নতুন বাড়ি এসেছি দু’দিন হল। একটা উইধরা তাকের ধুলো ঝেড়ে একটা নীল খাতা নামালাম। দেখলাম গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে— …ওই দিন পুজোয় পুরানো পূজাবার্ষিকী খুলে বসে আছি। ঘর প্রায় অন্ধকার, সন্ধ্যে হব হব করছে। পুজো অবশ্য শেষ প্রায়, রাত্রেই কালান্তক নবমী নিশি। বেরোনোর কোনও ব্যাপার নেই। ওই দিনটা আমার ছবির মতন মনে থাকবে। সেই অনুভূতি অবশ্যই সুখকর নয়। ভূমিকম্প, বন্যা, অগ্ন্যুৎপাত-এর মতো সমস্ত স্মৃতি আমার সামনে পসরা নিয়ে হাজির। প্রত্যেকটা তেতো স্বাদের। হঠাৎ মায়ের ডাক এসেছিল। মায়ের ফোনে আমার জন্য ফোন। অবাক হয়েছিলাম আমার ফোন শুনে, আমায় আবার কে ফোন করবে!
১.
বাসবীদির নাটকের দল। দশমীতে পাড়ার ফাংশন, বাসবীদির ওপরেই সমস্ত দায়িত্ব। নাটক হবে রবীন্দ্রনাথ-এর ‘রাজা ও রাণী’। বাসবীদির ভাগলপুর থেকে আগত বোন লোরা হয়েছে রানি সুমিত্রা। আর রাজা বিক্রমদেব-এর চরিত্রে কুশল। আমায় ডেকেছে কোরাস-এ চেঁচানোর জন্য, আর মঞ্চসজ্জার টুকটাক ফাইফরমাশ খাটার জন্য। এমনিই মায়ের ভাষায় ‘মস্ত অপোগণ্ড’ বলে কোথাও পাত্তা পাই না; তাও বাসবীদি নিজে ডেকেছে, যেতে তো হবেই! পুজোর তখনও মাস দেড়েক বাকি। যাচ্ছিও রোজ রিহার্সালে। কুশলের ভিক্স লজেন্স এনে দিচ্ছি, গানের আর নাচের মেয়েদের জন্য পাড়ার কল থেকে জল এনে দিচ্ছি, বাসবীদির বাবার নস্যিও এনে দিচ্ছি পাড়ার দোকান থেকে। আর মাঝে মাঝে কোরাসে এমন গান ধরছি, বাসবীদি দাঁত খিঁচিয়ে বলছে ‘আস্তে আস্তে’, মেয়েরা হেসে উঠছে, ছেলেরা হাততালি দিয়ে উঠছে আর লোরা তাকিয়ে আছে ঠান্ডা চোখে, তখন মনে হচ্ছে হে ধরণী দ্বিধা হও! তারপর হঠাৎ একদিন রিহার্সালে গিয়ে দেখি কুশল উত্তেজিত হয়ে কী সব বলে হাত-পা নেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর লোরার মুখ লাল। আমি বিন্তিকে জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে, উত্তর দিল না।
এমনিই এত বকি মানুষের সঙ্গে যেচে, উত্তর না পাওয়াটা আমার এক রকম অভ্যেস হয়ে গেছে; তাও হাওয়া বুঝে আর কথা বাড়ালাম না। বুঝলাম কুশল কোনও নতুন পোঁ ধরেছে, মনে হয় নাটক করবে না। একটা কথা আজও বুঝি না যারা ভালবাসা না চাইতেই পেয়ে যায়, তারা কেন এত পোঁ ধরে? আর আমার মতো মানুষরা তীব্র জ্বালাতে টুঁ-ও করতে পারে না। যা হোক, হঠাৎ বাসবীদি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই আপাতত রাজা-টা করে দে, প্রক্সি দে কিছুদিন, তারপর ভাবা যাবে। আর লোরা, তুই ওকে একটু বুঝিয়ে দিয়ে তারপর যাস। আগে দিন পনেরো সবাই বসে বসে নাটক পড়া হোক। সবার মুখস্থ হোক, গানগুলো উঠে যাক, তারপর দেখছি।’ আমি আমার ভয়ঙ্করী অল্পবিদ্যা নিয়ে ভাবলাম, আমিই হচ্ছি রাজা বিক্রমদেব আর লোরা হচ্ছে আমার রাণী সুমিত্রা। লোরা— ভাগলপুরের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা কাটারির মতো উচুঁ নাক, পুকুরের মতো দীঘি চোখওয়ালা মেয়েটা আমার রানি। ভাবতেই কী রকম হচ্ছিল! যখন রিহার্সালে চরিত্র পড়া শুরু করলাম তখন গলা শুকিয়ে একসা, তাও সাহস সঞ্চয় করে পড়ছিলাম। সবাই হাসছিল এ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আর বাসবীদি গালে হাত দিয়ে আর লোরা ঠান্ডা চোখে তাকিয়েছিল। তা যা হোক, বেশ কিছুদিন বাসবীদির খিঁচুনি আর লোরার চাহনি নিয়ে, বাড়িতে-বাথরুমে নানা ভাবে চেষ্টা-চরিত্র করে একটু পদে এল।
তারপরই বজ্রপাত— রিহার্সালে গিয়ে দেখি কুশল আর লোরা পাশাপাশি বসে একই স্ক্রিপ্ট থেকে পড়ছে নাটক। কুশল আমায় অভ্যর্থনা করল ‘একদিন কা সুলতান’ বলে। বাসবীদি বলল, ‘তোকে অনেক ধন্যবাদ রে, প্রক্সির জন্য এত পরিশ্রম করেছিস। তোকে বোঝাতে গিয়ে লোরারও ভাল মুখস্থ হয়ে গেছে। শেষে কুশল-ই করবে, ওদের দুজনকে দারুণ মানাবে।’ লোরা মুখে হাত চাপা দিল আর কুশল খামোখা লোরার মুখ থেকে হাত টানতে লাগল আর বাকি সবাই ওদের খুনসুটি উপভোগ করতে লাগল। আর আমি বুঝলাম, আমি প্রক্সি শব্দটা খেয়াল করিনি— আসলে তো আমি রাজা নই! চোখ ফেটে জল এল, এত কষ্ট বাবা বেল্ট দিয়ে মারলেও হয়নি, অথচ লোরা কালই বলছিল, ‘হচ্ছে হচ্ছে ভাল হচ্ছে’। তবে লোরাকে ফোন হাতে একটু অন্যমনস্ক লাগছিল, মুচকি মুচকি হাসছিল। ও হরি, হয়তো কুশল মেসেজ করছিল, হয়তো কুশলের অভিমান শেষ। ওসব কুশলের করা সাজে— দুর্দান্ত ফার্স্ট বয়, ওর বাবা পাড়ার পুজোর সিংহভাগ চাঁদা দেয় এবং কুশল ফুটবল আর ক্যারামটা খেলে দুরন্ত।
যা হোক, লোরা আজ আমার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না; বাসবীদি বলল, ‘আজ তুই বাড়ি চলে যা, আজ শুধু নাটক নিয়েই বসব, কোরাসের জন্য কাল আসিস।’ হঠাৎ বুকের মধ্যে ফাঁকা তেজ চলে এল, বললাম, ‘না গো দিদি আমার হবে না, পুজোয় আড়িয়াদহ যাব ঘুরতে। আমি বারণ করতেই এসেছিলাম’ বলে ঘুরে রাস্তায় চলে এলাম, ভাবলাম কেউ হয়তো ডাকবে, দেখলাম কেউ ব্যাপারটা কানেই নিল না। আর আড়িয়াদহ জায়গাটা কোথায়, ভাল করে তা-ই জানি না। নামটা ভূগোল বইয়ে পড়েছিলাম না কাগজে, কে জানে! তবে যেখানেই হোক, খুব দূরে নিশ্চয়ই— চলে যেতে ইচ্ছে করল সেখানে। গাপ্পুদা আমায় মাঝে মাঝেই ‘ক্যালানে’ বলে, আজ নিজেকে খুব ওই-টা বলে ডাকতে ইচ্ছে করল। হাতে দেখলাম এখনও স্ক্রিপ্টটা ধরা, ওপরে কুশলের নাম লেখা, নির্ঘাত লোরা লিখেছে। অবশ্য এটা তো কুশলের, স্ক্রিপ্টটা দিলুম ছিঁড়ে। বাড়ি যাব আমি, গিয়ে পাশবালিশ জড়িয়ে কাঁদব। কিন্তু বাড়িতে কী বলব? আমি তো গল্প করে ফেলেছি, আমি রাজা এবারের পুজোয়! পাশে দেখলাম চওড়া নর্দমার পাশে একজন গরম উনুনে ভুট্টা ভাজছে। গরম উনুনে মাথাটা গলিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। তখনই মায়ের মুখটা মনে পড়ল।
২.
