রিডার্স ডাইজেস্ট
উনিশ বা বিশ শতকের সুপরিচিত ইংরেজি সাময়িকপত্রগুলির দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে লক্ষ করা যাবে, অধিকাংশ পত্রিকার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিষয়কেন্দ্রিকতাই তাদের জনপ্রিয়তার নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। লিখনভঙ্গি, সম্পাদকের স্বর কিংবা গঠনগত বিষয়গুলিও নিশ্চয় থেকেছে, কিন্তু তা প্রভাব ফেলেছে পরবর্তী স্তরে। সামগ্রিক এই প্রবণতার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে উঠেছিল বিশ শতকের একটি মার্কিন পত্রিকা। শুধু ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠাই নয়, বিষয়কেন্দ্রিকতার বদলে ভাবনা ও আঙ্গিকের জোরে তারা পৌঁছে গিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতির শীর্ষে।
‘রিডার্স ডাইজেস্ট’। একেবারে শুরু থেকে পত্রিকার নামেই স্পষ্ট হয়ে যায় তার মূল ভঙ্গিটি। নতুন লেখা নয়, অন্যান্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পুনরায় এখানে মুদ্রিত হত, কিন্তু সবসময়ে তা ঠিক ‘পুনর্মুদ্রণ’ ছিল না। লেখা যেমন ছাপা হত সংক্ষেপকৃত আকারে, অনেক ক্ষেত্রে আবার গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় নিয়ে অন্যত্র বেরোনো লেখার নির্যাসটুকু কিংবা নির্বাচিত অংশ-বিশেষও। ইদানীং বৈদ্যুতিন মাধ্যমে কিংবা টেলিভিশনেও এমন সাঁটে খবর পরিবেশনের প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায়—মানুষের কর্মব্যস্ততার কথা ভেবে বিস্তারিত সংবাদের বদলে অল্প সময়ে পড়া বা দেখার মতো কেজো তথ্যগুলি তুলে দেওয়া হয়। ভাবলে অবাক লাগে, শতাধিক বছর আগেও কিছুটা এই পথেই এসেছিল ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর সাফল্য।
এই পত্রিকার যাত্রা শুরুর পিছনে আছে লম্বা কাহিনি। ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর প্রতিষ্ঠা মার্কিন নাগরিক ডেউইট ওয়ালেস-এর (১৮৮৯-১৯৮১) হাতে। শিক্ষিত পরিমণ্ডলে বড় হলেও তিরিশের কোঠায় পা রাখা পর্যন্ত তিনি পরিবারের চোখে ছিলেন আদ্যন্ত ব্যর্থ। বাবা জেমস ওয়ালেস গ্রিক ভাষার পণ্ডিত, অথচ ছেলে কলেজ-ছুট। পেশার ক্ষেত্রেও থিতু হতে পারেননি। কখনও প্রকাশনা সংস্থায় চাকরি করেছেন, কখনও বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বিক্রি করেছেন মানচিত্র। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গিয়েও আহত হয়ে ফিরে এসেছেন। প্রথম জীবনের এইসব আপাত-ব্যর্থতার মধ্যেও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কাজটি চালিয়ে গিয়েছিলেন ওয়ালেস। মানচিত্র বিক্রি করতে গিয়ে শুরুতেই ধাক্কা খান, তারপর অভিজ্ঞ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে কৌশল রপ্ত করেন, আগ্রহী হয়ে ওঠেন বিক্রিবাটার সামগ্রিক বিষয়টি নিয়েই। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, মাস চারেকের বন্দিদশায় সময় কাটান মার্কিন পত্রপত্রিকার নিবিড় পাঠে। আরও একটি অভ্যাস তাঁর ছিল দীর্ঘদিনই, কোনও পত্রিকা পড়ার সময়ে, সংক্ষেপে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি সুস্পষ্ট হস্তাক্ষরে টুকরো কাগজে নথিবদ্ধ করা। আর এসবের সঙ্গেই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত নিজের পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা। অভিজ্ঞতা, অভ্যাস ও সেই ভাবনার মিশেল প্রাথমিক রূপ পেল ১৯২০ সালের জানুয়ারিতে— প্রকল্পিত পত্রিকার নমুনা কপি তৈরি করে ফেললেন ডেউইট।
এ-কাজের পুঁজি জোগাড় করতেও পরিবারের কাছেই হাত পাততে হয় তাঁকে। সেই প্রস্তাব প্রথমে নাকচ করলেও, পরে ধার দিতে সম্মত হন তাঁর বাবা। ছাপা হয় নমুনা কপি। তা নিয়ে সগর্বে বিভিন্ন প্রকাশনার দফতরে ঘুরতে থাকেন ডেউইট— যদি কেউ তা প্রকাশ করতে রাজি হন এবং তাঁকে সম্পাদক হিসাবে নিযুক্ত করেন, এই আশায়। কিন্তু সব চেষ্টাই গেল জলে। তাঁর পরিকল্পনাকে কেউ বললেন খুব সাদাসিধে, কারোর চোখে তা বড্ড গভীর। বিষণ্ণ, বিপর্যস্ত ডেউইট একদিন কলেজের এক পুরনো বন্ধুর বোন, লায়লা বেল অ্যাচেসন-কে (১৮৮৯-১৯৮৪) দেখালেন সেই নমুনা কপি। প্রায় একইসঙ্গে দিয়ে ফেললেন বিবাহের প্রস্তাবও। মিলল লায়লার অকুণ্ঠ সমর্থন। একযোগে জীবনসঙ্গী ও সহযোগী সম্পাদককে পেয়ে গেলেন ডেউইট। ঠিক হল, তাঁরা নিজেরাই বের করবেন ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’। ১৯২১ সালের অক্টোবরে বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়লেন লায়লা ও ডেউইট। নিউ ইয়র্ক সিটির ঠিকানায় তৈরি হল তাঁদের রিডার্স ডাইজেস্ট অ্যাসোসিয়েশন। আর পরের ফেব্রুয়ারিতেই এই সংস্থার পক্ষ থেকে প্রকাশিত হল প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা।
‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর প্রথম সংখ্যা থেকে এটিকে অভিহিত করা হত ‘The Little Magazine’ হিসাবে। যদিও লিটল ম্যাগাজিন বলতে বাংলায় আমরা যা বুঝি, এই উদ্যোগ একেবারেই তা ছিল না। মাসিক পত্রিকাটির ‘A Word of Thanks’ শীর্ষক প্রথম সম্পাদকীয়তেই চারটি পয়েন্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেওয়া হয় এর বৈশিষ্ট্যসমূহ। প্রথমত, প্রতি সংখ্যায় একত্রিশটি করে লেখা থাকবে, যাতে প্রত্যহ একটি করে লেখা পাঠক পড়তে পারেন এবং লেখাগুলি হবে বিখ্যাত পত্রপত্রিকা থেকে সংকলিত ও সংক্ষেপকৃত। দ্বিতীয়ত, লেখাগুলির গুরুত্ব ক্ষণস্থায়ী বা ‘সাময়িক’ হবে না। তৃতীয়ত, পত্রিকাটি হবে আঁটোসাঁটো, সহজে পকেটে রাখার উপযোগী এবং ভবিষ্যতের প্রয়োজনে রেখে দেওয়ার মতোও। চতুর্থত, লেখাগুলি গড়ে উঠবে তথ্যবহুল ও আকর্ষক বিবিধ বিষয় নিয়ে। শুরুর দিকে প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদেও উল্লেখ থাকত—
‘Thirty-one articles each month from leading magazines
Each article of enduring value and interest, in condensed and compact form’
দৈর্ঘ্যে সাড়ে সাত ইঞ্চি, আর প্রস্থে সাড়ে পাঁচ। প্রচ্ছদ-সহ চৌষট্টি পাতায় বেধ মাঝামাঝি। এই যে পকেটে পুরে নেওয়ার মতো আঁটাসাঁটো অবয়ব, এটি দৃশ্যত তুলে ধরেছিল ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর কেজো ভঙ্গিটি। ভিতরের লেখাপত্রও তথ্যে ঠাসা ও আড়ম্বরবিহীন। কোনও গল্পগাছা নেই, ছবি নেই, এমনকী বিজ্ঞাপনও নেই। বাৎসরিক তিন ডলার সাবস্ক্রিপশনে শুরু হল ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর উড়ান।
