ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • হিয়া টুপটাপ, জিয়া নস্টাল : পর্ব ৩২

    শ্রীজাত (January 20, 2024)
     

    প্রথম আলাপ

    ছোটবেলা থেকে যে খুব কবিতা পড়বার অভ্যেস ছিল, তা একেবারেই নয়। পড়বার অভ্যেস সাধারণত দু’ভাবে তৈরি হয়। এক, স্কুলের বই থেকে আর দুই, বাড়িতে জমা হয়ে থাকা বইপত্তর থেকে। স্কুলের সিলেবাসে গোড়া থেকেই কবিতা ছিল, বাংলা আর ইংরেজি, দুই-ই। বছর বছর সেসব কবিতা বদলেও যেত, আর সেইসঙ্গে আরও কঠিন হয়ে উঠত তাদের ব্যাখ্যা। ওই বয়সে আমার কেবলই মনে হত, কবে কোন দেশে একজন মানুষ মনের খেয়ালমতো কিছু লাইন লিখেছেন, আমরা খামোকা কেন এত কষ্ট করে এতদিন পর তার কাটাছেঁড়া করছি? কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই, এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর আমার কাছে ছিল না।

    বাড়িতে কিন্তু বই ছিল প্রচুর। তখন সেসব বই হাতের কাছে ছিল বলে তাদের প্রাচুর্য বিশেষ টের পাইনি, কিন্তু আজ বুঝি, তারা বেশ জাঁদরেল সমস্ত গ্রন্থ যাকে বলে। কিন্তু কবিতার বই তুলনায় ছিল কম। একেবারেই কি ছিল না? গড়পড়তা বাঙালি বাড়িতে যা যা থাকে, তা তো ছিলই, তার কিছু বেশিও ছিল। কিন্তু দিব্যি অনেকদিন ধরে উলটে-পালটে দেখা ও পড়া যাবে, এত সংখ্যক কবিতার বই বাড়িতে সে-সময়ে সত্যিই ছিল না। এবং সেটা দোষের কিছুও নয়। স্কুলের সিলেবাসে দু’ভাষাতেই যে-সমস্ত কবিতার সম্ভার রাখা ছিল আমাদের, তাদের ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা কেউ ফেলে দিতে পারবে না। তাই অভ্যেস তৈরি না হলেও, পাঠ্যবইয়ের মধ্যে কবিতার অংশ আমাকে টানত বই কী।

    সমস্যাটা তৈরি হল ক্লাস সেভেনে উঠে। কেন যে হল, সে-কথা বলতে পারব না, কিন্তু হল। সেটা হল এই যে, মোটের ওপর কবিতা নামক ব্যাপারটিকে বেশ ভাল লাগতে শুরু করল। প্রথমে অতটা গা করিনি। বুঝিওনি বিশেষ। কিন্তু ক্লাস সেভেনের মাস দুয়েক গড়াতে না গড়াতেই মনে হল, আরে! এ-ব্যাপারটায় তো এক রকমের ম্যাজিক আছে! এর আগে যা যা পড়েছি, ক্লাস সেভেনে উঠে কবিতা তার থেকে অনেকটাই বাঁক নিল যেন। বাংলা আর ইংরেজি, দুই ভাষাতেই। তারা যেন আর এতদিন ধরে পড়ে আসা শব্দগুচ্ছের মতো নয়। তারা যেন এবার হয়ে উঠতে চাইছে বহুস্তরীয়, বহুমাত্রিক। ক্লাসের পড়ানোর বাইরেও তাদের মধ্যে আলাদা করে হাঁটার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি যেন। আর ওই বয়সে ওরকমটা হলে নেশা আটকানোর কোনও উপায় নেই। আমারও হল, নেশা। কবিতার।

    বাড়ির বুক শেলফ-এ যা যা ছিল, পেড়ে-পেড়ে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু তখন এত বেশি আচ্ছন্ন যে, আরও পড়তে ইচ্ছে করছে প্রতি মুহূর্তে। কেননা, বুঝতে পারছি, আমার জানার বাইরে অনেকখানি বিস্তৃত হয়ে আছে কবিতার অঞ্চল, আর সেখানে গিয়ে না দাঁড়ালে আমার শান্তি নেই। কিন্তু উপায় কী? পকেটমানি নামক কোনও বস্তু তখন আমাদের ছিল না। তা ছাড়া পুজো আর জন্মদিন ছাড়া বাড়িতে কিছু চাইবার দস্তুর নেই। আর এ তো এমন চাওয়া নয় যে একবারেই ফুরিয়ে যাবে। বরং প্রতিদিন উত্তরোত্তর বাড়বে বৈ কমবে না। অত বইয়ের জোগান কে দেবে বাড়িতে? বাবা সাংবাদিক ছিলেন, বেশ কিছু বইপত্তর বাড়িতে নিয়ে আসতেন অফিস থেকে, তার মধ্যে কবিতার বই কম-ই। অতএব নিজেকেই খুঁজে বার করতে হবে কোনও উপায়।

    উপায় অবশ্য আশ্চর্য ভাবেই হল একখানা। আমি যে বেঞ্চে বসতাম, সেখানে আমার পাশেই বসত আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু সপ্তর্ষি। পড়াশোনায় দিব্যি ভাল ছেলে, কিন্তু আমার মতো ফাঁকিবাজের সঙ্গে তার দোস্তি বেশ জমে গেছিল তখনই। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়ার একটা নেশা তারও ছিল, এ আমি জানতাম। একদিন টিফিনের সময়ে হঠাৎ সে স্কুলব্যাগ হাতড়ে বার করল একখানা হলদেটে বই, মাঝারি মাপের। ‘এটা পড়েছিস?’ বলে আমার দিকে এগিয়ে দিল সপ্তর্ষি। পড়ার বইয়ের বাইরে আরও আরও কবিতা পড়বার ইচ্ছে যে হচ্ছে খুবই, সে-কথা ওকে বারকতক বলেছিলাম। তার জেরেই বোধহয় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসেছে আমার জন্য। দেখলাম বইয়ের মলাটে লেখা ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, নীচে কবির নাম, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। এ-কবির নাম ততদিনে শুনেছি বটে, কিন্তু একটি কবিতাও তাঁর পড়া হয়নি। কবিতাপ্রেমিক কিশোরের কাছে ঘটনাটা লজ্জার হলেও, বইটা প্রাপ্তি।  

    বইটা কয়েক দিনের জন্য ধার নিলাম। সপ্তর্ষি আমায় আশ্বস্ত করল এই বলে যে, ফেরত দেওয়ার বিশেষ তাড়া নেই, আমি ধীরেসুস্থে পড়ি যেন! সেই শুরু হল আমার বাংলা কবিতার সঙ্গে রাতজাগা। এ-ব্যাপারটা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। অনাস্বাদিতের আস্বাদ যে কী জিনিস, সে অলিখিত থাকাই ভাল!

    ‘কই দেখি!’ বলে একরকম ছিনিয়েই নিলাম বইটা ওর হাত থেকে। ওই দু’মলাটের মধ্যে বন্দি ছাপার অক্ষরেরা তখন আমার কাছে অজানা হিরের খনি। তাকে হাতের কাছে পেয়েও ছেড়ে দেওয়ার মতো বোকা আমি ছিলাম না। বইটা কয়েক দিনের জন্য ধার নিলাম। সপ্তর্ষি আমায় আশ্বস্ত করল এই বলে যে, ফেরত দেওয়ার বিশেষ তাড়া নেই, আমি ধীরেসুস্থে পড়ি যেন! সেই শুরু হল আমার বাংলা কবিতার সঙ্গে রাতজাগা। এ-ব্যাপারটা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। অনাস্বাদিতের আস্বাদ যে কী জিনিস, সে অলিখিত থাকাই ভাল! বুঝতে পারলাম, বাংলা কবিতার আরও নানা অলিগলি দিয়ে আমাকে হাঁটতে হবে, তৈরি করতে হবে পাঠকের পরিক্রমা। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী’র কবিতা কাজ করল স্ফুলিঙ্গের মতো। আর সেই এক ঝলকের ঝলসে ওঠায় আমি বুঝতে পারলাম, সামনে বিশাল অজানা এক অরণ্য, এক পর্বত, এক মালভূমি, এক সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। অশেষ, অতল। কিন্তু ডাকছে। কবিতার চেহারা নিয়ে ডাকছে। আমি বুঝতে পারলাম, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মশায় আমার বিপদটি ঘটালেন। এবং সে যে আজীবনের জন্য বিপদ, তাও বুঝলাম।

    এই মানুষটিকে দেখতে হবে তাহলে। চাক্ষুষ করতে হবে। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে একবার, নইলে আমার চলবে না। এমনটা অবশ্য পরে বহুবার করেছি আমি, প্রিয় লেখক বা কবিকে একবার দেখার বায়না। সাহিত্যের মহলে বাবা’র অবাধ যাতায়াত ছিল বলে এমন আবদার করতে পারতাম। আমার সেই আবদার শুরু হয়েছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে দিয়ে। বাবা বোঝালেন, অত বড় মাপের কবি, ব্যস্ত মানুষ, তাঁকে কি হুট করে ওভাবে বিরক্ত করা যায়? কিন্তু আমি নাছোড়। দেখা আমায় করাতেই হবে, নইলে মানব না। শেষমেশ বাবাও রাজি হলেন ঝুঁকি নিতে। একদিন ওঁর আপিসে গিয়ে দেখাই যাক, দেখা হয় কি না।

    যাওয়া হল ওঁর কাজের জায়গায়। সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, বাবা’র আলতো ডাকে যখন স্মিত মুখখানা তুলে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলেন আমাকে, বুকের মধ্যে কী যে হল, আজও লিখে বোঝাতে পারব না। প্রণাম করলাম, তিনি নাম জিগ্যেস করলেন, ব্যাগে করে নিয়ে যাওয়া সইয়ের খাতায় সইও করে দিলেন আমার নামসহ। কিন্তু এই সমস্ত কিছু ছাপিয়ে এক আশ্চর্য অনুভূতি, এক অবাক করা আলোড়ন আমার মধ্যে কাজ করছিল এই ভেবে যে, ইনিই তাহলে সেই কবি? যাঁর কবিতা আমার জন্য সহস্র দরজার প্রথমটি খুলে দিল!

    এরপর গড়িয়ে গেছে অনেকগুলো বছর, আমিও পেরিয়ে এসেছি অনেকখানি পথ। বাংলা কবিতার অলিগলি আমার রোজকার ঠিকানা হয়ে উঠেছে। ওই একটি মাঝারি চেহারার বই আমাকে অন্য এক পৃথিবীতে ভর্তি করে দিয়েছিল সেই যে, সেখান থেকে আর বেরোতে পারিনি। চাইওনি বেরোতে। ২০০৪ সাল, বাড়িতে তখন ভারী রিসিভারওয়ালা ফোন, সে বেজে উঠল একদিন ঝমঝমিয়ে। ফোন ধরবার ভারী শখ ছিল তখনও, এই আজকের মতো মুখচোরা হয়ে যাইনি। ধরলাম। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল, ‘শ্রীজাত’র সঙ্গে কথা বলা যাবে? আমি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলছি’। এই অনুভূতিও, ওই প্রথমবার দেখা হবার মতোই, লিখে বোঝানো সম্ভব না। যা বললেন, তা হল এই যে, ‘উড়ন্ত সব জোকার’ নামক কবিতার বইটির জন্য আমাকে আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হবে এবং সেই মানপত্র লেখার দায়ভার পড়েছে ওঁরই উপর। তাই লেখা শুরু করবার আগে উনি আমার সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে চাইছেন। জানালাম, ওঁর যা যা খোঁজ ছিল। সাহস করে সেই ক্লাস সেভেনে দেখা করতে যাবার কথাও বললাম একবার, হো হো করে হেসে উঠলেন দীর্ঘদেহী মানুষটি। বললেন, ‘আবার দেখা হবে’।   

    ফোনটা ছেড়ে দেওয়ার পর আমি ভাবলাম, জীবন কখনও কখনও কী নিপুণ সুতোয় একটা বৃত্ত বুনে দেয় আমাদের অজান্তেই। যে-কবির লেখা পড়ে আমার এই লেখালিখির জগতের দিকে আরও বেশি করে ছুটে আসা, আজ নিজেরই লেখার স্বীকৃতি পাচ্ছি খোদ তাঁর কলমের ভাষায়। এ-পুরস্কার যেমন প্রতিষ্ঠানের, তেমনই জীবনেরও বটে। সময়-এর মিঠে ষড়যন্ত্র ছাড়া এ-জিনিস সম্ভব নয়। সেই মানপত্র আজও ভারী যত্নে আগলে রেখেছি— আমার কথা ভেবে, আমার জন্য, আমাকে নিয়ে লেখা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর শব্দমালা। দেখতে দেখতে একশো বছরে পা রাখল তাঁর দীর্ঘ ছায়া। স্মৃতি ছাড়া তাঁকে প্রণাম জানানোর মতো আমার হাতে আর কিছুই নেই…

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook