খেলাকেন্দ্রিক মতি নন্দী আর খেলার বাইরে মতি নন্দী। শুধুমাত্র গ্রন্থপঞ্জির বিন্যাসে ‘লেখক’ মতি নন্দীর এমন মোটাদাগের বিভাজন করে ফেলা সম্ভব। ক্রীড়াসাংবাদিকতা ও ক্রীড়াসাহিত্যের বাইরে যে-ছোটোগল্পকার মতি নন্দীকে আমরা খুঁজে পাই, তিনি মুখ্যত শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির আখ্যানকার। সেই আখ্যানের একটা প্রান্ত যদি ধরে রাখে পিছুটানে ত্রস্ত কেরানিকুল, তাহলে তার অপর প্রান্ত নারীদের কণ্ঠস্বরে উদ্বেল। মতি নন্দীর কথাসাহিত্য নিয়ে আলাপকালে এই দু’প্রান্ত-ই বরাবর অন্তরালে থেকেছে। মধ্যবিত্ত বঙ্গজীবনের চরিতকার সংক্রান্ত আলোচনা কখনও সখনও পর্দা টেনে উঁকিঝুঁকি দিলেও নারীচরিত্রের রূপদক্ষ শিল্পী হিসেবে মতি নন্দী যে সর্বোতভাবে উপেক্ষিত— এ কথা বেশ জোর গলায় বলা যেতে পারে। অথচ কোনও রকম বাছবিচার, ছুঁতমার্গিতা ছাড়াই বিভিন্ন সামাজিক স্তরের, বয়সের ও জীবিকার নারীচরিত্র মতি নন্দীর গল্পে যে ভাবে জায়গা করে নিয়েছে তা শুধুমাত্র বৈচিত্র্যের নিরিখে বিস্ময় জাগাতে বাধ্য! শরীর ও মনের রসায়ন-বদল নিয়ে জিজ্ঞাসু কিশোরী, বিবাহবিচ্ছিন্ন কিংবা প্রেমিক-প্রতারিত রমণী, অনূঢ়া যুবতী— সকলের নির্ভীক, স্বচ্ছন্দ সমাবেশ তাঁর গল্পভাণ্ডারে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ নারীবিশ্ব রচনা করে। নারীদের আচরণ, মনোভঙ্গি প্রধানত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ, নীতি-আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সমাজ চায় অধিকার, আদর্শ ও সংস্কারের ধুয়ো তুলে তাদের অবরুদ্ধ করতে। আর এই অবরোধের তাৎপর্যপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে ‘বিবাহ’।
বিশেষত, কুমারী মেয়ের বিয়ে নিয়ে পরিবার ও পাত্রীর দুশ্চিন্তার বিষয়টিকে মতি নন্দী অনেক গল্পের কেন্দ্রীয় সমস্যা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। বাড়ির মেয়ে বিয়ের বাজারে পাত্রী হিসেবে যেন যোগ্য মূল্য পায়, সেই মতো তাকে প্রশিক্ষিত করার কথা ‘বেহুলার ভেলা’-য় রয়েছে। প্রমথ তার মেয়ের অভিমান ভাঙাতে বলে— ‘লক্ষ্মী মা আমার ওঠ, যা রান্নাটা শিখে নে। আরে বোকা শ্বশুরবাড়িতে যখন রাঁধতে বলবে তখন যে লজ্জায় পড়বি, আমাদেরও নিন্দে হবে।’ গলিজীবনে লোকনিন্দার ভয় প্রবল। ঘনসন্নিবিষ্ট বাড়ি। একে অন্যের হাঁড়ির খবর রাখে। কুমারী মেয়ের নামে যেন কোনও অপবাদ না রটে, সে কারণে প্রমথর স্ত্রী দেরি করে বাড়ি ফেরা মেয়েকে এলোপাথাড়ি চড় মেরে জানায়— ‘কি এত কথা ফিসফিস, গুজগুজ? তৃপ্তির মাস্টারের সঙ্গে হাসাহাসি কেউ যেন আর দেখতে পায় না, না?’ প্রমথও তার স্ত্রীর এই দুশ্চিন্তাকে সঙ্গত মনে করে মেয়ে পুতুলকে বলে— ‘ঘরে আইবুড়ো মেয়ে থাকলে অমন ডাকাডাকি সবাই করে, তোর মেয়ে থাকলে তুইও করতিস।’ এই দুর্নামের ভয় যদিও দ্বিপাক্ষিক। বোঝা যায় ‘এবং তারা ফিরে এল’ গল্পে। যখন ফেলা দত্তর বউ ফেলাকে বলে— ‘তোমার সেজছেলেকে ছাদে ওঠা বন্ধ করতে বলো। অজিত মাস্টারের মেয়েটার সঙ্গে তো আজকাল খুব ঠ্যাকার চলে, তারপর কোনদিন একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে’খন।’
পটভূমি উত্তর কলকাতা। পাশাপাশি গা ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা বাড়ি। ছিটেফোঁটা নিভৃতি নেই। হাঁফধরা মধ্যবিত্ত জীবনে তাৎক্ষণিক মুক্তির স্বাদ দিতে বাড়ির ছাদ মতি নন্দীর গল্পে তাই অসম্ভব গুরুত্ব পেয়েছে। কখনও অকপট স্বীকারোক্তি, কখনও নিরপেক্ষ আত্মানুসন্ধানের মঞ্চ হয়ে উঠেছে ছাদ। ‘নায়কের প্রবেশ ও প্রস্থান’-এ শেফালি, বত্রিশে পড়লেও যার বিয়ে হচ্ছে না, পাড়ার ছোকরাদের কাছে যার নাম ‘শাকচুন্নি’, সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ‘ছাদের কিনারে’ বসে থাকে। ‘বেহুলার ভেলা’ গল্পেও প্রমথ রাতের বেলা ‘আরও অনেক তারা দেখা যাবে’ এই আশা নিয়ে ছাদে ওঠে আর সেখানে অমিয়ার সঙ্গে নিজেদের দাম্পত্য-সম্পর্কের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চালায়। ‘যুক্তফ্রন্ট’ গল্পের খুকি নির্জন দুপুরে তিনদিক দিয়ে চাপা একতলা বাড়ির ছাদে উঠে ‘একটুখানি মাত্র গলির দিকে’ তাকিয়ে নিঃসঙ্গতা কাটাতে চায়।
‘ছাদ’ গল্পে দিনান্তে একতলার ভাড়াটে পরিবারের সমবয়সি কিশোরী মঞ্জু ও রেখা ‘বিকেল হলেই সাজগোজ করে উঠে আসে ছাদে। শাঁখ বাজলেই নেমে যায়। দিনের পর দিন আজ পাঁচ বছর ধরে।’ জীবনযাত্রার এই যান্ত্রিক অনুবর্তন রেখার কাছে দুঃসহ ঠেকে। ছেলেবেলার বান্ধবী কলেজপড়ুয়া ইতুর সঙ্গে হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দূরত্ব তার নিঃসঙ্গতাকে দ্বিগুণিত করে। এখানে রেখার মানসিক জটিলতা লক্ষণীয়। রেখা একদিকে হীনমন্যতাবশত ‘শিক্ষিত মেয়ে’ ইতুর সঙ্গে যেচে আলাপ করতে অস্বস্তি বোধ করে, ছেঁড়া জামাকাপড় পরে তার বাড়ি যেতেও রেখার সংকোচবোধ হয়, কলেজের ছেলেদের সঙ্গে ইতুর ‘যত ভাব’ বলে নিজেকে তার সংস্রব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়, ঘোষণা করে— ‘গরিব মানুষ, গরিবের মতোই থাকব।’ অন্যদিকে এই রেখা-ই খুনুপিসির সদ্যবিবাহিতা মেয়ে টুলুদির ‘প্রেম করে বিয়ে করা’ বিষয়টিকে গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করে। তার সন্ধেবেলা বরের সঙ্গে বাইরে বেরোনো (লক্ষণীয়: রেখা ‘’শাঁখ বাজলেই’ ছাদ থেকে নেমে আসতে বাধ্য হয়), স্বামীর বন্ধুদের নিজের হাতে চা এনে দেওয়া, সর্বসমক্ষে গান গাওয়া, স্বামীর অনুমতি নিয়ে চাকরি করা-কে অবরোধ-ভাঙা জীবনযাপনের প্রকাশ বলে মনে করে। কিন্তু তার এই চিন্তাভাবনাকে সোচ্চারে সর্বসমক্ষে তুলে ধরা রেখার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সুতরাং, একাধারে নিজের মধ্যবিত্ত সত্তা এবং অর্জিত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে লালন এবং ক্ষেত্রবিশেষে তার বিরোধিতা করতে চাওয়ার দ্বন্দ্বে রেখার মধ্যে জন্ম নেয় মানসিক অবদমন। এই পরিস্থিতিতে পাশের বাড়ির তিনতলার ছাদে দাঁড়ানো জীর্ণ চেহারার লোকটি, পাঁচিলের ওপর থেকে যার ‘সরু বুক, গলার কণ্ঠা, কনুইয়ের হাড় আর ভুরুর ওপরের খানিকটা’ দেখা যায়, তার দিকে চেয়ে মঞ্জু আর রেখার মনে জমে থাকা হতাশা, স্বপ্নপূরণের ব্যর্থতা প্রবলভাবে বেরিয়ে আসে। মঞ্জু ‘ছাগলের মতো তাকিয়ে থাকা’ লোকটার চোখদুটো গেলে দিতে চায়; রেখা তার চেহারা নিয়ে তাচ্ছিল্য করে। কিন্তু দিনের শেষে ঘোর অপছন্দ সত্ত্বেও একজন পুরুষের চাহনি তাদের প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণার প্রশমন ঘটায়।
মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার এই ছবি আরও নিপুণভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘একটি পিকনিকের অপমৃত্যু’ গল্পে। ‘আরও নিপুণভাবে’ বলছি, তার কারণ ‘ছাদ’ গল্পে নারীমনের সূক্ষ্ম দিকগুলি উঠে এলেও তাতে হালকা ভাবালুতা, কিঞ্চিৎ দুঃখবিলাসিতা মিশে রয়েছে। দ্বিতীয় গল্পে লেখকের বর্ণনাভঙ্গি আরও শাণিত। আরও প্রত্যক্ষ। মানসিক দ্বন্দ্ব এখানে আরও অকপটে বেরিয়ে আসে। যদিও চরিত্র এবং বিষয়গত উপস্থাপনার সাদৃশ্য পাঠকের চোখ এড়ায় না। যেমন, আর্থিকভাবে অসম প্রতিপক্ষ উভয় গল্পে রয়েছে। প্রথম গল্পে একদিকে ইতি, টুলুদি, অন্যদিকে মঞ্জু আর রেখা, তেমনই দ্বিতীয় গল্পে একপক্ষে চিত্রা অন্যপক্ষে দীপালি, শীলা, সুপ্রিয়া ও করুণা। বস্তুত, এই অর্থনৈতিক বৈষম্যই চরিত্রদের মানসিক জটিলতাকে প্রকাশ্যে আনে। উদাহরণ হিসেবে আমরা গল্পে মেয়েদের পিকনিক-পরিকল্পনার দৃশ্যটির কথা ভাবতে পারি। ‘বড়োলোক’ প্রেমিক অরুণ বনভোজনের সমস্ত খরচ বহন করবে— চিত্রা ‘তাচ্ছিল্যভরে’ এই ঘোষণা করামাত্র দীপালি তার সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। আবার সমস্ত প্ল্যানিংয়ের পর বাড়ি ফেরার পথে সকলে ভাবতে থাকে— টাকা খরচ করে বনভোজনে যাওয়াটা আদৌ ঠিক হবে কি না। তাদের দুশ্চিন্তার সূত্রে মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের পরাধীনতার ছবি প্রকট। একটি দৃষ্টান্ত:
‘করুণা একা দাঁড়িয়ে চৌমাথার মোড়ে। কাছেই বাড়ি। কিন্তু বাড়ি গিয়ে কী করবে? বৌদি বলবে সিনেমা চলো, বাবা বলবে সেতার বাজিয়ে শোনা, মা বলবে একফোঁটা দুধ ফেলে রাখা চলবে না… মাস্টারমশাই বলবে আজকাল আর তুমি মন দিয়ে মোটেও পড়া শোনো না।
করুণা একা দাঁড়িয়ে ভাবল, বাড়ি গিয়ে কী করবে?’
শুধু দিনগত পাপক্ষয়-ই নয়। ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতিও কী ভাবে অন্যের ইচ্ছে-অনিচ্ছে দ্বারা চালিত হচ্ছে, করুণার এই মনে হওয়া তার প্রমাণ। পরিবারে তার নিজস্ব কোনও মতামত বা দাবি প্রকাশের সুযোগ নেই। মতি নন্দী গল্পের এই বিশেষ অংশের চারটি অনুচ্ছেদে উপার্জনক্ষম অথচ সংসারে অবহেলিত চারজন নারীর দুর্দশাকে তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গল্পে খুকির বিয়ে নিয়ে তার বাবা-মায়ের কথোপকথন আমাদের স্মরণে আসবে। খুকির জন্য শ্যামপুকুর নিবাসী, দোজবরে, খুকির দ্বিগুণ বয়সি, দুই সন্তানের পিতা ‘অবস্থাপন্ন’ পাত্রের কথা বলতে গিয়ে তার মা মন্তব্য করে— ‘… খুকির অত বাছবিচার নেই, যা দেবে আমার সোনামুখ করে নেবে।’ মধ্যবিত্ত পরিবার ও সমাজে এই অন্ধ আনুগত্য, বিনা প্রশ্নে বশ্যতাস্বীকারকে ‘বিবাহ’ নামক সামাজিক প্রথার মোড়কে কী ভাবে ন্যায্যতা দেওয়া হয়, মতি নন্দী তাঁর গল্পে তা বারবার দেখাতে চান।
পাশাপাশি পৌরুষের সংজ্ঞা হিসেবে প্রচলিত ধারণাটিকেও প্রসঙ্গক্রমে লেখক পাঠকের সামনে পেশ করেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে গোটা প্রেক্ষিতটি তিনি উপস্থিত করেছেন নারীর চোখ দিয়ে। ‘ছাদ’ গল্পে ক্রুদ্ধ মঞ্জু প্রশ্ন ছুড়ে দেয়— ‘পুরুষমানুষের আবার ছাদে ওঠা কী।’ আর ‘একটি পিকনিকের অপমৃত্যু’ গল্পে শিবুর দিকে চেয়ে শীলার তাচ্ছিল্যভরা মন্তব্য— ‘… ওটা আবার পুরুষমানুষ নাকি।’ প্রথম গল্পে (‘ছাদ’) ‘সযত্নে পাট-করা চুলে মাঝে মাঝে আঙুল ছুঁইয়ে আদর’ করতে করতে ছাদে পায়চারি করা লোকটির সঙ্গে শিবুর (‘একটি পিকনিকের অপমৃত্যু’) চেহারা এবং ব্যক্তিত্বের মিল চোখে পড়ার মতো। শিবুর ‘জিরজিরে বুক’। তার ‘কণ্ঠার হাড় স্পষ্ট’। সে ‘মেয়েদের ফাই-ফরমাস পাওয়ার জন্য সতত ব্যস্ত’। আর এর ঠিক উলটো ইমেজ ফুটে ওঠে চিত্রার প্রেমিক অরুণের দৈহিক বর্ণনায়। পিকনিকে যাওয়ার পথে ‘দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে সুন্দর স্বাস্থ্যটা’ বিবদমান জনতাকে দেখানোমাত্র ‘তার কর্তৃত্ববাচক কণ্ঠের দাপটে’ সকলে কিনা বাকস্তব্ধ হয়ে যায়। পিকনিকে গিয়ে কস্টিউম পরা অরুণের ‘জানুদ্বয় ও নাভি’ ‘নির্জন স্থানে মেয়েদের কাছে অস্বস্তিকর’ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে শিবু সকলের আড়ালে থাকতে চেয়ে নিজেকে রান্নায় ব্যস্ত রাখে। ক্ষমতা ও সম্ভ্রমের দুটি আলাদা মেরুতে রয়েছে অরুণ ও শিবু— ‘ছাদ’ গল্পে যে-জায়গায় ছিল রেখার সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসা দিব্যেন্দু ও ছাদে পায়চারি করে বেড়ানো হাড়জিরজিরে যুবকটি। অরুণের সঙ্গে শিবুর যতটা ব্যবধান, ঠিক ততটাই ব্যবধান রয়েছে শীলা, সুপ্রিয়া বা করুণার। তাই গল্প যত এগোয়, আমরা দেখতে পাই, নিছক ‘মজা করার জন্য’ আনা হলেও মেয়েরা শিবুর পক্ষ নিয়ে তাকে অরুণের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলতে চাইছে। চাইছে তাকে নিজেদের ধারণামাফিক বীর্যবান পুরুষ বানাতে। এভাবেই করুণা এবং তাচ্ছিল্যের দূরত্ব আস্তে আস্তে মুছে যেতে থাকে। (‘ছাদ’ গল্পের শেষেও আমরা একই পরিণতি লক্ষ করি।)
এতক্ষণ শিবুকে অবহেলা করা, দাক্ষিণ্য দেখানোর মধ্য দিয়ে মেয়ের দল অবসাদ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল। কিন্তু পরীক্ষার রণভূমিতে তো শিবু নেহাতই এলেবেলে। অরুণের সঙ্গে পেরে ওঠা তার পক্ষে কার্যত অসম্ভব। তাই ট্রাপিজের দড়িতে দাঁড়িয়ে শিবু ক্রমশ টলতে থাকে। সেইসঙ্গে চড়তে থাকে মেয়েদের মানসিক বিক্ষোভ। অরুণ আর চিত্রার বেপরোয়া ঘনিষ্ঠতা দেখে মধ্যবিত্ত সংস্কারের খোলস ভেঙে অন্তিম টোপ ছুঁড়ে দেয় শীলা— উঁচু গাছ থেকে ডাব পেড়ে আনতে পারলে তাদের যে-কাউকে সে (শিবু) ভোগ করতে পারে। শিবু গাছে চড়ার পর লক্ষ্যবিন্দুতে না পৌঁছনো পর্যন্ত তারা ছুঁড়ে চলে ঢিল। দীপালি ‘উন্মাদের মতো’ চিৎকার করে ওঠে— ‘পারতে হবে। পারতেই হবে, নইলে নামতে দেবো না।’ হিংস্রতা ও কাতরতায় জারিত এই বিস্ফোরণ আসলে চারজন মেয়ের এতদিনকার পুষে রাখা হীনমন্যতা, পরিবার ও সমাজের চাপানো সংস্কার নিঃশর্তে মেনে চলার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু গল্পের শেষে শিবুর মৃত্যু চরিত্রগুলিকে পুনরায় স্থিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনে। কিছুক্ষণের জন্য যে-জৈবিক সত্তার নিরাভরণ চেহারা প্রকাশ্যে এসেছিল, তাকে চাপা দেয় মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদিতা, মধ্যবিত্ত আত্মসর্বস্বতা। শিবুর মৃত্যুর দায় ঝেড়ে ফেলে শীলা ‘শান্ত গলায়’ জানায়— ‘কারুর ইঁট-ই ওর গায়ে লাগেনি। বোকার মতো ওঠার চেষ্টা করছিল, এটা অ্যাক্সিডন্ট।’
‘বিবাহ’, ‘পৌরুষ’ পেরিয়ে যদি ‘যৌনতা’-র দিকে তাকাই, তাহলে বলতে হয়, মতি নন্দীর গল্পে তৃতীয় অনুষঙ্গটিও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে। স্বামী-স্ত্রী-র মধ্যেকার গতানুগতিক, ছন্দহীন সম্পর্কের মাত্রা বোঝাতে যান্ত্রিক রতিক্রিয়ার দৃশ্য রয়েছে ‘পর্দার নীচে একজোড়া পা’ কিংবা ‘যুক্তফ্রন্ট’-এর মতো গল্পে। আবার বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে খুকি-র মানসিকতার পরিবর্তন, বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে তার ধারণা একটু একটু করে বদলে যাওয়ার ছবি গল্পকার তুলে ধরেন এভাবে— ‘খুকির তখন কারখানাবাড়ির চালায় চোখ। দুটো পায়রা, নিশ্চয়ই মদ্দা এবং মাদী, বকম-বকম করতে করতে যা করার তাই শুরু করে দিয়েছে। খুকি প্রথমেই পিছনে তাকিয়ে ঘুমন্ত মাকে দেখে নিল। অতঃপর নিশ্চিন্ত হয়ে, গভীর মনোযোগে যখন মুখটি উপরে তুলে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল তখন শুনতে পেল না গলি দিয়ে ছুটে আসা পায়ের শব্দ।’ একটু তলিয়ে পড়লে আমরা বুঝতে পারব, যৌনতা ও যৌনজীবন সম্পর্কে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে এবং তাদের জীবন নিয়ে গল্প লেখেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে যে রক্ষণশীলতা, ছুঁতমার্গিতা এবং দ্বিচারিতা রয়েছে— গল্পকার এখানে আসলে তাকেই আলোয় আনতে চান। ‘আমার লেখক হয়ে ওঠা’ প্রবন্ধে মতি লিখেছেন— ‘যৌনজীবন এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে ট্যাবু হয়ে আছে। তার জন্য হয়তো বাংলা ভাষার দুর্বলতাই দায়ী। যৌনজীবন, আমাদের শরীরের অনেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নাম লেখায় প্রকাশ করার মতো ভাষা শব্দ বাংলায় এখনও নেই।… ভিক্টোরিয়া রুচিবোধের দ্বারা আক্রান্ত হবার ফলে বাংলা সাহিত্য কুঁকড়ে গেল। সম্পূর্ণ জীবন বাংলা সাহিত্যে উঠে এল না।’ মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের সমগ্রতাকে ধরতেই মতি নন্দী যৌনতাকে তীক্ষ্ণ আয়ুধ করতে চেয়েছেন। বাঙালি সমাজ যে-প্রবৃত্তিকে সন্তানের বড় হয়ে ওঠার স্বাভাবিক দিক মনে করে না, বিশেষ করে মেয়েদের কুমারীত্ব এবং সতীত্বকে রক্ষা করার ব্যাকুলতায় যে-বিষয়টিকে তাদের বিবাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়, মতি নন্দী তাঁর গল্পে সেই মানসিকতাকে প্রবল সমালোচনায় বিদ্ধ করতে চান।
আমরা ‘একচক্ষু’ গল্পটি নিয়ে আলোচনা করতে পারি। সেখানে কণিকা কলেজের অধ্যাপিকা। কণিকা রুচিশীলা। সামাজিক ভব্যতাবোধ প্রখর। দীর্ঘ এগারো বছর পর তার স্বামী স্ত্রী ও কন্যাকে ফিরে পেতে মামলা করে। কিন্তু ফিরে যেতে না চেয়ে তাকে পালটা আইন-আদালতের পথ বেছে নিতে হয়। যুক্তি, প্রমাণের ওপর মামলার হার-জিত নির্ভর করে। আদালতে উপযুক্ত প্রমাণ, সাক্ষী পেশ করতে হয়। এই পথ জটিল। ক্ষেত্রবিশেষে নির্মম। এতদিন ধরে মেয়ের কাছে বাবার পরিচয় গোপন রাখার পর কণিকা উপলব্ধি করে, স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়া তার পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব। তাই বাধ্যত, সে অসততার পথ বেছে নেয়। এক-সময়ের বাড়ির কাজের মেয়ে গীতাকে জোর করে মিথ্যে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাতে চায়। এর জন্য গীতার চরিত্র কলঙ্কিত হবে জেনেও কণিকা পিছপা হয় না। সাক্ষীসংগ্রহের এই কুৎসিত রাস্তা বেছে নিতে চাওয়া কণিকার সঙ্গে তার শালীন, ভদ্র সত্তাটির দ্বন্দ্ব দানা বাঁধে।
এই সংঘাতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়, যখন কণিকা মেয়ে রুনুর বইয়ের তাক থেকে যৌনবিজ্ঞানের বই আবিষ্কার করে। পেশায় অধ্যাপিকা হওয়া সত্ত্বেও কণিকার চোখে বইটি ‘খারাপ বই’। উপরন্তু বইটি দিয়েছে একজন পুরুষ। রুনুর এই আচরণ কণিকার কাছে নীতিবিগর্হিত মনে হয়। মেয়ে ইংরেজি বই দেখে এসেছে শুনে কণিকার প্রতিক্রিয়াটি তাৎপর্যপূর্ণ—
‘… ইংরেজি বই দেখে এসেছে রুনু। কথাগুলো নিশ্চয় বুঝতে পারেনি, কিন্তু বইতে যা ঘটে তাতো অন্ধকার ঘরে চোখ দিয়ে দেখেছে। পাশেই ছিল দুটো পুরুষ। হায় ঠাকুর! কণিকার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। অশ্লীল দৃশ্য রুনু দেখেছে, অসভ্য বই পড়েছে বা পড়ার জন্য এনেছে।’
লক্ষণীয়, কণিকার এই বিলাপের পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে অনুমানের ওপর। মেয়ে ইংরেজি ছবির কথা বুঝতে পারেনি, সে শুধু অশ্লীল দৃশ্যটুকু উপভোগ করেছে, হয়তো বা পাশে বসা দুজন পুরুষদের মনোরঞ্জন করেছে, যৌনবিজ্ঞানের ‘অসভ্য বই’ পড়ে জ্ঞান অর্জনের বদলে অশ্লীলতার শিক্ষা গ্রহণ করেছে— এই আগাম অনুমাননির্ভর সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়াটি বিত্ত, রুচি ও সামাজিক পদমর্যাদার আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্ধত্ব ও মানসিক সীমাবদ্ধতাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। কণিকার চোখে যৌনতা একটি অশ্লীল বিষয়। তাতে সে কেবলমাত্র প্রবৃত্তির উলঙ্গ প্রকাশ লক্ষ করে। কিন্তু বই পড়ে বিষয়টিকে যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব, ইংরেজি ছায়াছবি মানেই যে অশ্লীলতার অবাধ উৎসার নয়— এই বোধ কণিকার মনে জাগেনি। অর্থাৎ, চরিত্র এবং মানসিকতা বিকাশের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি হিসেবে যৌনতার কোনও তাৎপর্য তার কাছে নেই। লোকসমাজে নিজের সম্ভ্রম বিষয়ে সচেতন, উচ্চবিত্ত, পেশায় অধ্যাপিকা কণিকাও যে ছাপোষা মধ্যবিত্ত সংস্কার ও ভিক্টোরীয় শুচিবোধের ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ হন— ‘একচক্ষু’ গল্পটিতে প্রসঙ্গক্রমে লেখক তা-ই দেখাতে চেয়েছেন। পাশাপাশি পিতৃতন্ত্র, শুচিতা ও সতীত্বের কাঠামোর মধ্যে যে ভাবে মেয়েদের পুরে রাখতে চায়, তাতে যে নারীদেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে, আলোচ্য প্রসঙ্গে সেই বিষয়টিও আর গোপন থাকে না।
‘এবং তারা ফিরে এল’ গল্পে লেখক আরও নির্মোহ, আরও আক্রমণাত্মক। এখানে তাঁর নজর গলিজীবনের দিকে। পাড়ার টিউবওয়েলের পাশেই আঁস্তাকুড়ে ‘কেলেঙ্কারির জিনিস’ পড়ে থাকতে দেখে সকলে সচেতন হয়ে ওঠে। শুরু হয় ঘর বাঁচিয়ে পরস্পরকে সন্দেহের পালা। খেয়াল করার বিষয় হচ্ছে, লেখক আখ্যানবিবৃতির মধ্যে একটি ইঙ্গিতময়তা বজায় রেখেছেন। কথনে এই আবছায়াভাব, এই অস্পষ্টতা আসলে মধ্যবিত্তের ভণ্ডামি ও জড়ত্বের প্রতি তীব্র কষাঘাত। গোটা গল্পে একবারও ‘গর্ভপাত’ শব্দটি উল্লিখিত হয় না; বদলে চরিত্রগুলির কথনে ‘এ জিনিস’, ‘কেলেঙ্কারি’, ‘কী কাণ্ড’, ‘বিধবা কি কুমারী মেয়ের কীর্তি’-র উল্লেখে মতি নন্দী মধ্যবিত্তের দ্বিধার জায়গাটিকে সুকৌশলে তুলে ধরেন। পাশাপাশি মেয়েরা পরিবারে কী ভাবে ব্যবহৃত হয়, সেই প্রসঙ্গও উঠে আসে। পাড়ার লোকের চোখে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চেয়ে সকলেই নিজেদের বাড়ির কুমারী, সধবা মেয়েদের বাইরে বেরিয়ে হাসিখুশি, স্বচ্ছন্দ থাকার নির্দেশ জারি করে। অজিত ধরের মেয়ে খুকি জ্বর গায়ে ছাদে উঠে স্কিপিং শুরু করে। ভেলোর মা নিদান দেয়— ‘মেয়ে-বউ সবাইকে এগজামিন করলেই বেরিয়ে পড়বে।’ তাই শুনে সুব্রত মৈত্র সরস মন্তব্য করে জানায়, তার স্ত্রী নিশ্চিতভাবে সেই পরীক্ষায় ডিস্টিংশন সমেত পাস করবে। চাটুজ্জে গিন্নি-কে আসতে দেখে ছোটবউ তার স্ফীত মধ্যদেশের ওপর আঁচল বিছিয়ে দেয়, যা দেখে গিন্নির বারকয়েক ভ্রুকুঞ্চন ঘটে। গৌরীর মা পরপর আট বছর ‘বিশ্রাম’ না পাওয়ার পর যখন তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে – ‘আমি কি পশু, আমি একটা বছরও ছাড় পাব না?’ তখন তাকে উত্তর শুনতে হয়— ‘ওরে বাব্বা, তুমি যে খুব আধুনিকা হয়েছ দেখছি, ডিভোর্স করবে না তো?’
গল্পের শেষে সকলে জানতে পারে অবস্থার চাপে বেশ্যা হয়ে যাওয়া ছবি নামের মেয়েটি সম্ভবত গর্ভপাত করাতে গিয়ে মরে পড়ে রয়েছে। ছবির আর্থিক দুরবস্থার দিনে পাড়ার কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি বরং সকলে মিলে তাকে সামাজিকভাবে একঘরে করেছিল। খুকি, স্নিগ্ধারা মিলে ছবির বাড়ি যাওয়ার সময় মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে ‘কেলেঙ্কারি’ যেন ছবিরই হয়। মৃত ছবিকে দেখে তাদের ‘সন্তর্পণে, দ্রুত পায়ে, নীরবে’ নিষ্ক্রমণ মধ্যবিত্তের আত্মধ্বংসী অমানবিকতার চিহ্ন হয়ে ওঠে। আর এই ধ্বংসের চিত্র আরও স্পষ্ট অবয়ব পায় গল্পের অন্তিমবিন্দুতে। যখন ছবির মৃত্যুর খবর শুনে গৌরীর মা পুনরায় সঙ্গমে রাজি হয়, স্বামীর মারকে সমর্থন করে সে মন্তব্য করে— ‘… তুমি তো আর পর ভেবে মারোনি। রাগ তো নিজের জনের উপরই লোক করে।’ রুবি সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে ‘ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো উদ্ধত’ হয়ে ওঠে আর ছোটবউ ঘুমন্ত স্বামীকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে— ‘আচ্ছা ওইরকম কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় না?’
নিশুতি রাতের ঘেরাটোপে আপাতনিরীহ অন্যোন্যবাচক সর্বনাম ‘ওইরকম কিছু’ সূচিমুখ বর্শা হয়ে মধ্যবিত্তের উপরচাপানো খোলসটাকে সমূলে উপড়ে ফেলে। তির্যক মতির আলোয় ফুটে ওঠে চাপ চাপ অন্ধকার। পিঞ্জরে নীরব আর্তনাদ গুমরে ওঠে ৷