ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আলোর রং সবুজ : পর্ব ১৩


    মন্দার মুখোপাধ্যায় (March 2, 2024)
     

    হরশঙ্কর

    তরঙ্গনাথ বা তনুদা পুলিশে চাকরি পেয়ে ট্রেনিং শেষে একেবারে অফিসারের পদে যোগ দেওয়ায় শুধু হরুদের বাড়ি নয়; সারা পাড়ায় বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেছে। হরুর পরিবারে একটু বেশি আলোচনা চলছে; কারণ তনুদা আর হরুর মায়েরা দুই আপন বোন, একই পাড়ায় বিয়েও হয়েছে দুজনের। রূপ ও যোগ্যতার বিচারে তনুদার মা অনেক উজ্জ্বল হলেও হরুর মায়ের বিয়েটা বেশি ভাল হয়েছে। কারণ তনুর বাবা কোনও চাকরিতেই বেশিদিন টিকে থাকতে পারেন না; তনুর জ্যাঠামশাই এবং দাদামশাই দুজনেই ডাকসাইটে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং কাছাকাছি বয়সের বন্ধু হওয়ার সুবাদে, তিনি বার বার চাকরি পেয়ে যান। হরুর বড়মাসির তাই চোখের জল ফেলতে ফেলতেই তনুর চাকরিতে যোগ দেওয়ায় মত দিতে হয়েছে। হরুরও আফসোস যে তনুদা এত ভাল ছাত্র হয়েও কলেজে যাওয়ার সুযোগই পেল না; কে বলতে পারে সে সুযোগ পেলে তনুদাও যে একদিন বিলেত যেত না!

    এদিকে হরু আর তার ছোটভাই নিশি বা নিশিপ্রকাশ বেশ যত্নে বড় হচ্ছে। তাদের বাবা কালেক্টর ডিপার্টমেন্টের ক্লার্ক হলেও, মায়ের প্রখর সাংসারিক জ্ঞানের ফলে তাদের লেখাপড়ায় কোনও বিঘ্ন ঘটেনি; তার বন্ধু ভূতেশ বা মাসতুতো দাদা তনু এদের কারোর পরিস্থিতিই তাদের দু-ভাইয়ের মতো অনুকূল নয়। ম্যাট্রিকের পর ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে তারা যে বি এ পড়ছে এটাই যেন নির্ধারিত ছিল। তার উপর হরুদের কোনও বোন না থাকায়, বিয়ের চিন্তা থেকেও বাবা-মা মুক্তি পেয়েছেন। হরুদের দিদিমা ছিলেন কবি; ছাপা বই বেরিয়েছিল দাদামশাই বেঁচে থাকতেই। কিন্তু অকাল বৈধব্য আর পাঁচ ছেলেমেয়ের নানা জটিলতায় তার জীবন বদলে গেলেও লেখার অভ্যেস তিনি ছাড়েননি। হরুর মা-মাসিরা সময় পেলেই কবিতা, গল্প লেখেন বা ইংরেজি সাহিত্য থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন— এই সদিচ্ছা তাঁরা পেয়েছেন তাঁদের মায়ের কাছ থেকে। বিয়ের আগে বালিকা বয়সে মেমসাহেবের কাছে লেখাপড়া শেখায় এঁরা সকলেই খুব সুন্দর চিঠি লেখেন, দিনান্তে ডায়েরি রাখেন। এঁদের সকলেরই হিসেব লেখার খাতাগুলিও দেখবার মতো। মায়েরা বিদ্যাপ্রেমী হওয়ায় নানা ধরনের বই, বিশেষত বাংলা পত্রপত্রিকার সঙ্গে পরিচয় হয় বাড়ির ছেলেমেয়েদের।      

