তবে যুদ্ধ লেগে যাওয়ায় পরিস্থিতি এমনই বদলে গেল যে, ভূতেশকে আর কোনও সিদ্ধান্তই নিতে হল না। প্রভার বাবা নিজে আবার সোদপুরে গিয়ে সকলকে নিয়ে এলেন মালদায়। নিধিকাকা, কাকিমা এবং পবার সঙ্গে এবার নিত্যও চলে এল তার কাকিমার বাপের বাড়িতে। ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রশ্নই নেই। সে এক ভয়ানক ডামাডোল। নব্বই ভাগ লোক জানে না যে যুদ্ধটা ঠিক কোথায় লেগেছে, এবং কে-ই বা যুদ্ধ করছে কার সঙ্গে! চারিদিকে অনটন দেখা দিলেও দেদার টাকা উড়তে লাগল আর্মি বিভাগে।

    প্রভার শরীরে-মনেও চলছে এক অসম যুদ্ধ; এবারেও কি মেয়ে হবে! তবে দেহ-লক্ষণ দেখে অভিজ্ঞেরা বলেছেন যে, এবারে যোগ নাকি খোকা হওয়ার!   

    আমি ভূতেশ। দেশে-দেশে যুদ্ধ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমি তো দেখছি যে জয়-পরাজয় ছাড়াও, শুধুমাত্র প্রস্তুতিই কী বিশাল এক পর্ব! স্বদেশিরা ভাগ হয়ে গেছে দু’দলে। চরমপন্থীরা ভাবছে যে, এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের সমর্থন না করে, জার্মানির দিকে ঝুঁকে থাকলে বেশ আচ্ছা করে টাইট দেওয়া যাবে ওই অত্যাচারী ইংরেজদের; আর অন্যদিকে নরমপন্থীদের মত হল, ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলালে আখেরে লাভবান হবে ভারতীয়রাই। কৃতজ্ঞ ইংরেজ তখন স্বাধীনতা উপহার দেবে ভারতীয়দের। তিলক এবং অ্যানি বেসান্তের পাশাপাশিই উঠে আসছে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামে একটি গুজরাটি ব্যারিস্টারের কথাও; সে নাকি তাঁর সাউথ আফ্রিকার পাট উঠিয়ে ফিরে আসছে নিজের দেশ উদ্ধার করতে; তবে তাঁর বক্তব্য আমার অন্তত বেশ গোলমেলে বলেই মনে হচ্ছে— ব্রিটিশ-বিরোধী হয়েও কিন্তু সে চায় এই যুদ্ধের সময়ে ভারতীয়দের পক্ষ থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। এইসব দেখেশুনে মনে হচ্ছে যে আমাদের কপালে লেখা আছে ঘরে-বাইরে সমান যুদ্ধ। অবোধ-অশিক্ষিত উলুখাগড়ারা অবশ্য নিরুত্তর।               

    ওপর মহলের এই বৈঠকি-আলোচনার ফলাফল যা-ই হোক না কেন, বিপুল পরিমাণে কর্ম-সংস্থানেরও সুযোগ এসেছে এ-দেশের মানুষদের সামনে। সকলের মুখে-মুখে একটাই কথা, ‘যুদ্ধের বাজার’। বাজারই বটে! যুদ্ধ পরিষেবাও এক বিপুল আয়োজন। রাতারাতি সকলেই যে সৈন্যসামন্ত হয়ে উঠল তা কিন্তু নয়। যুদ্ধ-কোটায় এক লাখ লোকের যে নাম উঠেছে, তার মধ্যে তিরিশ হাজার অন্তত লেবার; যারা সমানেই ব্যবস্থা করে যাবে খাবার, খাবার জল, বাথরুম-পায়খানা পরিষ্কার এমন আরও কত কিছুর; ফলে রাঁধুনি-ধোপা-নাপিত-মেথর-ডাক্তার নার্স সব চলেছে যুদ্ধ করতে। সেইসঙ্গে চলেছে ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, উট, ইয়াক এবং বিভিন্ন জাতের কুকুর; এবং এই জন্তু-জানোয়ারদের দেখভাল করার মতো বিস্তর লোক। যাতায়াতের সুবিধের জন্য কোথাও মেরামতি, কোথাও-বা নতুন করে তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট, রেলপথ, রানওয়ে, হাসপাতাল, ডক, জেটি এবং ব্যারাক; গ্রাম-গ্রামান্তরের আনাড়ি-অশিক্ষিত মানুষও যুদ্ধে যোগ দিতে দলে-দলে চলেছে সাউথ আফ্রিকা, চিন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা ইজিপ্ট। নিজের দেশেই তো কেউ কাউকে চেনে না তারা, কথাও বলে না একে অন্যের ভাষায়; তা সত্ত্বেও তারা পাড়ি জমাচ্ছে একেবারে ভিনদেশে। একই সঙ্গে একেবারেই ভ্রুক্ষেপহীন বেঁচে ফিরতে পারবে কি না সে-বিষয়েও। এদিকে বাজার তো অগ্নিমূল্য; কিন্তু যুদ্ধখাতে টাকার স্রোত! 

    বাপের বাড়ি থাকার সময়ে প্রভার এবার একটি ছেলে হল; একটু সাব্যস্ত হতেই প্রভা একেবারে জেদাজেদি করে ফিরে এল সোদপুরের বাড়িতে!বাবা-মা এবং বড়খুকিকে নাতির মুখ দেখানোর জন্য। দেখুক কতদিন থাকতে পারে!  

    এই সুযোগে আমার কেবলই ইচ্ছে হতে লাগল স্পেশাল অফিসারের চাকরি নিয়ে ইজিপ্ট, মেসোপটেমিয়া বা কানাডায় চলে যেতে। নিশির কাছে শুনলাম যে তার চেনা কেউ-কেউ মেসোপটেমিয়ায় গিয়ে দেশলাইয়ের কারবার করে মেলা টাকা নিয়ে ফিরেছে।

    মনে-মনে ভাবলাম, আমার কি সত্যিই কোনও পিছুটান আছে?     

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook