বালকবয়সে আমার মধ্যে ডেঁপোমির বেশ একটা স্পষ্ট ঝোঁক ছিল। ১৯৮১ সালে সলমন রুশদির ‘মিডনাইট্স চিলড্রেন’ বুকার পুরস্কার পায়। আবার ১৯৮৮ সালে রুশদির ‘দ্য সেটানিক ভার্সেস’ বুকার পুরস্কারের চূড়ান্ত তালিকায় জায়গা পায়। এবং তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকারের প্রগাঢ় অবিমৃষ্যকারিতায় বইটি ভারতবর্ষে নিষিদ্ধ হয়। রাজীব ‘দ্য সেটানিক ভার্সেস’ পড়েছেন এমন দাবি গত ছত্রিশ বছরে কেউ করেননি। যদিও ধরে নেওয়া হয়েছে তাঁর দাদু বেঁচে থাকলে বইটি নিশ্চিতভাবে পড়ে দেখতেন। এবং তাঁর সহজাত সেই উন্নাসিক আভিজাত্যে বইটি নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতেন। যাই হোক, সদ্য-স্কুল-পেরোনো বাংলামাধ্যম আমি নেহাত ডেঁপো বলেই, ‘দ্য সেটানিক ভার্সেস’-এর বদলে রুশদির ‘শেম’ বইটা খোদায় মালুম কীভাবে যেন জোগাড় করি। এবং দিনপাঁচেক শুদ্ধ মনে পদ্মাসনে বসে প্রথম তিন পাতার প্রতিটি অক্ষরের হাতে নিষ্ঠুরভাবে লাঞ্ছিত হই। কয়েক দিন আগেই পড়লাম রুশদি লিখছেন সাহিত্য নাকি অনেকটাই বুলফাইটিং, যেখানে লেখককেও শ্রেষ্ঠ মাতাদোরের মতো খুনি ষাঁড়ের সবচেয়ে কাছাকাছি এগিয়ে যেতে হবে— ‘ইয়োর বেস্ট রাইটিং উইল বি ইয়োর মোস্ট ডেঞ্জারাস রাইটিং।’ কচিবয়সের আঁতেল পাঠক হিসেবে এমত সাহিত্যচর্চার বিপজ্জনক দিকটা অবশ্য তখনই আমার হাড়ে-হাড়ে জানা হয়ে গেছে। মনে হয়েছে বুকার পেতে হলে বুঝি গেম থিয়োরি বা পালি ভাষায় লেখা ত্রিপিটকের মতো দুরূহ কিছুকে চেনা ইংরেজি অক্ষরে বিন্যস্ত করতে হয়। সেই থেকেই বুকার শব্দটা আমার কাছে ট্রমাবিশেষ। ফলে ১৯৯৭ সালে অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’ যখন বুকার পেল, তখন বইটি পড়ে দেখার কোনও রকম দায় আমি বোধ করিনি। ভাগ্যিস করিনি।
বুকার পাওয়ার ঠিক কুড়ি বছর পরে অরুন্ধতী লিখবেন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস— ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’। দুই উপন্যাসের মধ্যবর্তী দুই দশকে তাঁর লেখা সতেরোটি উপন্যাস-নয়-এমন (নন-ফিকশন) বই চুরমার করে দিয়েছে আমার মধ্যে বাসা-বাঁধা নিমগ্ন সাহিত্যের বোধ। খুনি ষাঁড়ের পিঠে চড়ে বসে অরুন্ধতী তাকে ছুটিয়েছেন ইচ্ছেমাফিক। আর সেই ষাঁড়ের গুঁতোয় জর্জর হয়েছি আমি, আপনি— রাষ্ট্র তো বটেই। ‘দ্য লোনলিনেস অফ নোয়াম চমস্কি’ লেখায় অরুন্ধতী চমস্কির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এই কারণে যে, সমস্ত সুখময় দৃশ্যবিভ্রমের খোসা ছাড়িয়ে-ছাড়িয়ে চমস্কি রাষ্ট্রের অন্ধকারতম বাস্তবের ওপর আলো ফেলা শিখিয়েছেন। অরুন্ধতীর লেখায় এই সর্বগ্রাসী অন্ধকারই হয়ে দাঁড়িয়েছে আলোর চেয়েও বেশি উন্মোচক। নিজের আরাম ক্ষেত্র বা কমফর্ট জোনে নোঙর ফেলে ইতিউতি ঠুকরে বেড়ানো হৃদয়ঘাতী সাহিত্যবিলাস যে কতখানি কদর্য হতে পারে, সেই বোধ পাঠক পান অরুন্ধতীতে। ‘থিংস দ্যাট ক্যান অ্যান্ড ক্যান নট বি সেইড’ বইতে অরুন্ধতী বলছেন ইতিহাস অতীতকে খনন করা নয়, বরং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য চেহারাটা অনুমান করার চেষ্টামাত্র। এই বইতেই অরুন্ধতী আরও বলছেন ‘যুগোস্লাভিয়ায় একটা প্রবাদ আছে— সত্যি কথাটা বলেই পালিয়ে যাও। কিন্তু কিছু লোক পালায় না। এমনকী যখন পালানো উচিত, তখনও পালায় না।’ অরুন্ধতী পালিয়ে যান না। তাঁর মুগ্ধ পাঠক যারা, তাদেরও পালাতে দেন না। যে-অন্ধকার ঠিকরে বেরোয় তাঁর সম্ভাব্য ভবিষ্যতের আলেখ্য থেকে, তাতে অন্ধ হয়ে যাওয়া নিশ্চিত জেনেও আমরা চোখ খুলেই রাখি। খুন হয়ে যাওয়ার পরেও যেমন খোলা চোখে চেয়েছিলেন চে গেভারা।
২০০২ সালে অরুন্ধতী লেখেন ‘ডেমোক্রেসি— হু ইজ শি হোয়েন শি ইজ অ্যাট হোম’ (বই: ‘লিসনিং টু গ্রাসহপার্স’)। কুড়ি পৃষ্ঠার এই লেখাটি আমার মতে অরুন্ধতী রায়ের ইতিহাসচেতনার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আজকের ভারতবর্ষের চেহারাটা ঠিক কী হবে, তা ত্রিকালজ্ঞ ঋষির মতো স্পষ্ট চোখে অরুন্ধতী তখনই দেখে ফেলেছেন। এবং তথ্য ও তত্ত্বের টানটান বয়ানে তখনই নিখুঁত ব্যাখ্যা করে গেছেন। অনিবার্য সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন— ‘আর উই রেডি, মেনি মিলিয়নস অফ আস, টু গেট অফ আওয়ার স্টার্টিং ব্লক?’ আমরা ‘রেডি’ ছিলাম না এটা আজ ঐতিহাসিক সত্য। ‘হাউ ডিপ শ্যাল উই ডিগ?’ লেখাটায় অনিয়ন্ত্রিত পুঁজি ও ফ্যাসিজমের সহবাস কী উপায়ে ঘটে থাকে ব্যাখ্যা করে অরুন্ধতী জানিয়েছেন— ‘রাষ্ট্রক্ষমতা প্রথমে সাবধানে প্রতিবাদের কাঁধে হাত রাখে। তার ভরণপোষণের ভার নেয়। তারপর তাকে বুকে টানে। এবং শেষে তাকে গৃহপালিত করে তোলে।’ যাকে তিনি বলেছেন ‘লোয়েস্ট কমন ডিনোমিনেটর’, সেই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে জনচৈতন্যকে রাতারাতি হিংসায় মাতিয়ে তোলা যায়, তার স্টেপ-বাই-স্টেপ প্রকরণ ব্যাখ্যা করতে অরুন্ধতীকে তিনশোর বেশি শব্দ খরচ করতে হয়নি। অনেক পরে, ২০১২ সালে, ‘ক্যাপিটালিজম: দ্য গোস্ট স্টোরি’-তে (বই: ‘আজাদি’) অরুন্ধতী দেখিয়েছেন কীভাবে প্রচারমাধ্যমে পুঁজির বিনিয়োগ ফাঁদ পেতেছে আমাদের সামগ্রিক ধারণায় (কালেকটিভ পারসেপশন) পরিকল্পনামাফিক বিকৃতি ঘটিয়ে দিতে। ‘গোদি-মিডিয়া’ শব্দবন্ধের উৎপত্তি তখনও অবশ্য হয়নি।
জেল-এ রাখলে আলাদা কথা, নইলে কোনও রাষ্ট্রক্ষমতাই— সে-ক্ষমতা যে-গোত্রেরই হোক না কেন— অরুন্ধতী রায়ের ভরণপোষণের ভার নেবে এমনটা বিশ্বাস করা শক্ত। ক্ষমতায় নেই এমন সংগঠিত শক্তিও (রাজনৈতিক, ধর্মীয়) যে তাঁকে খুব খাতির করে, এমন মনে করারও কোনও কারণ নেই। দেশের মূলধারার রাজনীতিকে যিনি লিখিত অক্ষরে বলেই থাকেন ‘সুগারড্যাডি পলিটিক্স’, তাঁকে কোনও প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই সহ্য করা শক্ত। বুকার পাওয়ার পর ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’-কে অরুন্ধতীর রাজ্য কেরলেই তখন ক্ষমতায় থাকা বামপন্থীরা বলেছিলেন অ্যান্টি-কমিউনিস্ট। উপন্যাসের চূড়ান্ত পর্বে একজন দলিত মানুষের মৃত্যুর বিরুদ্ধে স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতার জনবিক্ষোভ সংগঠিত করার সহিংস বর্ণনা আছে। এই বিক্ষোভ কেন কমিউনিস্টসুলভ নয় তা আজও আমার বোঝা হয়ে ওঠেনি। তবে এ-কথা বলতেই হয় যে, অরুন্ধতী রায় সাদা পৃষ্ঠায় আঁচড় টানেন যখন, তখন তিনি সহজাত ভাবেই আগুন নিয়ে খেলেন। বুকার পাওয়ার পর কুড়ি বছরে যে-লেখক একটাও উপন্যাস লেখেন না, তাঁকে আত্মঘাতী বলা চলে না কি? বিশেষত সেই কুড়ি বছরে যাবতীয় ক্ষমতা-সমষ্টির বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি যদি বারুদ ঠাসতে থাকেন বইয়ের পর বইয়ে, তখন তাকে কী বলা উচিত? স্ববিনাশী? সর্বনাশী? গেরিলা কলমচি?
২০০১ সালে ভারতীয় সংসদে সন্ত্রাসবাদী হামলার দায়ে নিম্ন আদালত মহম্মদ আফজল গুরু-কে দোষী সাব্যস্ত করে, এবং তার ফাঁসির হুকুম হয়। গোটা দেশের গণমানস যখন পারলে আফজলকে সপ্তাহের সাতদিনই ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে চাইছে, ঠিক তখনই ঝলসে উঠলেন অরুন্ধতী। ‘অ্যান্ড হিজ লাইফ শুড বিকাম এক্সটিন্ট’ লেখায় নিপুণ কাউন্টার-আরগুমেন্টে গিয়ে অরুন্ধতী বিশদ করলেন কীভাবে, নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত কোনও অপরাধ ছাড়াই স্রেফ প্রতিহিংসার বশে একজন সম্বলহীন কাশ্মীরিকে হত্যা করতে চাইছে রাষ্ট্র। কাশ্মীরে স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের একজন কুখ্যাত ডি এস পি, যাঁর ভাষ্য ‘আই টর্চার ফর দ্য নেশন’, আফজল বিষয়ে তাঁর বয়ানও লেখায় তুলে আনলেন অরুন্ধতী। মামলা সর্বোচ্চ আদালতে গেলে বিচারকরা সরকারি যুক্তিতে বহু ফাঁকফোকর খুঁজে পান। কিন্তু আফজল গুরুর ফাঁসির সাজা বহাল রাখেন তাঁরা এই যুক্তিতে যে মৃত্যুদণ্ড না দিলে দেশের সম্মিলিত চেতনা (কালেক্টিভ কনসেন্স) সন্তুষ্ট হবে না।
