কোত্থেকে শুরু করি?
‘আমিও একাকী, তুমিও একাকী।’ এরকম একটা অতুলপ্রসাদী ছিল না? ছিল।
দুলালের বাপের শাশুড়ি, ‘এখনো ছ্যাঁচা পান আলাপাতায় চিরে যাওয়া গলায় বুড়ি ঠিক গায় বলা যায় না। কাঁদে। খুব সুরে, খুব খাদে গিয়ে কাঁদে।’ তারপর কী হয়? তারপর ‘আমারও যে সাধ, বরষার রাত–এ এসে বরাবর গলা ভেঙে যেত… ফ্যালফ্যাল করে পড়ে থাকা স্বাভাবিক কিছু জল পথ খুঁজে নিত। জলের সে পায়চারি – শোক, না স্মৃতি, না শুধু গড়ানোর ধাত তা বোঝা খুব শক্ত এমন সব পথে।’ দেবার্ঘ্য গোস্বামীর ‘ঊনচারণ’ উপন্যাসে স্মৃতি-শোক–স্বপ্ন–ইতিহাস আর বোরোধানের বর্তমান থেকে এক থাল গরম ভাত হয়ে ওঠার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এমন সহজেই গড়িয়ে যায়। যে দেশে তিস্তা, বালাসন, রঙ্গিত কিংবা সিপাইখোলারা অবিরাম বয়ে চলেছে, সেই ভূগোলের ইতিহাস এ ভাবেই বহমান হবে। ‘সন্ধ্যা গড়ালে এখানে পাইনের পাতায় হিসহিস আড্ডা টের পাওয়া যায়। ভিক্টোরিয়ান ইংরেজি, খাস কুরা, ভোজপুরি, বাংলা, টিবেটান ইত্যাদি শ’-দেড়শো বছর পাতার তলে মজে মজে যে আঠালো হিসহিসানি তরল তৈরি হয়, সন্ধ্যা হলে তা এখানে পাইন আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে বৈঠকি আয়েশে ল্যাদ খায়।’ আর বেদম আড্ডা চলে… আড্ডায় উঠে আসে ‘দুই হাতের সবকটা আঙুলের কর উপচানো হিসাবেরও বাইরের’ সব গল্প… কলকেতার আবগারি তর্ক বা চুলোয়-যাক-মার্কা যুক্তি নয়। মায়া আর স্নেহ দিয়ে মোড়া গল্প। কোচবিহারের দিনহাটার আলুর খেত, দার্জিলিং-এর নেপালিদের বস্তি, ঢিমে আঁচে জাল দেওয়া রাজবংশী অস্তিত্ব আর গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনে পুড়ে যাওয়া ল্যান্ডরোভারে চড়ে বসা দুই ভূত। ভূত? হ্যাঁ ভূত, নিশ্চয়ই ভূত। মানুষের ইতিহাস ভূত ছাড়া আর কে-ই বা বলবে? তেমন করে খুঁজলে নাকি ভগবান পাওয়া যায়, তবে আমার ধারণা ভূত পাওয়া আরও কঠিন।
দেবার্ঘ্য পেয়েছে।
দার্জিলিং-এর যা ওয়েদার তাতে টিকে থাকতে গেলে হয় প্রেম করে যেতে হবে, নয়তো ভূতের ভয় পেতে হবে! মানে আর কিছু তাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে না জীবনের দিকে। তা ছাড়া যে জনজাতির ইতিহাসে দীর্ঘ ট্রমা রয়েছে তাদের যৌথ-অচেতনে ভূতের অস্তিত্ব এসেই যায়।
‘ঊনচারণ’-এর দুই ভূতের বৈঠকে উত্তরবঙ্গের তিনটি রাজনৈতিক ঘটনা আর সেইসব ঘটমানতায় সম্পৃক্ত চরিত্ররা আনাগোনা করে; ইস্ট-পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশ থেকে আসা রিফিউজি অর্থাৎ ভাটিয়াদের ছিন্নমূল হওয়ার কথা, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন আর কামতাপুরি বিক্ষোভ। ইস্ট-পাকিস্তানের বগুরা থেকে বর্ডার পেরিয়ে আসা দুলালের পূর্বজরা কোচবিহারে এসে জুটেছিল। এই দুলালের দিদিমা এখন নাতির ঘরের পুতির ছোট্ট লিঙ্গের ত্যানা বানাতে আশি কালের বাসি কাপড়ের সলতে পাকানো হলে পর, প্রতি শুক্কুরবার দুপুর সাড়ে তিনটে থেকে ইন্ডিয়ায় বসে ছোট ব্যাটারিওলা টিভিতে বাংলাদেশের বই দেখে। দার্জিলিং-এর নেপালি দর্জি ফুরলামুর বর, অ্যাডিডাসের লোগো নিখুঁত সেলাই করতে করতে তার সিপাহি ঠাকুরদার কথা ভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় লড়ে আসা ঠাকুরদা আর গোর্খাল্যান্ডের ঝামেলায় ’৮৫ সালে পড়শির দু-মাসের বাচ্চার মুণ্ডহীন শরীর— মাথার মধ্যে গুলিয়ে যেতে থাকে। এই ঘোলাটে কুয়াশার ভিতর দিয়ে চা-বাগানের বাঙালি মালিকের শ্যেন নজর ঠাওর হয় শুধু— যে কলকাতায় তিরিশ বছর আগে মরে যাওয়ার পরেও এই কামানবস্তির ঘরে-ঘরে দৃষ্টি গেড়ে রেখেছে। কারও একটু চা কী রেশন চুরি করার উপায় নেই। আর এসবের মধ্যে ইস্কুল পালানো রাজবংশী কিশোর সহদেব, দুলালদের বাড়ি মজুরি খাটতে এসে কাচের বয়ামে রাখা রঙিন মাছের সাঁতার-কাটা দেখতে বসে যায়। এ ভাবেই দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও তার সংলগ্ন অঞ্চলের বহু বছরের সমাজ নিজের রাজনৈতিক ইতিহাসের খাতে তিরতির করে বইতে থাকে। গোর্খাদের সামরিক বীরত্ব আর পাহাড়ের কলোনিয়াল ঐতিহ্যের তলা থেকে উঁকি মারে আনুগত্য আর ভয়ের ইতিহাস। কোচবিহারের ক্ষত্রিয়-গর্বের আড়াল থেকে উঠে আসে হেরে পালিয়ে আসা মানুষদের থিতু হওয়ার গল্প। এসবের সঙ্গে কাঁটার মতো বেঁধে ভাটিয়া–রাজবংশী সহাবস্থানের আনুষঙ্গিক ঘৃণা ও বোঝাপড়া। পাশাপাশি লেপচা-লিম্বু উপকথা আর কোচদের মহাকাব্য ‘গোসানীমঙ্গল’, পাহাড়তলির কনকনে ঠান্ডায় ফিনফিনে সিল্কের স্কার্ফের মতো আলতো লেপ্টে থাকে।
‘ঊনচারণ’ পড়তে পড়তে কখন যেন খেয়াল হয় দেবার্ঘ্যর উত্তরবঙ্গের হুসলখোলার জল গড়িয়ে এসে আমার পূর্বপুরুষের উত্তর কলকাতার শ্যাওলা এমব্রয়ডারি করা দেয়ালে জমতে শুরু করেছে। একটাই রক্ষে, এখন আর সিমলেপাড়া চত্বরে এত সহজে জল দাঁড়ায় না। তবু কিছু চলমান চেতনার স্মৃতি অস্বস্তি তৈরি করতে থাকে। এই স্মৃতি আবার তেমন প্রত্যক্ষ রোমন্থনও নয়। কারণ আমি কখনও উত্তর কলকাতায় থাকিনি। আমার পূর্বজরা থেকেছে। ‘ঊনচারণ’ সেই ব্যক্তিগত গলিঘুঁজি ফিরে দেখার তাগিদ জোগায়। দেবার্ঘ্যর কিছু পাকদণ্ডী আদলের বাক্য ভাবতে বাধ্য করে যে আমার স্মৃতি আসলে আমার একার নয়। আমার, আমার জিভের, আমার পাকস্থলীর, আমার সাইনাসের ও আমার সঙ্গে কোনও দিন তেমন ভাল করে কথা-না-হওয়া ঠাকুমার— যে দুলালের দিদিমার মতো ডান চোয়ালে একখিলি পুরে অতুলপ্রসাদ নাকি কাননবালা, কী একটা মিনমিন করত।
এই স্মৃতি দেখতে কেমন?
সকালে উঠে খুব ধীর লয়ে মনে পড়া স্বপ্নের আদল। নেপালি বস্তির ফুরলামুর-এর যেমন রোজ রাতে নিয়ম করে স্বপ্ন আসে। ‘সকালে চোখ খোলার পরও সঙ্গে থেকে যায় দিনভর। অবিকল স্বপ্ন নয়। দুপুরে শুকর কো খুট্টা খাওয়ার পর দাঁতে লেগে থাকা মাংসের সুতোয় বার বার জিভ চলে গেলে যেমন শুয়োরের ঝোলের স্বাদ মনে পড়ে…’ তেমন।
এই শোকের ভার কেমন?
‘দুই সুপারি গাছের মাঝে নাইলনের দড়িতে ঝুলতে থাকা দুলালের বউয়ের শাড়ির সবটুকু ভেজা যখন গুটিয়ে এসে ভারী পাড়ে ল্যাতল্যাতা…’
তেমন।
এই ইতিহাস কত দিনের?
‘গৌড় সুলতান হুসেন শাহর গুঁতা খায়ে পীর ইসমাইল গাজীর স্যাঙাত যখন জুটল এসে তোর্সার চরে… কিংবা গীতালদহতে বি.এস.এফ–এর হাতে খানিক কাগজ গুঁজে কাঁটাতারে পিঠ ছিলিয়ে সেই যবে থেকে শুরু হল আসা, সেইসব তো নিতান্ত দিন দুই এক আগের কথা।’
‘ঊনচারণ’, দেবার্ঘ্য গোস্বামী
তবুও প্রয়াস প্রকাশনী
৩৫০.০০