ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অনর্থশাস্ত্র: পর্ব ২


    প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (January 6, 2024)
     

    যুক্তি, কুযুক্তি ও এক বিশ্বাসহন্তা

    Thou shalt not suffer a witch to live. (Exodus 22:18 KJV, The Bible)

    অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’— সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে খুব কম মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যাবে যিনি ১৯৫৪ সালে তৈরি চলচ্চিত্রটি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন। ‘আ স্ট্রিটকার নেমড্‌ ডিজায়ার’ (১৯৫১) সিনেমায় অভিনয় করে মার্লন ব্র্যান্ডো আমেরিকার দর্শককুলের মন জয় করে নিয়েছিলেন, ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’-এ মার্লনের অভিনয় তাঁকে সারা পৃথিবীর দর্শকের কাছে পরিচিতি দিয়েছিল। মার্লনের চরিত্রটির নাম টেরি ম্যালয়, এক স্বল্পশিক্ষিত বক্সার, যার কেরিয়ার শেষ হয়ে যায় এক ম্যাচফিক্সিং-এর দৌলতে। নিউ জার্সির বন্দর এলাকায় ছুটকোছাটকা কাজ করে টেরি দিন গুজরান করে, যে বন্দর এলাকায় ট্রেড ইউনিয়ন এবং মাফিয়া বসদের আঁতাতে ঘটে চলে একের পর এক অপরাধ। টেরির সহকর্মী জোয়ি তিতিবিরক্ত হয়ে ঠিক করে এই আঁতাত এবং দুষ্কর্মের ব্যাপারে সরকারি কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দেবে। স্বাভাবিকভাবেই জোয়ির কাছে আসতে থাকে একের পর এক হুমকি; প্রাণভয়ে জোয়ি নিজের অ্যাপার্টমেন্টেই দিনের অধিকাংশ সময়টা কাটাতে থাকে। এমত অবস্থায় ইউনিয়নের লোকেরা যোগাযোগ করে টেরির সঙ্গে, তাকে বোঝানো হয় জোয়ির সঙ্গে আলোচনার একটা সুযোগ ঘটিয়ে দিলে উভয়পক্ষেরই মঙ্গল। জোয়ির হারিয়ে যাওয়া পায়রাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অছিলায় টেরি জোয়িকে পাঠায় ছাদে। ইউনিয়নের লোকেদের সঙ্গে টেরি অপেক্ষা করতে থাকে, পর্দায় দেখা যায় বাড়ির ছাদ থেকে জোয়ির শরীরটি পড়ছে।

    সিনেমাটি না দেখলেও বুঝে নিতে অসুবিধা নেই জোয়ির মৃত্যুই টেরির জীবনকে বদলে দেবে। যাঁরা বলিউড চলচ্চিত্রের অনুগ্রাহী, তাঁরাও যদি আমির খানের ‘গুলাম’ (১৯৯৮) দেখে থাকেন তাহলে গল্পের ঘাতপ্রতিঘাত নিয়ে একটা সম্যক ধারণা পেয়েই যাবেন।    

    কিন্তু চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে হলিউডের বাস্তবিক ঘাত-প্রতিঘাতের ইতিহাস জানা না থাকলে বোঝা যাবে না ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’-এর এই আপাতসরল প্লটলাইনের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের এক অতীব কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনি।  

    সে ইতিহাসের পর্দা উন্মোচনের আগে আপনাদের শোনাই আরেক বিশ্ববিখ্যাত চিত্রনাট্যর এক সংলাপ। এ সংলাপ অবশ্য রুপোলি পর্দায় আসার বহু আগেই শোনা গেছে ব্রডওয়ের নাট্যমঞ্চে। ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের সালেম শহরে ১৬৯২ এবং ১৬৯৩— এই দু’বছর ধরে হওয়া ‘Witch trials’-এর ওপর ভিত্তি করে লেখা এই নাটকের নাম ‘দ্য ক্রুসিবল’। মেরি ওয়ারেন নামক এক গৃহকর্মীকে আদালতে তোলা হয়েছে; অভিযোগ সে ডাইনি, অপদেবতাদের সঙ্গে তার কাজকারবার। মেরি জানায় সে কোনও দিন প্রেতাত্মা দেখেনি, প্রেতাত্মা নিয়ে সে অতীতে যা বলেছে তা নেহাতই রং-চড়ানো কথা। বিচারক ড্যানফোর্থ মেরির কথা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেন, অস্বীকার করেন মেরির দেওয়া লিখিত বয়ান গ্রহণ করতে। এবং মেরির মনিবের উদ্দেশে বলে ওঠেন,    

    ‘I judge nothing. I tell you straight, Mister – I have seen marvels in this court. I have seen people choked before my eyes by spirits, I have seen them stuck by pins and slashed by daggers. I have until this moment not the slightest reason to suspect that the children may be deceiving me. Do you understand my meaning?’

    গভীর অর্থবাহী এই সংলাপ এবং ‘দ্য ক্রুসিবল’ নাটকের রচয়িতা আর্থার মিলার তাঁর নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলেন ১৯৫৩ সালে, ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ মুক্তি পাওয়ার এক বছর আগে। এলিয়া কাজান ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ পরিচালনার জন্য অস্কার পেয়েছিলেন, আর আর্থার মিলারের নাটকটি পেয়েছিল ব্রডওয়ের শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘টোনি অ্যাওয়ার্ড’। কিন্তু সেরা সম্মানের হিসাবনিকাশের বাইরে গিয়ে ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ এবং ‘দ্য ক্রুসিবল’ বহু দশক ধরে হয়ে থাকবে দুই বিরোধী মতাদর্শের যুযুধান প্রতিভূ।  

    ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ ছবিতে মার্লন ব্র্যান্ডো

    এই ঘাতপ্রতিঘাতের ইতিহাসের শুরু গত শতকের বিশের দশকের শেষের দিকে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধসে পড়ার মুখে। সারা দেশ জুড়ে দেখা দিয়েছে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’— চাকরি নেই, ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায় লগ্নিকারীরা সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে; এমনকী বৃহত্তম কর্পোরেট হাউসগুলিরও এমন দুর্দশা যে, স্টক-মার্কেটের গ্রাফ গোঁত্তা খেয়ে সেই যে পড়তে শুরু করেছে, তার আর বিরাম নেই। এই সময়ে আমেরিকার দু’প্রান্তের দুটি মানুষ তাদের সর্বস্ব খুইয়ে বসলেন। পশ্চিমপ্রান্তে লস অ্যাঞ্জেলস-এ জর্জ কাযান্তজোলুর কার্পেটের ব্যবসা উঠে গেল, আর পূর্বে নিউ ইয়র্ক শহরে ইসিডোর মিলার-এর সমস্ত সঞ্চয় চলে গেলে স্টক-মার্কেটে। বলা বাহুল্য যে জর্জ আর ইসিডোরের পুত্রদের নিয়েই আজকের আলোচনা।

    গ্রেট ডিপ্রেশনের অভিজ্ঞতার দরুণ এলিয়া আর আর্থার দুজনেই বামপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এলিয়া ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৬ আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। আর্থারের অধ্যায়টি আরেকটু জটিল— তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হয়েও বামপন্থী রাজনীতির অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন। চল্লিশের দশকে মার্ক্সিস্ট ম্যাগাজিন ‘New masses’-এর পাতায় তিনি বহু কমিউনিস্ট নাটকের সমালোচনা লিখেছেন। শুধু কী তাই! আর্থার প্রাগে বিশ্ব যুব উৎসব আয়োজনে টাকা দিয়েছেন, আমেরিকা ছেড়ে পূর্ব জার্মানিতে আশ্রয় নেওয়া বামপন্থী নেতার সমর্থনে কলম ধরেছেন, এমনকী আমেরিকায় কমিউনিস্ট পার্টি ব্যান হওয়ার বিরুদ্ধে যে প্রচার চালানো হয় সেখানেও স্বেচ্ছায় শামিল হয়েছেন।    

    এলিয়া কাজান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও কিন্তু এত কাজ করে ওঠার সুযোগ নিজেকে দেননি। এক বছরের সামান্য বেশি সময়েই তিনি হাঁফিয়ে উঠেছিলেন পার্টির কড়া নিয়মকানুন নিয়ে। মার্কিন গণতন্ত্রের যে আপাতউদার জীবনদর্শন, তার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির গোঁড়া নিয়মানুবর্তিতাকে কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকেও দমিয়ে রাখতে হচ্ছিল। তিরিশ বা চল্লিশের দশকেও হলিউডে সিনেমা বানাতে যে পরিমাণ পুঁজির দরকার ছিল, তা সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতি করে পাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে বিশ্ব-রাজনীতিতে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব দেখে আমেরিকান নেতারা প্রমাদ গুনছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল দেশজুড়ে ‘লাল আতঙ্ক’ তৈরি করতে। ছাড় পেল না হলিউড-ও; বৃহৎ পুঁজির একটি বড় আখড়া সেখানে, অতএব আমেরিকান নীতিনির্ধারকরা চাইলেন হলিউডের সঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির সামান্যতম সংস্পর্শও যেন না থাকে। স্টুডিয়োগুলিকে সামিল করা হল রুপোলি পর্দায় কমিউনিজমের বিরুদ্ধে জেহাদে। গসিপ ম্যাগাজিনগুলিতে আলোচনা শুরু হল, ইতিউতি এর-তার নাম হাওয়ায় ভাসতে শুরু করল, দক্ষিণের রাজ্যগুলির একাধিক বর্ণবিদ্বেষী নেতা আবার হলিউডকে ইহুদি এবং বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি বলে অভিহিত করতে লাগলেন।         

    ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ‘The House Un-American Activities Committee’ ডেকে পাঠাল একচল্লিশজন নির্দেশক, প্রযোজক এবং চিত্রনাট্যকারকে। মূল প্রশ্নটি খুবই সহজ— আপনারা কি অতীতে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন বা বর্তমানে আছেন? কিন্তু মানসিক নির্যাতনের এটি শুরুর ধাপ মাত্র। এঁদের অতীত ইতিহাস জেনেই ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সরকার যে সব জেনেশুনেই ডেকে পাঠিয়েছেন সে কথা জানতেন যাঁরা তলব পেলেন তাঁরাও। কিন্তু যে মুহূর্তে স্বীকারোক্তি দেওয়া হল, তখনই বলা হল কমিউনিস্ট পার্টির অন্যান্য সদস্য বা পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল শিল্পীদের নাম দিতে হবে। কিছু মানুষ নাম বললেন, আরও কিছু হয়তো বলতেন; কিন্তু এই সময় ‘হলিউড টেন’ প্রকাশ্যেই বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। দশজন শিল্পীর একটি দল, জেরার নামে এই প্রহসনকে অনৈতিক তো বটেই, সংবিধানবিরোধী বলেও আখ্যা দিলেন। এঁদের প্রত্যেকেই সে সময় প্রতিষ্ঠিত এবং ওয়ার্নার ব্রাদার্স, কলম্বিয়া পিকচার্স বা ইউনিভার্সাল-এর মতন বড় স্টুডিয়োগুলির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। নাম বলা তো দূরের কথা, ‘হলিউড টেন’ সরকারের সঙ্গে কোনও রকম সহযোগিতা করতেই রাজি হলেন না।

    ‘হাউস কমিটির’ সুপারিশে এঁদের প্রত্যেকের এক হাজার ডলার জরিমানা এবং এক বছরের কারাদণ্ড হল। কিন্তু সবথেকে কঠিন শাস্তিটি এল অন্যদিক থেকে, প্রত্যেকটি স্টুডিয়ো এই শিল্পীদের বয়কট করল। সারা জীবনের মতন তাঁরা কাজের সুবিধা হারালেন। এঁদের সবাইকেই এলিয়া কাজান এবং আর্থার মিলার চিনতেন। কয়েকজন ছিলেন তাঁদের সহকর্মীও। যেমন লেস্টার কোল। মেক্সিকান বিপ্লবী এমিলিয়ানো জাপাটা-র জীবন নিয়ে কোল লিখছিলেন ‘ভিভা জাপাটা’ নামক একটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য। এ সিনেমার নির্দেশক ছিলেন এলিয়া কাজান এবং নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মার্লন ব্র্যান্ডো। কিন্তু হাজতবাস ইত্যাদির পর কোল-এর কাছ থেকে সে চিত্রনাট্য নিয়ে নেওয়া হয়। চিত্রনাট্যকার হিসাবে কোলের ভবিষ্যৎ হাউস কমিটির কাছে তলব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছিল বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। শাস্তিপ্রাপ্ত অন্যান্য শিল্পীদের অনেকেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মেক্সিকোয় চলে যান।   

    ‘হলিউড টেন’ সাংঘাতিক শাস্তি পেলেও এঁদের বিদ্রোহের দরুণ কমিউনিস্ট পার্টির বহু সদস্যদের নাম অনুচ্চারিত রইল। তলায় তলায় ‘হলিউড টেন’-এর প্রতি সমর্থনও তৈরি হচ্ছিল, তার একটি বড় কারণ হল এঁদের অধিকাংশের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। এতজন দক্ষ শিল্পীকে বিনা বিচারে এভাবে হলিউড থেকে নির্বাসনে পাঠানোয় তাঁদের পরিচিতরাও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ফলে যারা কমিউনিজমের বিরোধী ছিলেন তাঁরাও চুপ করে রইলেন; হাউস কমিটির প্রথম জেরা-তল্লাশির পরেই কমিউনিস্টদের খুঁজে বার করার প্রচেষ্টায় খানিক ভাঁটা পড়ল। হাউস কমিটি আরও শিল্পীদের তলব পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। কিন্তু এবারে তাঁরা চান কোনও রাঘববোয়ালকে, যাঁর সাক্ষ্য ‘হলিউড টেন’-এর প্রতি সহানুভূতির ঝড়কে স্তিমিত করতে পারে।         

    মার্কিন গণতন্ত্র আমাকে শেখায় ব্যক্তি হোক বা রাষ্ট্র, কেউ-ই আমার বাক্‌স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে না— এলিয়া যদি হাউস কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা করতে চান, তার জন্য কোনও নীতিগত আদর্শ নিয়ে ভাবার দরকার নেই, গণতন্ত্র তাঁকে সে স্বাধীনতা দিয়েই রেখেছে।

    এদিকে এলিয়া এবং আর্থার একে অপরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছেন। আর্থারের লেখা অসামান্য নাটক ‘ডেথ অফ আ সেলস্‌ম্যান’ ব্রডওয়েতে মঞ্চস্থ হয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে, এবং সে নাটকে নির্দেশনা দিয়েছেন এলিয়া কাজান। পঞ্চাশের শুরুতে এলিয়া আর্থারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন তাঁর তৎকালীন বান্ধবীর, যাঁর নাম মেরিলিন মনরো! মেরিলিন এবং এলিয়ার সম্পর্ক ছিল স্বল্পস্থায়ী এবং সে সম্পর্ক বিবাহ অবধি গড়ায়নি। কিন্তু ১৯৫৬ সালে মেরিলিন তৃতীয়বারের জন্য বিয়ে করবেন, এবং যাকে বিয়ে করবেন তাঁর নাম আর্থার মিলার। যাই হোক, এলিয়া এবং আর্থারের আড্ডাগুলি পুরোপুরিভাবেই আবর্তিত হত তাঁদের কাজ, শিল্প ও চলচ্চিত্র নিয়ে। ১৯৫২ সালের এপ্রিলের এক বৃষ্টিভেজা সকালবেলা আর্থারকে এলিয়া ডেকে পাঠালেন তাঁর বাড়িতে। তাঁদের শেষ কয়েকটি সাক্ষাতে এলিয়া আর্থারকে জানিয়েছিলেন তাঁদের দুজনকেই হাউস কমিটি ডেকে পাঠাতে পারে। এরকম একটা দিন যে আসতে চলেছে, সে কথা দুজনেই বিলক্ষণ জানতেন। কিন্তু এবার এলিয়া যে কথা বললেন তার জন্য আর্থার একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না।

    আর্থার মিলার আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন এলিয়া আর্থারকে জানান তাঁকে এর আগেও হাউস কমিটি ডেকে পাঠিয়েছিল, একাধিকবার, এবং প্রত্যেকবারই এলিয়া তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন। কিন্তু এবারে এলিয়া মত বদলেছেন এবং তিনি ডজন খানেক নাম বলবেন। যাঁদের নাম জানানো হবে তাঁরা প্রত্যেকেই এলিয়ার মতনই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন তিরিশের দশকে। এলিয়াকে টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স স্টুডিয়োর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তিনি হাউস কমিটিকে সন্তুষ্ট না করলে এলিয়াকে আর কোনও কাজই দেওয়া হবে না। আর্থারকে হতবাক করে দিয়ে এলিয়া আরও জানান আর্থার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হলে আর্থারের নামও এলিয়াকে হাউস কমিটিকে জানানো হত।  

    আর্থারের সঙ্গে সাক্ষাতের কিছুদিন পরেই এলিয়া হাউস কমিটির কাছে বারোজন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যের নাম দেন, যাঁদের মধ্যে আটজন গ্রুপ-থিয়েটারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ এলিয়া কাজান যাঁদের নাম দিলেন তাঁরা শুধু রাজনৈতিক কর্মী-ই নন, এলিয়ার সহকর্মীও ছিলেন। যে আটজনের নাম এলিয়া নিয়েছিলেন তাঁদের নাম হাউস কমিটির কাছে আগেই পৌঁছেছিল। কিন্তু এলিয়ার সাক্ষ্যের বিস্তর ভার ছিল। যে কারণে এই আটজনের অনেকেই স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকারে বাধ্য হন। এবং ‘হলিউড টেন’-এর মতন এঁরাও হলিউড থেকে প্রায় ব্রাত্য হয়ে পড়েন। এলিয়া নিজের আত্মজীবনীতে জানিয়েছিলেন এঁদের অনেককেই জনসমক্ষেও প্রচুর হেনস্থার শিকার হতে হয়।      

    শেষ লাইনটি পড়ে অনেকেই বিস্মিত হবেন। যাঁর কারণে এই নাট্যকর্মীদের এহেন দুর্দশা, তিনিই অনায়াসে তাঁর আত্মজীবনীতে সে দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে চলেছেন! কিন্তু বিস্ময়ের তো এখানেই শেষ নয়। এলিয়া অবলীলাক্রমে আর্থারকে তাঁর পরিকল্পনা যেভাবে জানিয়েছিলেন তাও যথেষ্ট বিস্ময় উদ্রেককর। এও শোনা যায় আর্থারের মতন ঘনিষ্ঠ আরও কয়েক বন্ধুকে এলিয়া আগেভাগেই জানিয়ে রেখেছিলেন যে তিনি তাঁর প্রাক্তন সহকর্মীদের নাম হাউস কমিটিকে দিতে চলেছেন। যে কারণে ১৯৫২-র বসন্তে এলিয়ার আগাম বিশ্বাসঘাতকতার খবরে হলিউড ছিল সরগরম।  

    এলিয়া নিজের আত্মজীবনীতে জানিয়েছিলেন যে হলিউডের স্টুডিয়োগুলি থেকে তাঁর ওপরে প্রচণ্ড চাপ ছিল। যে মানুষগুলির নাম অন্যরা আগেই নিয়েছেন তাঁদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে গিয়ে কেন এলিয়া নিজের ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দেবেন? আর কমিউনিস্ট পার্টির অভিজ্ঞতার জন্যই তিনি বাকি জীবনটা কমিউনিস্টদের ঘৃণা করেছেন, মতাদর্শগতভাবেও তাঁর তো কোনও দায় ছিল না।    

    কিন্তু ’৫২ সালের পর থেকে এলিয়া কমিউনিস্টদের প্রতি ঘৃণার লাইন থেকে সরে এসে বাক্‌স্বাধীনতাকে করে তোলেন আত্মসমর্থনের মূলমন্ত্র। মার্কিন গণতন্ত্র আমাকে শেখায় ব্যক্তি হোক বা রাষ্ট্র, কেউ-ই আমার বাক্‌স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পারে না— এলিয়া যদি হাউস কমিটির সঙ্গে সহযোগিতা করতে চান, তার জন্য কোনও নীতিগত আদর্শ নিয়ে ভাবার দরকার নেই, গণতন্ত্র তাঁকে সে স্বাধীনতা দিয়েই রেখেছে। চিন্তার এই পরিসর থেকেই তৈরি হল ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ (১৯৫৪)। ট্রেড ইউনিয়ন দেখা দিল আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টির জায়গায়। এলিয়া কাজানের বদলে গল্পে থাকলেন টেরি ম্যালয়। টেরি ম্যালয় ট্রেড ইউনিয়নকে ঘৃণা করে তারা ইউনিয়নবাজি করে বলে নয়, বরং তারা কথা বলতে দেয় না বলে। যে কারণে জোয়ি সামান্য আলাপ-আলোচনার সুযোগটুকুও পায় না ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’-এ— নেতৃত্বের কথার প্রতিবাদ মানেই মৃত্যু। টেরি নিজেও এ বিপদের সম্মুখীন হবে পরে। জোয়িকে মারা যেতে দেখে টেরি ঠিক করে ক্রাইম কমিশনে সাক্ষী হবে। সাক্ষ্য দিয়ে বেরিয়ে আসছে টেরি, ডকের সহকর্মীরা তাকে দেখে চেঁচাচ্ছে ‘You ratted on us, Terry’।
    টেরি তাদের দিকে তাকিয়ে গলার শির ফুলিয়ে পালটা চেঁচায়, ‘You think you are god almighty, but you know what you are? You’re a cheap, lousy, stinking mug… and I’m glad what I done to you!’  
    যে কথা এলিয়া কাজান নিজে চেঁচিয়ে বলতে পারেননি, টেরি ম্যালয় সে কাজটাই করে দেখায়।   

    নাট্যকার আর্থার মিলার (বাঁ দিকে) ও নির্দেশক এলিয়া কাজান (ডান দিকে), সঙ্গে অভিনেত্রী বারবারা লোডেন ও জেসন রবার্ডস

    কিন্তু এলিয়ার আত্মজীবনী, ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’, এমনকী নিউ ইয়র্ক টাইমসে এলিয়ার দেওয়া পাতাজোড়া আত্মসমর্থনের বয়ান, কোনও কিছুই এলিয়া কাজানকে বিশ্বাসঘাতকতার কলঙ্ক থেকে মুক্তি দেয়নি। সারা জীবন ধরে হলিউডে, নিজের সহকর্মীদের মাঝে ব্রাত্য হয়ে থেকেছেন এলিয়া। ১৯৯৯ সালে যখন তাঁকে সাম্মানিক অস্কার দেওয়া হয় তাঁর সারাজীবনের কাজের প্রতি সম্মান জানিয়ে, লস অ্যাঞ্জেলসের প্রেক্ষাগৃহে বহু শিল্পী উঠে দাঁড়াতে অস্বীকার করেন। কিন্তু এলিয়ার মতন বুদ্ধিমান মানুষ তাঁর এই ভবিতব্য কি দেখতে পাননি? তাঁর বন্ধু আর্থার মিলার থেকে শুরু করে অনেকেই তাঁকে বুঝিয়েছিলেন এলিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য কতটা কঠিন হতে পারে। রিল এবং রিয়ালের তফাৎ থাকবেই, ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’-এর টেরি ম্যালয় ‘Noble rat’ হতে পারে কিন্তু বাস্তবে এলিয়ার ভাগ্যে জুটেছে অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ। অথচ এর মধ্যেই এলিয়া কাজ করে গেছেন, এবং করেছেন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সব কাজ। সিনেফিলদের বিভিন্ন লিস্টে গিয়ে যদি এলিয়ার সর্বোত্তম পাঁচটি সিনেমার নাম আমরা দেখি, প্রায় আশি শতাংশ সিনেমাই দেখা যাবে হাউস কমিটিতে এলিয়ার সাক্ষ্যদানের পর তৈরি হয়েছে। সেই কারণেই, এবং এলিয়া কাজানের আবেগবাহুল্য জীবনদর্শনের প্রেক্ষিতে একাধিক চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও গবেষক বিশ্বাস করেন এলিয়া কাজান চেয়েইছিলেন এরকম এক বিপ্রতীপ পরিস্থিতি তৈরি হোক। পরিস্থিতি যত প্রতিকূল হবে, এলিয়া বাকিদের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারবেন, পারবেন নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়তে, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটা দাগ রেখে যেতে পারবেন।

    ‘হলিউড টেন’ এর অন্যতম সদস্য ডালটন ট্রাম্বো (যিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যর জন্য পরে দু’বার অস্কার জিতবেন, একবার বেনামে এবং একবার স্বনামে) । ১৯৪২ সালের চলচ্চিত্র ‘দ্য রিমার্কেবল অ্যান্ড্রু’-র জন্য একটি সংলাপে লিখেছিলেন ‘Democracy isn’t like Sunday suit to be brought out and worn only for parades. It’s the kind of a life a decent man leads, it’s something to live for and to die for’। এলিয়া নিজের স্বার্থের জন্য যতই আবেগবিহীন সিদ্ধান্ত নিন, ট্রাম্বো যে শালীনতার কথা বলেছেন সেই শালীনতা সামাজিক জীবদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। আর এখানেই এলিয়া ডাহা ফেল, হয়তো সে কারণেই তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার সত্তর বছর পরেও মার্কিন শিল্পীদের অধিকাংশই এলিয়াকে ক্ষমা করতে নারাজ।    

    আর্থার মিলার অবশ্য আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন— এ শুধু শালীনতার প্রশ্ন নয়, হাউস কমিটি যা করেছে তা একটি আমেরিকান ট্রাজেডি। সালেমের ডাইনি-নিধন ইতিহাসে সে ট্রাজেডির রূপক খুঁজে পেয়েছিলেন আর্থার। তাঁর ‘দ্য ক্রুসিবল’ নাটকের বিচারক যখন অতীব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘোষণা করেন তিনি আদালত চত্বরেই ডাইনিদের ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ প্রত্যক্ষ করেছেন, তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না বিচারক ড্যানফোর্থ আসলে হাউস কমিটির অংশ। আর্থার মিলারের বামপন্থী অতীতকে মুছে ফেলার জন্য তাঁর বহু শুভানুধ্যায়ীও প্রচার চালিয়েছিলেন এই বলে যে ‘দ্য ক্রুসিবল’ আসলে একটি ঐতিহাসিক নাটক, তার সঙ্গে হলিউড ব্ল্যাকলিস্টিংকে মিলিয়ে দেওয়াটা নেহাতই এক বিদ্বান ষড়যন্ত্র। জীবনের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে, হাউস কমিটিতে সাক্ষ্যদানের প্রায় চল্লিশ বছর পর, ১৯৯৬ সালে মার্কিন ম্যাগাজিন ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’-এর পাতায় আর্থার মিলার সে ষড়যন্ত্রও ভেস্তে দেন। জানান এ নাটক তাঁকে লিখতে হতই, যে ভাবে সারা দেশ ‘লাল আতঙ্ক’-এর ধারণাটিকে মুখ বুজে মেনে নিয়েছিল তাঁর পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব ছিল না। যদিও এ লেখায় আর্থার একই সঙ্গে সমালোচনা করেছিলেন সেই সব বামপন্থীদের যারা চুপ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনকে মেনে নিয়েছিলেন।

    সাচ্চা বামপন্থীদের চোখে এ হয়তো নেহাতই এক প্রতিক্রিয়াশীল লেখা, কিন্তু ট্রাম্বোর শালীনতার মাপকাঠিতে আর্থার মিলার গণতন্ত্রের এক প্রধান মুখ হয়ে রইলেন। প্রত্যাশা মতোই আর্থার মিলারকেও হাউস কমিটি ডেকে পাঠিয়েছিল, এবং আর্থার মিলার একটি নামও নেননি। তাঁর বিরুদ্ধেও হাউস কমিটি খাপ পঞ্চায়েত বসায়। কিন্তু সে খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আর্থারের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন মেরিলিন মনরো। আর্থারের স্ত্রী হিসাবে তো বটেই; তবে যে মেরিলিনের কথা শুনেছিল গোটা আমেরিকা তিনি আদতে ছিলেন রুপোলি পর্দার চিরন্তন হার্টথ্রব। এবং মেরিলিনের কথা রাখতেই, মেরিলিনের মৃত্যুর পর আর্থার শেষ একবার এলিয়া কাজানের সঙ্গে কাজ করেন। সেই ‘ডেথ অফ আ সেলসম্যান’-এর মতনই আর্থারের নাটক, আর এলিয়ার নির্দেশনা। আর সে নাটকের বিষয়? হাউস কমিটি তাড়া করে বেড়াচ্ছে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে, কারণ সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ‘আফটার দ্য ফল’ নামক এই নাটকে নির্দেশকের নাম দেখে চমকে গেছিল গোটা দেশ, কিন্তু এর থেকে শালীন প্রতিশোধ আর কী-ই বা হতে পারত!

    ছবি সংগৃহীত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook