ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ: পর্ব ৩১


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (July 6, 2024)
     

    ভূতেশ – ছয়

    ভূতেশের মনে কোনও সংকট নেই; কারণ যাবতীয় যা সমস্যা— তার কোনও সমাধানই যেন ভূতেশের অজানা নয়। অনেক আগে থেকেই তো সে বুঝে যায় যে কোন কাজে কী ঘটতে পারে; তেমনই সে একেবারে সঠিক আন্দাজ পায় যে, কার আচরণ ঠিক কেমন হবে। ফলে এখনও অবধি তার অনুমান একেবারে অব্যর্থ; সে তার বাড়ির লোকজন বা বন্ধু বা সহকর্মী বা বড়সাহেব— যেই হোক না কেন! ভূতেশের আরও একটা সুবিধে হল এই যে, তার নিজের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কখনওই আবেগকে জড়িয়ে ফেলে না সে। তাই তার আচরণে যেমন আলস্য নেই, তেমনই নেই কোনও স্মৃতিকাতরতাও। আর ঠিক এই কারণেই তার যৌনতাবোধেও প্রেম এসে বিরক্ত করে না তাকে। ভূতেশ যে উচ্ছৃঙ্খল তা নয়; সে আসলে ক্ষমতালিপ্সু এবং দোর্দণ্ড এক ক্ষমতাসীন পুরুষ। এরকমই তার মনের গঠন যে, পরনারী গমনকেও সে মনে করে তার  সক্ষমতারই প্রকাশ। মনের মধ্যে কোথাও কোনও অপরাধবোধ নেই তার। কেউ যে মনে দুঃখ পেতে পারে, এমন ভাবনার দায় থেকে সে একেবারেই মুক্ত। এমন সব আলোচনাকেও সে মনে করে বাতুলতা এবং এইসব কারণে দুঃখ পাওয়াকেও ভূতেশ মনে করে মনের বিকার। ফলে, তার সক্ষমতার পরিধি যত বাড়ছে, ততই ছোট হয়ে আসছে মনের মধ্যে জারিত তার অনুভূতির  দাবিগুলোও। শরীরের এবং উপার্জনের দাবি মেটাতে গড়পড়তা মানুষদের মতো বাছবিচারে না গিয়ে এটাই সে অন্তর থেকে বিশ্বাস করে―  

    লজ্জা-ঘৃণা-ভয়/ তিন থাকতে নয়!  