    হরুর মধ্যে যে স্বদেশপ্রেম জেগে উঠছে, তা যে শুধু ইংরেজ বিরোধিতা এবং ইংরেজ নিধনের এক সুপ্ত ইচ্ছে তা কিন্তু নয়। তার মধ্যে গড়ে উঠছে নব্য-সংস্কৃতি এবং দেশজ শিক্ষার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর এসবের খবরে যেমন অরবিন্দ-বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বা গান্ধীজি-সুভাষচন্দ্র; তেমনই তার মনে সাড়া জাগায় গিরিশ ঘোষ, বিনোদিনী, গ্রামোফোন কোম্পানি এবং নির্বাক চলচ্চিত্রের সূচনা। মন জুড়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল উপস্থিতি। আগ্রহ নিয়ে পড়ে কীভাবে কংগ্রেসের সভায় উপস্থিত হয়ে গান্ধীজিকে শোনাচ্ছেন তাঁর নিজের লেখা গান, বা তাঁর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের গান্ধীজির লাইভ স্কেচ করার কথা। কেমন যেন ঘোর লেগে যায় হরুর; এমন এক অবিশ্বাস্য সময়ের মধ্যে সে বড় হয়ে উঠছে যে নিজেরই বিস্ময়ের সীমা থাকে না।       

    আবার তার মন বিমর্ষ হয়ে পড়ে যখন জানতে পারে যে, কত তরুণকে বিচারের প্রহসন করে অনায়াসে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেলুলার জেলে। সব ফাঁসি, গ্রেপ্তারির খবর কি আর কাগজে বেরোচ্ছে! ভাবে যে দ্বারকানাথের নাতি হওয়ার সুবাদে কত অনায়াসে বিলেত যেতে পারেন রবিঠাকুর ও তাঁর দাদারা। এমনকী কেউ কেউ আবার ছেলে-মেয়ে নিয়ে সস্ত্রীকও! হরুর মনে প্রতিবাদ জাগে সাহেবদের নতুন নতুন প্রশাসনিক আইন, কৃষকদের দুরবস্থা এবং জমিদার তোষণের আয়োজন দেখে। হরু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যে, কোন পথ ধরলে সে তার ভাবনাগুলোকে একটু গুছিয়ে ভাবতে পারবে! আকর্ষণ এবং বিরাগের মধ্যে দিয়ে তার মধ্যে আসলে যা গড়ে উঠছে তা হল মেধার প্রতি অনুরাগ। তার ভাই নিশির এসব সঙ্কট নেই। মাঝারি মেধা নিয়ে মোটামুটি পাশমার্ক পেয়ে, পাড়ায় একটু আড্ডা দিয়েই সে খুশি। বাবার মতো সে স্বভাব-তৃপ্ত। সময়ের নিয়ম মেনেই তার যে চাকরি, বিয়ে এবং ছেলেপিলে, এসব হয়েই যাবে সে ব্যাপারে নিশি একেবারেই নিরুদ্বিগ্ন। তাই যে কোনও আড্ডায় সে বসে যেতে পারে, কারণ তার কোনও মতামত নেই। সে একজন শ্রোতামাত্র। সময়টুকু কাটানো নিয়ে কথা। নিশি সবকিছু সময়ে করে— স্নান-খাওয়া, লেখাপড়া, আড্ডা ছাড়াও নিজের কাপড়জামা কেচে, শুকিয়ে, গুছিয়ে রাখা, টানটান করে বিছানা এবং মশারি ভাঁজ করা; এমনকী দোকান-বাজারও। বলতে গেলে হরুর একেবারে বিপরীত তার ভাই নিশি। ফলে বাবা-মায়ের সঙ্গে হরুর তর্কাতর্কি লাগলে নিশি সেখান থেকে টুক করে কেটে পড়ে।

    হরুর মধ্যে যে স্বদেশপ্রেম জেগে উঠছে, তা যে শুধু ইংরেজ বিরোধিতা এবং ইংরেজ নিধনের এক সুপ্ত ইচ্ছে তা কিন্তু নয়। তার মধ্যে গড়ে উঠছে নব্য-সংস্কৃতি এবং দেশজ শিক্ষার এক অপূর্ব মেলবন্ধন।

    ২.

    ছুটির দিনে ঘরের কোথাও খুঁজে না পেয়ে, হরুর বাবা তাকে ছাদে বসে থাকতে দেখেই জানতে চাইলেন, ‘তনু তো এসেছে। দেখা করতে যাসনি?’

    ‘সময় পাইনি। সময় করে যাব, কালকে যখন হোক।’

    ‘নিজের দাদাকেই যদি এত ভয়, তাহলে সাহেব-পুলিশের চোখে ধুলো দিবি কী করে!’

    ‘ভয় কেন? কিসের ভয়? আমি কি চোর না গুণ্ডা; নাকি সাহেব মেরে ঘরে এসে লুকিয়েছি!’

    ‘তোর ধরনটা ইদানীং ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। চেনাজানা কেউ নেই অথচ ভূতেশও একটা চাকরি জুটিয়ে নিল…’

    ‘ওর দরকার তাই; উপায় কী!’

    ‘তোর দরকার নেই? একটা কিছু তো জোটাতেই হবে! এরপর নিশিও অফিস যাবে…’

    ‘তাহলে তো আরও ভাল! আমার ওপর ভরসা রাখছই বা কেন?’

    ‘তবে এ ভাবেই থাক। বই মুখে করে যদ্দিন কাটে… পট করে আমি যখন চোখ বুঝব তখন মালুম পাবি। মা তোকে যতই লাই দিন, একদিন তাকেও পস্তাতে হবে।’  

    এটা খুবই সত্যি যে, বাবা মাঝে মাঝে চটে উঠলেও মা কিন্তু তাকে খুবই প্রশ্রয় দেন। সংসারের খরচ বাঁচিয়ে টাকা দেন দামি-দামি ইংরেজি বই কেনবার জন্য, ট্রেন ভাড়া দেন ঘন-ঘন কলকাতা যাবার; কখনও জানতে চান না চাকরির চেষ্টা করছি কি না। অবসর পেলেই আমার কাছটিতে বসে, নিজের সেলাইতে ফুল তুলতে-তুলতে জানতে চান কোথায় কী ঘটছে; নতুন আর কার সম্পর্কে কী জানলাম; মা নিজেও যে কত কিছুর খবর রাখেন! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ভূতেশের ওই বিধবা বড়বোন বিরজাবালার সঙ্গে মায়ের পরিচয় করিয়ে দিতে। বিরজাবালার মধ্যে সে দেখতে পায় নিজের মায়ের মেধা এবং সবকিছু জানবার আগ্রহ। নারীমুক্তি বিষয়ে যেসব খবর হরু এখন ছাপার অক্ষরে পড়ে জানতে পারছে, তারই যেন জীবন্ত উদাহরণ তার মা এবং পাড়ার মেয়ে বিরজাবালা। তফাত এই যে, সরলাদেবীদের কথা ফলাও করে কাগজে বেরোয় আর তাদের মতো সাধারণ ঘরের মেয়েদের যেন সেই প্রদীপে সলতে পাকানোই সার হয়; তেল সংযোগে আলোটুকু জ্বালানো আর হয়ে ওঠে কোথায়!     

    হরু মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবা মেয়েদের সত্যিই কি আবার বিয়ে হয়?’

    ‘নিশ্চয়ই হয়। তবে ওই একটা-দুটোই; কুমারীদের বিয়ে দিতেই বাপ-মায়ের দম ফুরোয় তায় আবার বিধবা! তাহলে তো ভূতেশের বোন, দুই বউদি সকলেরই আবার বিয়ে হয়ে যেত!’

    ‘আইন তা হলে কিছু নয়? লোক ভুলানো সংস্কার!’

    ‘আইন তো দরকার। কিন্তু সব থেকে বড় হল সংগতি… ট্যাঁকের জোর।’  

    ‘দাদামশায়ের তো সংগতি ছিল! ছোটমাসি যখন অত অল্পবয়সে কচি মেয়েটাকে নিয়ে বিধবা হল, তাকে আবার বিয়ে দেওয়ার কথা কেন ভাবলেন না দাদামশায়?’

    ‘বাবা চেয়েছিলেন, দাসীই চায়নি। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ দেওয়া ওর বর কালাজ্বরে মারা যেতেই ও যেন কেমন হয়ে গেল। আর বিয়েতে সম্মত হলে মেয়েকে ছেড়ে আসতে হত! শ্বশুরবাড়ির লোক মেয়ে সমেত ওর অন্য সংসারে যাওয়া কিছুতেই বরদাস্ত করত না।দাসী বিধবা হওয়ার পর, সময় গড়িয়ে ঠিক ওই বয়সেরই তিন-তিনটে বিধবাকে যখন ভূতেশদের সংসারে দেখি, তখন ভাবি কতটুকু আর বদলাল সেই সাবেক সময়!’    

    ‘বউদিদের সঙ্গে কথা বলিনি, তবে বিরজাবালা খুবই অন্যরকম— বই পড়ে, দেশসেবার কথা ভাবে। আবার সংসারের কাজেও খুব খেয়াল রাখে।’

    ‘সেটা হয়তো জয়নারায়ণের কারণে। জয়নারায়ণ পাশ থেকে সরে গেলে তবে বোঝা যাবে! এখন তো ঘি আর আগুন— দুজনেই দুজনকে অন্যভাবেও ইন্ধন যোগাচ্ছে…’

    মায়ের এই কথায় স্তম্ভিত হয়ে গেল হরু! মা কি তাকে সাবধান করলেন! এসব কথা মায়ের কানে কে তুলল? হরুর ধারণা জয়নারায়ণের সঙ্গে বিরজাবালার অন্তরঙ্গতা সে ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ জানে না। তবে কি নিশি? ভূতেশ তো তারও বন্ধু! মায়ের বলা ওই ‘ঘি আর আগুনের’ সম্পর্কটা কেমন যেন মাথায় ঢুকে গেল হরুর। যে বইটা হাতে নিয়ে গুছিয়ে বসেছিল আজই পড়ে শেষ করে ফেলবে বলে, সেটাতে আর মনই বসাতে পারল না। বিরজাবালার সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে বুক কেঁপে উঠল হরুর। বিহ্বল হয়ে ভাবল, সে-ও কি ভালবাসে বিরজাকে! জয়নারায়ণের মতো? নাকি তার থেকেও অনেক-অনেক বেশি!    

    ৩.

    ভূতেশের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে না করলেও, তনুদার সঙ্গে দেখা করে সময় কাটাতে কিন্তু খুব ইচ্ছে করে হরুর। হয়তো তনুদারও তাই, কিন্তু অসম্ভব ভয় করে! স্থির দৃষ্টিতে তনুদা যেভাবে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তা দেখেই ভয়ে তার হাড় সত্যিই হিম হয়ে যায়। নিজে থেকে বিশেষ কিছু জিজ্ঞাসাও করে না; যেন সবই সে জানে। এবারেও দেখা করে চলে আসার সময়ে একটা কথাই জানতে চাইল— কলকাতায় রবিঠাকুরের কোনও বক্তৃতা শুনেছি কি না! মাথা নেড়ে না বলাতে চুপ করে রইল। তনুদা কি খুব বদলে গেছে? নাকি সে নিজেই সাবধান হয়ে গেছে একটু বেশি রকম! এত এত বোমার মামলা, ইংরেজ হত্যা, জেল-দীপান্তরের গুপ্ত খবর— কী ভাবে সহ্য করছে তনুদা? সংসারের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বোধহয় ভেঙেচুরে, দুমড়ে ফেলে এক অন্যরকম মানুষ বানিয়ে ফেলেছে সে। সব জেনেও হরু ভয় পায় তার এই পুলিশ অফিসার দাদা তরঙ্গনাথকে; কারণ তনু জানে, যে স্বদেশিমন্ত্রের আকর্ষণে সে নিজেকে সঁপে দিতে চাইছে, তাদের ধরার জন্যই তনুদাদের নিয়োগ। এই বিষয়ে দক্ষতা বাড়াবার জন্য অনুশীলনও দেওয়া হচ্ছে, সে চুনোপুঁটি বা রাঘব বোয়াল যে-ই হোক না কেন!        

    ভাল করে ভেবে দেখে এটাই ধারণা হয়েছে হরুর যে, সমস্যাটা শুধু ইংরেজদের নিপীড়ন তা-ই নয়। বিশ্বব্যাপী মানুষ রুখে উঠছে নানা ভাবে; রাশিয়ায় কমিউনিস্ট জাগরণ, এ দেশে সন্ত্রাস বনাম সমঝোতা এবং মৌলবাদী হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষের রাজনীতি। সেই সঙ্গে গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ এবং সুভাষচন্দ্রের তিন ধারার নিজস্ব মত। আদিবাসীরাও তাদের মতো করে ভাবছে; নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে দেশীয় রাজারা। একই সঙ্গে নতুন প্রত্যয়ে গড়ে উঠছে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি এবং বিজ্ঞান ও চিকিৎসার প্রসার। হরুর মনে একদিকে যেমন উপচে পড়া খবরের শিহরণ, অন্য দিকে তেমন দ্বন্দ্বও। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের জোয়ার, ব্যাপক দুর্ভিক্ষ এবং আসন্ন বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক— সব নিয়ে হরুর বুদ্ধি একেবারে গুলিয়ে যাচ্ছে। রানি ভিক্টোরিয়া দেহ রেখেছেন, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টেও নানা বদল; আর এ দেশটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, টাইফয়েডে, নয়তো কুষ্ঠ, হাম-বসন্তে। সেখানে হরুর চিন্তা একটা সার্বিক পথ— ‘Anglicism’, ‘Modernism’ নাকি ‘Sovereignty’! আরও বেশি করে অক্ষরে ডুব দিতে লাগল হরু। কার কাছে যাবে? নেতা না মালিক? চাকরি না মুক্তি— কোনটা চাই তার?

    আমি হরশঙ্কর, পাড়ার সকলের ডাকে হরু। বিরজাবালাকে জয়নারায়ণের ভাগে ছেড়ে দিয়ে কলকাতা যাতায়াত বাড়িয়ে দিলাম; এই প্রত্যন্তে পড়ে থাকলে আমার খোঁজের হদিশ মিলবে না। কাগজের আপিসগুলোয় দরখাস্ত দিতে দিতেই আবিষ্কার করলাম কত ছোট ছোট কাগজ বেরোচ্ছে। মাইনে দিয়ে এমন লোকই খুঁজছে তারা যে ইংরেজি এবং বাংলা দুটো-ই লিখতে পারে। মুস্কিল হল বেছে নেওয়া। সাবধানের মার নেই ভেবে, এশিয়াটিক সোসাইটিতে দেখা করে, Medical and Physical Society of Calcutta-র অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পারলাম Your Health বলে একটি ইংরেজি জার্নালের কথা; সেখানে একটা কাজ হলেও হতে পারে।

    ঠিকানা নিয়ে শেয়ালদার কাছে সে দপ্তরে গিয়ে দেখা করতেই কাজটা হয়ে গেল। দরখাস্ত লিখে কাজে যোগ দিয়ে বেরিয়ে আসার সময়ে মনে হল, বাড়িতে কী বলব? রোজ রোজ দশটা-পাঁচটা করতে হলে না বললে চলবে কী করে? পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত নিয়ে মেসবাড়ির দিকে হেঁটে গেলাম। কলকাতার মেসে থাকলে কোথাও আর জবাবদিহি করতে হবে না। ভাল না লাগলে চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে কতক্ষণ! মাকে সব বলব। আর প্রথম মাসটা কাটানোর টাকা মায়ের কাছ থেকে ধার করে চালিয়ে নিলেই হল। এই প্রথম বুঝলাম যে চাকরি, স্বাধীনতা এবং মুক্তি সব একসঙ্গেই জড়িয়ে থাকে। নিজের জন্য এমন এক সিদ্ধান্ত নিতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সেও তো এই প্রথম। পুরোপুরি একজন ইন্টেলেকচুয়াল হওয়ার পথেই পা বাড়ালাম আমি।      

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook