পরিযায়ী পাখির কলকাতা, শীতের মিঠে রোদ্দুরে ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কাপের কলকাতা, রঙিন সবজি-বাজার আর ঝোলাগুড়-মোয়া-ফিরিওয়ালার কলকাতা, আর তাকে আরও মায়াময় করে তোলা বিভিন্ন ঘরোয়া মজলিস থেকে শহরের বিভিন্ন মঞ্চ আলো করে হয়ে চলা মার্গসঙ্গীতের আসরের কলকাতা— আজ বিষণ্ণ। এ-লেখাও যে লিখতে হবে, আর এত অকালে লিখতে হবে, তা যেমন এ-কলম মানতে চাইছে না, তেমনই মনও ক্ষমা চেয়ে উঠছে। ভারাক্রান্ত মন ও মগজ নিয়ে তবু বসেছি সাদা কাগজের সামনে আজ সেই ছেলেটির কথা লিখব বলে, যে সুদূর বদায়ুন থেকে চলে এসেছিল কলকাতায় তার গুরু তথা দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খান সাহেবের সঙ্গে শিক্ষার্থী হয়ে, উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে নিজের স্থান করে নিতে। উস্তাদ রাশিদ খান— যাঁকে আমি ছোট থেকে রাশিদ চাচা বলে জেনেছি। চোদ্দো বছরের সেই ছেলেটি, আজীবন সুরের ভিতরে, সুরের সাধনার ভিতরে বাস করে উস্তাদ রাশিদ খান হয়ে ওঠা মানুষটি দেহের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন গত ৯ জানুয়ারি। ভেতরে জমাট বাঁধছে অদ্ভুত এক শূন্যতা আর মনে হচ্ছে আরও যে অনেক কিছু দেওয়ার ছিল তাঁর, আরও যে অনেক মগ্ন আসর শোনার ছিল, শেখার ছিল আমাদের। আবার সান্ত্বনার মনে ঘুরছে একটাই কথা— সুরের তো ক্ষয় নেই, মৃত্যু নেই। তাঁর হেঁটে যাওয়া দরবারি, মেঘ, যোগকোষ, শাহানা, শুদ্ধকল্যাণের পথে-ঘাটে হেঁটে বেড়াব আমি, আমরা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম আরও বহু বছর, কাল; যতদিন এ-পৃথিবী রয়েছে।
মার্গসঙ্গীতের সাধকদের ঘরে জন্মেছি বলে বহু তাবড়-তাবড় শিল্পী এবং সঙ্গীতসাধকদের সঙ্গ করার সৌভাগ্য হয়েছে অগণিতবার। যা শিখেছি, যা অনুভব করেছি, তা প্রকাশ করার পক্ষে ভাষা যথেষ্ট নয়। তবু রাশিদ চাচাকে যতটুকু দেখেছি, যতটুকু শুনেছি, তাতে বার বার মনে হয়েছে তিনি এক অন্য দরজার শিল্পী। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গুরুমুখী বিদ্যা, আর সেই সঙ্গীত যাদের জীবনের ধ্যান-জ্ঞান, জীবনধারণের উপায়, তাদের যাপনও একটু অন্যরকমের হতে হয়। রাশিদ চাচারও ছিল সেরকমই।
আমি তখন স্কুলে, আশির দশকের শেষের দিকের কথা, বাবার মুখে প্রথম শুনি রাশিদ চাচার কথা— ‘নিসার হুসেন খাঁ সাহেবের নাতি খুব ভাল গাইছে শুনছি।’ আর তারও কয়েক বছর পর, তখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ নয়, সর্বদা সব কিছুকে ক্যামেরাবন্দি করে রাখার যুগ নয়, এহেন একদিন বাবা সকালের ক্লাস শেষ করে উঠেছেন, বেলা হয়েছে অতএব এবারে স্নান-খাওয়া সারতে হবে; এমন সময় দরজায় ঘণ্টি বেজে উঠল। বেশির ভাগ দিনই বিভিন্ন লোকজন, ভক্তরা না বলেই চলে আসত আর এরকম সময়ে কেউ এলে আমার কাজ ছিল তাকে ফোন নম্বর দিয়ে বলা, ফোন করে সময় নিয়ে আসতে। আমি নীচে নেমে দরজা খুলতেই দেখলাম একজন অল্পবয়সি ভদ্রলোক, গায়ে ঘিয়ে টি-শার্ট আর প্যান্ট, দাঁড়িয়ে দরজায়। আমাকে বললেন, ‘পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী আছেন? আমার নাম রাশিদ। দাদা চেনেন আমাকে।’ কথায় একটু হিন্দির টান। বাবা উপরে সিঁড়ির কাছ থেকে হয়তো কিছু শুনে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’, আমি কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক একটু গলা বাড়িয়ে বললেন, ‘দাদা, আমি রাশিদ!’ বাবা তৎক্ষণাৎ উপর থেকে বললেন, ‘আয়, আমার মেয়ের সাথে চলে আয় উপরে!’
উপরে এসে গানের ঘরে ঢুকে বাবাকে প্রণাম করে বললেন, ‘তালিম শেষ হয়ে গেছে? ভাবছিলাম একটু যদি শুনতে পাই!’ বাবা হেসে বললেন, ‘আরেকদিন আয়, সকাল-সকাল।’ তারপর দুজনে বসলেন কার্পেটে। খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন রাশিদ চাচা, তারপর হাত জোড় করে বললেন, ‘দাদা, সেদিন সুধকল্যাণ শুনলাম আপনার।’ বলতে-বলতে মাথা নাড়তে লাগলেন, যেন তখনও শুনতে পাচ্ছেন গান— ‘ভীমসেনজির পরে… দাদা, এই বাঢ়ত শুধু রিয়াজে হয় না। দিল-দিমাগের মেল লাগে।’ বাবা পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘তুই বুঝেছিস, কারণ তুই আসল গানবাজনাটা বুঝে করিস। এই মনটাকে ধরে রাখিস, তোর গান তোকে ধরে রাখবে।’ সেদিন আরও অনেক কথাবার্তা আলোচনার পর রাশিদ চাচা চলে গেলেন। এরপর বহু সাক্ষাৎ হয়েছে অনুষ্ঠানে, বাড়িতেও এসেছেন দরকারে-অদরকারে। যতবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছি, পরম স্নেহে আশীর্বাদ করেছেন এই বলে, ‘জিতে রহ, ভাল গাও।’
শুদ্ধকল্যাণের কথা বলতে-বলতেই সেই শুদ্ধকল্যাণেরই আরেক সন্ধ্যার স্মৃতি ঘিরে আসছে। সালটা ১৯৯৪-’৯৫, কাননজেঠু অর্থাৎ পণ্ডিত এ টি কানন সাহেবের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে সে-বছর কানন জেঠু ও মালবিকা পিসির আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমির বাড়িতে ঘরোয়া অনুষ্ঠান চলছিল সারা বছর ধরে। প্রত্যেক মাসে বিভিন্ন গুণি শিল্পীরা গানবাজনার মাধ্যমে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছিলেন। বাবাও গেয়ে এসেছেন কয়েক মাস আগে কাননজেঠুর আমন্ত্রণে, এমন সময়ে একদিন কানন জেঠুর ফোন, ‘মানস, রাশিদ গাইবে সামনের সপ্তাহে আমার বাড়িতে। বড় ভাল গাইছে। তোমাকে আসতেই হবে।’ তখন রাশিদ চাচা তরুণ প্রতিশ্রুতিমান গায়ক হিসেবে সকলের নজর কাড়তে শুরু করেছেন। যথাসময়ে সেই দিনটিতে আমিও বাবার সঙ্গে-সঙ্গে গিয়ে উপস্থিত হলাম আসরে। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতেই শুনতে পাচ্ছিলাম শুদ্ধকল্যাণের বাঢ়ত শুরু হয়ে গেছে। বাবা ঢুকতেই রাশিদ চাচা গাইতে-গাইতেই হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে, সামনের আসন দেখিয়ে দিলেন বাবাকে। সামনে আসর উজ্জ্বল করে বসে রয়েছেন ফাল্গুনী কাকা, উস্তাদ আমজাদ আলি খান সাহেব, কানন জেঠু প্রমুখ। বাবার সঙ্গে-সঙ্গে আমিও গিয়ে বসলাম অত ঔজ্জ্বল্যের মাঝে ছোট্ট শিক্ষার্থীর মতো। সবাই সবাইকে নিঃশব্দে নমস্কার জানালেন। লক্ষ করলাম, রাশিদ চাচা বাঢ়তের কিছুদূর এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে আবার ফিরে ষড়জ থেকে বিস্তার আরম্ভ করলেন। একজন শিল্পীর তো আসলে সবসময়েই খিদে থাকে তাঁর গান গুণি শিল্পী ও মানুষের কাছে পূর্ণ রূপে পৌঁছোক। আর এমন ঘরোয়া অথচ শিল্পীপরিবৃত আসরই তো আদর্শ এমন এক ক্ষুধার্ত শিল্পীর জন্য! মুহূর্তমধ্যে বুঁদ হয়ে গেলাম শুদ্ধকল্যাণে। ষড়জ থেকে নিষাদের কণ নিয়ে ধৈবতে অথবা পঞ্চম থেকে তীব্র মধ্যমের কণ নিয়ে গান্ধারে মীড় দিয়ে আসার যে-আকুতি, যে-মেজাজ, রাগের দর্শনের প্রতি যে-সমর্পণ, তা সত্যিই প্রকৃত শিল্পী ছাড়া আসে না। এবং রাশিদ চাচার সবচেয়ে বড় সম্পদ তাঁর কণ্ঠ, মেজাজ এবং লয়কারী; যা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সম্পদ হয়ে থাকবে। রামপুর-সাহসওয়ান ঘরের গায়ক হওয়া সত্ত্বেও তিনি কিন্তু ঘরানার গণ্ডির মধ্যে তাঁর গানকে আবদ্ধ করে রাখেননি। যে-ঘরের যা সম্পদ, তাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন। সেদিন আসরের শেষে নেমে এসে বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন যখন, রাশিদ চাচা বলে উঠলেন, ‘বাঢ়তটা চেষ্টা করেছি একটু…’ বাবা তার পিঠে আলতো চাপড় মেরে তারিফ করে বললেন, ‘জিতা রেহ!’ এক মুহূর্তের জন্যও মনে হল না দুটো মানুষের ঘরানা আলাদা, ধর্ম আলাদা, কে কোথাকার বাসিন্দা। এইসব ভেদাভেদের রেখা আসলে তো একই হাতের তেলোর মধ্যে পাশাপাশি রয়ে যায়, হাতের তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। সঙ্গীতও তেমনই ভারতবর্ষের মতন এই সব কিছুকে ধারণ করেও এইসবের ঊর্ধ্বে পারস্পরিক ভালবাসা আর সৌহার্দ্যের জায়গায় নিয়ে যায় আমাদের। রাশিদ থেকে উস্তাদ রাশিদ খান হয়ে ওঠার যাত্রায় সেই পরিযায়ী পাখির কলকাতা তাকে মায়ের মতন পরম স্নেহে আগলেছে, যে-মানুষটি শিশু অবস্থায় মাকে হারিয়েছিলেন। সেই মায়েরই স্মৃতিতে শাখরী বেগম মেমোরিয়াল ট্রাস্ট তৈরি করেছিলেন এইখানেই, উদ্বোধনে সেবারও সসম্মানে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবাকে। আরও পরে তার সঙ্গে জুড়েছে ফিফ্থ নোট। এক আসরে বহু গান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, তা ছাড়াও দাদু সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর স্মৃতিতে যে-অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন বাবা, তাতেও গেয়েছেন পরম শ্রদ্ধা-নিমগ্ন মনে। দাদুর শতবর্ষ উদ্যাপনেও এসে গান গেয়ে আসর মাত করে দিয়ে গেছেন। সাফল্যের পথ যত অতিক্রম করেছেন প্রকৃত গুণিজনের প্রতি শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে কোনওদিন ঔদ্ধত্যের ছায়া পড়তে দেখিনি। গানবাজনা নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে ফিউশন সবই তাঁর কণ্ঠে অনন্য মাত্রা পেত কিন্তু তাঁর মন চিরকাল মার্গসঙ্গীতের কায়েল থেকে গেছে। সেইখানে মেজাজটাই আসল রাজা। প্রকৃত অর্থেই তাঁর পথ ছিল শুদ্ধ কল্যাণের। এই শেষ না-হতে-চাওয়া যাত্রার ইতিকথা লিখতে গিয়ে একটা ভোর হয়ে আসা রাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আর মন চাইছে সেই সময়টায় থেকে যেতে আজীবন। বাবা চলে যাওয়ার বছরখানেক আগের শীতের একটা রাত, আমরা বাবার গানের শেষে আসর থেকে বাড়ি ফিরছি শেষরাতে, ভোর তখন প্রায় দরজায় এসে দস্তক দিচ্ছে। গাড়িটা সাদার্ন এভিনিউয়ের রাস্তা ধরল, নজরুল মঞ্চের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে একটা গলা ভেসে এল যেন কোন এক অমোঘ হাতছানির মতন। বাবা গাড়ির কাচটা অল্প নামিয়ে কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে থেকে বলে উঠল, ‘রাশিদ গাইছে… ভৈরবী।’ সমস্ত আয়োজনের শেষে ভৈরবী আসে কিন্তু ভেতরে ঘর করে নেয়। তেমনই যে-ঘর উস্তাদ রাশিদ খানের মতন শিল্পী অগুনতি শ্রোতার মনে গড়ে রেখে গেলেন, তাতে তাঁর কণ্ঠ নিয়ত খেলা করে যাবে সেই ভৈরবীরই মতন।
ছবি সৌজন্যে লেখক