    বউ নিয়ে বাড়ি এসেও বিশেষ কোনও বদল চোখে পড়ল না তার আচরণে। নমো-নমো করে বউভাত সেরেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তার কলকাতা অফিসে যাতায়াত নিয়ে। নিশিকান্তর কাছ থেকে পাড়ার খবরাখবর নিতে গিয়ে ভূতেশ বুঝল যে, বাড়ি বা পাড়া এসব থেকে এখন সে অনেক দূরেই সরে গিয়েছে; নিজের চাকরি বা মিরাটে কাটানো জীবন নিয়েও বিশেষ কিছু বলবার নেই তার; তবে হরশঙ্করের উন্নতিতে সে যেন একটু থমকেছে। মানে একেবারে ইংরেজি কাগজে লেখালিখির চাকরি! এমন একটা যোগাযোগ, এবং রোজগারের পথে ফেরার মতি কার সুবাদে এবং উৎসাহে হরুর জীবনে যে ঘটে গেল, এখনও অবধি সেটাই বুঝে উঠতে পারল না ভূতেশ। ইস্কুল পরীক্ষায় ইংরেজিতে চিরকাল বেশি নম্বর পাওয়া ভূতেশ, মন থেকে যেন মানতেই পারছে না, যোগ্যতা এবং সাংবাদিকতা করার স্বপ্নই যে পথ নির্দেশ দিয়েছে হরুকে। তবে তনুদার ভাই এবং বোনের খবরে খুবই বিচলিত বোধ করল সে। জীবনে কাউকে যদি মন থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে থাকে ভূতেশ, তো সে হল ওই তনুদা এবং তরুবউদি। ভূতেশের মনে ভেসে উঠল বড়খুকি বিরজার মুখখানি; রানির মতো হয়তো সেও অবসাদে তলিয়ে যেত, যদি না জয়নারায়ণ থাকত! তবে আপাতত একটাই বাঁচোয়া যে, ধরপাকড়ের ভয়ে জয়নারায়ণ আর পাড়ায় নেই; নিশিকান্তর কথা অনুযায়ী, সে নাকি তার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে এখন চাষবাস দেখাশোনার সঙ্গে-সঙ্গে একটা ইস্কুলও চালায়; তার কাছে উৎসাহ পেয়ে, বড়খুকিও এখন নাকি পাড়ার মেয়ে-বউদের লেখাপড়া শেখাতে লেগেছে। এসব অবাস্তব বদলে কোনই উৎসাহ পায় না ভূতেশ। তবে এখন সে মনে-মনে খুবই আত্মপ্রসাদ অনুভব করে, কারণ আত্মীয়স্বজনদের বলাবলিতে সে শুনেছে যে― একটা বিয়ের মতো বিয়ে করেছে বটে ‘তাঁদের’ ভূতেশ; প্রতিমার মতো সুন্দরী বউ এবং একশো ভরি সোনার গয়না! ‘কামিনী-কাঞ্চন’ এই কথাটা মনে হতেই, ছোটখুকি অমৃতবালার স্বামী বিপিনের মুখটাই ভেসে উঠল; তার স্ত্রী সুপ্রভাকে দেখামাত্রই সে এই কথাটাই বলেছিল। তার লোলুপ দৃষ্টি যেন চারিয়ে গিয়েছিল সুপ্রভার সর্বাঙ্গে; আর তখনই ভূতেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ছুটি শেষ হয়ে মিরাট ফিরে যাবার সময়ে সুপ্রভাকে কোনোমতেই একা সে এখানে রেখে যাবে না; ফলে একটা করে দিন কাটছে আর ভূতেশ হাতড়ে বেড়াচ্ছে যে, সুপ্রভাকে কোথায় রেখে যাবে! কার কাছে! আর সঙ্গে করে নিয়ে গেলেও বা কী বন্দোবস্ত সে করবে সুপ্রভার জন্য!     


    আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে সুপ্রভা; তার মধ্যে কোথাও কোনও আড়ষ্টতা নেই। তাকে দেখে মনে হয়, সে যেন বেড়াতে এসেছে খুব চেনা কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সুন্দরী বলে খুব একটা সচেতনতাও নেই তার, গুমর তো নেই-ই; সতেজ একটা ফুলের মতোই সে ঘুরে বেড়ায়, সংসারের কাজ করে, বাড়ির পুকুরে হই হই করে সাঁতার কাটে, মন্দিরে সন্ধে দেয়। সব থেকে ভালবাসে, সন্ধেবেলা বড়খুকির কাছে বসে স্লেট-পেনসিল নিয়ে লেখাপড়া করতে। ভূতেশ বাড়ি ফিরে এরকম-ই দেখে। দেখে যে বাবা-মায়ের ঘরে গিয়ে কত না গল্প করে সুপ্রভা; তার ভাই-বোনেদের গল্প, মহানন্দা নদীর গল্প, গ্রামের গল্প; বরের সঙ্গে যৌনসংসর্গ বিষয়ে ছোটখুকি তাকে পাকাতে চেষ্টা করলেও, সেসবে তার মন নেই; বড় হতে-হতেও সে যেন থমকে আছে তার বালিকাবেলায়; ভয় পায় শুধু ভূতেশকে। কারণ বরের কলমে কালি ভরতে গিয়ে, হাত চলকে যাওয়ায় একদিন রামবকুনি খেয়েছে সে ভূতেশের কাছে; আর বকুনি খেয়েছে ফাজলামি করে ভূতেশকে কী একটা বলে, খিলখিল করে হেসে ওঠায়। সুপ্রভা বুঝে গেছে যে, তার বর একেবারে অন্যরকম; সে যা বলবে শুনে যেতে হবে; না হলেই ভীষণ বকবে ভূতেশ; তবু তার খুব ভাল লাগে, অন্ধকার ঘরে ভূতেশ যখন তাকে আদর করে বা পাশবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে; মেঘের ডাকে ভয় পেয়ে সুপ্রভার ঘুম ভেঙে গেলে, ভূতেশ তাকে কাছে টেনে নেয়। দিনের বেলা দেখা এই মানুষটাই একেবারে যেন বদলে যায়, রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন সে বরের কাছে আসে। নিজে পা ঝুলিয়ে খাটের ওপর বসে, সুপ্রভাকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে শুধু তাকে দেখতে থাকে ভূতেশ। কী দেখে কে জানে? সুপ্রভা জানতেও চায় না; প্রথম-প্রথম লজ্জা করলেও, এখন সেও দেখে ভূতেশকে। কী যে সুন্দর দেখতে তার বর! মা তো বলেই ছিল যে, একেবারে যেন সাহেবটি!  বিয়ের পর থেকে পাঁচ-ছ’দিন কেটে গেলেও তাদের মধ্যে কোনও গল্পই হয়নি; একটাও প্রশ্ন করেনি ভূতেশ; সুপ্রভাও জেনে গেছে যে, বেশি কথা বলা একেবারেই পছন্দ করে না ভূতেশ। 