অরুন্ধতী রায়ের উপন্যাস-নয়-এমন লেখার সংকলন ‘মাই সিডিশাস হার্ট’। পৃষ্ঠাসংখ্যা এক হাজার। এই বই প্রায় সবটা জুড়ে ব্যাখ্যা করে গেছে কীভাবে অর্থনৈতিক উদারীকরণের ভিতর দিয়ে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে ‘সম্মিলিত চেতনা’। অরুন্ধতী বলছেন, অবিরত যুদ্ধ এখন নেমে এসেছে মানুষের যাপন-প্রক্রিয়ায় (লাইফস্টাইল ওয়ার) এবং, এমনকী, গণতন্ত্র ‘হ্যাজ বিন টেকেন ইনটু দ্য ওয়ার্কশপ এন্ড ফিক্সড, রিমডেলড টু বি মার্কেট ফ্রেইন্ডলি।’ এই কুসময়ে অরুন্ধতী স্বীকার করছেন ‘হারিয়ে ফেলা প্রিয় উপত্যকার জন্য কাঁদি হয়তো, কিন্তু কোনো দেশের জন্য কখনোই নয়।’ যখন এই দেশ প্রতিনিয়ত হয়ে ওঠে আরও বুরবক, বে-শিক্ষিত এক বাহুবলী, তখন অরুন্ধতী স্পষ্ট উচ্চারণে ঘোষণা করেন নিজের পরিচয়— ‘আই হিয়ারবাই ডিক্লেয়ার মাইসেলফ অ্যান ইন্ডিপেন্ডেন্ট, মোবাইল রিপাবলিক’ (বই: ‘দ্য এন্ড অফ ইমাজিনেশন’)।
ওড়িশার কেওনঝড়ে বহু আদিবাসীকে উচ্ছেদ করে খুঁড়ে ফেলা লোহার খনির খাদে দাঁড়িয়ে অরুন্ধতী রায়ের মনে হয়েছিল ‘এখানে জল লাল, বাতাস লাল, মানুষের চুল এবং ফুসফসও লাল, মানুষও—তাই—লাল’ (‘ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস’)। এ দেশে এই লাল-এর স্পর্শ চিরকালই বিপজ্জনক। ২০০৮ সাল থেকে এই ‘লাল’ ঘনীভূত হয় ছত্তিশগড়ের বস্তারে প্রায় ৬০০০০ বর্গ কিলোমিটার নিষিদ্ধ জঙ্গলে। ২০০৯ সালে মাওবাদী গেরিলাদের নেতৃত্বে উচ্ছেদবিরোধী যে-আন্দোলন গড়ে তোলেন বস্তারের আদিবাসীরা, তার ধাক্কায় টাটা গোষ্ঠীকে লোহাডিংগুড়ায় ইস্পাত কারখানা তৈরির আশা ছেড়ে খালি হাতে ফিরতে হয়। প্রত্যুত্তরে ভারত সরকার মাওবাদীদের ‘সিঙ্গল লার্জেস্ট ইন্টারনাল সিকিওরিটি থ্রেট’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এবং অপারেশন গ্রিনহান্ট নাম দিয়ে নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধেই সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন।
সেই যুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখনই নিঃশব্দে মাওবাদী গেরিলাদের মধ্যে মিশে যান অরুন্ধতী। শুরু হয় কমরেডদের সঙ্গে পথ চলা। আক্ষরিক অর্থেই। সংখ্যাগত পরিচয় সরিয়ে রেখে এই যে বিপ্লবের আগুন ছুঁয়ে দেখার তাগিদ, এ তো শব্দসংখ্যা দিয়ে মাপার বিষয় নয়। দুঃসাহসিক সাংবাদিকের প্রতিবেদন এই অসভ্য সময়ে প্রতিদিন আমাদের চেতনাকে খুঁচিয়ে তোলে। আর চমকে উঠতে-উঠতে চেতনাও এক সময়ে ক্লান্ত হয়, এবং ঘুমিয়ে পরে চিরতরে। সুসান সোনতাগ একেই বলেছেন ‘কমপ্যাশন ফ্যাটিগ’। অথচ অরুন্ধতী অনায়াসে পেরিয়ে যান সেই ক্লান্তির বেসলাইন। তাঁর লেখায় উঠে আসে ছবি— যে-কোনও মুহূর্তে অ্যামবুশ হবে এমন হতদরিদ্র গেরস্থালিতে উনুনের পাশে ঘুমিয়ে পরা ছোট্ট মেয়েটার পায়ে ঝকমক করে ওঠে রুপোর মল। মধ্যরাতে পাথরের আড়ালে শুয়ে-শুয়ে দূরে আলোকবিন্দুর নড়াচড়া দেখতে-দেখতে তার মনে হয় এই আলো কি নক্ষত্রের? না কি জোনাকির? না কি সচল বিপ্লবের?
‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ উপন্যাসের শুরুতেই এক বৃদ্ধ হিজড়ের প্রেতাত্মা পরিত্যক্ত কবরখানায় ঝাঁকড়া গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতি ভোরে সেই গাছের ডাল থেকে কাকেরা উড়ে যায়, আর বাদুড়েরা ফিরে আসে। একলা গাছ বা একক প্রজাতন্ত্র ক্রমশ বিছিয়ে দেয় তার শিকড়। ‘মাই সিডিশাস হার্ট’ পড়ার পর আটমোস্ট হ্যাপিনেস পড়লেই বোঝা যায় জাদু বাস্তবের ছোঁয়ায় কীভাবে ক্রমশ প্রকাশ্য হয়ে ওঠে কাশ্মীরের লুকোনো গণকবর। পরিষ্কার হয় অরুন্ধতীর ‘দ্য অ্যালজেব্রা অফ ইনফাইনাইট জাস্টিস’।
অরুন্ধতী রায়ের ব্যাপ্তি ও বিস্তার অসীম। সেটিই তাঁর রক্ষাকবচ। তাই ‘দ্য প্রেসিডেন্ট টুক দ্য স্যালুট’ বা ‘স্ক্যান্ডাল ইন দ্য প্যালেস’ লেখার পরেও তিনি এখনও— মোটামুটি অক্ষতই আছেন। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মতো লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে, বা এডওয়ার্ড স্নোডেনের মতো মস্কোতে তাকে— অন্তত এখনও— নির্বাসিত হতে হয়নি। বিপদটাও সেখানেই। ক্রমশ আরও স্বৈরতান্ত্রিক হতে চাওয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে অরুন্ধতী হয়ে উঠেছেন সর্বোচ্চ শিকার।
১৪ জুন জি-৭ সামিটে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন দশ দিন আগে ঘোষিত নির্বাচনের ফল প্রকৃত গণতন্ত্রের জয়। ওই এক-ই দিনে দিল্লির গভর্নর ২০১০ সালে কাশ্মীর বিষয়ে একটি ‘সিডিশাস’ বক্তৃতা দেওয়ার অপরাধে অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে ইউ এ পি এ ধারায় মামলা করার অনুমতি দেন। স্বৈরাচারী শাসক যখন টের পায় যে তার প্রতি প্রজাদের ভীতি ক্রমশ কমছে, তখন বৃহত্তর ভয়ের আবহ তৈরি করতে সে বেপরোয়া প্রস্তুতি নেয়। ২৭ জুন ‘পেন পিন্টার’ পুরস্কার পাওয়ায় অরুন্ধতী এখন গোটা পৃথিবীর নজরে আছেন। তাই আশু অমঙ্গলের আশঙ্কা কিছুটা কম। তবে ডিপ স্টেট বা গভীর রাষ্ট্রের স্মৃতিও কিন্তু গভীরই হয়।
যদিও ধরে নেওয়া যায় পরিত্যক্ত কবরখানার বিস্তারধর্মী বৃক্ষকে উৎপাটিত হতে দেখলে তার ডালপালা থেকে সমস্ত কাক ও বাদুড় তাদের আরামক্ষেত্র ছেড়ে অনিশ্চিত শূন্যে ঝাঁপাবে। ঝাঁপাবেই। সেটাই অরুন্ধতীর অ্যালজেব্রা অফ ইনফাইনাইট জাস্টিস— অনন্ত সুবিবেচনার অঙ্ক।
ছবি নির্মাণ: শুভময় মিত্র