ভূতেশ – চার
অফিস থেকে ফিরে বড়বউদিকে দেখতে পেল না ভূতেশ। খেয়াল করে দেখল যে তার জন্য ঢাকা দেওয়া এক গ্লাস জল এবং হাতপাখা একরকম ভাবেই টেবিলের ওপর রাখা; দেওয়ালে টাঙানো কাঠের আলনায় ছেড়ে পরবার কোঁচানো ধুতি এবং হাত-মুখ মোছার জন্য বিছানার একপাশে ভাঁজ করে রাখা কাচা গামছা— সবই নিপুণ করে গোছানো। কাপড় ছেড়ে, মুখ-হাত-পা ধুয়ে নিজের চেয়ারখানা টেনে আয়েশ করে বসতেই, একবাটি মুড়ি নারকেল নিয়ে বড়বউদির বদলে ওই ঘরে যে ঢুকে এল, সে হল ছোটখুকি অমৃতবালা; সেই সঙ্গে তার আঁচল ধরে বড়ভাগ্নে গুপীও। ভূতেশের ধাতে নেই প্রশ্ন করে কোনও কিছু জানা। মুড়িটা হাতে নিয়ে একগাল মুখে দিতে না দিতেই, ছোটখুকি নিজেই শুরু করল— বড়বউকে বাড়িছাড়া করা হলেও, তার ছেলে নিত্যকে নয়। বড়খোকা নিত্য এ-বাড়িতে থেকেই বড় হবে; বাবা তার দায়িত্ব নিয়েছেন।
ভূতেশের প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই সে আরও জানাল, হরশঙ্করের কাশীবাসী দিদিমা এবং ছোটমাসি— এই দুজনের সাহায্যে সব ব্যবস্থা পাকা করেই পাঠানো হয়েছে তাকে; একখানা ভাড়াঘরও পাওয়া গেছে সেখানকার বাঙালিটোলায়। নিশানাথদাদার সঙ্গে জয়নারায়ণদাও গেছে আজকের রাতের ট্রেনে, বড়বউকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে রেখে আসতে।
সব শুনেও ভূতেশকে রা কাড়তে না দেখে ছোটখুকি আবার শুরু করল, বড়বউয়ের বাপের বাড়িতে বাবা জানিয়েছিলেন; প্রথম পত্রের কোনও উত্তর না এলেও বাবার দ্বিতীয় পত্রের উত্তর এসেছে; তা এই দিন পাঁচেক হল; পত্র মারফৎ তিনি জানিয়েছেন যে, নিজের সম্মতিতে সে যদি কাশীবাসী হতে চায় তো, তাঁর কেন আপত্তি থাকবে; তবে এ-বাবদ খরচ বহন করার সামর্থ্য যে তাঁর নেই, সেটা জানাতেও কোনও সংকোচ দেখাননি তিনি।
মুড়িটা শেষ করে কাঁসার বাটিটা ছোটখুকির হাতে ধরিয়ে দিতেই, কিছু একটা বুঝে সেখান থেকে সে চলে গেল; ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, দু-ভাইবোনের চোখাচোখি হল; ভূতেশ আসলে মুখ তুলে দেখছিল, দরজার কোন সেঁটে অপরাধীর মতো দাঁড়ানো বছর দশেকের নিত্যকে; তার বড়দাদার ছেলে; আজকে থেকে মা-ছাড়া হয়ে গেল। কার দোষে? দায়ী কে? বড়বউ নিজে, না ভূতেশ! নাকি অকাল বৈধব্য শুষে খাওয়া এই হিন্দু সমাজ!
একবার ভাবল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে, বাইরে গিয়ে একটু দম নিয়ে আসে; পরক্ষণেই সাবধান হয়ে গেল, নিজের মনের ভাব লুকোতে; তবে কি সেই আশঙ্কাই সত্যি হল! ভূতেশের ওপর আক্রোশ বশে, ইচ্ছে করেই গর্ভবতী হল সে! গর্ভ সঞ্চারের আভাস মিলতেই কি বাবা-মা এই সিদ্ধান্ত নিলেন! ভূতেশ সামান্য ভাবল যে, এর উল্টোদিকে আর কী সমাধানই বা তার হাতে ছিল! গর্ভপাত করাবার দায়িত্ব নেওয়া কি সম্ভব হত তার পক্ষে! বড়বউদিও কি জানত না যে এ-পাড়ায় কোন ‘দাই’ গোপনে গর্ভপাত করায়? খরচ-খরচা বাবদ কিছু টাকা দিয়ে সে নাহয় সাহায্য করত তাকে! শত হলেও তার নিজের বড়দাদার বউ তো সে! গর্ভপাত বা সন্তানের জন্ম দিয়ে পরিবারের মুখ ডোবানোর থেকে এ একরকম ভালই হল; কাশীবাসী ব্রাহ্মণ-বিধবার গর্ভপাত সেখানে তেমন কোনও বড় ঘটনাই নয়; মোটের ওপর সব দোষ যে বড়বউয়ের ঘাড়েই পড়বে, সেটা তো ভূতেশ জানেই; ফলে তার গায়ে দুর্নামের আঁচড়টিও লাগবে না।
ভূতেশ তবু মনে মনে সিঁটিয়ে গেল, বড়ভাইপো নিত্যর মুখটা মনে করে। আজ নাহয় সে ছোট আছে, কিন্তু সন্দেহের বীজ মাথায় ঢুকতে কতক্ষণ! দু-একবার তো ভূতেশের সঙ্গে তার মাকে বিছানাতে দেখেও ফেলেছে সে; তাদেরই অসতর্কতার কারণে! ওই অন্ধকার ঘরে, আচম্বিতে নিত্যর উপস্থিতি টের পেয়েও বড়বউ তো কই ভূতেশকে ছেড়ে, বিছানা থেকে সরে যায়নি! ভূতেশও অবশ্য সংকোচ বা ভয়ে ছাড়িয়ে নেয়নি নিজেকেও। বড়বউদি নিজের সেই নাবালক ছেলেকে গ্রাহ্যের মধ্যে না আনলেও, ভূতেশ কিন্তু তাকে মন থেকে তাড়াতে পারল না। কারণ ভূতেশ বুঝল যে, এই পরিস্থিতিতে মা-ছাড়া হয়ে, নিত্য যদি চতুর স্বভাব নিয়ে বড় হয়, তবে সে তাকে সারাজীবন ভাঙিয়ে খাবে; আর যদি সে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, তবে কোনও-না-কোনওদিন দৃঢ়তার সঙ্গে আইনি পথেই সে আসবে, নিজের ভাগ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে। ভূতেশ তাই নিজের সঙ্গেই সমঝোতা করে, নিজের উদ্ধত অহংকার ঝেড়ে ফেলে, নিত্যকে দেখতে শুরু করল, তার পারিবারিক সম্পত্তির অন্যতম দাবিদার হিসেবেই। ভূতেশের চোখে সে আর পিতৃহীন নাবালক রইল কই! দাদা বা বউদির অবর্তমানেও ওই নিত্যই হয়ে উঠল ভূতেশেরই একমাত্র সমকক্ষ অংশীদার।
২.
ভূতেশকে রাতের খাবার খেতে ডাকতে এসে মেজবউদি জানাল যে, রান্নাঘরে যাবার আগে একবার বাবা-মায়ের ঘরে যেতে; তাঁরা নাকি তাকে সে-ঘরে ডেকেছেন। ভূতেশ গিয়ে দাঁড়াতেই বাবা ইঙ্গিত করে বসতে বললেন। নীচু একটা চৌকিতে বসে, দু’চোখ বন্ধ রেখে হুঁকোতে সুখটান দিচ্ছেন বাবা; মা লুটিয়ে আছেন বিছানার একপাশে; পুষ্যি বেড়ালটাকে কোলের কাছে নিয়ে ঠাকুমার পিঠে হেলান দিয়ে বসে আছে, মেজদার নাবালিকা মেয়ে তারা। ‘রামায়ণ’ পড়া শেষ করে, লাল একটা সালুতে মুড়ে সে বইখানা তাকের ওপর তুলে রাখছে বিরজাবালা। ভূতেশকে ওই ঘরে ঢুকতে দেখেই বিরজাবালার দু’হাত যেন ধীরে হয়ে গেল; বাবা চোখ না খুললেও, মা এপাশে ঘুরে শুয়ে তারার পিঠে চাপড় মেরে বললেন,
‘যা, খেয়ে নিগে যা; কাকাকে বসতে দে দিকি!’
আড়ষ্ট হয়ে মায়ের খাটের এক কোণে ভূতেশ বসেছে এমন আন্দাজ করেই বাবা বললেন,
‘তোমার বিয়ের ঠিক হয়েছে। পাত্রীর বয়স বছর সাতেক হবে। বড়খুকির শ্বশুরবাড়ি, শ্যামনগরের মেয়ে; পাল্টিঘর; ভালই দেবেথোবে। সম্বন্ধটা এনেছে ওখানকার এক পুরুত।’
‘আমাকে কী করতে হবে! মানে বিয়ের দিন কবে ধার্য হয়েছে?’
‘শুভস্য শীঘ্রম; তুমি স্যায়না হয়েছ, চাকরি পেয়েছ; এবার একটু থিতু হয়ে বসে সংসারে মন দাও; আর নিজের আচরণের দায়িত্বও নিতে শেখো।’
‘আমার তো মীরাটে পোস্টিংয়ের অর্ডার এসে গেছে। এক মাস পরেই চলে যেতে হবে।’
‘তবে তো তার আগেই সেরে ফেলতে হবে বিয়েটা। বেলা বইয়ে তো হিতে বিপরীত হচ্ছে।’
মা বললেন, ‘অসুবিধের কিছু তো দেখছি না; ‘বড়’ না হওয়া অবধি সে তো বাপের বাড়িতেই থাকবে। আর ছেলের বিয়ের খরচই বা কী! আশীর্বাদী আর ওই মুখ-দেখানিটুকু তো ঘরেই আছে!’
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ভূতেশ বলল, ‘বয়সে এত ছোট মেয়ে বিয়ে করতে মন চাইছে না। বুঝেসুঝে চলার বয়স না হলে, এখনকার দিনে চলবে কী করে? আজ নাহয় বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিলে, কিন্তু এ-বাড়ির চালচলন তো আবার একটু আলাদা ধাঁচের, তাই না!’
বড়খুকি ঝাপটা মেরে জানতে চাইল, ‘কেন? কীসে আলাদা!’
‘একই ঘরে বিধবা বউদি এবং বিধবা ননদ! তার ওপর গোঁতাগুঁতি করে বড় হওয়া তিনজন খোকা-খুকু; ছোটখুকির কোলেও আবার সন্তান আসছে; সেই সঙ্গে আমার একার আয় ছাড়া আর কোনও সহায়-সংগতি নেই।’
বাবা বললেন, ‘তার মধ্যেই কুলিয়ে যাবে; মোটা কাপড় আর ডাল-ভাতের অভাব হবে না।’
মা বললেন, ‘তাছাড়া ছোটখুকিই কি আর বাপের অন্নে পড়ে থাকবে সারাজীবন? জামাই তো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কলকাতায় চাকরি এবং ঘর দুটোই জোটাবার!’
ভূতেশ বেশ দৃঢ় ভাবেই বলল, ‘দেশের অবস্থা খুব জটিল; যে-কোনও সময় দাঙ্গা-মারামারি আরও চরমে উঠবে; সমস্ত দেশটাই না গারদখানা হয়ে যায়! মীরাটে গিয়ে চাকরিতে যোগ দিলে, তবেই বুঝতে পারব যে ওই চাকরিটা আদৌ আমি করতে পারব কি না; একটু থিতু না হয়ে এখনই আর একটা হাঁ-মুখ বাড়াতে আমি রাজি নই, বাবা।’
খেতে ডাকবার ছল করে ছোটখুকিও গুটি গুটি এসে বসে পড়বার আগেই ভূতেশ উঠে পড়ল; ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েই মৃদু ধাক্কা লাগল, অন্ধকারে নিজের ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মেজবউদির সঙ্গে; কাতর মেজবউদি ফিসফিস করে জানতে চাইল, রাতে সে আসবে কি না, মাথায় তেল বুলিয়ে দিতে! তাকে কোনও উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেল ভূতেশ। কী মনে হল ভূতেশের? নিজেকে খুব দামি, না ঘৃণ্য এক যুবক!
৩.
বঙ্গভঙ্গ আইন রদ হল না বটে, তবে লর্ড কার্জনের ইস্তফা গৃহীত হবার পরেই চলে এলেন লর্ড মিন্টো; অবশ্য এর আগেই লর্ড কিচনারের তৎপরতায় আর্মি বিভাগকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। সেপাইদের শায়েস্তা করার পথ থেকে অনেকটাই সরে এসে, আরও জবরদস্ত প্রশাসন গড়েছে তারা; ১৯০৩ থেকেই নতুন করে শুরু হয়েছে মীরাটকে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে গড়ে তোলা। একদিকে পাহাড়ি গোর্খা এবং অন্যদিকে শিখ— এ-দু’দলের থেকেই আক্রমণের ভয়; সেজন্যই বোধহয় এদের মধ্যে থেকেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেপাই এবং সৈন্য নিয়োগ করা হচ্ছে এই আর্মি বিভাগে; ভূতেশের কাছে খবর আছে যে, এখনে যোগ দেওয়া সাহেব-সৈন্য যদি দু’হাজার হয়, তো নেটিভ সৈন্যদের সংখ্যা তিন হাজার। এ ছাড়াও আছে শ’পাঁচেক নেটিভ সেপাই এবং গোলন্দাজও। প্রাদেশিক মানচিত্র দেখতে দেখতে, এও মনে হয়েছে ভূতেশের যে, এই মীরাটকে বেছে নেওয়ার আর এক কারণ হল, এই অঞ্চলটা হালের রাজধানী দিল্লির খুব কাছে; তা ছাড়াও গঙ্গা-যমুনার উর্বর পলিমাটিতে দারুণ ভাল শস্য ফলে এখানে; লোকালয়ের অসুবিধে নেই; ফলে মোটা মাপের রাজস্বও আদায় হবে এখান থেকে।
কোনও এক কালে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল এই মীরাট শহর; তবে তার থেকেও কয়েক কিলোমিটার তফাতে সেনা ছাউনি গড়ে তুলল তারা। শহর-বসত আর সেনা ছাউনিকে আলাদা করে রাখল বিশাল একটা খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ টলটলে জলের ‘আবু নালা’। মারাঠাদের দখল থেকে সেই যে ছিনিয়ে নিয়েছিল সাহেবরা, সে-দখল সেই থেকে রয়ে গেল তাদেরই হাতে। এখানেই ‘সদর বাজার’। গ্রামের সাধারণ মানুষ থেকে সেপাই-সৈন্য সকলেই এখানে আসে জিনিসপত্র কিনতে। ভূতেশ জেনেছে যে, সেনাদের জন্য এখানে যেমন একটা কোতোয়ালি-থানা আছে, সেরকমই আর একটা কোতোয়ালি আছে, পাঁচিলঘেরা অংশে বাস করা সাধারণের জন্য। পোক্ত এক সেনাকেন্দ্র বানাতে, সাহেবরা যে-হারে জমি অধিগ্রহণ, রাস্তাঘাট তৈরি এবং বড়-বড় পাকা ইমারত তৈরিতে উঠে পড়ে লেগেছে, তাতে খুব বেশিদিন লাগবে না এই মীরাটকে সৈন্য-শহর হিসেবে গড়ে তুলতে। ভূতেশের আন্দাজ যে, বেঙ্গল আর্মির সৈন্য-প্রশিক্ষণকেন্দ্র দমদম থেকে এখানে চালান হয়ে যাবার জন্যই তার নিয়োগ হল মীরাটে।
সংরক্ষিত নথির পাতা উল্টে উল্টে যা সে পড়েছিল, সেগুলোই ভূতেশ লিখে রাখল তার নিজস্ব নোটবুকে—
ভূতেশের খুব অবাক লাগছে এই ভেবে যে, ভাগ্যিস সে এই চাকরিটা পেয়েছিল! সোদপুরের সমতল-গঙ্গার ধার ছেড়ে এবার সে চলে যাবে কোন সুদূর উত্তরে; একেবারে পাহাড়ি গঙ্গার এলাকায়; সৈন্য-সেপাই ছাড়াও অনেক ধনী বাঙালিদের সঙ্গে ওঠাবসা হবে তার; বিশেষ করে, গরম এড়াতে কিছুদিনের জন্য যারা থাকতে চলে যায় এই সব শৈল শহরে। ভূতেশ বেশ আচ্ছন্ন হয়ে ভাবছিল, তার বাড়ির থেকে একটু দূরে সে দেখেছে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট; অফিস থেকে ভিজিটে গিয়েছিল, দমদম ক্যান্টনমেন্টে। কাশীপুর আর ইছাপুরের আর্মি দপ্তরেও পাঠানো হয়েছিল তাকে। এবার সে চলে যাবে সবথেকে বড় ক্যান্টনমেন্টে বসবাস করতে, যার নাম মীরাট। এই মীরাট তার জীবনে এল বেশ বড় রকমের এক বিস্ময় হয়ে; বলতে গেলে সমূলে বদলে দিল ভূতেশকে; ভাগ্যের চাকাটাও ঘুরে গেল তার।
৪.
সাহেবদের কাছ থেকে শেখা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে কেনাকাটা করার ব্যাপারটা বেশ লাগে ভূতেশের। মনে মনে স্বপ্নও দেখে, ওইরকম একটা মস্ত দোকান নিজেও বানাবার। সময় পেলেই তাই ঘুরে বেড়ায় সে; ডালহৌসি আর চৌরঙ্গী অঞ্চলের প্রায় সব দোকানেই নিয়মিত যাতায়াত করে সে; লক্ষ করে দেখেছে যে সাহেবরা, অপ্রয়োজনেই কেনাকাটা করতে ভালবাসে; বিশেষ করে ঘড়ি, কলম, খেলনা-পুতুল, চশমা এবং শৌখিন খাবারদাবার। আজ কী মনে হতে হাঁটতে হাঁটতে ভূতেশ চলে এল, একটা বন্দুকের দোকানে; সাইন বোর্ডে লেখা— ‘আর বি রোড্ডা এন্ড কোং’; সাহেবরা যে এখানে কে কতদূর আসে তা অবশ্য খুব একটা জানা নেই তার; তবে কয়েকজন বাঙালি-সাহেবকে দেখে সে আন্দাজ করল যে, হয় এদের শিকারের নেশা, নয়তো এরা হল বন্দুকের লাইসেন্সধারী জমিদার। ধরপাকড়, দাঙ্গা এসব যত বাড়বে, বন্দুকের ব্যবসাও ছুটবে রমরমিয়ে। ভূতেশ অবাক হয়ে দেখল যে, এইসব অস্ত্র-বাহারের কী ভীষণ দাম! পরক্ষণেই তার হাসি পেল, এই ভেবেও— আচ্ছা, তার স্বপ্নের সেই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে টোটা-বন্দুকও থাকবে নাকি! তবে মনে মনে তারিফ করল, মরক্কো চামড়ায় বানানো বন্দুকের কেসগুলির; কোনওটায় আবার সোনার জলে খোদাই করা বন্দুক-মালিকের নাম; আর দেখল কোমরে বা কাঁধে সেগুলি ঝোলানোর জন্য নানা নকশায় সোনা-রুপো, এমনকী হীরে-পান্না-চুনী-পোখরাজ বসানো চেইনও।
ভূতেশ ভাবতে বসল, সেপাই-সেনাদের বন্দুক আর বাবুদের বন্দুকের বাহার-জোহারে কত না তফাত! মিল শুধু একটাই— ওই বুলেট এবং তার দুমদাম আওয়াজে। খোশমেজাজে এবং আপন মনে একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে বেরিয়ে আসার সময়, মাথার মধ্যে প্রবল এক ঝাঁকুনি খেল ভূতেশ। দোকানের দরজায় পা রেখেও, কে একজন যেন হুট করেই সরে গেল না! দ্রুত বেরিয়ে এসেও ডানদিক, বাঁ-দিক বা সামনে— কোত্থাও আর দেখতে পেল না তাকে! এই দেখতে না পাওয়াতেই নিশ্চিত হল সে, চেনা বলেই সটকে পড়ল তাকে দেখে! কিন্তু এত জিনিস থাকতে, এই ভর সন্ধেবেলায়, দোকানটা বন্ধ হওয়ার মুখে কেনই-বা এসেছিল হরশঙ্কর?
আমি ভূতেশ। এ-মাসের মধ্যেই নতুন চাকরিতে যোগ দিতে মীরাট যাচ্ছি। মীরাট জায়গাটার সঙ্গে সঙ্গে আম্বালা নামের অঞ্চলটাও দেখে নিতে হবে। শুনেছি ছোট ছোট গঞ্জ আছে; ব্যাপারীরা আসে। জিনিসপত্র সেখানে নাকি দামেও সস্তা। একটা জায়গা তৈরি করতে যেমন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ওষুধ-ইস্কুল-পিওন-আর্দালি সবই লাগে, তেমনই লাগে দালাল বা মিডলম্যান। আমি হলাম সেই দালাল। ফলে আর্মি বিভাগে চাকরি পেলেও গুলি-বন্দুকের ধারকাছও ঘেঁষতে হবে না আমাকে। পুলিশ হয়ে তনুদার মতো শিখতে হবে না ড্রাইভিং বা ঘোড়ায় চড়া। আমার জীবনের কোনওখানেই কোনও ঝুঁকি নেই। মারের যে সাবধান নেই— আমার থেকে ভাল, সেটা আর কে বোঝে!
কত অনায়াসেই না ঘাড় থেকে নেবে গেল, বড়বউ! এবার নিশ্চিন্তে বিয়ে-থাওয়া করে নিজের বউ নিয়ে ঘর করতে কোথাও আর কোনও কাঁটা বিঁধবার ভয় রইল না। তাছাড়াও দূরদেশ— ওই মীরাটে চলে গেলে, সম্পত্তির ভাগীদার এই নিত্যকেও তো রোজ রোজ দেখতে হবে না চোখের ওপর।
আরও একটা চাহিদাও মিটবে সেখানে গিয়ে; শুনেছি যে ব্যারাক এলাকায় ‘মেয়েমানুষ’ নাকি সস্তা; পাহাড়ি মেয়েদের রূপও নাকি মন ভোলানো; সবচেয়ে বড়কথা যে, চেনাচেনির দায় নেই বলে চোরাগোপ্তা পথ ধরতে হবে না।
কিন্তু হরু মানে হরশঙ্কর কেন গিয়েছিল বিশেষ ওই বন্দুকের দোকানে! ও কি তাহলে সত্যি সত্যিই কোনও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদলের সঙ্গ ধরেছে? সে আবার কবে এসব শিখল ! মানে, প্রাণের ভয় বিসর্জন দিয়ে ওই টোটা বন্দুক চালানো!
সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বড়বউ আবার খুন করবে না তো আমাকে!
বাবা-ই বা কেন বললেন, ‘নিজের আচরণের দায়িত্বও নিতে শেখো!’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র