    সাতদিন পার হতেই বড়খুকি সুপ্রভাকে ডেকে বলল, ‘কালকে যে বাপের বাড়ি যাওয়া, সে কথা জানো তো!’ একটু অবাক হয়ে গেলেও মাথা নেড়ে সুপ্রভা বোঝাল যে সে জানে। একটা ছোট স্যুটকেসে তার জামাকাপড় গুছিয়ে, সুপ্রভাকে চুল বেঁধে সাজিয়ে দিল বড়খুকি; ভূতেশও তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসতেই মা বললেন, ‘মন্দিরে প্রণাম করে রওনা দিয়ো দুজনে।’ বাবা-মাকে প্রণাম করে, মন্দির হয়ে, ঘোড়ার গাড়িতে উঠে বসল দুজনে। সুপ্রভার পায়ে লেসবাধা জুতো দেখে ভূতেশ একটু হাসল; আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘হাঁটতে কি অসুবিধে হচ্ছে?’  

    সুপ্রভা বলল, ‘মেমসাহেবরা  সব এমন জুতো পরে বুঝি?’

    ভূতেশ মজা করে বলল, ‘বিয়ের পর মেমসাহেবরা এমন শ্যু-ই তো পরে। ওইজন্যই তো তোমার জন্য এনেছি; কানপুরের জুতো।’

    কী মনে হতে কথা ঘুরিয়ে সুপ্রভা বলল, ‘বড়ঠাকুরঝি তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বলেছে; নইলে সব পচে যাবে।’

    ভূতেশ বলল ‘ঠিক আছে। গাড়ি আর একটু চলুক; পুরো রাতটাই তো এই রেলে কাটাতে হবে।’

    ভূতেশের মুখের দিকে বড়-বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল সুপ্রভা। তার দু-চোখ ছাপিয়ে জল ঝরতে লাগল অনবরত। ভূতেশ যেন এই প্রথম দেখল যে, সুপ্রভার চোখদুটো কী সুন্দর! অভিমান আর মায়া যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।  

    সুপ্রভার হাতটা ধরে ভূতেশ জানতে চাইল, ‘কান্না কেন? বাড়ি যাচ্ছ তো; আনন্দ হচ্ছে না?’

    চোখের জল না মুছেই সুপ্রভা বলল, ‘এখন তো ওটা-ই আমার বাড়ি; ওখান থেকে কেন আমাকে নিয়ে এলে? কৃপানাথের থানে সন্ধের বাতি কে দেবে? গরুর জাবনা, মশলাবাটা এসব করবে কে?’  

    ভূতেশ অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘তুমি এসব করো? বাপের ঘরে করতে?’

    সুপ্রভা বলল, ‘ওখানে লোক ছিল তাই করিনি; এখানে সব শিখে নিয়েছি। ভাল লাগে।’