নির্দিষ্ট ধরনের কোনও বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার বদলে বিষয়বৈচিত্র্য রক্ষার দিকেই নজর দেওয়া হত। যেমন, দ্বিতীয় সংখ্যাতেই ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর মাসিক পত্রিকা ‘কারেন্ট হিস্ট্রি’ থেকে ছাপা হচ্ছে ‘The Farmer and His Troubles’ শিরোনামের একটি প্রয়োজনীয় লেখা। আবার এর পরের লেখাটিই ‘ফিজিক্যাল কালচার’ থেকে নেওয়া, আমাদের স্বাস্থ্যের উপরে সংগীতের প্রভাব বিষয়ক। এই সংখ্যাতেই থাকছে চুম্বনের ইতিহাস নিয়ে আকর্ষক একটি নিবন্ধ কিংবা মানুষের হাসির কারণ অনুসন্ধানে চার্লি চ্যাপলিনের একটি প্রকাশিতব্য বইয়ের অংশ। বেশির ভাগ লেখা শুধু তথ্যবহুলই নয়, মানবজীবনের ছোট-বড় বিভিন্ন মূলগত প্রশ্নকে তুলে ধরাও যেন সেগুলির উদ্দেশ্য।
এই যে প্রকাশিত লেখাকে পুনরায় সংকলিত করা, এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে সম্পাদকের ভূমিকা। কোন লেখা বাছা হবে এবং তা কতটা সংক্ষেপ করা হবে বা কোন অংশ ছেঁটে ফেলা হবে, সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বশিক্ষিত ডেউইট ছিলেন অতিদক্ষ। একটি পত্রিকা ততটাই ভাল, যতটা তার সম্পাদক— এই আপ্তবাক্যের উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে উঠেছিল ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’। আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। পঞ্চাশ বছর পেরোনোর পর দীর্ঘদিনের সিনিয়র এডিটর স্যামুয়েল এ স্ক্রেইনার জুনিয়র পত্রিকার ইতিহাসের পাতা ওলটাতে গিয়ে ১৯৭৭ সালে ‘The Condensed World of The Reader’s Digest’ বইয়ে লিখেছিলেন—‘The beginning, and perhaps the end, of an understanding of the Reader’s Digest is an understanding of DeWitt Wallace…’।
একদা বলা হত, দুনিয়ায় কেবল বাইবেলই ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর থেকে অধিক পঠিত! গ্রাহকদের জন্য ডাকযোগে পাঠিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ১৯২৯ সাল থেকে নিউজস্ট্যান্ডে এই পত্রিকা বিক্রি হতে থাকে। ১৯৩৩ থেকে ক্রমে জায়গা পেতে থাকে কিছু মৌলিক লেখা। আবার পত্রিকায় বেরোনো প্রবন্ধ-নিবন্ধের পাশাপাশি পূর্বপ্রকাশিত গোটা কোনও বই সংক্ষেপ করে ছাপাও শুরু হয়। ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত মৌলিক রচনা ‘—And Sudden Death’ প্রসঙ্গে ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ লেখে— দুনিয়ার যেকোনো প্রান্ত থেকে পত্রিকায় প্রকাশিত অদ্যাবধি সবচেয়ে বেশি পঠিত রচনা! এই বছরেই ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর পাঠকসংখ্যা পনেরো লক্ষ ছুঁয়ে ফেলে। আরও বছর তিনেকের মধ্যে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর প্রথম আন্তর্জাতিক সংস্করণ। ১৯৩৯ সালে ছাপা হয় প্রথম দ্বি-বর্ণ অলংকরণ। পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধি আর ঊর্ধ্বমুখী কর্মীসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও বাড়তে থাকে পাঠকসংখ্যা। শুধু তা-ই নয়, জনমানসে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রেও ততদিনে গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’।
‘In the history of the printed word, no one editor has ever had so much influence on so many people in so many different countries as DeWitt Wallace, the creator of Reader’s Digest’— ১৯৭০ সালে লেখা হয়েছিল ‘The 100 Most Important People in the World Today’ বইয়ে। একদা সম্পাদক ডেভিড রিড যেমন মজার ঢঙে বলেছিলেন— আন্তর্জাতিক দুনিয়ার মহান তিনটি প্রতিষ্ঠান হল ক্যাথলিক চার্চ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’! ইংল্যান্ডে এর চল এতটাই ছিল যে এমন ঘটনাও ঘটেছে, অনেক ইংরেজ গ্রাহক আমেরিকায় পা রেখে বিমানবন্দরের নিউজস্ট্যান্ডে ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ দেখে বিস্মিত হয়ে জানিয়েছেন— দারুণ ব্যাপার তো, এখানেও এটা পাওয়া যায়! ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় এবং অন্যান্য দেশে পৃথক সংস্করণ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে এই প্রভাবের মাত্রাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৪০ সালে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হয় লাতিন আমেরিকান সংস্করণ। ক্রমে পর্তুগিজ, ফিনিশ, জাপানি, ফরাসি— তালিকা আরও লম্বা হয়। গত শতকের সাতের দশকের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, তাইওয়ানে ব্যবহৃত মার্কিন পণ্যের তালিকায় কোকাকোলা, হিলটন হোটেলস ও ফোর্ড মোটর্সের পরেই চতুর্থ স্থানে ছিল ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’!
বিশ্বব্যাপী এই জনপ্রিয়তার অন্যতম বড় কারণ পত্রিকার পাতাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা আশাবাদ। প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক উপযোগিতার কথা মাথায় রেখে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত লেখাপত্র তো রাখা হতই, তার উপরে ছিল অন্যান্য রচনার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গির ভূমিকাও। মজা করে বলা হত, ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর চূড়ান্ত ট্যাগলাইন হতে পারে— ‘New Hope for the Dead’! কিছুটা গতানুগতিক ভাবনাচিন্তা থাকা কিংবা এক ধরনের পল্লবগ্রাহী রচনা প্রকাশের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিপুল জনপ্রিয়তা এসেছিল এই আশাবাদের হাত ধরে। জীবনকে আরও সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলার স্বপ্ন ফুটে উঠেছিল পাঠকের চোখে। সঙ্গে ছিল নিপাট মজা আর কৌতুকের সহাবস্থান— ‘Laughter, the Best Medicine’! আমজনতাকে আকৃষ্ট করার মতো বিষয়বস্তু আর প্রকাশভঙ্গির যৌগ্য সংগত করেছিল বিপণনী কৌশল। বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে ডাকযোগে পৌঁছে যাওয়ার মতোই, পরবর্তীকালে ‘সুইপস্টেক’ বা বিবিধ প্রতিযোগিতাকে পত্রিকার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে গ্রাহক বাড়িয়ে যেতে সফল হয়েছিল ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ কর্তৃপক্ষ।
এই পত্রিকার ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। সাধারণ পাঠকের কাছে সাদরে গৃহীত হলেও, অনেক লেখাতেই গভীরতার অভাব দীক্ষিত পাঠকের মধ্যে তৈরি করেছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ১৯৫৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারির ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ শিরোনামে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নব প্রতিষ্ঠিত বিভাগটিতে পড়ার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছিলেন অমিয় দেব। শুরুতেই তিনি বলছেন, সদ্য চালু হওয়া কম্পারেটিভ লিটারেচার বিভাগে তিনি ভর্তি হয়েছেন শুনে, বন্ধুদের বিস্মিত হওয়ার কথা। মৃদু হেসে তাঁদের মন্তব্য ছিল— ‘ও তাই বল, রিডার্স ডাইজেস্ট গোছের ব্যাপার।’ এরপর অমিয়বাবু গভীর পাঠের বিপরীতে ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর অবস্থানটি ব্যাখ্যা করছেন—
‘কতটা দিতে পারে রিডার্স ডাইজেস্ট? আলোও নয়, অন্ধকারও নয়; আলোর নাম ক’রে জলুস, অন্ধকারের নাম ক’রে ক্লীবত্ব। দিতে পারে একধরণের আত্মতৃপ্তি, যা শুধু নিশ্চেতনার আপাতস্বর্গেই সম্ভব। বিশ্বসাহিত্যের অন্তরমহলে রিডার্স ডাইজেস্টের প্রবেশ নিষেধ; তার রাজত্ব হাটে বাজারে, যেখানে মানুষ পুতুল খুঁজে ফেরে।’
সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর এই পল্লবগ্রাহী চারিত্র্যের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়। ‘শাখা-প্রশাখা’ ছবিতে সংগীতের ব্যবহার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রবীর (দীপঙ্কর দে) আর তপতীর (মমতাশঙ্কর) কথোপকথনের একটি দৃশ্য তুলে এনেছেন সুধীর চক্রবর্তী। সেখানে মেজদা প্রশান্তর (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) ঘর থেকে ভেসে আসছে একটি সুর। তারপর সেই কথোপকথন—
প্রবীর : কী যে ছাইভস্ম শোনে, ও-ই জানে!
তপতী : এটা Bach।
প্রবীর : কী?
তপতী : Johann Sebastian Bach। নাম শোনোনি বোধ হয়।
প্রবীর : (হাসি) শুধু নাম শুনেছি নয়—ভদ্রলোক যে পাঁচ গণ্ডা সন্তানের জনক ছিলেন সে খবরও জানি।
তপতী : বাবা! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না।
প্রবীর : Reader’s Digest, Madam! আপনার স্বামীকে অত অবজ্ঞা করবেন না! কিন্তু আপনি হঠাৎ ধাঁ করে Bach বলে দিলেন কী করে, সেটা জানতে পারি?
তপতী : দাদাও বিলেত থেকে ওই একই শখ নিয়ে ফিরেছিলেন। পনেরো বছর বয়স থেকে বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত ওইসব Music-ই বাড়িতে শুনেছি।
এরপর সুধীরবাবু সংগীত সম্পর্কে সত্যজিতের শ্রদ্ধা-সম্ভ্রম এবং চিত্রনাট্য রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে লিখছেন—
‘… প্রশান্ত তার আমগ্ন পাশ্চাত্য সংগীত প্রীতির নেশা বয়ে এনেছে বিলেত থেকে, যেমন তপতীর দাদাও। আনন্দমোহনের পরিবার সংগীতছুট। অবশ্য প্রবীর বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী, তাই ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-পড়া অল্প বিদ্যায় পাশ্চাত্য সংগীতের মতো বিষয়েও (যা শুনে শুনে আয়ত্ত করতে হয়) দু-চার কথা লাগসই বলতে পারে।…এই সুগ্রথিত সংলাপের মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ হয়তো তাঁর কোনো কোনো চেনাজানা চালিয়াতের ইঙ্গিত দিয়েছেন পশ্চিমি সংগীত সম্পর্কে যাঁদের সম্বল রিডার্স ডাইজেস্টের পরিবেশিত হাল্কা ধারণা এবং যাঁদের উৎসাহ সুরে নয়, স্ক্যান্ডালে।’
‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ এবং তার পাঠকশ্রেণির বৈশিষ্ট্য বেশ খানিক আঁচ করা যায় এই রচনাংশ থেকে। একইসঙ্গে বুঝতে পারা যায় আমজনতার বাজারকে ধরতে কেন সফল হয়েছিল ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’। যে-কথা আরও সরাসরি লিখেছেন তারাপদ রায়। ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’ শীর্ষক টুকরো গদ্যেই তিনি বলছেন—
‘বিদ্বজ্জন নাক কুঁচকোবেন, হাতের সামনে পড়ে থাকলেও পণ্ডিতেরা ছুঁয়ে দেখবেন না।
রিডার্স ডাইজেস্ট নিতান্ত সাধারণ, আটপৌরে পাঠকের জন্যে নলেজ মেড-ইজি। ইতিহাস-ভূগোল, বিজ্ঞান-স্বাস্থ্য, চাঞ্চল্যকর সত্য ঘটনা, সমসাময়িক বিষয় কি নেই এই মাসিক পত্রিকায়। এই পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ধৰ্ম, মানবিক সম্পর্ক, পারিবারিক জীবন এমনকি দাম্পত্য সমস্যা।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে রচনা বাছাই করে, কখনো কিছুটা সম্পাদনা করে, কিছুটা রচনা সহ রিডার্স ডাইজেস্টের প্রতিটি সংখ্যাই সুমুদ্রিত এবং সুসম্পাদিত। বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে দশটা বই বা পত্রিকা না পড়েই এই কাগজ থেকে মোটামুটি জানা যায়।’
শুধু এটুকুই নয়, স্বকীয় ভঙ্গিতে তিনি জানাচ্ছেন, বহুকাল ধরেই এই পত্রিকার অনুগত পাঠক ছিলেন। এমনকী এই পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে তিনি আর্থিকভাবে লাভবানও হয়েছেন! কী করে? সমশীর্ষক আরেকটি রচনায় সে-কথা কবুল করতে দ্বিধা করছেন না তারাপদ রায়—
‘আমার ‘বিদ্যাবুদ্ধি’, ‘কাণ্ডজ্ঞান’ প্রায় সবই ওই পত্রিকাগুলি থেকে টুকে। আমি যে ধরনের রম্যরচনায় অভ্যস্ত তার অফুরন্ত ভাণ্ডার এই আন্তর্জাতিক পত্রিকা।’
কেমন ছিল ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এর সেসব কৌতুক কাহিনি? তাঁর লেখা থেকেই পড়া যাক গত শতকের নয়ের দশকে প্রকাশিত এমন একটি নমুনা, যে-গল্পটির কেন্দ্রে রয়েছে এক কিশোর—
‘ছেলেটির বাবা তাঁর চুয়াল্লিশ বছরের জন্মদিনে সকালবেলা চায়ের টেবিলে চায়ের মধ্যে নিয়মমতো স্যাকারিন না দিয়ে এক চামচ চিনি মিশিয়ে বললেন, ‘মনের বয়েসই আসল বয়েস। মনেই হচ্ছে না চুয়াল্লিশ বছর বয়েস হয়েছে। মনে হচ্ছে আমার বয়েস ত্রিশ বছর।’ একথা শুনে ছেলেটির মা হেসে বললেন, ‘আমার তো পঁচিশ বছরের বেশি নিজেকে মনে হচ্ছে না।’
এতক্ষণ চৌদ্দ বছরের ছেলে ওমলেট খেতে খেতে মা-বাবার কথা শুনছিল, এবার সে বলল, ‘আমারও মনে হচ্ছে আমার বয়েস আঠারো হয়ে গেছে।’ মা-বাবা অবাক। মা বললেন, ‘আমাদের বয়েস কমলো, তোমার বয়েস বাড়ল কেন?’ ছেলে বলল, ‘আজ রাতে আমি একটা অ্যাডাল্ট মুভি দেখব।’’
আর-পাঁচটা পত্রিকার মতোই সময়ের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বদলেছে ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’। নানা দিকে শাখা বিস্তার করেছে। গ্রাহকসংখ্যাও নেমেছে, উঠেছে। কিন্তু নানাভাবে উপভোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তা বজায় রেখে যে-ভরসা সে আমপাঠকের মনে শতকাধিক কাল ধরে বপন করে চলেছে, তার নিদর্শন পত্রপত্রিকার দুনিয়ায় খুব বেশি নেই।
ছবি সৌজন্যে : লেখক