২০২৪-এ আন্তর্জাতিক যোগ দিবস-এর ১০ বছর পূর্তি। এ -বছরের থিম ‘yoga for self and society’। এই উপলক্ষ্যে বিশ্বশ্রী মনতোষ রায়-এর পুত্র অর্জুন পুরস্কার-প্রাপ্ত বডিবিল্ডার শ্রী মলয় রায়–এর সঙ্গে ডাকবাংলা.কম–এর পক্ষ থেকে কথা বললেন সারস্বত সেন।
শরীরচর্চার আখড়া থেকে বিশ্ববরেণ্য পরিচালকের বিশ্বশ্রী হয়ে ওঠা― সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আলাপ কীভাবে?
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর আগে আমি কোনও দিন সিনেমা-থিয়েটার করিনি। সৌমিত্রদার সঙ্গে বাবার আলাপ ছিল, উনিই একদিন এসে জানান যে, সত্যজিৎ রায় তাঁর ফেলুদা সিরিজের নতুন ছবির জন্য একজন ব্যায়ামবীর খুঁজছেন। না করার প্রশ্নই ওঠে না। তো সৌমিত্রদার সঙ্গে একদিন গেলাম সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। সেদিনটা কখনও ভুলব না। আমার অংশের শুটিং ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে হয়েছিল। ছবিতে সন্তোষ দত্তকে তুলে ধরার একটা সিন ছিল আমার। শুটিংয়ের দিন কামু মুখার্জি মজা করে বললেন যে, তিনি সন্তোষদাকে তুলবেন, সন্তোষদা তাতে আরও নার্ভাস হয়ে গেলেন। আমায় বললেন, মলয় দেখো আমায় ফেলে দিয়ো না। প্রথমবার আমিও বুঝতে পারছিলাম না যে কীভাবে তুলব; আমরা ওয়েট-লিফটিং করি ঠিকই কিন্তু মানুষ তোলা অন্য ব্যাপার! আমাদের দুজনের কাছেই সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। প্রথম কয়েকটা টেক-এ ওকে হল না; একবার আমার হাতে লেগেও গেল। পরে সৌমিত্রদা আমায় বললেন অন্য কারোর সঙ্গে রিহার্সাল করে নিতে। রিহার্সালের পরে শট ঠিকঠাক হল। ওই সময়ের অনেক ঘটনা আপনারা জানতে পারবেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের ‘সত্যজিতের বিশ্বশ্রী মলয় রায়’ বইটিতে। সত্যি বলতে, বডিবিল্ডিংয়ে আমি যতটা না পরিচিতি পেয়েছি, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ওই ছোট্ট চরিত্রে কাজ করেও অনেক বেশি মানুষ চিনেছেন আমায়।
আপনি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা করে যতটা বিখ্যাত হয়েছেন, তেমনই বিখ্যাত বিশ্বশ্রী মনতোষ রায়ের ছেলে হিসেবেও। তাই আজকের দিনে আপনার বাবার কথা জানাটাও এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে খুব জরুরি। আপনার বাবা আবার ব্যায়ামাচার্য বিষ্ণুচরণ ঘোষের ছাত্র। আপনার বাবার জীবন ও সাফল্যের পিছনে তাঁর অবদান…
বাবা বিষ্ণুচরণ ঘোষকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে এখানে আসার পরে, বাবা একটা পার্কে, খোলা আকাশের নীচে ব্যায়াম করতেন। ক্লাবে ব্যায়াম করতে গেলে টাকা লাগবে, বাবা কোথা থেকে দেবেন! দু-বেলা ভাত জোটানোই তখন প্রধান চিন্তা। যাই হোক, ব্যায়াম করার সময়ে বাবা সামনে রাখতেন বিষ্ণুচরণ ঘোষের একটা ছবি, আয়নার মতো। যেন দ্রোণাচার্য ও একলব্য। এসব কথা আমার বাবার কাছেই শোনা; কোনও এক দিন, পার্কের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন বিষ্ণুচরণ ঘোষ, বাবাকে দেখে তাঁর পছন্দ হয়ে যায়। খোঁজখবর নিয়ে একদিন জ্যাঠার কাছে গিয়ে বাবাকে নিজের বাড়িতে রেখে তালিম দেবার প্রস্তাব দেন। যৌথ পরিবারের গার্জেন ছিলেন আমাদের বড় জ্যাঠামশাই। তিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন প্রথমে, চেয়েছিলেন বাবা পড়াশুনা করে একটা চাকরি জোগাড় করুন। বিষ্ণুবাবু আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, শরীরচর্চা মন দিয়ে করলে বাবা নিজেই একদিন পরিবারের দায়িত্ব সামলাতে পারবেন। নিজের বাড়িতে রেখে বাবার খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে তালিম, পুরোটাই করিয়েছিলেন, বাকিটা তো ইতিহাস। এরকম বহু ছাত্র ওঁর হাতে তৈরি হয়েছেন― মধু পাণ্ডে, রেবা রক্ষিত, বিকাশ দত্ত, হিতেন রায়, আরও অনেকে। আমাদের দেশে বডিবিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে বিষ্ণুচরণ ঘোষের অবদান ভোলার নয়। ওঁর আরও একটা পরিচয় স্বামী যোগানন্দের ভাই। ফলে বুঝতেই পারছেন কোন পরিবারের রক্ত ছিল তাঁর শরীরে! তিনি না থাকলে এসব হয়তো কিছুই হত না।
কমবয়সে আপনি মা-কে হারিয়েছেন; প্রায় একার হাতে বাবা আপনাদের ভাই-বোনদের মানুষ করেছেন। বাইরে এত কর্মকাণ্ড সামলে আপনাদের প্রতি নজর দেওয়ার সময় পেতেন?
আমার যখন ১৭ বছর বয়স, তখন মা চলে যান। সেই সময়ে ইন্ডিয়ান বডিবিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশন আলাদা কোনও সংস্থা ছিল না, ইন্ডিয়ান ওয়েটলিফটিং অ্যাসোসিয়েশন-এর অংশ ছিল। তাতে বডিবিল্ডাররা অবহেলিত হতেন। বাবা সেজন্য ইন্ডিয়ান বডিবিল্ডিং অ্যাসোসিয়েশনের আলাদা একটা অস্তিত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এসব নিয়ে প্রায়ই দিল্লি, মুম্বই ছোটাছুটি করতে হত। স্কুল-কলেজে যোগাসনের ক্লাস নিতেন। তা ছাড়াও শরীরচর্চা, যোগাসনের উপর বেশ কিছু বই লিখেছেন। ফলে এত ব্যস্ততায় সত্যি বলতে রোববার ছাড়া আমাদের সঙ্গে বাবার দেখাই হত না। এমনও অনেকদিন গেছে যখন ঠিকঠাক সময়ে খাওয়া জোটেনি। আমিও তখন শরীরচর্চা শুরু করেছি, ওই বাড়ন্ত বয়সে খিদে পেত খুব। মা না থাকলে যা হয়, আমাদের যৌথ পরিবার হলেও সবার প্রতি নজর দেওয়া সম্ভব ছিল না। সেই সময়ে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে তার মা আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওঁর কাছে যে স্নেহ, মমতা পেয়েছি তা আজীবন মনে থাকবে।
১৯৫১-তে মনতোষ রায় মি. ইউনিভার্স খেতাব জিতলেন, সেই প্রথম কোনও ভারতীয় এমনকী এশীয় বডিবিল্ডারের বিদেশের মাটিতে খেতাব জয়! তার পরের বছর আরেক বাঙালির মি. ইউনিভার্স সম্মানলাভ― মনোহর আইচ । কীরকম ছিল দুজনের সম্পর্ক?
একই ক্ষেত্রে থাকলে কিছু প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকে, তবে দুজনের মধ্যে সু-সম্পর্কই ছিল। বাবা যে-বছর বিশ্বশ্রী হলেন, সেই বছর মনোহর আইচও ছিলেন একই গ্রুপে। সে-বছর না জেতায় তিনি ভেঙে পড়েননি। বাবার মতোই অদম্য জেদ ছিল ওঁর। ইংল্যান্ডেই থেকে গেছিলেন আরও এক বছর। এক বছর পরে ১৯৫২-তে তিনিই হলেন মি. ইউনিভার্স। সেটা সত্যিই স্বর্ণযুগ; স্বাধীনতার পরে সাহেবদের ডেরায় গিয়ে পর পর দু-বছর বাঙালির বিশ্বজয়!
আপনি নিজে বডিবিল্ডিংয়ে মি. ইন্ডিয়া হয়েছেন, অর্জুন পুরস্কার পেয়েছেন। ব্যায়ামের জগতে আসার ক্ষেত্রে আপনার বাবা মনতোষ রায় নিশ্চয়ই আপনার অনুপ্রেরণা?
দেখুন, বাড়ির পরিবেশ তো আমাদের সকলের বেড়ে ওঠায় একটা প্রভাব ফেলে। সেটা অস্বীকার করা যায় না। বডিবিল্ডিং, যোগাসনের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট মানুষরা, বাবার ছাত্ররা প্রায়ই বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে আসতেন। পড়াশুনোর পাশাপাশি এদের আলোচনা শুনতাম, সেগুলো আমার মনে একটা ছাপ অবশ্যই ফেলেছিল। একটা কথা আজ খুব মনে পড়ে, ছোটবেলায় বাবা হয়তো ঘুমোচ্ছেন, আমিও তার পাশে গিয়ে শুয়ে থাকতাম। তাঁর হাতের বাইসেপে মাথা রেখে, সেটাকেই বালিশ করে নিতাম। ছোটবেলার সেইসব ঘটনা হয়তো আমার জীবনের পথ ঠিক করে দিয়েছিল।
আমাদের দেশে ক্রিকেট ছাড়া অন্য খেলাগুলো পিছনের সারিতে, সরকারি স্তরে কীরকম আগ্রহ দেখেছেন বডিবিল্ডিং নিয়ে?
বডিবিল্ডিং, কোর স্ট্রেংথ, যোগাসন― এগুলোই কিন্তু মাদার অফ অল স্পোর্টস। এটা ভুললে চলবে না। শরীর ফিট না হলে আপনি ক্রিকেট-ফুটবল-টেনিস খেলবেন কী করে? এমনকী ইনডোর গেমেও শরীরচর্চার গুরুত্ব আছে। ভিত শক্ত না হলে কিন্তু কিছু হবে না। শরীর ও মন একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে শরীর ভাল না থাকলে মনে তার প্রভাব পড়বে। আশা করব, বডিবিল্ডিং, যোগাসন এসব ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ভবিষ্যতে বাড়বে। সব স্তরের মানুষের মধ্যে শরীরচর্চা নিয়ে আগ্রহ বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি দুই তরফেই সদর্থক পদক্ষেপ নেওয়া হবে এই আশা রাখব।
আপনার বাবার মতোই আপনিও বহু বছর শরীরচর্চার শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত, এই দীর্ঘ সময়ে মহিলাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা নিয়ে কতটা উৎসাহ দেখেছেন?
আমরা যে-সময়ে শুরু করেছিলাম, তখন মহিলাদের মধ্যে এ-বিষয়ে কোনও উৎসাহ দেখিনি। তার সুযোগও সেই সময়ে তাঁরা পাননি; সমাজ-সংসারের চাপেই হয়তো, জিমে গিয়ে পুরুষদের পাশাপাশি শরীরচর্চা করার কথা তাঁরা কল্পনা করতেও পারতেন না, তাঁদের অভিভাবকরাও অনুমতি দিতেন না। তবে এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে— এখন ছেলেদের থেকে মহিলাদের মধ্যেই স্বাস্থ্যসচেতনতা বেশি। অনেক মহিলা এখন অফিস-সংসার সামলেও জিমে যান। আমার জিমেই এ রকম বহু মহিলা আসেন যাঁরা সিনিয়র সিটিজেন। অভিভাবকরাও এখন অনেক সচেতন, তাঁরা নিজেরাই অনেক ক্ষেত্রে স্কুল বা কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসে জিমে ভর্তি করাচ্ছেন। তবে বাংলায় শরীরচর্চা নিয়ে যেটুকু উৎসাহ, সেটার জন্য বিষ্ণুচরণ ঘোষ, মনোহর আইচ, আমার বাবা মনতোষ রায়, এঁদের অবদান ভুললে চলবে না। এ রকম দিন ছিল যখন তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেহসৌষ্ঠব-এর লাইভ শো করতেন, সেইসব লাইভ শো বহু দর্শককে বডিবিল্ডিংয়ে উৎসাহী করেছে।
শরীরচর্চা, যোগাসনের গুরুত্ব জেনেও আজকের ব্যস্ত জীবনে আদৌ কতজন তা অনুশীলন করেন?
এখন তো মানুষ মেশিন হয়ে গেছে; হয় কম্পিউটারের সামনে বসে সারাদিন কাজ করছে, কাজ না থাকলে কখনও মোবাইল নিয়ে, কখনও টিভির সামনে ঠায় বসে আছে। কোনও মুভমেন্ট নেই! শরীরের কলকবজাগুলোতে যে এতে জং পড়ে যাচ্ছে, এই কথাটা সে বুঝতে পারে না। যখন বুঝছে, তখন ডাক্তার ছাড়া আর উপায় নেই। অতিমারীর সময়ের কথা মনে করুন, দেখা গেছে যাদের শরীরচর্চার অভ্যাস আছে, ঠিকঠাক ডায়েট যাঁরা মেনে চলেন, তাঁরা অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। জিম হোক কী যোগাসন, কার্ডিও করুন কী আইসোমেট্রিক এক্সারসাইজ, সাঁতার কিংবা ফুটবল— নিয়মিত শারীরিক কসরত করলে ভাল। মাসল মুভমেন্ট হয়, ব্লাড সারকুলেশন হয়, শ্বাসযন্ত্র, হৃৎপিণ্ড ভাল থাকে।
শরীরচর্চার পাশাপাশি সঠিক ডায়েটেরও একটা ভূমিকা থেকে যায়!
সঠিক খাদ্য-অভ্যাস সেদিক থেকে দেখতে গেলে নিজেকে সুস্থ রাখার প্রথম পদক্ষেপ। পেটের সমস্যা থেকেই অনেক রোগের সূত্রপাত, ফলে খাওয়া-দাওয়ার দিকে নজর দিতে হবে। বেশি তেল-মশলা, ঝাল দেওয়া খাবার যতটা এড়ানো যায়, ততই ভাল। অতিরিক্ত ফ্যাটি ফুড, কোল্ড-ড্রিংক বা রেড মিট না খাওয়াই ভাল। এর সঙ্গে নিয়মিত শরীরচর্চার অভ্যাস থাকলে অনেক রোগভোগ এড়ানো যায়। আমার বয়স এখন ৭৫। এখনও আমি নিয়মিত শরীরচর্চা করি। জিমে যাওয়া সম্ভব না হলে বাড়িতে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করুন! সাইক্লিং, স্পট রানিং করতে পারেন। কপালভাতির মতো ব্রিদিং এক্সারসাইজ রোজ করুন। যত তাড়াতাড়ি এই অভ্যাস শুরু করবেন, ততই মঙ্গল। কয়েকটা কথা মনে রাখা দরকার― যে-বয়সেরই হোন, সকালবেলায় ব্যায়াম করলেই ভাল। দ্বিতীয়ত, খালি পেটে নয়, ব্যায়াম করার আগে কিছু খেয়ে নিতে হবে। আর যা-ই করুন, অবশ্যই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রফেশনাল ট্রেনারদের তত্ত্বাবধানে করবেন।
ছবি সৌজন্যে: মলয় রায়