    ভূতেশের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল; সে বুঝতে পারল যে, সুপ্রভা ঠিক তার বড়বউদি বা মেজোবউদির মতো নয়; খুব নরম আর সংসার-আনাড়ি এই মেয়ে; এমন কোমল মন নিয়ে কীভাবে সংসার করবে সুপ্রভা! ওকে তো সবাই মিলে খাটিয়ে একশা করে ফেলবে। পরক্ষণেই মনটাকে গুটিয়ে নিল ভূতেশ; সংসারের এই হিংস্রতায় মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই; সুপ্রভা বুঝলে বুঝবে; আর না বোঝে তো ক্রমে নিজেই পস্তাবে! আপাতত সুপ্রভাকে তার বাপের বাড়ি রেখে ভূতেশ চলে যাবে মিরাট; নিজের বাড়িতে রেখে আসা মানে, বিপিনের হাঁ-মুখে সুপ্রভাকে ফেলে দিয়ে আসা; এখানে অন্তত সে-ভয় নেই; লম্বা ছুটি না পেলেও এখানে এসেই সে নাহয় দেখা করে দু-একটা দিন কাটিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়িতে। সুপ্রভাকে নিয়ে তেমন সমস্যা হবার কথা নয়; কারণ তার ওই বালিকাসুলভ স্ত্রীর মনে না আছে জটিলতা, না কোনও সংশয়; তা ছাড়াও এমন কোনও গা-মাখামাখিও সুপ্রভার সঙ্গে সে করেনি যে, কেঁদেকেটে সুপ্রভা তার পথ আটকাবে। শ্বশুরমশাই লোকটি সাদাসরল হলেও খুবই বুদ্ধিমান এবং মেয়ের ভাল-মন্দের ব্যাপারেও বেশ সজাগ; তবে মাস তিনেক বাপের বাড়িতে তো সুপ্রভা কাটাতেই পারে; এতে আর কার কী অসুবিধে হতে পারে! তার মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা যে ভূতেশ করে ফেলবে, এটুকু আত্মবিশ্বাস তার নিজের ওপর আছে। ফলে আপাতত ভূতেশের লক্ষ্য হল, সুপ্রভাকে তার বাপের বাড়িতে রেখে মিরাটে ফিরে গিয়েই একটা ফ্যামিলি কোয়ার্টারের ব্যবস্থা করা।    

    শ্বশুরমশাই লোকটি সাদাসরল হলেও খুবই বুদ্ধিমান এবং মেয়ের ভালমন্দের ব্যাপারেও বেশ সজাগ; তবে মাস তিনেক বাপের বাড়িতে তো সুপ্রভা কাটাতেই পারে; এতে আর কার কী অসুবিধে হতে পারে!

    ৩ 
    দুটো রাত শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে মিরাটে ফিরে এল ভূতেশ। কাজে যোগ দিয়ে এবং দু-একজন প্রতিবেশী অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করেই বুঝল যে, তার কপালে শিকে ছিঁড়তে চলেছে খুব শিগগিরই। রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি ভ্রমণ উপলক্ষ্যে শুধু যে দরবার সাজানো হয়েছিল তা-ই নয়, রাজধানীকেও সরিয়ে আনা হয়েছে কলকাতা থেকে দিল্লি। এখন একেবারে সাজো-সাজো  রব; নতুন ইমারত আর পথঘাট সাজিয়ে শুরু হতে চলেছে রাজধানী সূচনার এক নয়া ইতিহাস। ভূতেশ এখনও নিশ্চিত নয় দিল্লিতে তার পোস্টিংয়ের ব্যাপারে; তবে মনে-মনে সে একেবারে সিঁটিয়ে আছে, কলকাতায় যদি আবার ফিরে যেতে হয় তাকে! তার থেকে ঢের ভাল বড় পোস্টে প্রোমোশন পেয়ে মিরাটেই থেকে যাওয়া। ভূতেশের আন্দাজ মোটামুটি সঠিক ছিল। তার ডিপার্টমেন্টেরই একজন বড় অফিসারের নিজের শহর কলকাতায় ফিরে যাবার আর্জি সরকারি স্তরে গৃহীত হলে, ভূতেশ প্রোমোশন পেল তাঁরই জায়গায়; সঙ্গে পেল মাঝারি মাপের তাঁর সেই বাংলোটিও; কিন্তু সাহেবের দেওয়া অলিখিত শর্ত এই যে, ফ্যামিলি নিয়ে থাকতে হবে; কারণ যখন-তখন ছুটি চাইলে তা নামঞ্জুরই হবে; ফলে বড়সাহেবের উপদেশ অনুসারে বিবাহিত ভূতেশকে সস্ত্রীক থাকতে হবে ওই বাংলোয়; ইচ্ছে করলে সে বাবা-মাকে নিয়েও থাকতে পারে। এর অর্থ একটাই― বাড়ির পিছুটান মুছে সরকারি চাকুরে, এটাই হবে একমাত্র পরিচয়; ভূতেশ জানে যে ‘নেটিভ’দের এই ‘এক্সটেনডেড ফ্যামিলি কালচার’টা সাহেবরা একেবারেই গ্রাহ্য করতে চায় না; উলটে যথেষ্ট হাসাহাসি করে তাদের নিয়ে। নতুন পদে নিয়োগের চিঠি এবং বাংলোর চাবি হাতে পেয়েই সে এবার প্রমাদ গুনল; সুপ্রভাকে নিয়ে একা থাকা কি সম্ভব! বাড়ি থেকেই বা কাকে নিয়ে আসবে তার সঙ্গে ‘ফ্যামিলি’ হিসেবে থাকতে! বড়খুকিকে নিয়ে আসাই যায়, কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে বাড়ির হাল ধরবে কে! সাতপাঁচ চিন্তা করে, নিজের বাড়িতে এখনই কিছু না জানিয়ে, শ্বশুরমশাইকেই একটা চিঠি লিখল ভূতেশ।      

    শ্রী খগেন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় সমীপেষু,                           ২রা ডিসেম্বর ১৯১২,  মিরাট 

    পরম পূজনীয় বাবা,

    দিল্লি বা কলিকাতায় বদলির বদলে মিরাট-সার্ভিসেই আমার পদোন্নতি হইয়াছে; ফ্যামিলি লইয়া থাকিবার উপযুক্ত একটি বাংলোও বরাদ্দ হইয়াছে আমার নামে; আপনাদের অনুমতি সাপেক্ষে সুপ্রভাকে লইয়া আমি এ-স্থানেই থাকিতে পারি; কিন্তু তাহার সঙ্গে আরও কেহ না থাকিলে তাহার হয়তো ভাল লাগিবে না। সোদপুরের বাড়ি হইতে যে কাহাকেও লইয়া আসিব তেমন সুবন্দোবস্ত দেখি না। সবদিক বিবেচনা করিয়া আপনি যাহা ভাল বুঝিবেন, তাহা জানাইলে সেইমতো ব্যবস্থা লইতে অগ্রসর হইব। মনে কোনও সংকোচ না রাখিয়া সত্বর জানাইবেন আশা করি। 

    আপনার পত্রের আশায়

    পূজ্যপদে প্রণাম জানাইয়া

    ইতি

    আপনাদের সেবক

    জামাতা ভূতেশ

    এর দিন কুড়ি পরে, একই ঠিকানা থেকে দুখানা চিঠি এল ভূতেশের নামে; ভূতেশ চিঠিদুটি খুলে দেখল যে, একটি চিঠি লিখেছে সুপ্রভা, এবং অন্যটি তার শ্বশুরমশাই খগেন্দ্রমোহন।

    পরমস্নেহাধিকেষু বাবাজীবন ভূতেশ,                             ২৭ ডিসেম্বর, ১৯১২

                                                                                  আংরেজাবাদ-মালদহ  

    তোমার পদোন্নতির খবর পাইয়া যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছি। তোমার শাশুড়িমা বাড়ির সকল পরিজনকে মিষ্টিমুখ করাইয়াছেন। পরদেশে চাকুরি করিতে যাইলে ইহাই দস্তুর যে, পুনরায় বদলির নির্দেশ না আসিবা-তক তোমাকে তথায়-ই বসবাস করিতে হইবে। সুপ্রভাকে সেথায় লইয়া যাইবার বিষয়ে আমাদের কাহারও কোনও প্রকার আপত্তি নাই। তুমি চাহিলে, সুপ্রভার মা এবং ছোটবোনও তাহার সহিত সেথায় যাইয়া, কিছুদিন থাকিয়াও আসিতে পারেন; সেরকম হইলে আমি নিজে যাইয়া তাহাদের পৌঁছিয়া দিবার ব্যবস্থা করিব। ইহা ছাড়াও সোদপুর হইতে তুমি তোমার মেজোবউদি এবং কন্যাকেও আনাইয়া লইতে পারো। সুপ্রভার মা এবং বোন ফিরিয়া আসিলেও, সকন্যা মেজোবউদি যদি কিছুদিন থাকিয়া যান তো, সবদিক দিয়াই মঙ্গলের হইবে।    

    জানি না, এই সিদ্ধান্ত তোমার মনঃপুত হইবে কি না! ইহা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প পথ আমার জানা নাই।

    তোমার পত্রের আশায়

    আশীর্বাদক বাবা

    চিঠিটা পড়ে শ্বশুরমশাইয়ের বিচার-বিবেচনার বেশ তারিফ করল ভূতেশ; কারণ মেজোবউদিকে আনিয়ে নেওয়ার কথাটা তো তার মাথাতেই আসেনি। দ্বিতীয়ত তার মনে হল যে, এই খগেন্দ্রমোহন লোকটি শুধু যে প্রখর বাস্তববাদী তা-ই নয়, একইসঙ্গে যথেষ্ট সাহসীও বটে! তিনজন মেয়েমানুষকে এই বিভুঁইয়ে শুধুমাত্র তার ভরসায় রেখে যেতে, দু’বার ভাবলেন না তো তিনি! মনে-মনে খুবই আশ্বস্ত হল ভূতেশ। খানিকটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতেই সুপ্রভার চিঠিখানি খুলে চোখের ওপর মেলে ধরল ভূতেশ। সুপ্রভা লিখেছে,

    ও বর,

    আমার পুতুলের বিয়েতে তোমার নেমন্তন্ন; কনের জন্য একজোড়া মেম-বুট কিনে এনো; আমার জুতোটা ওর খুব পছন্দ হয়েছে।

    তোমার বউ প্রভা

    চিঠিটা হাতে ধরে কতবার যে চোখ বোলাল ভূতেশ! এমন মিষ্টি মেয়ে সে তো আর দুটি দেখেনি; সেই সঙ্গে এও ভাবল, কবে যে বড় হবে প্রভা! বা আদৌ কি হবে?  


    নিশিকান্তকে সব জানাতে, মিরাটে সে নিজে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল মেজোবউদি আর তার মেয়ে তারাকে; তারা আর সুপ্রভা প্রায় একই বয়সি হলেও, তারা কিন্তু ইতিমধ্যেই বেশ পাকাপোক্ত গিন্নি হয়ে উঠেছে; লেখাপড়ায় তেমন মন না থাকলেও সাংসারিক জ্ঞানে সে বেশ দড়। মেজোবউদিরও মাথায় ঘুরছে তাকে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর কথা। তার আগেই দুই মেয়েকে নিয়ে স্বামী খগেন্দ্রমোহনের সঙ্গে চলে এসেছেন ভূতেশের শাশুড়িমা-ও; ফলে ভূতেশের বাংলো একেবারে জমজমাট; খগেন্দ্রমোহন আবার সেইসঙ্গে নিয়ে এসেছেন একজন বয়স্ক মানুষকেও, যে নাকি মা-মরা প্রভাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে; সে থাকলে প্রভার আর কোনও অসুবিধে হবার কথাই নয়; ফলে ভূতেশেরও আবার মনে হতে লাগল যে, নিজের বাড়িতে থাকার মতোই সে বেশ একবগ্‌গা হয়েই চাকরি করে যেতে পারবে; কোনও ব্যাপারেই বিশেষ মাথা ঘামাতে হবে না তাকে। শুধু বুঝে পেল না যে, ওই বালিকা প্রভার সঙ্গে কী করে রাতের পর রাত সে এক ঘরে কাটাবে স্বামী-স্ত্রীর মতো। সমাধান হিসেবে মনে পড়ল নিশিকান্তর কথাটা; প্রভার কোলে তাড়াতাড়ি একটা বা দুটো সন্তান এসে গেলেই প্রভাও ব্যস্ত হয়ে পড়বে জ্যান্ত পুতুল নিয়ে খেলতে। বাকিটা নিশিকান্তর মাথায় না এলেও ভূতেশ নিজেই ভেবে নিল― রাতগুলোকে তখন সে আবার নিজের মতো করেই পাবে; কারণ ছেলেপুলে নিয়ে প্রভা শোবে অন্য ঘরে এবং অন্য খাটে।     

