কোরিয়া কেমন করিয়া
উত্তর কোরিয়ার একটা ভিডিওতে দেখা গেল, দুটি ১৬ বছরের ছেলে ১২ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হল, কারণ তারা দক্ষিণ কোরিয়ার ওয়েব সিরিজ দেখেছিল, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গীত শুনেছিল ও মিউজিক ভিডিও দেখেছিল। শুধু তা-ই নয়, তারা নাকি সেগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল, যাতে অন্যরাও দেখতে পারে। (সম্ভবত বছর-দুয়েক আগে তোলা) এ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট অ্যাম্পিথিয়েটার, মানে, গ্যালারি-মতো জায়গায় আরও বহু টিন-এজার বসে (বোধহয় তারা ছাত্রছাত্রী) এবং সকলের সামনে এই বিচার চলছে। অর্থাৎ এই রায়দানের মাধ্যমে তাদেরও বোঝানো হল, দক্ষিণ কোরীয় সংস্কৃতির পাল্লায় পড়লে তোমাদেরও জীবনে কঠোর শাস্তি নেমে আসবে। অনেকে বলছে, আগে এই ধরনের ‘অপরাধ’-এ বছর পাঁচেকের জন্য ক্যাম্পে পাঠানো হত, একেবারে ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হত না। সে অবশ্য এমনও শোনা যাচ্ছে, ২২ বছরের এক উত্তর কোরীয় ব্যক্তিকে গুলি করে মারা হয়েছে, কারণ তিনি দক্ষিণ কোরীয় সিরিজ দেখেছিলেন ও বন্ধুকে দেখতে বলেছিলেন। উত্তর কোরিয়ায় নাকি মার্কিন টিভি-সিরিজ দেখলেও ঘুষ-টুস দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাপারে কোনও মায়াদয়া নেই। আসলে দুটো দেশ যখন পরস্পরকে পাঁড়-শত্রু হিসেবে দেখতে থাকে, তখন শুধু মিসাইলকে ভয় পায় না, গভীর সন্দেহে ভোগে যে ওদের নাচ-গান-খেলা-কৌতুকনকশা সবকিছুই একবগ্গা ভাবে শুধু এই দেশটার বিরুদ্ধেই ধাবিত হচ্ছে, ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য শুধু এদের ধ্বংস। যেজন্য উত্তর কোরিয়ায় বলা হয়, দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি একটা মাদকের মতো, যা তোমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে ও বাস্তবে বাঁচতে দেবে না। যেজন্য ২০২০ সালে উত্তর কোরিয়া-য় ‘প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনাচিন্তা’র বিরুদ্ধে আইনও পাশ হয়ে গেছে। আরও ঝঞ্ঝাট আছে। উত্তর কোরিয়ায় আগাগোড়া প্রচার চলে, দক্ষিণ কোরিয়ার লোকগুলো সাংঘাতিক দুঃখকষ্টে শ্যাওলায় মুখ ঘষড়াচ্ছে। কিন্তু কে-সিরিজের একটি ফ্রেমে চোখ রাখলেও তার উল্টো ধারণাই হয়। তাহলে যদি উত্তর কোরিয়ার জনগণ প্রশ্ন করতে শুরু করে, এই দৃশ্যগুলো কি পূর্ণ বানানো, এ কি স্টুডিওয় নির্মিত মেকি দক্ষিণ কোরীয় শহর পথঘাট দোকানপাট? না কি ওরা আসলে সাংঘাতিক সম্পন্ন সুখী ও সানিকসিনিক, এবং আমরাই বরং মলিন দরিদ্র এঁদো? অবশ্য কেউই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না, উত্তর কোরিয়ার লোকজন নিঃসন্দেহে জানে যে তারা একটা লৌহপর্দার আড়ালে ও মিথ্যে প্রচারের কম্বলের তলায় হেদিয়ে চাপা পড়ে আছে, অবশিষ্ট পৃথিবীতে বিষাদ নিশ্চয় আছে কিন্তু সঙ্গেই আছে কিছু প্রসন্নতা ও অনেকটা স্বাধীনতা, যা তাদের দেশে কোনওকালে লভ্য হবে বলে মনে হচ্ছে না। সারা বিশ্ব এখন দক্ষিণ কোরীয় সংস্কৃতিতে মজে আছে, আর তাদের যারা সর্বোচ্চ সহোদর, সেই উত্তর কোরিয়া সে-সংস্কৃতির কণামাত্র আন্দাজ পাবে না, এ যুগে তা অসম্ভব। ফলে তাদের তা এখন ড্রাগের মতোই চোরাপথে লুকিয়েচুরিয়ে ভোগ করতে হবে, আর হরদম পড়তে হবে প্রশাসনিক রোষে।
এ আখ্যান শুনে ‘সত্যি, এ সুজলা সুফলা গ্রহে উত্তর কোরিয়া এক যাচ্ছেতাই অসভ্য ভূমি বটে’ আউড়ে হাত ঝেড়ে উঠে গেলে হবে না, চোখ ফেড়ে বুঝতে হবে, প্রায় সমস্ত দেশই একই মতবাদে বিশ্বাসী। তাবৎ অনাচারের মতোই, ইদানীং এই রক্ষণশীলতা প্লাস বৈরিতার মনোবৃত্তি সক্কলেই স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়েছে। চিন গোটা পাশ্চাত্যকেই (এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সব ফসলকেই) চিন-বিরোধী চক্রান্তে অংশী মনে করে (তাই নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, ইউটিউব, টুইটার, ফেসবুক— সব্বাই ব্যান-যোগ্য), প্রায় যে-কোনও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রই এই সিদ্ধান্তে উপনীত যে ধনতান্ত্রিক দেশের সমুদয় সংস্কৃতি শুধু মানুষকে বখিয়ে দিতে ও প্রকৃত মনুষ্যত্ব থেকে (বিশেষত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে) চ্যুত করতে নির্মিত ও প্রচারিত, ইউক্রেনের ঘাড়ে রাশিয়া বোম ফেলতেই ইউক্রেন চটজলদি সমস্ত রুশ শিল্পীর নাম রাস্তা থেকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলছে, আর ইজরায়েলে নির্ঘাত প্যালেস্টাইনের কোনও শিল্পী আগামী পাঁচ বছরে গান গাইতে যেতে পারবেন না। ভারত এক মহান গণতন্ত্র, যেখানে আইপিএল অনুষ্ঠিত হয় ও একজনও পাকিস্তানি খেলোয়াড়কে সেখানে সুযোগ দেওয়া হয় না। সারা পৃথিবীর খেলোয়াড়কে এই টুর্নামেন্টে আহ্বান করা হয়, তাঁদের প্রতিভাকে উদযাপন করা হয়, কিন্তু আশ্চর্যভাবে বাবর আজম বা মহম্মদ রিজওয়ানের ব্যাটিং দেখতে বা শাহিন আফ্রিদির বোলিং দেখতে কেউ উৎসাহী হয় না। পাকিস্তানি গায়ক-গায়িকাদের ভারতে এসে কাজ করে রোজগার করা বচ্ছর-সাত একেবারে বন্ধ ছিল, আগের বছর আদালত সে নিষেধের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে বটে, কিন্তু জন-আদালত, মানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তার ভাই-ভাতিজার বিচারক্ষেত্র (ও সর্বোপরি উদ্যত হাতুড়ি) এখন এমন শক্তিশালী যে লোকে তার সামনে হাত কচলে হেঁ-হেঁ করতে পথ পাচ্ছে না। আমাদের কারও সাধ্য আছে, বা সাধ আছে, আইপিএল-কে সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক বলে বয়কটের ডাক দেব? বা বলব যে পাক গায়কদের অসামান্য স্বর থেকে নিজেদের সুরকে বঞ্চিত করে আমরা সংগীতকে দরিদ্র করছি? বরং মনে মনে আমরা খুশি যে ওই শয়তান শত্তুর-দেশটার অন্তত এই দেশে কোনও স্বীকৃতি নেই।
সাধারণত আড্ডায় এসব কথা ক্যাঁকক্যাঁক করে যে চেঁচিয়ে বলে, এবং কিছুতে থামতে চায় না, তার দিকে তাকিয়ে আমার একে-অপরকে চোখ টিপি ও কিছুক্ষণ পর বিরিয়ানি ও পানীয়-গ্লাস হাতে অন্যত্র উঠে যাই: শালাকে কে ডেকেছে বলতো, তত্ত্বকথা আউড়ে মুড নষ্ট করার মাস্টার? এমনকী আমরা যদি একথা ভাবিও: রাজনৈতিক শত্রুতাকে এতটা তোল্লাই দেওয়া উচিত নয় যে চূড়ান্তবাদীরা ম্যাচের আগের দিন পিচ খুঁড়ে রেখে দেবে, তবু আমাদের ধরনটা হল: আহা, যখন পাকিস্তানকে ডাকলে ঝঞ্ঝাট পাকছে তখন সেটা বাদ দিয়েই আসরটা জমিয়ে তোল না বাপু। যা আছে তা তো মন্দ নয়, তাহলে শুধু শুধু ‘সবটা কেন নেই’ চিল্লে বখেড়া রচবার দরকারটা কী? এ ছাড়া এমন তত্ত্বও আছে: যে-দেশ আমার লোককে মারছে তার সঙ্গে আমি খেলাধুলো গানবাজনার সম্পর্ক রাখছি কী করে? সংস্কৃতি বা ক্রীড়া কি জীবন-বহির্ভূত কুঠুরি? উত্তর হল, রাজনৈতিক সম্পর্কই গোটা আদানপ্রদানের পূর্ণ নির্ণায়ক নয়, এবং এক দেশের ব্যক্তি ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে একাত্ম ভাবা ঠিক নয়। আমরা রাশিয়াকে ঘৃণা করেও রাশিয়ান টেনিস খেলোয়াড়কে শ্রদ্ধা করতে পারি, চিনকে অপছন্দ করেও চিনা গদ্যকারের রচনায় আলোড়িত হতে পারি, কারণ ব্যক্তিপ্রতিভার সঙ্গে রাষ্ট্রসিদ্ধান্তকে গুলিয়ে ফেলা অনুচিত, এবং বিশ্বের বিচিত্র ব্যক্তির অসামান্যতার রসাস্বাদন না করলে নিজেই ঠকতে হয়। কিন্তু সে উত্তর খতিয়ে শোনার চেয়ে, ‘যে আমার বোনকে ধর্ষণ করেছে তার গান জলসায় বসে আমি শুনব, বাঃ বাঃ’ হিস্টিরিয়া আছড়াবার হাতে-গরম আবেদন বেশি। তাই উত্তর কোরিয়া যা করেছে, তার প্রতিধ্বনি যদি ইদানীং প্রায় সব দেশের মধ্যেই দেখা যায়, যদি কানা ক্রোধ এসে সবকিছুকেই অন্ধকারে ছুপিয়ে দেয়, যদি বাংলাদেশের কোনও সাধারণ মানুষ বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের হারের পর বলতে পারে, বাংলাদেশ জিতলেও এত আনন্দ পেতাম না, ভারত হারতে যতটা আনন্দ পেয়েছি— তাহলে নির্দিষ্ট একটা দেশকে গাল না পেড়ে, ফ্যাসিস্ট বা আলট্রা-অসহিষ্ণু থাবা-খাবলানোকে স্বাভাবিক কাণ্ড ভেবে পাশ ফিরে ঘুমোনোই ভাল। ঠিকই, ওই দুই উত্তর কোরীয় কিশোরের জীবন নষ্ট হল, কিন্তু এ তো বোঝাই যাচ্ছে আরও বহু মানুষের জীবন নষ্ট করবে দেশে দেশে সংকীর্ণতার চাষ, যতদিন যাবে আরও ছবি নিষিদ্ধ হবে (যেমন শিব সেনা ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের চাপে একদিনে নেটফ্লিক্স থেকে উড়ে গেল ‘অন্নপুরানি’, কারণ সেখানে বলা হয়েছে রাম মাংস খেতেন, এ ছাড়াও নাকি ‘লাভ জিহাদ’কে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, শেষে ওই তামিল ছবির নায়িকা নয়নতারা ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন যে ইনস্টাগ্রাম পোস্টে, তার প্রথম লাইনে আছে ‘জয় শ্রীরাম’, তার ওপরে গোল্লার মধ্যে বড় করে লেখা ‘ওঁ’), আরও গান বন্ধ হবে, আরও শিল্পী মার খাবেন, এবং এক দেশে থেকে যদি কেউ অন্য দেশের— মানে শত্রু-তকমা পাওয়া দেশের— শিল্পীকে বা শিল্পকে প্রশংসা করে, তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে তক্ষুনি দেগে দেওয়া হবে। এর ফল হবে— বা বলা যায় ইতিমধ্যেই হচ্ছে— চমৎকার। একটা গোষ্ঠী তো জন্মাবেই যারা শুধু রাম আর হনুমানকে নিয়ে ছবি করবে, কিংবা এমন অতিমানবিক সৈন্যকে নিয়ে যে একাই ১৪৪জন পাক সৈন্যকে পেঁদিয়ে বেন্দাবন দেখিয়ে দেবে, কিন্তু এই সরাসরি-চাটুকারদের বাইরে একটা বিরাট গোষ্ঠী গজাবে, যারা কোনওভাবেই চারপাশে যা দেখছে তা নিয়ে শিল্প করার সাহস দেখাবে না। রূপকথা বা ভূতের বাংলো বা নিরাপদ প্রেমের সংকটে গুঁজড়ে কেরিয়ারটা বইয়ে দেবে। দেখছে হয়তো গাদা গাদা জনজাতির লোককে জেলে ভরে রাখা হচ্ছে আর তাদের অধিকারের বনভূমি কেড়ে ব্যবসায়ীদের বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিংবা বুলডোজার দিয়ে এক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি ও দোকান গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিংবা একটা বড় আন্তর্জাতিক সমাবেশের আয়োজনের জন্য গরিবদের পিটিয়ে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটা বিস্তীর্ণ জায়গা থেকে, কিন্তু কবিতা বা গান বা সিরিয়ালে এসবের বদলে শিল্পী বয়ন করবে আকাশের নীলিমা বা টম্যাটোর লালিমা কিংবা এইদেশ-নিন্দুকদের কালিমা। আর কিচ্ছুটি নয়। এবং অচিরে ধরে নেওয়া হবে এটাই রীতি, প্রথা, আদর্শ, এবং অন্যদেশের মতো সংস্কৃতিচর্চা করলে, মানে বাকস্বাধীনতার অধিকার নিয়ে বৃহৎ ট্যান্ডাইম্যান্টাই করলে, তা বিদিশি মাদক খেয়ে ধ্রুপদী উঠোনে যজ্ঞ লন্ডভন্ড করার শামিল, তাকে সবার সামনে হাতির তলায় পিষে শিক্ষা দেওয়া দরকার, অ্যাম্পিথিয়েটারে বা সিনেমা থিয়েটারে। তাই উত্তর কোরিয়া কেমন করিয়া প্রবেশ করিল প্রত্যেকের মরমে, শীতে কিংবা গরমে— এই নিয়ে নতুন ভাবনা না ভেবে, মস্তিষ্ককে মাংকি-টুপি পরিয়ে যত্নআত্তি করাই ভাল।