আউলাগাছি শিবশক্তি সংঘের মাঠ, সারাদিন ব্যাপী আট ওভারের টেনিস বলের নক আউট টুর্নামেন্ট, সেভেন এ সাইড টিমের আমাদের গাপ্পুদা ক্যাপ্টেন। টুর্নামেন্টে একবারও ব্যাট করিনি, আসলে ধরার চান্সই পাইনি। আমাদের প্রথম তিন-চার জন মিলিয়ে তিনটে ম্যাচে প্রতিপক্ষের পিণ্ডি চটকেছে আচ্ছা করে। তবে বল করেছি রীতিমতো, উইকেট আর বাহবা দুটোই পেয়েছি। নিজের ওপর তীব্র বিশ্বাস চলে এসেছে ফাইনাল ম্যাচের সময়ে। দেখলাম ফাইনালে খেলা পড়ছে অল স্টার ক্লাবের সঙ্গে, ক্যাপ্টেন বিরাজদা। লোকটাকে দেখলেই আমার গা-পিত্তি জ্বলে ওঠে। ওর জন্য ফুলি আমার সঙ্গে কথা বলে না আর, ফুলি আমার ছোটবেলার বন্ধু। একসঙ্গে ক্লাস ফাইভ থেকে পড়েছি টুয়েলভ্ অবধি। দু’বছর আগে ফুলিকে দেখলাম সরস্বতী পুজোয় নীল শাড়ি পরে। দারুণ লাগছিল সত্যি, আমি রাস্তায় দেখতে পেয়ে সাইকেল থেকে আওয়াজ দিলাম ‘জিও ফুলি, কী লাগছে!’ আগে ফুলি শুনলে খুশি হত। ফুলিই প্রথম নারী যে আমার মতামত গুরুত্ব দিত। কান ফুটিয়ে, নাক ফুটিয়ে, মাথায় বিনুনি করে, সিঙ্গার টিপ পরে জানতে চাইত— ওই কেমন লাগছে? আমি যা পারতুম খুব ভাল বলতুম। তাতে ফুলি যখন ফিক ফিক করে হাসত, আমার সব থেকে ভাল লাগত তখনই। তবে এবার ফুলি দেখলাম উত্তর দিল না, বাইকের পিছনে সোঁ করে বেরিয়ে গেল। বাইকটা বিরাজদা চালাচ্ছিল।
সেই প্রথম ফুলি আমার সঙ্গে কথা বলল না। সেই শুরু, তারপর থেকে আর কোনও দিন ফুলি আমার সঙ্গে কথা বলেনি। এখন রাত্রে ভাবি, আমি ফুলিকে ভালবাসতাম কি! হয়তো, বা হয়তো নয়। কিন্তু ফুলি আর আমার মধ্যে নিখাদ বন্ধুত্ব ছিল। কত কিছু শিখিয়ে দিত ফুলি, কত কষ্টের কথা বিলিতি আমড়া খেতে খেতে, কোচিং থেকে পড়ে ফেরার সময়ে বলত। ফুলির বাবা মদ খেলে ফুলির কষ্ট লাগে, ফুলির মা ফুলির ভাইকে বেশি ভালবাসে, ফুলি কত কী না বলত। সে সব আমি কাউকে বলিনি, বলবও না, ডায়েরিতেও লিখব না। সেই ফুলি আমায় চিনতেই পারল না! যা হোক, একবার ফুলিকে রাস্তায় ধরে অসহায় ভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কীরে ফুলি, আর কথা বলিস না!’ ফুলি শুধু বলেছিল, ‘রাস্তা ছাড়! বিরাজ আমায় ন্যালা-ক্ষ্যাপাদের সঙ্গে মিশতে বারণ করেছে। আর রাস্তায় কখনও ওরকম বিচ্ছিরি ভাবে ডাকবি না, আর ডাক নাম ধরে তো নয়ই।’ জীবনে মানুষ অচেনা হয়ে যাওয়ার দুঃখ খুব কষ্টের। আমার একবার জন্ডিস হয়েছিল মারাত্মক, কিন্তু ফুলি যে এভাবে বলল তাতে আমার তার থেকেও বেশি কষ্ট হল। ডাকনাম আসলে একটা মস্ত বড় অধিকার, যারা পায় তারা বোঝে না! আর যারা ডাক পায় না বা যারা ডাকে না, তারা-ই শুধু জানে…
দারুণ খেলা হচ্ছিল ফাইনাল, আমরা আট ওভারে ৭২, আর ওরা সাত ওভারে ৫০। ম্যাচ আমাদের পকেটে প্রায়। প্রথম ওভারে বল করে পাঁচ রান দিয়ে, একটা উইকেট নিয়ে নিজেকে নিদেনপক্ষে মুনাফ প্যাটেল ভাবছি। গাপ্পুদা আমায় লাস্ট ওভারটা দেবে আমি জানি। গাপ্পুদা আমায় খুব ভালবাসে, ওর প্রেমের কত চিঠি, ওর প্রেমিকার জন্য কত কবিতা লিখে দিয়েছি আমি। ফুলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে; শিবশক্তি সংঘের মাঠের বাঁ দিকে ফুলিদের বাড়ি। ব্যাট করছে বিরাজদা, বল করতে গেলাম আমি। একটু গুড লেংথ-এ বলটা দিলাম ঠুকে, বাউন্সটা জাজ করতে না পেরে বল লাগল বিরাজদার পেটে। আমি ভাব নেওয়ার জন্য সামনে এগোতে যাব, হঠাৎ চোখ গেল বারান্দায়— ফুলির চোখে জল! বুকটা খালি হয়ে গেল, ভূগোলে ছত্রিশ পেয়ে এরকম মনে হয়েছিল। ফুলি দেখলাম বিমর্ষ, বিরাজদা অসহায়। আর খেয়াল করলাম চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে আমার। বল করলাম, হাত থেকে বেরোল ফুলটস— ছয়, আবার করলাম, এবার হাফ ভলি— আবার ছয়! পরেরটা ফুল লেংথ-এ স্লোয়ার, আবার ছয়। আমার মাথায় তখন কী ভর করেছে কে জানে, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। সবাই আমায় কত কী বোঝাচ্ছে, কিছু শুনতে পাচ্ছি না। খালি মনে হচ্ছে, ফুলিকে আমি কাঁদালাম!
আমি অপোগণ্ড— ভূগোলে ছত্রিশ, বাবার চাকরিটা মাস তিনেক নেই, নাটক থেকেও বাদ, পুজোয় আমার একটাও জামা হয়নি, মানিব্যাগে পড়ে আছে তেত্রিশ টাকা আর মনে পড়ছে ফুলির চোখে জল। বিশ্বাস কর ফুলি, আমি তোকে কাঁদাতে চাইনি! পরের বলটা সত্যিই ভাল করেছিলাম, পারফেক্ট ইয়র্কার জায়গায় পড়ল, কিন্তু আমার কপাল! বিরাজ ব্যাট চাপল কোনও মতে। বলটা ব্যাটের নীচের কানায় আলতো চুমু খেল, যেমন ফুলি বিড়াল ছানা দেখলেই খেত, ঠিক তেমন। তারপর চার। আর মনে নেই। গোটা টিম খিস্তি করল এসে, গাপ্পুদা সবাইকে থামাল। আমি মাঠে বসে পড়েছি। দেখলাম ফুলি নীচে নেমে জোরসে তালি দিচ্ছে— শুনলাম যেন বলল, ভাগ শালা, হুররে! আরও নানাবিধ শব্দ। অতি কষ্টে বাড়ি এসেছিলাম। রাত্রে একটাও রুটি খাইনি। সারা রাত্তির মুখে বালিশ চাপা দিয়ে কেঁদেছিলাম আর নিজের মনে ডায়েরি লিখেছিলাম। তারপর যতবার খেলতে গেছি, এখনও মনে আছে আমায় মাস সাতেক বল ব্যাট কিচ্ছু দেওয়া হয়নি। তিনটে টুর্নামেন্টে ডাকা হয়নি। সবার খেলা শেষ হয়ে গেলে লোক-কে যেচে যেচে বল করতাম, তারা মারলে নিজেই কুড়িয়ে আনতাম। রোজ রাত্রে স্বপ্ন দেখতাম সাইকেলে পাইকারি দোকানদারের জিনিস এনে দিচ্ছি গোডাউন থেকে (ওই কাজই করতাম তখন) আর বাইকে করে বেরিয়ে যাচ্ছে ফুলি আর বিরাজদা। আকাশে, নীল আকাশে উড়ছে দুজন। ফুলির পরনে সেই শাড়ি, সরস্বতী পুজোর। ফুলি বলছে ‘ভাগ শালা!’ আমার তো আর বিরাজদার মতো বাইক নেই, সাইকেলও দাদুর আমলের। আমি পিছিয়ে পড়ছি ক্রমশ… দূরে, অনেক দূরে…
মলুরা পুজোয় পুরী চলে গেল। আর কেউ রইল না আমার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার জন্য। একদল বন্ধু ঠিক করল ঘুরতে যাবে কলকাতা, আমি মানিব্যাগের অবস্থা দেখে দোহাই দিলাম বাড়ি থেকে ছাড়বে না। ওরা বেশি বললও না, জানে কী অবস্থা আমাদের। আর আমার সাধের ক্রিকেট টিম আমায় ডাকল না, বাইশ রানের জন্য বেমালুম ভুলে গেল পায়ের নখ উঠে গেলেও আমার রান আউট, আমার হ্যাটট্রিক। মলু আমার ভারী ভাল বন্ধু ছিল, ওকে আমি সব বলতাম। ও একটু তোতলা ছিল ঠিকই কিন্তু কী ভাল কবিতা লিখত! সব যে বুঝতাম তা নয় কিন্তু এ বুঝতাম যে আমি ওর একমাত্র পাঠক। আমিই পড়তাম আর আমি যা বলতাম, ও খুব শুনত। যাওয়ার আগে বলে গেল যে আমার জন্য ওর বাবার ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে আনবে, কিন্তু গোটা পুজো একা কাটাব? কী অপরাধ খুঁজে না পেয়ে ভাবলাম জীবনে যত মশা মেরেছি, মাকে মিথ্যে বলেছি, বাজারের দু’টাকা ফিরলে দিইনি, সেই সব পাপের ফল পাচ্ছি আমি হাতেনাতে।
৩.
ফোনটা মায়ের হাত থেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কে ফোন করছে, মা বলল বাসবীদি। ফোনটা ধরতেই বাসবীদি হাউঁমাউঁ করে বলল, যে ছেলেটার স্টেজে আলো ফেলার কথা, তার কাল রাত্তির থেকে তীব্র বমি, পায়খানা, জ্বর। তো আমায় যেতেই হবে। কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, হঠাৎ শুনি একটা ঠান্ডা গলা, শুনে বুঝলাম লোরার। ও বলে উঠল ‘দায়িত্ব এড়িয়ে নিজের দর বাড়িও না। এসো, দরকারেই ডাকা হচ্ছে।’ আমি বললাম ‘আচ্ছা।’ মনে মনে নিজেকে খুব খিস্তোলাম। সত্যি, ওরা করবেন নাটক আর আমি ফেলব আলো। ধুর ধুর! হে ভগবান, হে মাধব আমিই কেন? যা হোক গেলাম। গিয়ে বুঝলাম অবস্থা আরও খারাপ। যার ওপর সঞ্চালনার ভার পড়েছিল, দুর্গাপুজোয় তেড়ে ঠান্ডা খেয়ে তার স্বর পুরো কোলাব্যাঙ। বাসবীদি আমায় বলল সঞ্চালনা করে দিতে। আমতা আমতা করছি, কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, তখন লোরা শ্লেষ দিয়ে বলে উঠল, ‘আড়িয়াদহ থেকে ফিরলে কবে?’ কী যে উত্তর দেব বুঝে পেলুম না। তবে লোরার দিকে চেয়ে দেখলাম ওকে অপূর্ব লাগছে। মনে হল ওর রানি সাজার দরকার পড়বে না কোনও দিন— ও এমনিই রানি। পৃথিবীর সমস্ত আলো ওর মুখেই পড়ছে। যা বুঝলাম আমায় সঞ্চালনা করতে হবে, একটা কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হল আমায়। লাইটম্যান একা ম্যানেজ করে দেবে আলোর সব ব্যাপার, শুধু নাটকের সময়ে আমায় আলোর বিভিন্ন ফিল্টার ধরার কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠান শুরু হল, হঠাৎ দেখি লোরার নাম গানের লিস্টে। ডাকলাম, লোরা কুশলকে বলল হারমোনিয়ামটা স্টেজে দিয়ে যাওয়ার জন্য। কুশল কেমন বিশ্রী করে আমায় ইঙ্গিত করল। আমি আর কী করব, বয়ে দিয়ে এলাম। লোরার দেখলাম মুখটা সামান্য লাল। রাগলে লোরাকে ঠিক মা দুগ্গার মতো লাগে। মনে মনে মা দুগ্গাকে বললাম, লোরার গানটা যেন ভাল হয়। তবে হঠাৎ লোরা আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘ঘোষণাটা বেশ হচ্ছে তো।’ মাথায় আমার বিনবিন করে ঘাম দিল, শরীরটা হালকা লাগল, মনে হল বুকের ভেতর থেকে তিনটে পায়রা উড়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, আর আমি মুগ্ধ চোখে লোরার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখলাম কুশল আমার দিকে ভেটকি মাছের মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে। লোরা গান ধরল— আশা ভোঁসলের গান, ‘আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম শুধু একটি তোমার সই গো, তুমি চোখের পাতায় লিখে দিলে…’
কী যে ভাল লাগছিল কী বলব! অমন প্রাণ ঠান্ডা খুব কমই হয়েছে, এত রাগী মেয়ে গান গাইছে, যেন মনে হচ্ছে সাক্ষাৎ মা সরস্বতী। গান গাইলে ওর গলাটা কী মিষ্টি, কী আদুরি হয়ে যায়; কেন যে ও এমন গলায় কথা বলে না! বা বলে হয়তো, আমার সঙ্গে অমন গলায় কথা বলেনি কোনও দিন। ভুলে যাচ্ছিলাম যে মা দুঃখ করে বলে পড়াশোনার যা অবস্থা আমার দ্বারা কিস্যু হবে না। বাবার চাকরি চলে গেল, বাবা দোকানে দোকানে মাল সাপ্লাই করে সুবিধা করতে পারছে না। আমার কোনও বন্ধু নেই, পুজোয় একদিনও ঘুরতে যাইনি, আমাদের বাড়িতে কতদিন মাংস হয়নি, মা নতুন শাড়ি কেনেনি কতদিন, বাবা রাত্রে খুব কাশে। সওব ভুলে গেছিলাম, সওব ভুলে যাচ্ছিলাম… লোরা এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে গাইছিল, হঠাৎ দেখলাম লোরা আমার দিকে তাকিয়ে, আমি লোরার দিকে। আর কোথাও কিছু নেই, লোরার আঙ্গুলগুলো কী সুন্দর, যেন সাদা শাঁখের তৈরি, সেটা দিয়ে হারমোনিয়ামকে যেন আদর করছে।
লোরা গাইছে, ‘আমি রাগ করে চোখ বন্ধ করি, দেখি তোমার অনুরাগ গো’। আমার আর পা কাঁপছে না, অদ্ভুত জোর পাচ্ছি আর ওর গান শুনছি ভেতর থেকে। গানটা শেষ হল। আমি খুব হাওয়া নিয়ে বলতে গেলাম— তোমায় দারুণ লাগছে, কী ভাল হয়েছে গানটা; কিন্তু বলতে গিয়ে সব গুলিয়ে গেল আর লোরা হেসে উঠল বলল ‘যাও, মন দিয়ে মাইক ধর।’ বেশ আমি জোর পেয়ে গেলাম। মনে হল— আহা, এই হেরে যাওয়া জীবনে লোরার মতো যদি কেউ থাকত পাশে আমার, তাহলে এমন কাদায় পড়তে হত না, বা পড়লেও উঠে পড়তাম। তারপরই নাটকের পালা। যেমন যেমন কাগজে লেখা ছিল, তেমন তেমন আলো ফেললাম আর নাটক জমে উঠল লোরা আর বাসবীদির জন্য। লোরা সত্যিই এ পৃথিবীর কেউ নয়, ও দেবী! এই গোটা মঞ্চ মায় পৃথিবী ওর শুধু ওর। আর বাসবীদি ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম’ যা গাইল, আমার চোখ ফেটে জল এল। কুশল দু’বার ভুল ডায়লগ বলল, দেখলাম লোরার মুখ আবার লাল হয়ে উঠছে।
তবে কুশল আর লোরা যখন কাছাকাছি আসছিল, আমার প্রথমে খুব হিংসে হচ্ছিল। খুব ইচ্ছে করছিল কুশলকে ঘা-কতক মারি, নয়তো লাগাতার বাউন্সার করে একদম নাজেহাল করে দিই। তবে কিছুক্ষণ পর দেখলাম স্টেজে কুশল নয়, যেন আমি আর লোরা। আর লোরা আর আমি। বুঝলাম মাথাটা সত্যিই খারাপ হয়েছে নয়তো পেট গরম হয়েছে। যা হোক, নাটক শেষ হল ভাল-য় ভাল-য়। সবার মুখে শুধু লোরা আর লোরা। তবে বাসবীদির বাবা নস্যি আর সিকনি মাখা হাতে আমায় খুব পিঠ চাপড়ে দিল আর বলল ‘রক্ষা করলে তুমি’ আর ‘তোমার গলায় কী জোর মাইক লাগবে না তো, রাজা তো তুমি হলেই পারতে হে।’ হঠাৎ দেখলাম লোরা রেগে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে কুশলকে কী বলল আর কুশল টিফিন না নিয়েই বেরিয়ে গেল। দেখলাম লোরা রেগে ফুলছে, মনে হল আচ্ছা, লোরার কী উনুন লগ্নে জন্ম? এত রাগ কীসের ওর? তারপর আমার সেই বিখ্যাত সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম নাকে, আর পিছন থেকে ডাক, ‘এই যে আড়িয়াদহতে ফিরে যাওয়া হচ্ছে না কি?’ পিছন ফিরে দেখলাম লোরা। বলল, ‘কী মশাই, বাড়িতে এক্ষুনি না গেলে মা বকবে না কি! চলো, দুটো ঠাকুর দেখি, তারপর বাড়ির গলির কাছ দিয়ে যাবে। আমার কুকুরে খুব ভয়।’
কুকুরে আমারও ভীষণ ভয়, তাও চেপে গেলুম। তারপর আমার ভাল করে মনে নেই, এখনও যখন লিখছি ভাবছি স্বপ্ন ছিল না কি কল্পনা, না কি পুরোটাই সত্যি! বিশ্বাস হয় না। আমায় চারটে ঠাকুর দেখাল, জোর করে রোল খাওয়াল, তারপর বসে কত কী বলল। কী বলছিল তা থাক, তবে কথা শুনছিলাম কম, আমি শুধু দেখছিলাম ওকে। কথা বললেও ওকে ভারী ভাল লাগে। হঠাৎ মনে পড়ল মায়ের মুখে আজই শুনেছি, আমরা এখানে আর বেশি দিন থাকব না। মামার বাড়ি চলে যাব, মামা বাবার জন্য কাজ দেখেছে। আমি একা ছিলাম, আরও একা হয়ে যাব। এখানে পুজোয় আর আসা হবে না, পুজোয় লোরা আসবে, আমার আর দেখা হবে না লোরার সঙ্গে। আমি কাঁদতে শুরু করলাম, লোরা ভারী লজ্জায় পড়ে গেল। একটু রেগেও গেছিল, তবে কিছুক্ষণ পরে দেখলাম আমার পিঠে একটা তুলোর মতো হাত আর আমি সব বলে দিলাম ভেতরে যা জমে ছিল। লোরা যখন গলাটা নামিয়ে বলল, ‘বাড়ি যাও, লক্ষ্মী ছেলে, এভাবে কাঁদতে নেই’ তখন মনে হল, ঠিক এটার-ই অভাব ছিল আমার জীবনে। আমায় কেউ কখনও এইভাবে ‘লক্ষ্মী ছেলে’ বলে ডাকেনি। ওকে এগিয়ে দিতে গেলাম। সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি কিন্তু ফাংশনের গানটা নিজের মনে গুনগুন করে গেয়ে গেল। আর ফেরার সময়ে বলল, ‘শোনো, আমাদের আবার দেখা হবে। আমি কাল চলে যাব ভাগলপুর। ঠিকানা আর ফোন নম্বর দুটোই রেখে যাব। কখনও নিজেকে বদলাবে না, আর শোনো, কখনও খুব একা লাগলে আমায় মনে কোরো।’ বলেই গটগট করে হেঁটে চলে গেল। ভেবেছিলাম একবার পিছু ফিরে তাকাবে, তাকাল না! তবে কেমন দুলে উঠল বাসবীদিদের বাড়ি ঢোকার আগে। আচ্ছা, ও কি কাঁদছিল?
৪.
লোরা চলে গেছে। যাওয়ার সময়ে বাসবীদির কাছে আমার জন্য একটা বই রেখে গেছে আর একটা চিঠি। বইটা ‘অক্ষয় মালবেরি’, চিঠিতে লেখা— ‘…বইটা একবার শুরু থেকে পড়বে, আর একবার শেষ থেকে। আর শোনো, নিজেকে হারিও না। বদলিও না। কখনও মনটাকে পাথর কোরো না। মাথার ওপর দিয়ে ঢেউ গেলে, ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করতে নেই। পরম শ্রদ্ধায় মাথা নিচু করে নিতে হয়। কথাগুলো মনে রেখো, কাঁদুনে রাজা… আমাদের আবার দেখা হবে। পরের বার দেখা হয়ে অমন করে চোখের জলে, নাকের জলে করলে কিলিয়ে সোজা করে দেব… এই চিঠিটাতে ঠিকানা আর নাম্বার রইল। যোগাযোগ রেখো… এই চিঠি তোমায় পথ দেখাবে।’ চিঠিটাতে আরও অনেক কিছু ছিল। আজ আর লিখতে ভাল লাগছে না। কাল আমরা চলে যাব। খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্ত জোরও পাচ্ছি। আমাদের আবার দেখা হবে। চিঠিটা আমায় পথ দেখাবে… থাক আর লিখব না।
পরিশিষ্ট: নতুন বাড়ি এসে আমি এই খাতাটা পাই। মনে হয় আগের ভাড়াটে পরিবারের ছেলের রেখে যাওয়া। ও খাতাটা ফেলে গেছে না কি রেখে গেছে, জানি না। তবে নিশ্চয়ই ওই চিঠি আর বই নিয়েছে। খাতায় ওর নাম ছিল আর তারিখ ধরে ধরে ছিল লেখা। সেগুলো বাদ রাখলাম। সব কথা সবার না জানলেও চলে। তবে এটুকুই ও লিখেছিল। ভাষায় দখল আর চিহ্ন এখনও সম্পূর্ণ রপ্ত করতে পারেনি কিন্তু ভেতরটা ফাঁকা করে লিখতে জানে। আমার এক সাহিত্য নিয়ে পড়া বন্ধু, এসব নিয়ে খুব চর্চা করে। ওকে পড়াতে, ওই বুদ্ধি দিল ছাপানোর। তবে সেই ছেলেটাকে বলছি— তোমার লেখা তুমি ঠিক চিনবে। ভাই পড়ছ কী জানি না। ঠিকানা, ফোন নম্বর কিছুই নেই আমার কাছে। কিছু রেখেও যাওনি কোথাও। যদি কোনও দিন দরকার পড়ে, খাতাটা এসো নিতে তোমার পুরনো ঠিকানায়, ততদিন খাতাটা বুকে আগলে রাখার দায়িত্ব নিলাম আমি। চিঠিটা তোমায় পথ দেখাক আর তোমাদের আবারও দেখা হোক।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র