    নিজের স্বাধীনতা না হারিয়ে, পরিকল্পনামাফিক এমন একটা ব্যবস্থা ফেঁদে ফেলায় বেশ আত্মপ্রসাদ অনুভব করল ভূতেশ। মনে-মনে সে এটাও ধরে নিল যে, তার জীবন বারে বারেই বদলে যাবে; তবে সবটাই হবে তার বাস্তববুদ্ধির নিয়ম মেনে। তার জীবনে কেনই-বা উঠবে কোনও আবেগের ঢেউ! ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণ— এ দুটোই তো সে প্রয়োগ করে চলেছে তার বুদ্ধির অনুশাসনে।  

    আমি ভূতেশ— প্রভার যেন কোনও হেলদোল নেই; এটা যে তারই সংসার এবং সে-ই যে এ সংসারের কর্ত্রী সেটা তার মাথাতেই ঢোকে না; ফলে মেজোবউদি চুটিয়ে গিন্নিপনা করছে। নিধিকাকাকে এখানে রেখে প্রভার বাবা, মা, বোন সকলেই ফিরে গেছেন; বিকেল হলেই পরিপাটি সেজে বারান্দায় বসে থাকে তারা; আর প্রভার ঝোঁক হল নিধিকাকার সঙ্গে সারা দুপুর ধরে হয় বাগান করা, নয়তো রাজ্যের কুকুর-বেড়াল-পাখি এসব নিয়ে মেতে থাকা; সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে আদ্ধেক দিনই দেখি যে, প্রভার না হয়েছে কাপড় ছাড়া বা চুল বাঁধা, না সারা হয়েছে তার ঘরের কাজ। এসব সারতে-সারতেই ঘুমে ঢুলতে থাকে প্রভা।

    মাঝে মাঝে বায়না করে নদী দেখতে যাবে বলে; শুনেছি কোয়ার্টারের মধ্যে বড়-বড় গাছে উঠে হনুমান তাড়ায়। মেজোবউদি সুযোগ বুঝে তারাকে এগিয়ে দিয়ে দেখাতে চায় যে, আমার বউ দুরন্ত বালিকার মতো অবুঝ হলেও, ভাইঝি তারা কত না বুঝদার! মাঝে মাঝে শাসন করলে চুপ করে কথা শোনে প্রভা; বড় মায়া লাগে; এমন সরল কি সত্যিই কেউ হয়!

    দু-একজন বলায় এখানকার ‘নওচণ্ডী’ মেলায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম প্রভাকে; গাড়ি থেকে নেমেই তো সে দৌড়োতে লাগল; অতবড় মেলা আর রাশি-রাশি লোক! ভাগ্যিস নিধিকাকাও সঙ্গে গিয়েছিল! জিনিসপত্র-শাড়ি-চুড়ি সব ফেলে তার পছন্দ হল ‘গজক’ নামে এখানকার তিলের মিষ্টি; আর কিনল ‘নানখাটাই’ বলে একরকম দিশি বিস্কুট; বাড়ির কাজের মেয়েদের কাছ থেকে শিখে নিল ‘নানখাটাই’ বানানো; কী করে বুঝল কে জানে যে, আমি মিষ্টির চেয়ে ‘নোনতা’ খাবার বেশি পছন্দ করি; এখন দেখি প্রায়ই সে নানখাটাই বানিয়ে, থালায় সাজিয়ে বলে ‘এই নাও― নুন ঠিকরি করেছি।’ আর যাই হোক, প্রভার রান্নার হাতটা কিন্তু বড় ভাল!

    মিরাটে থাকতেই, নিশিকান্তর যোগাযোগে তারার জন্য একটি সুপাত্র পাওয়া গেল। সোদপুরের থেকে আরও একটু এগিয়ে কামারহাটি অঞ্চলে তার বাড়ি; মিরাটের আর্মি-অফিসেই যোগ দিয়েছে ক্লার্কের পদে। প্রভার বাবার দেওয়া গয়নার ভরসায় তারার বিয়েটা পাকা-ই করে ফেললাম।

    সন্তানসম্ভবা হতেই প্রভাও বাপের বাড়ি থাকতে গেল মালদায়। এখানকার স্থানীয় লোকের দেখাদেখি প্রভা আবার মিরাটকে বলে ‘মেরট’

    আমারও বদলির অর্ডার হল, খাস দিল্লিতে একেবারে ভাইসরয়ের অফিসেই।     

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook