মাতা গৌতমী স্তন্যপান করিয়ে শিশু সিদ্ধার্থকে লালন করেন। মাতা গৌতমী আসলে সিদ্ধার্থর মাসি। পালি ভাষায় তাঁর নাম গোতমী (আমরা এ-লেখায় পালি উচ্চারণই ব্যবহার করব)। সিদ্ধার্থর জন্মের অব্যবহিত পরেই জন্মদাত্রী মা মারা যান এবং গোতমী হয়ে ওঠেন সিদ্ধার্থর মা। আজ গোতমীর পরবর্তী জীবনের কথা বলি।
কোলের সেই শিশু গোতম ততদিনে তথাগত বুদ্ধ। দেশজুড়ে তাঁর নামডাক। ভক্ত-অনুগামীর সংখ্যা তাঁর বিপুল। অনুগামী গৃহত্যাগীদের নিয়ে তিনি সংঘ তৈরি করেছেন— এবং সেখানে ভিক্ষুদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। তবে এখানে ভিক্ষু বলতে শুধুই পুরুষ— সংঘে নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। একদিন গোতমী তথাগতর সাক্ষাৎপ্রার্থী হলেন। এসে বললেন, ‘হে তথাগত, এ আপনার কেমন বিচার? ভিক্ষু বলতে শুধুই পুরুষ? তবে কি নারীরা কখনওই চতুর্থ ফল প্রাপ্ত হতে পারবে না?’
তথাগত-প্রচারিত অনুশীলন অনুসারে, তাঁর পথ যাঁরা অনুসরণ করেন, তাঁরা চার রকমের ফল প্রাপ্ত হতে পারেন। চারটি পৃথক ধাপ। প্রথম ধাপে যাঁরা, তাঁদের বলা হয় সোতপন্ন। অর্থাৎ নদীস্রোত-তুল্য ধর্মপথে তাঁরা অবগাহন করেছেন। এঁরা শ্রাবক। দ্বিতীয় পর্যায়ে সকদগামী। এই ইহজগতে তাঁদের আর মাত্র একবারই জন্ম নিতে হবে। তৃতীয় ধাপে অনাগামী। যাঁরা নির্বাণ লাভ করবেন না, কিন্তু মর্ত্যলোকে পুনর্জন্মের দুঃখলাভের সম্ভাবনা থেকে তাঁরা মুক্ত। এঁদের পুনর্জন্ম হবে, কিন্তু উচ্চতর লোকে। এবং চতুর্থ ধাপে অর্হন্ত (সংস্কৃত উচ্চারণে অর্হৎ)। তাঁরা এই জন্মেই নির্বাণ লাভ করবেন।
অর্হন্তরা সংসারযাপন করেন না; বা উল্টোটাও বলা যায়, সংসারযাপন করে অর্হন্ত পর্যায়ে উত্তরণ সম্ভব হয় না। অতএব গোতমী যে চতুর্থ ফল লাভের কথা বলছিলেন, তা সংসারে থেকে সম্ভব নয়। এক কথায়, তিনি চাইছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনী হওয়ার অনুমতি, সংঘে ভিক্ষুণী হিসেবে প্রবেশাধিকার।
তথাগত এক কথায় মেনে নেননি। বলেছিলেন, ‘গোতমী, তুমি মস্তক মুণ্ডন করো, কষায় ধারণ করো, নিষ্ঠা সহকারে অষ্টাঙ্গ মার্গ পালন করো— কিন্তু এসবই ঘটুক গৃহসংসারের নিরাপত্তায়।’
আড়াই হাজার বছরের পুরনো ঘটনা। লিখিত বয়ান মূল ঘটনার কয়েকশো বছর পরে লিপিবদ্ধ। অনেক পাণ্ডুলিপি অধুনা বিলুপ্ত। পালি বয়ান ও চিনা ভাষায় অনূদিত বয়ানে ফারাক রয়েছে; এমনকী একাধিক চিনা বয়ানের মধ্যেও অল্পবিস্তর ফারাক বর্তমান। কেউ বলেন, এ-কথা বলার কিছুদিনের মধ্যেই, নাছোড় গোতমীর অনুনয়ে, স্বয়ং তথাগত গোতমীকে সন্ন্যাসিনী হওয়ার অনুমতি দেন। কোনও বয়ানে আবার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত— তথাগতর কথা খানিক অমান্য করেই গোতমী এবং পাঁচশো নারী মস্তক মুণ্ডন করে সন্ন্যাসিনীর বস্ত্র ধারণ করে তথাগতর সামনে উপস্থিত হন এবং তথাগত তাঁদের সংঘে গ্রহণ করতে বাধ্য হন; নারীদের জন্য পৃথক সংঘ তৈরি করেন।
তবে, এ ছাড়াও অন্য একটি বয়ান রয়েছে যা মনের গভীরে নাড়া দেয়। গোতমীকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর প্রিয় শিষ্য আনন্দ তথাগতকে প্রশ্ন করেন, নির্বাণ লাভের পক্ষে নারীরা কি অনুপযুক্ত? তথাগত বলেন, না, এমন কথা আমি কখনওই বলি না। সোতপন্ন, সকদগামী, অনাগামী এবং অর্হন্ত— নারীর পক্ষে এই চার রকম ফলই লাভ করা সম্ভব। আনন্দের প্রতিপ্রশ্ন, সংসারে থেকে অর্হন্ত পর্যায়ে উত্তরণ এক কথায় অসম্ভব। তাহলে সংসারযাপন করে নারীরা কীভাবে নির্বাণ লাভ করবেন?
প্রশ্ন জাগে, বুদ্ধ এই জগৎ সংসার থেকে নির্বাণের কথা বলছেন। দুঃখ থেকে মুক্তির কথা বলেছেন। এবং সেই মুক্তির জন্য কঠোর সাধনা করতে বলেছেন যাতে সংসারের তুচ্ছতা মনকে বিচলিত করতে না পারে। আর যে সংসার থেকে মুক্তির পথ তিনি গ্রহণ করতে বলেছেন, সেই সংসারের দুই স্তম্ভ নারী এবং পুরুষ। তবে, মুক্তি, সাধনা এবং সর্বোচ্চ নির্বাণের পথ কেবল কেন পুরুষের কথা ভেবে তিনি স্থির করেছিলেন? তিনি তো বুদ্ধদেব, তিনি তো বোধিপ্রাপ্ত। তিনি তো নারী-পুরুষ বাছ-বিচারের ঊর্ধ্বে। তিনি তো কেবল ‘মানুষের’ মুক্তির পথ বলে দেবেন! তবে কি সমাজের বাঁধুনি মুক্তির পথের অন্তরায়?
যা-ই হোক, যে-কারণেই হোক, ভিক্ষুণী হওয়ার ব্যাপারে গোতমী-র উপরোধ তথাগত অস্বীকার করেননি। সংঘে স্থান হয়েছিল নারীদেরও। গঠিত হয়েছিল পৃথক নারী-সংঘ।
কিন্তু প্রাথমিকভাবে তথাগত সংঘে নারীদের গ্রহণ করতে চাননি কেন? কারণটা কি অবহেলা? নারীদের অযোগ্য হিসেবে বিবেচনা? সম্ভবত এর কোনওটিই যথার্থ কারণ নয়। এখানে আমরা মনে করিয়ে দিতে চাইব তৎকালীন বাস্তবতার কথা। নারীদের অভিভাবক হবে পুরুষ— জীবনের পর্যায় অনুসারে পিতা স্বামী বা পুত্র— এমনই ছিল প্রথা। (সে-নিয়ম এখনও বদলেছে কি? হাতেগরম উদাহরণ দিই। এই তো সেদিন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে কর্মরতা অধ্যাপিকাদের ‘ম্যারাইটাল স্টেটাস’ জানতে চেয়ে ফর্ম পাঠিয়েছিলেন— এবং আরও আশ্চর্যের বিষয়, এ-নিয়ে কোনও রকম প্রতিবাদ বা শোরগোল ছাড়াই অধিকাংশ, প্রায় সব অধ্যাপিকা সে-ফর্ম ভরে পাঠিয়ে দিয়েছেন) এ-প্রথার পিছনে নারীদের নিরাপত্তা বা সুরক্ষার দিকও ছিল। কেননা পুরুষ-অভিভাবকহীন নারীদের সহজলভ্য ভেবে বিবিধ লাঞ্ছনার সম্ভাবনা থাকত (আজও হয়তো আছে)।
সন্ন্যাসিনী বা ভিক্ষুণী শহরে-গ্রামে ভিক্ষাপ্রার্থী হিসেবে গিয়ে যদি কোনও সমস্যায় পড়েন, তখন তথাগত কী করবেন? সংঘ পত্তনের শুরুর সময়ে এমন বিপদের সম্ভাবনা তথাগত অস্বীকার করেন কীভাবে? অতএব, সংঘে সন্ন্যাসিনীদের গ্রহণের ব্যাপারে তাঁর আপত্তির কারণ, প্রাথমিকভাবে, নিরাপত্তা— এবং খানিকটা লজিস্টিক্সের সমস্যাও— এটুকু অনুমান অযৌক্তিক নয়। বিশেষত তথাগত যখন একাধিকবার বলেছেন, ইহজাগতিক দুঃখ হতে মুক্তিলাভের জন্য নারীজন্ম কখনওই পুরুষজন্মের তুলনায় কম উপযুক্ত নয়। লজিস্টিক্সের সমস্যা, কেননা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা-প্রার্থনার দায় থেকে সন্ন্যাসিনীদের মুক্ত করতে চাইলে পুরুষ-ভিক্ষুদের জোগাড় করা ভিক্ষান্ন দিয়েই সংঘ-নারীদের অন্নবস্ত্রের জোগান দিতে হয়— সংঘের শুরুর পর্যায়ে তা কতদূর সম্ভব, তথাগতর মনে সে-বিষয়ে অনিশ্চয়তা স্বাভাবিক।
অবশ্য আবারও বলি, গোতমীর প্রশ্ন বা অনুনয় তথাগত ফেলে দিতে পারেননি। বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের জন্য পৃথক সংঘের ব্যবস্থা হয়েছিল। ভিক্ষুণীদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা-প্রার্থনা করতে হত না, নিরাপত্তার কথা ভেবেই এমন ব্যবস্থা। ভিক্ষুদের সংগৃহীত অন্নেই নারী-সংঘ চলত। তদুপরি, নারী-সংঘ ও পুরুষ-সংঘ, দুটির ক্ষেত্রে নিয়ম পুরোপুরি একই ছিল না— এমনকী নারীদের পালনীয় অষ্টাঙ্গ মার্গেও কিছু ভিন্নতা ছিল— এক অর্থে পুরুষ-সংঘকে সংঘ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রায় অভিভাবকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল, ভিক্ষুণীদের অভিভাবক হিসেবে ভিক্ষুদের চিহ্নিত করা হয়েছিল, এসবই হয়তো ভিক্ষুণীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই।
সংঘে ভিক্ষুণীদের স্থান হয়েছিল। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, এ-ঘটনা আড়াই হাজার বছর আগেকার। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এখনকার মূল্যবোধ দিয়ে পুরোটা বিচার করতে চাইলে তথাগতর সিদ্ধান্তে অনেক খামতিই ধরা যেতে পারে, কিন্তু তৎকালীন বাস্তবতার নিরিখে, নারীর অধিকার স্বীকারের ক্ষেত্রে এটি একটি প্রণিধানযোগ্য সিদ্ধান্ত। বিশেষত এটুকু যদি মনে রাখি, তথাগত আড়াই হাজার বছর আগে যে-কাজটি করেছিলেন, সে-কাজ তার পর খুব বেশি এগোয়নি। বাকি ধর্মপ্রতিষ্ঠানের কথা তো ছেড়েই দিলাম, এমনকী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংঘ, দেশে-বিদেশে, প্রায় সর্বত্র প্রবল পুরুষকেন্দ্রিক, এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষতান্ত্রিকও। সব দিক বিবেচনা করলে তথাগতর এই সিদ্ধান্তকে বৈপ্লবিকও বলা যেতে পারে।
তৎকালীন বৌদ্ধ সংঘের ভিক্ষুণীদের রচিত কবিতার অনেক হারিয়ে গেলেও কিছু-কিছু এখনও বেঁচে আছে— ‘থেরিগাথা’ গ্রন্থে, পালি ভাষায়— সেখানে ছত্রে-ছত্রে সাংসারিক জীবনে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব থেকে তাঁদের মুক্তির আনন্দ প্রকাশ পেয়েছে।
বৌদ্ধ নারী-সংঘের প্রথম ভিক্ষুণী— গোতমী। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে যাঁর নাম— মহাপোজাপতি গোতমী। বুদ্ধের বার্তা কণ্ঠস্থ করে বাকিদের আলোকিত করার গুরুদায়িত্ব তথাগত যে সীমিত কয়েকজনকে দিতে ভরসা করেছিলেন, মহাপোজাপতি তাঁদের অন্যতম।
ফিরে আসা যাক, তথাগত ও গোতমীর সম্পর্কের আরও একটি ঘটনায়। গোতমীর পক্ষ নিয়ে তথাগত-র সঙ্গে আনন্দ কথা বলেছেন, তার আরও একটি উদাহরণ রয়েছে। একবার তথাগত বুদ্ধের পরিধানের জন্য গোতমী একটি বস্ত্র প্রস্তুত করে আনেন। তথাগত সে-বস্ত্র গ্রহণে অসম্মত হন। বলেন, সংঘের মধ্যে কোনও একজনের পক্ষে, এমনকী সে-ব্যক্তি স্বয়ং তথাগত বুদ্ধ হলেও, কোনও রকম উপহার গ্রহণ অনুচিত। গোতমী যখন সংঘের সকলের জন্য উপহার নিয়ে আসতে পারবেন, তখনই সে-উপহার গৃহীত হবে, নচেৎ না। তখন আনন্দ বলেন, গোতমী মাতৃস্তন্যে সিদ্ধার্থকে প্রতিপালন করেছেন, যে-ঋণ, বোধিজ্ঞান প্রাপ্তির পরেও, তথাগতর ফুরায়নি। অতএব, গোতমীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান তথাগতর অকর্তব্য। উত্তরে তথাগত বলেন, গোতমী সোতপন্ন, শ্রাবক হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করার মুহূর্তেই তথাগত যাবতীয় পূর্বঋণ পরিশোধ করেছেন। অতএব, বর্তমান ঋণ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
তথাগত বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ ঘটবে অনতিবিলম্বে, এ-খবর আগাম পেয়ে মহাপোজাপতি গোতমী স্বয়ং তথাগতর কাছে তৎপূর্বে নিজের নির্বাণের অনুমতি ভিক্ষা করেছিলেন। মৌনতার মাধ্যমে গোতমীর সে-প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন তথাগত। মহাপরিনির্বাণের কিছুদিন পূর্বেই মহাপোজাপতি গোতমীর নির্বাণ— সঙ্গে নির্বাণ লাভ করেন গোতমীর ভিক্ষু সঙ্গিনীদের অনেকেই। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে, বোধিজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধে পরিণত হলেও তথাগত তো রক্তমাংসেরই মানুষ ছিলেন— ভিক্ষুণী গোতমীও তা-ই— নির্বাণে তথাগতর সম্মতিপ্রদানের পিছনে কি আসন্ন অনিবার্য পুত্রশোক থেকে স্তন্যদায়ী মাতাকে রক্ষা করার ইচ্ছা? এমনকী তথাগত বুদ্ধের পক্ষেও, বোধিজ্ঞান লাভের পরও কি কিছু-কিছু মায়া অতিক্রম করে ওঠা সম্ভব হয় না? না কি…
সূত্র : Daughters of the Buddha : Teachings by Ancient Indian Women, Bhikkhu Analayo
ছবি: সংগৃহীত