ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ৩৪


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (July 28, 2024)
     

    তরঙ্গনাথ – দশ

    বাড়ির পরিস্থিতি দিন-দিন জটিল হয়ে যাচ্ছে। দুই মেয়ে আর সদ্যোজাত খোকাকে নিয়ে তরু এখন সোদপুরের বাড়িতেই; নিজের বাচ্চা, বয়স্ক শ্বশুর-শাশুড়ি এবং উন্মাদ ননদ— সব একা হাতে সামলে চলেছে সে। জরুরি খবরাখবর দিয়ে নিয়ম করে তবু চিঠি লেখে। আর জিজ্ঞেস করে, কী কী নতুন গান শেখা হল। পাটনায় এসে তরুর জন্য একটা সেতার কিনেছিলেন তরঙ্গনাথ; গানের গলা না থাকলেও সুরবোধ তো থাকতেই পারে, এই ভেবে। কিন্তু তরুর ঝোঁকটা যেন লেখাপড়ায় বেশি; একটা বই পেলে হল। আর ভালবাসে সেলাই করতে। পাটনায় শাড়ি-পরা একজন ‘অ্যাংলো লেডি’ বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মেয়ে-বউদের সেলাই শেখান; বিচিত্র তাঁর পোশাক। বগলে একটা ইয়া লম্বা ছাতা এবং কাপড়ের থলের মতো ব্যাগ; পুরো হাতা, গলাবন্ধ ফ্রিল দেওয়া ব্লাউজের সঙ্গে জর্জেট শাড়ি এবং পায়ে বকলস লাগানো চামড়ার জুতো। চুলগুলো উবো ঝুঁটি করে বাঁধা বলে খুব বেশি করে চোখে পড়ে কান থেকে ঝালরের মতো ঝুলে থাকা তাঁর দুলগুলো। পাড়ায় সবাই তাঁকে ‘মেম-ম্যাম’ বলেই ডাকে। কারোর কোনও অভিযোগ নেই তাঁকে নিয়ে; মেয়েরা তাঁর কাছে সেলাই শিখতে চায় মেমসাহেবি প্যাটার্ন বুকগুলোর জন্যেই; উল দিয়ে কার্পেট বোনাটা শাশুড়িমায়ের কাছে শিখলেও, ক্রুশ কাঠি দিয়ে লেস বোনা― এটা তরু শিখেছে এই মেম-ম্যামের কাছেই। বড়মেয়ে বিমিও বসে যায় মায়ের সঙ্গে; সে আবার লেস বোনার সঙ্গে-সঙ্গে রেশমি সুতোয় এমব্রয়ডারিও করতে পারে। রুমালে ফুল তুলে বাবাকে সে বলে, কোনটা ফ্রেঞ্চনট আর কোনটা লেজি-ডেইজি; তরঙ্গনাথের মনে পড়ে কাটিহারে থাকার সময়ে পুরনো পাড়ের সুতো তুলে গ্রামের দেহাতি মেয়েদের বোনা সেইসব দেশজ সেলাই। কী চমৎকার সব ফোঁড় এবং রঙের ম্যাচিং! গাছপালা, জলাজঙ্গল, পাখি সব যেন ফুটে ওঠে। তুলনায় এই ইউরোপীয় বুনন এবং সুতোর রং-বাছাই যেন অনেক অভিজাত এবং সূক্ষ্ম। এমন সব নকশাদার রুমাল বা ব্লাউজের হাতার হানিকম, সেসব যেন সাদা-চামড়াদের জন্যই তৈরি।               

    আর একটা জিনিসও যা বেশ উৎসাহ নিয়ে তরু শিখছিল, তা হল ফ্রেট মেশিনের কাজ। পায়ে প্যাডেল করা মেশিনে মেহগনির পাতলা কাঠ কেটে-কেটে পেরেক-হুক ছাড়াই ছোট-ছোট সব জিনিস বানানো; মেম-ম্যাম কাগজে এঁকে মাপজোপ করে দিলেই তরু মেশিন চালিয়ে কেটেকুটে তা বানিয়ে ফেলত। একটা বই পড়তে-পড়তে, শেষ না-হওয়া অংশে যে-পালকটা সেদিন রেখে দিয়েছিলেন তরঙ্গনাথ, সেদিন তিনি দেখলেন যে, পালকের বদলে সেখানে রাখা একেবারে পালিশ করা কাঠের একটা পেজমার্ক। তরুর কাছে জানতে চাইলে, এমন ভাব নিয়ে সে চলে গেল যেন অন্য কেউ বানিয়েছে ওটা। মাসখানেক পরে তরঙ্গনাথ এবার উপহার পেলেন তিন-চারটে খোপওয়ালা একটা অপূর্ব লেটার কেস; নিপুণ করে তাতে গোছানো পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড লেটার এবং এনভেলপ। আর একবারে সামনের খোপে রাখা তাঁর কাছে সদ্য-আসা চিঠিগুলি। এভাবেই তরুর বানানো কলমদান, চশমার কেস, টেবিলের ওপর পেতে লেখার কারুকার্যময় রাইটিং বোর্ড, বক্স ফাইল এবং আরও টুকিটাকিতে ভরে উঠল তরঙ্গনাথের কাজকর্মের টেবিলটি; এমনকী তরঙ্গনাথের ইউনিফর্ম বা অন্যান্য জামাকাপড় ঝোলানোর হ্যাঙারগুলিও তরুর হাতে বানানো। তরুর ওই ফ্রেট মেশিনটার দিকে তাকিয়ে একটু যেন বিষণ্ণ বোধ করলেন তরঙ্গনাথ। আজ কতদিন হল ওই মেশিনটার ঢাকা খোলাই হয়নি। তরু চলে যাবার পর মেম-ম্যাম দু-একবার খোঁজ নিলেও ইদানীং আর আসেন না। কিন্তু তরুর অনুরোধ রাখতে, তাঁর জন্য বরাদ্দ টাকাটা তরঙ্গনাথ তাঁকে নিয়মিত পাঠিয়ে দেন। কারণ আরদালির কাছ থেকে তরু জেনেছিল যে, মেম-ম্যাম নাকি কোনও উচ্চপদস্থ সাহেবের মেয়ে। তাঁর মা ছিলেন ওই সাহেববাড়ির অবিবাহিত পরিচারিকা। সাহেব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কন্যা-সহ তাঁকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে ফিরে যাবেন; পরে জানা যায় যে, সে-দেশে সাহেবের বউ এবং ছেলেমেয়ে থাকায় মেম-ম্যামের মাকে মিথ্যে কথা বলে দেশে গিয়ে আর ফেরেননি; মেম-ম্যামের মা আত্মঘাতী হয়েছেন জেনে সাহেব গোপনে খরচ পাঠিয়ে দেন। মেম-ম্যাম বড় হয়ে ওঠেন কোনও হস্টেলে থেকে। এখানকার এক ব্রাহ্ম পরিবারের আউটহাউসে থেকে, নানারকম হাতের কাজ শিখিয়ে, নিজের সংস্থানটুকু করে চলেছেন তিনি। টেবিলের ওপর রাখা লেটার কেসটার দিকে তাকিয়ে তরঙ্গনাথ দেখলেন এঁটে রাখা বেশির ভাগ চিঠিগুলোই তরুর লেখা।   

    তরঙ্গনাথের মা সংসার থেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। স্বামীর সঙ্গেও বিশেষ সময় কাটান না, তাঁর জগৎ অধিকার করে নিয়েছে দুই নাতনি এবং ওই কয়েক মাসের নাতিটি।       


    খোকা এখন বেশ হাত-পা নেড়ে খেলা করে; গায়ের রংটা তাঁর মতোই মাজা-মাজা। একটু অসুবিধে হলেই রেগে চিৎকার করে। ওর তর্জনগর্জন দেখে বাবা খুব মজা পান; বলেন যে ঠাকুরদাদার মেজাজটাই পাবে বলে মনে হচ্ছে। আগে যেমন নিঝুম হয়ে চেয়ারে বসে থাকতেন, এখন সেটা অনেক কমেছে। সকাল হলে খোকাকে দোলনায় দেওয়া হয়েছে দেখেই, নিজের ইজিচেয়ারটা বেতের দোলার সামনে টেনে নিয়ে, খোকার সঙ্গে অনর্গল কথা বলে যান; এক বাটি কড লিভার অয়েল নিয়ে, একটা টুলে বসে মা তখন খোকাকে দলাই-মলাই করে মালিশ করেন। সেখানেই দুজনে দুটো জলচৌকি নিয়ে পড়তে বসে বিমি আর ইলা; আর এই ফাঁকে রাণীর ঘরে ঢুকে, তার মাথায় তেল দিয়ে, ঘর থেকে বের করে, এক তলায় নিয়ে গিয়ে তাকে ঘষে-মেজে স্নান করিয়ে আনে তরু; তরুকে দেখলেই তার অস্থিরতা কেটে যায়। আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো ভেবেই তার সঙ্গে গল্প শুরু করে তরু। স্নান করানোর সময়ে কোনও বাধা দেয় না রাণী। প্রতিদিন উষ্ণ গরম জলে তার গা ধুইয়ে, তবে মাথায় ঠান্ডা জল ঢালা হয়। তরুর শাড়ির আঁচল ধরে টানাটানি করে বোঝাতে চায় যে সে-ও ওইরকম রঙিন শাড়ি পরবে। দু-একবার শাড়ি পরিয়ে দিয়ে দেখা গেছে যে, কিছুক্ষণ পরেই তা খুলে ফেলে উলঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে রাণী; তরু তাই তাকে সস্নেহে বুঝিয়ে, আবার সেই হাফ প্যান্ট আর ব্লাউজ পরিয়ে দেয়; রাণী এখন আর বদুর শার্ট গায়ে রাখতে চায় না। স্নানের পর একটু দুধ-খই খাইয়ে দিলেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে রাণী। কিছুক্ষণের জন্য বাড়িটাও যেন বিশ্রাম পায়। স্নান সেরে, ঠাকুরকে ফুল-জল-বাতাসা দিয়ে এবার তরু হাল ধরে সংসারের। তরঙ্গনাথের মা সংসার থেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। স্বামীর সঙ্গেও বিশেষ সময় কাটান না, তাঁর জগৎ অধিকার করে নিয়েছে দুই নাতনি এবং ওই কয়েক মাসের নাতিটি। বড়মেয়ে বিমিরও ঠাকুমার মতো বই পড়ার নেশা। সারাদিন সে হয় পড়ে, নাহয় সেলাই করে। ইলার অবশ্য ঘর-সংসারে খুব নজর। ভাইকে বলতে গেলে সে-ই সামলায়। মাকেও সাহায্য করতে চায় না বলতেই। তরঙ্গনাথ বাড়ি এলে ইলাই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণে সব বলতে থাকে কবে কী হল। ইলার কাছ থেকে জেনে তরুকে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে, এক-ই উত্তর তরু দেয় যে, ‘ও কিছু না; ছেলেমানুষ কী বুঝতে, কী বুঝেছে! তুমি এসবে থেকো না তো!’ তরুর যেন একটাই কাজ— যাতে তরঙ্গনাথের মনে উদ্বেগের মেঘ না জমে।        

    রাতে ছাড়া আজকাল আর এ-ঘরে আসতে পারে না তরু; খাটের একপাশে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে, ছেলেকে দুধ খাওয়াতে-খাওয়াতে গল্প করতে থাকে তরু। পাটনায় কত যে পরিচিতজন তার! খবরাখবর দেবে কী করে! বেশির ভাগ লোকই তো তার অচেনা। ফিরে যাবার সময়ে মিষ্টি বানিয়ে সঙ্গে দেয়, কোয়ার্টারের আরদালি-দারোয়ানদের জন্য। আর একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বলে যে, ‘রাণীর জন্য এগুলো আনতে মোটেই ভুলো না; ও কিন্তু আশা করে থাকবে।’  

    ‘তোমার জন্য কী আনব তরু?’

    ‘আমি তো না চাইতেই সব পাই; আলাদা করে বলতে হবে তোমাকে?’

    ‘ফ্রেট মেশিনটা? এখানেও একটা আনিয়ে দেব?’

    ‘পাগল হয়েছ! এখানে ওসব হবে না গো; রাঙাদি, সেজদি, নতুন— ওরা কী ভাববে!’

    ‘তুমি তোমার ঘরে মেশিন চালাবে, তাতে ওরা কেন ভাবতে যাবে?’

    ‘ওদের যদি চালাতে ইচ্ছে করে, আমি তো না করতে পারব না; আর আমি তো মেম-ম্যাম নই যে শিখিয়ে দেব। তা ছাড়া যখনই সময় পাই, রাঙাদি আর আমি দুজনেই যার-যার খোকার জন্য কাঁথা সেলাই করি; সকালবেলা ফুল তুলে পুজোর তাট সাজাই; সময় পেলে একটু মিষ্টি করে রাখি।’

    ‘আর কী করো তরু?’

    ‘কেন, তোমাকে চিঠি লিখি।’

    ‘আর কিছু করো না?’

    ‘করি! মনে-মনে ভাবি যে, এই তোমার আসার সময় হয়ে গেল। দিন গুনি।’

    বড় একটা কাঁথায় খোকাকে পাশবালিশের মতো করে মুড়িয়ে বিছানার একপাশে শুইয়ে দিল তরু; মুখ তুলে চাইতেই দেখল যে, তরঙ্গনাথ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তরুও নিঃসংকোচে দেখতে লাগল নিজের বরকে। এখন আর পুলিশ বলে মনেই হয় না; কী সুঠাম আর রূপবান তার বর! দু-চোখের চাহনিতে যেন গান ঝরে পড়ছে। দুজনেই দুজনের কাছে সরে এসে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলে। তাঁদের ঘিরে ক্রমে বিছিয়ে যেতে লাগল জানলার জাফরি চুঁইয়ে গড়িয়ে পড়া এক অদ্ভুত আলো; যা মোমের আলোর মতোই নরম কিন্তু হলুদের বদলে শ্যাওলা সবুজ এবং কোথাও-কোথাও যেন উজ্জ্বল নীলও।          


    সাহেব ডাক্তার বা দিশি কবিরাজ— কারোর ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। রাণীর অস্থিরতা দিনকে দিন বাড়ছে। বিমি-ইলাকে তার ঘরের কাছাকাছি দেখলেই কাছে ডাকে; জানলার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে। কাউকে চিনতে পারে কি না বোঝা যায় না। নিজের আঙুলের নখগুলো কামড়ে-কামড়ে ঘা করে ফেলেছে। এক মাথা ঢেউ-খেলানো চুলগুলো জানলার শিকে জড়িয়ে, সেগুলো উপড়ে ভেঙে দিতে চেষ্টা করে। দুম দুম করে লাথি মারে দরজায়। রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময়ে মুখ তুলে দেখে লোকে বলে যায় ‘পাগলি’। বিমি-ইলা পাড়ায় খেলতে বেরোলেই বন্ধুরা জানতে চায়, ‘পিসি কি পাগলি নাকি রে!’, বা ওরা তাকে ভয় পায় কি না। মা আর কাঁদেন না। বাবা সমানেই খোঁজ করে চলেন, আর কোনও চিকিৎসা আছে কি না! সেদিন তাঁর এক ছোটবেলার বন্ধু ‘জটু’ কোথা থেকে খোঁজ এনেছে এক তান্ত্রিকের, যে নাকি পাগল সারাবার ওষুধ দেয়; মায়ের আপত্তিতে তাঁকে বাড়িতে আনা না হলেও, বাবার অনুরোধে, একলা না গিয়ে হরুকেও আসতে বলেছেন তরঙ্গনাথ। এদিন হরুকে নিয়ে বাগবাজার এসেছেন তিনি। কাশী মিত্তির শ্মশানঘাটে সে নাকি পড়ে থাকে। এখানে গঙ্গার ধারে বড়-বড় গুদাম আর কিছু বাড়ি। অনেক লোক স্নানও করে। কুস্তিগিরদের কাছে মালিশও নেয় অনেকে; তাদের মফস্‌সল অঞ্চলের মতো এই ঘাট তেমন নির্জন নয়; দাহও হয় অনেকগুলো চিতায়। ডোম আর পুরুতদের আধিপত্যেই বেশ রমরমা ব্যাবসা। একপাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তরঙ্গনাথ সব দেখছিলেন; পুলিশের উর্দি না থাকায় তাঁকেও সকলে শ্মশানযাত্রীই ভাবছে মনে হয়। হরু এসে খুঁজে-পেতে বার করল সেই সাধুকে। পাড়টা ঢালু হয়ে যেখানে থেমেছে, সেখানেই তার পাতার ছাউনি। স্নান করে না বলে, গা-হাত-পা একটু নোংরা; কিন্তু ছাইমাখা-লেংটি সাধু নয়; নেশা করে আছে বলেও মনে হল না। হরুর কাছে সব শুনে, একটা পুঁটুলি থেকে বার করে কয়েকটা পুরিয়া দিল; বলল, আগের মতো স্বাভাবিক না হলেও অস্থিরতা কমবে; নিজে থেকেই বলল যে মুক্তি হয়ে যাবে; আয়ু আর বেশি দিন নেই। তাই যা খেতে ভালবাসে সব যেন দেওয়া হয়। কথা থামিয়ে তরঙ্গনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, রাজসম্মান পাবে। পারিশ্রমিক কী দিতে হবে জানতে চাওয়ায় সাধু বলল, ‘কড়ি স্পর্শ করি না; পাড়ের ধারে ওই মিষ্টির দোকানে কড়ি দিয়ে বলে যাও, যাতে দুটো দিনের খিদে মেটে।’ এ-ও বলল যে, আর আসবার দরকার হবে না।    

    ওই ঘাটের দিক থেকে হাঁটতে-হাঁটতে বাগবাজারের রাস্তায় পড়ে হরু বলল, ‘একটু তো সময় আছে, চলো একটা বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাই।’ তরঙ্গনাথ রাজি হয়ে হাঁটতে লাগলেন হরুর সঙ্গে। ফেরবার সমস্যা নেই, কারণ পুলিশের স্পেশাল অফিসার হিসেবে একটা গাড়ি পাওয়া গেছে। বড় রাস্তার ওপর একটা মস্ত বাগান দেওয়া বাড়ি। হরু বলল, কলকাতার নাকি সবচেয়ে বড় বাড়ি। আগে এঁরা থাকতেন বাগবাজারের হাঁড়ির গলিতে; তিন ভাইয়ের মধ্যে বড়ভাই তাঁদের নিঃসন্তান মামার জমিদারি পেয়ে সেটার বেশ কিছুটা বেচে, সেই টাকায় এই বাড়ি করেছে। অকালমৃত বড়ভাই মহেন্দ্রনাথ তা দেখে যেতে পারেননি; কিন্তু বাকি দুই ভাই, নন্দলাল এবং পশুপতি এই দুজনে মিলে বাড়িটা করে একেবারে ধাঁ ধাঁ লাগিয়ে দিয়েছে সকলের চোখে।   

    একজন পরিচিত ভদ্রলোকের খোঁজে হরু একটু এগিয়ে গেলে, তরঙ্গনাথ গেটের থেকে একটু দূরে গাড়িটা রেখে, সেখান থেকেই দেখতে লাগলেন বাড়ি এবং জমির বিস্তার ও বিপুল বৈভব। অনেক পদস্থ অফিসারদের বাড়ি ও বাংলো সে দেখেছে; দেখেছে ক্লাবের বৈভবও; কিন্তু এ বাড়ি তো লাটসাহেবের বাড়িকেও হার মানায়; হরুর পরিচিত লোকটি এসে খুব আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গেলেন তাদের। ঘুরে-ঘুরে দেখালেন মার্বেলের স্ট্যাচু, দেওয়ালে আঁকা পটচিত্র এবং পৌরাণিক বিষয়ের ওপর আঁকা নানা ছবি। বিত্তবৈভবের সঙ্গে রুচি যখন মিশে যায়, তখন তা নিদর্শনমূলকই হয়ে ওঠে। তরঙ্গনাথ যেমন দেখছিলেন, তেমনই তিনি মন দিয়ে শুনছিলেন এ-বাড়ি ঘিরে নানা গল্প। পশুপতি নামটা শোনামাত্রই কী একটা অনুষঙ্গ যেন কু্য়াশার মতো আচ্ছন্ন করছিল তাঁকে।     

    মেটিয়াবুরুজ থেকে বজরায় করে নবাব ওয়াজেদ আলি এসেছেন এ-বাড়িতে! তাঁরই উৎসাহে এখানে একটা ছোট চিড়িয়াখানাও করা হয়েছিল; স্টার থিয়েটারের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় গিরিশ ঘোষ এখানকার এই ঠাকুরদালানেই বেশ কয়েকটা নাটকও করেছেন; এসেছেন গদাধর পণ্ডিত এবং শিকাগো-ফেরত বিবেকানন্দও; যেইমাত্র তনু শুনল যে, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন উপলক্ষ্যে ফেডারেশন হল থেকে যাত্রা করে সেই মহামিছিল থেমেছিল এই উঠোনেই, সব যেন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল তনুর চোখের সামনে। সুরেন বাঁড়ুজ্জে, চিত্তরঞ্জন, কস্তুরবা গান্ধীদের উপস্থিতি ঘুম কেড়ে নিয়েছিল সাহেবদের। এই বাড়ি ঘিরেই বাগবাজার অঞ্চল হয়ে উঠেছিল স্বদেশি আন্দোলনের এক প্রধান ঠেক।   

    কিন্তু তনু তার থেকেও বেশি যেটা জানে, তা হল পশুপতিকে লেঠেল লাগিয়ে মারার ষড়যন্ত্রটা। সেটা ঘটেছিল বিহারের শিমুলতলায়। এবং শুরুটাও হয়েছিল বিহারেরই গয়ায়; প্রিভি কাউন্সিল অবধি পৌঁছে ওই জমিদারির প্রোবেট নিয়েছিলেন বড়ভাই মহেন্দ্রনাথ। আর নন্দলাল ধর্মপ্রাণ মানুষ হলেও, পশুপতি ছিলেন সক্রিয় জাতীয়তাবাদী। সমস্ত বড়-বড় নেতা এবং ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ওঠা-বসা ছিল তাঁর। ব্রিটিশ, বিশেষত কার্জন-দল এবং ব্রিটিশপন্থী জমিদাররা তলে-তলে হত্যা করার চেষ্টা করেন পশুপতিকে। তাঁর শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির কোনও মামলার নিষ্পত্তিতে পশুপতি শিমুলতলায় গেলে, সেখানেই লাঠিয়াল লাগিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর সেই শ্বশুরবাড়িটা এমন ভাবে ঘেরাও করে রাখা হয় যে, চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতায় তো আনা গেলই না; এমনকী তাঁকে দাহও করে ফেলা হল সেখানেই। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরের বছরই, ১৯০৬ সালে মারা গেলেন পশুপতি বাসু। এসব রিপোর্ট চাপা দিতে তখন তোলপাড় হয়েছে লালবাজার এবং পাটনার সদর দপ্তরেও।  

    আজ সেই বিত্তবৈভবের মধ্যে দাঁড়িয়েও তাই মুগ্ধ হতে পারছেন না তরঙ্গনাথ; তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে যে, এই বাড়ি দেখানোর পিছনে কি হরুর মনে আরও কিছু উদ্দেশ্য আছে! সে কি এখনও ভাবছে যে, তরঙ্গনাথের সাহায্য নিয়ে সেইসব খুঁড়ে বার করা যাবে!  

    আমি তরঙ্গনাথ। যে যা-ই ভাবুক, আমি জানি যে পুলিশ হল শাসকদের খেলার পুতুল। তারা সব জানবে; জীবন সংশয় করে খুঁড়ে বার করবে সাক্ষ্যপ্রমাণ; কিন্তু তার রায় দেবে সরকার। পশুপতি মারা যাবার পর কাগজে কি কিছু বেরিয়েছিল! মনে করতে পারছি না। এই যে এত বড়-বড় নেতা এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, এঁরা কি কোনও বিশেষ সভা করেছিলেন তাঁর মৃত্যুতে? প্রকাশ্যে জানতে চেয়েছিলেন, কেন তাঁর দেহ বাগবাজারে আনা গেল না! কারা ভয় পেল? ভয় দেখালই বা কারা?  

    শ্মশানবাসী সাধুর দুটো ভবিষ্যদ্বাণীতেই তেতো হয়ে আছে জিভের স্বাদ। রাণী আর সারবে না— এ যেমন  মর্মান্তিক, তেমনই ঘৃণা এবং লজ্জার ওই রাজসম্মান পাওয়ার যোগ। আমি জানি এ-যাবৎ কারা, এবং কীভাবে ওই রাজসম্মান পেয়েছে।

    বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করে আছে; রাণীর ওষুধ নিয়ে ঢুকে, অন্তত মা-বাবাকে মিথ্যে কথাগুলো কী ভাবে যে গুছিয়ে-সাজিয়ে বলব, তা ভেবেই ভীষণ মুচড়ে পড়েছি।

    স্তব্ধতা ভেঙে হরু জানতে চাইল, ‘কী বুঝলে তনুদা!’

    এক কথায় যে উত্তর হয়, তাই বললাম, ‘সবাই যেন ছদ্মবেশধারী; এমনকী বাড়িটাও।’

    ওই মস্ত বাড়ির আস্তাবল, চিড়িয়াখানা, মার্বেল স্ট্যাচু, ঠাকুরদালানের কারুকার্যময় খিলানগুলো আজ যেন ডুবে গেল, সার দিয়ে লাগানো বাহারি গাছের পাতায় জেগে ওঠা শ্যাওলা-সবুজ আলোয়। অশরীরী অতীতকে গিলে সে এখন নিঃশঙ্ক। কোনও প্রশ্নেরই তদন্ত চাইবে না কেউ।

    শ্মশানচারী ওই সাধুই শুধু নিষ্পত্তি করতে পেরেছে তার খিদের। দু-দিন সে পেট ভরে খাবে রাণীর উন্মাদ-আয়ু এবং আমার রাজসম্মান যোগ। এখন আর আলো নেই। চাপ-চাপ অন্ধকারে লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে সময়।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook