প্যান্ডেলের লাইনে দাঁড়ালে বা কোনও উঁচু জায়গা থেকে সেই লাইন দেখলে মনে হয়, একটা ভাসমান নৌকো। সারি-সারি কালো মস্তকের নিরন্তর ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে যাওয়ার ছন্দ কেন জানি না মনে করিয়ে দেয় বাবুঘাটের ফেরি চড়ার স্মৃতি, এক অদ্ভুত মৃদু দুলুনি নিয়ন্ত্রণ করে শরীরকে, যার স্মৃতি ধরে রাখে দুটো পা, নৌকো থেকে নামার পরেও। বহমান ইশারায় সাড়া দেওয়া পা ডাঙায় পড়লেই প্রতিবাদ করে ওঠে মাটির স্থিতিশীলতা, কয়েক মুহূর্তের জন্যে টলে যায় দেহ। বিজ্ঞানীরা বলবে এটা হল নিউটনের ফার্স্ট ল, তবে গঙ্গাবক্ষে হাত ধরে হাওয়া-খাওয়া, সদ্য-প্রেমে-পড়া কপোত-কপোতী বলবে, এ হচ্ছে প্রেমের মাদকতা। যাক গে, প্যান্ডেলে ভোগের লাইনে দাঁড়িয়ে অতি ধীর ছন্দে দুলতে-দুলতে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই; আর যতই মনে-মনে কাব্য করি না কেন, সূর্যের আলোর তাপ পিচ-রাস্তাকে শারদীয়ার সাজে সাজিয়ে তোলার ফলে কালো জলে ভাসমান নৌকোর কোমল স্মৃতি কোনও ভাবেই সান্তনা দিতে পারছেনা মনকে। আর গঙ্গার হাওয়া? ধুস, বিভিন্ন প্যান্ডেলের লাইনে দাঁড়ানো সকলের সমবেত নিশ্বাস বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেবে তাকে। ঘামের নিম্নগামী স্রোত ইতিমধ্যেই হালকা রঙের পাঞ্জাবির গায়ে নানারকম নকশা কাটা শুরু করে দিয়েছে, দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন কোনও অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট! সে যত বড় ডিজাইনার-ই হোক না কেন, পুজোর ভিড়ে ঘামের প্রলেপ ফ্যাব ইন্ডিয়াকে মুহূর্তে বদলে ফ্যালে স্যাড ইন্ডিয়ায়। মোদ্দা কথা, আপনার ইস্তিরি করা বাহারি সাজের করুণ অবস্থা অবশ্যম্ভাবী!
এইসব থেকে বাঁচার জন্যই বাড়িতে কয়েকটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি কিনেছিলুম, তবে পরে বেরোতে ভুলে গেছি! আর এ-গেঞ্জি সে- গেঞ্জি নয়, এ হচ্ছে জুপিটার কোম্পানির খাস গেঞ্জি। চুলবুলবাবু বিজ্ঞাপন করেছেন; মোটামুটি ঢাকুরিয়া, গোলপার্ক জুড়ে বিজ্ঞাপন। চুলবুলবাবুর সাড়ে সতেরো ইঞ্চি বাইসেপের নীচে লেখা, ‘জুপিটার ইনারওয়ার, প্যান্ডেল ভ্রমণ swag সে’। এবং এই গেঞ্জি পরে নিলে জেগে উঠবে শক্তির নতুন রূপ। গোলপার্ক থেকে ডানদিকে যাব না বাঁ-দিক, কিছুক্ষণের জন্য গুলিয়ে গেল। একটা বাজে হরর ফিল্মের মতো যেদিকেই তাকাচ্ছি, সেদিকেই পেশি বাগিয়ে গেঞ্জি পরে চুলবুলবাবু তাকিয়ে আছেন, কেমন যেন নাছোড়বান্দা, রাস্তা ছাড়বেই না। তাঁর ছবির পাশেই আঁকা দুর্গা ঠাকুরের মুখ, মনে হল যেন তাঁর পরের ছবির নায়িকা। আর সবচেয়ে যেটা অসহ্য, তা হল চুলবুলবাবুর কালো চশমা পরা মুখের অদ্ভুত স্মিত, ওস্তাদি হাসিটা। মনে হল যেন আমার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করছে, যেন তাঁর পরা গেঞ্জি না পরলে জানতেই পারব না জীবনের লুকোনো সব আশ্চর্য রহস্যময় অনুভূতির কথা। হেব্বি রাগ হল, তাই গোটা কয়েক কিনেই বাড়ি ফিরলাম। কী এমন আছে গেঞ্জিতে যার জন্য এত বিজ্ঞাপনের ঠেলায় চোখের আকার গোলপার্কের মতো হয়ে গেল? আরেকটু হলে সামনের গাড়িতে ধাক্কা মেরে দিতে যাচ্ছিলাম, জানেন? শুধু আমি না, প্রায় সব গাড়ির অবস্থাই ছিল এক রকম, কারণ ঠিক চুলবুলবাবুর বগলের নীচে ঢাকা পড়ে গেছিল ওই রাস্তার সব সিগন্যাল।
পরের দিনই জামার তলায় এই লুকোনো শক্তির রক্ষাকবচ পরে প্যান্ডেলের লাইনে দাঁড়িয়েই খেলাম একটা সজোরে ধাক্কা। কোনও এক অতি উৎসাহী এবং ভক্তিভাবে বুঁদ ভদ্রমহিলা প্যান্ডেলের মিউজিক সিস্টেমে চলা সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ ও ছাতিম ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে অনেকক্ষণ ধরে তার স্বামীকে বলছিলেন যে, এই শুভক্ষণে তার মনে হচ্ছে সে যেন এই বস্তুবাদি আকাঙ্ক্ষায় মোড়া পৃথিবী থেকে মুক্ত হয়ে চলে যাচ্ছেন সত্যযুগের দিকে । লম্বা নিঃশ্বাস টেনে ছাতিমের ঘ্রাণ নিয়ে তিনি বললেন, ‘আঃ, মনে হচ্ছে এই ফুলের গন্ধ আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই সুদূর তেপান্তরের মাঠে, যেখানে পুষ্পক রথে চড়ে রামচন্দ্র উড়িয়ে নিয়ে যেতেন তাঁর চোখের মণি সীতাকে’, তার পর আচমকা থেমে তাঁর স্বামীর দিকে ঘুরে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘উফ যাই বলো, প্রভাসকে কিন্তু দারুণ মানিয়েছে, ওর মতো রাম সেজে যদি আমাকে কেউ উড়িয়ে নিয়ে যেত, আর পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজত, ‘নীলে নীলে আম্বার পার, চাঁদ জব্ আয়ে…’। স্বামীর অপ্রস্তুত হাসি দেখে উনি মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘হুঁহ , তোমার ওই অডি তো কলকাতার রাস্তায় আশির বেশি স্পিডই তুলতে পারে না।’ যা বুঝলাম, এটা হল এবার পুজোয় রামমন্দির থিমের প্যান্ডেলে সময় কাটানোর ফল। তবে ঠাকুমার ঝুলিতে প্রভাসরূপী রামচন্দ্র আর তার সঙ্গে কিশোর কুমার, এই পুরো ব্যাপারটা কীরকম হবে সেটা কল্পনা করার চেষ্টা করছি, এমন সময়ে দেখি বিদ্যুৎবেগে ভদ্রমহিলা আমাকে সজোরে একটি ধাক্কা মেরে এগিয়ে গেলেন মণ্ডপের দিকে।
আমি ভাবলাম বোধহয় ভক্তিভাবের ঠেলায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মা দুর্গার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে যাচ্ছেন, তবে না, মণ্ডপে ঠাকুর দেখার জাজ হয়ে এসেছেন আমাদের সবার প্রিয় টুম্পাদা, ওরফে সুপারস্টার রোশনজিৎ। ব্যাস, সত্যযুগ থেকে সোজা সেলফিযুগে ফিরে মোবাইল নিয়ে ছুটলেন ভদ্রমহিলা। মাঝখান থেকে আমি কোমরে খেয়ে গেলাম একটি সজোরে গুঁতো। চুলবুলবাবুর গেঞ্জি জাগাতে পারল না শক্তির নতুন রূপ। যা বুঝলাম, গুঁড়ো সাবানের কাছে গেঞ্জি হোক বা সব্যসাচী, সবার দৌড় এক, সব শক্তি ধুয়ে বেরিয়ে যায় নর্দমা দিয়ে। তবে এই পুজোর সময়ে কেনা গুঁড়ো সাবানের প্যাকেটও লেখা ছিল যে, এই সাবানের গুণেও জেগে উঠবে শক্তির নব রূপ। মাঝে মাঝে ভাবি, পোস্তর পকেটেও যদি জেগে ওঠে শক্তির নতুন রূপ, তাহলে আর জিম, ব্যামসমিতি টাইপের জায়গাগুলোর উঠে যাওয়া উচিত । ভাবুন, ভাইরাসে আক্রন্ত হলেন, ভ্যাকসিনের দরকার নেই, কারণ পুজোর সময়ে কেনা পোস্তর প্যাকেটের শক্তিই আটকে দেবে ভাইরাসকে। যাই হোক, শক্তিরূপেণ গেঞ্জি পরার থেকে দাঁড়িয়ে কুলকুল করে ঘামা ঢের ভাল। অষ্টমীর দুপুরে হঠাৎ প্যান্ডেলের স্পিকারে, ‘ওরাই রাতের ভ্রমর হয়ে নিশিপদ্মের মধু যে খায়’ কেন বাজছে বুঝতে পারলাম না । ভেবে কাজ নেই, যা খুশি ওরা বলে বলুক, আমি কাউন্টারের প্রথম সারিতে পৌঁছে গেছি, ভোগের প্যাকেট নিয়ে এবার বাড়ির দিকে হাঁটা দেব।
কাউন্টারে যে-ছেলেটি সবার হাতে ভোগের প্যাকেট দিচ্ছিল, সে আমার হাতে প্যাকেটটা দিয়ে স্মিত হেসে অদ্ভুত একটা হাঁসজারু উচ্চারণে বলল, ‘আপনি লেটেস্ট প্রাসাদটা নিয়েছেন?’ আমি বুঝতে না পেরে বললাম, ‘ইয়ে, মানে না, আমি তো একটা ফ্ল্যাটে থাকি, মানে সেটা প্রাসাদ-টাসাদের মতো অত বড় একেবারেই… মানে একদম নরমাল!’ ছেলেটার মুখে অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি দেখে মনে-মনে ভাবলাম, কী জানি বাবা, আমাকে অন্য কেউ ভেবে ভুল করছে না তো! ইদানীং চলচ্চিত্র-জগতের সাথে যুক্ত কাউকে দেখলেই খুব সঙ্গত কারণেই সবার মনে হয় যে, তার একটা ছোটখাট প্রাসাদ আছে আর সেই প্রাসাদে ইডি কড়া নাড়ছে আর দিনরাত গান গাইছে ‘ওরে গ্রহবাসী’ থুড়ি ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল’। আমি আবার বললাম, ‘আপনি মনে হয় ভুল করছেন, আমি সে নই, আমি… আচ্ছা আপনি কী নেওয়ার কথা বলছেন বলুন তো?’ ছেলেটি জোরে-জোরে হেসে উঠে বলল, ‘আপনি হেব্বি ফানি আছেন, আমি বলছি মণ্ডপ থেকে ঠাকুরের প্রাসাদ (পড়ুন প্রসাদ) নিয়েছেন? দিস টাইম আমাদের কমিটি স্পেশাল প্রাসাদ আনিয়েছে, কো পাওয়ার্ড বাই হেলদি এন্ড টেস্টি লাভার’স হানি, ইসবার ভক্তি হোগা ডবল, একটা কিনলে একটা ফ্রি, একটা প্লেট নিয়ে দেখবেন না কি স্যার?’ আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘না থাক, আমি ডায়বেটিক ভাই, আজকেই ধরা পড়ল।’ ছেলেটি বলল, ‘ওঃ হাউ স্যাড, নো ইস্যুজ, তবে ভোগটা টেস্ট করবেন, ইট্স ভেরি হেলদি, এইটা স্পেশালি কুক করা বনানী এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল দিয়ে, একদম লো ফ্যাট।’ আমি প্যাকেটটা নিয়ে সবে বেরোতে যাচ্ছি, ছেলেটি আবার ডাকল, ‘ও, বাই দ্য ওয়ে, ডোন্ট ফরগেট টু ওয়াশ ইওর হ্যান্ড উইথ ফ্রেশ বয় সোপ, ভোগের প্যাকেটের নীচেই পাবেন, ভোগের সাথে ফ্রি, এনজয়!’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নামটা কী ভাই?’ ছেলেটি বলল, ‘মাই নেম ইজ, পৃথ্বীরাজ বটব্যাল। বাট বন্ধুরা আমায় ‘বট’ বলে, রোবটের শর্ট ফর্ম!’ এটা বলেই আঙুলে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করল, যার জ্যামিতি আমি বুঝতে পারলাম না। আমি মনে-মনে ভাবলাম, যাক বাবা, বটব্যালের শেষ অংশটার শর্ট ফর্ম বানায়নি! ছেলেটি প্রচণ্ড উত্তেজনায় হেসে বলল, ‘আসছে বছর?’ আমি খাবারের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে অলিভ অয়েলে তৈরি লো ফ্যাট খিচুড়ির কথা ভেবে ফ্যাকাশে মুখ করে বললাম, ‘আবার হবে?’
পাড়ার প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তা ধরে বাড়ির দিকেই হাঁটছি। আচ্ছা বাড়ির রাস্তার দিকে হাঁটছি তো? কিছু বুঝতে পারছি না। রাস্তার দু’ধারে উঁচু-উঁচু বাঁশের ভারায় শুধুই বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন খাচ্ছি, বিজ্ঞাপনে হাত ধুচ্ছি, স্নান করছি, বিজ্ঞাপনী কমোডে বসছি, নিজেও বিজ্ঞাপন সাজছি, কীরকম মনে হচ্ছে পড়ন্ত সূর্যটাও যেন বিজ্ঞাপনের অংশ, নিশ্চই কোনও ইলেক্ট্রিক বা লাইটের কোম্পানি স্পনসর করছে তাকে অস্ত যাবার জন্য, যাতে ঠিক সময়ে বিজ্ঞাপনী আকাশে জ্বলে ওঠে ঝিকিমিকি ডিস্কো বলের চাঁদ। আচ্ছা, আমরা সত্যি মানুষ তো? না কি বাঁদরের চোখের তারায় দেখা মানুষের বিজ্ঞাপনমাত্র? রাস্তার দিকে চোখ পড়ে মনটা একটু হালকা লাগল, রাস্তাজোড়া মন ভালো করা আল্পনা। আরও খানিকটা হাঁটার পর বুঝলাম যে, এ-গুড়েও বালি, এই আল্পনাও আসলে এক মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপনমাত্র। কেমন যেন রাস্তাজুড়ে এঁকে দিয়েছে মানুষের নিলামে চড়ার গতিপথ। সেই রাস্তা ধরেই এগোচ্ছি, হাঁটতে-হাঁটতে মনে হল কত মানুষ চলে গেলেন এই বছর যাঁরা কোনওদিন আর এই রাস্তায় হাঁটবেন না, তাদের মধ্যে এমন অনেককে চিনতাম যারা বেঁচে থেকেও কোনওদিন এই রাস্তার ধার ধারেনি। যেমন আমার দিদিমা।
দিদিমা যেদিন গা ভাসালেন, গঙ্গার স্রোতে সেইদিন ভোরে আকাশ ছিল নীল, আর তার গায়ে তুলোর মতো ছেঁড়া-ছেঁড়া অসংখ্য মেঘ। জানি, ভাবছেন এটা আর এমন কী দৃশ্য! আকাশ তো নীলই হয় আর মেঘ তুলোর মতো সাদা। হয়তো বোঝাতে পারব না, তবে সেদিনের ভোর ছিল অন্যরকম, সেদিনের আকাশের নীলটা ছিল গরমকালের ছুটির দুপুরে দাদুর বাড়ির লাল মেঝের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে দিম্মার কাছে শোনা রূপকথার আকাশের নীলের মতো। নরম মেঘগুলোর যেন ভেসে যাচ্ছে সাত ভাই চম্পার দেশে, এই বোধহয় মেঘের পাল্কির আড়াল থেকে উঁকি মারল রাজকন্যা। সেদিন ভোরে গঙ্গার ঘাটে সবাই এসছিল, লালকমল নীলকমল, শেয়ালপণ্ডিত, বুদ্ধু-ভুতুম, কিরণমালা, ব্রহ্মদৈত্য, আরও কতজন! ওরা সবাই মিলে নিয়ে চলে গেল দিম্মাকে, দূরে ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই দৃশ্য। পাশের গাছটায় চুপটি করে বসেছিল ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী। আমার মতো আজকে ওরাও ছিল নীরব দর্শক, তাকিয়ে রইল যতদূর চোখ যায়, দু’চোখ ভরে মাখল সেই নীল রং, তারপর উড়ে চলে গেল গাছটা থেকে, আর কোনওদিন ফিরল না।
কোনও এক দূরের স্মৃতির সিঁড়িতে দিম্মার কাছে চৌকাঠের বাইরে আল্পনা দেওয়া শিখতে-শিখতে শুনেছিলাম কৃষ্ণ আর সুদামার গল্প। কৃষ্ণের বাল্যকালের বন্ধু সুদামা যখন কপর্দকশূন্য অবস্থায় তার স্ত্রীর পরামর্শে দ্বারকায় যায় কৃষ্ণের সাথে দেখা করতে, তখন তার ঝোলায় ছিল তার স্ত্রীর হাতে বানানো কৃষ্ণের ছোটবেলার প্রিয় খাবার, কয়েকটা খুদের নাড়ু। দ্বারকার সুবিশাল ও জমকালো রাজপ্রাসাদে ঢুকে সুদামার মনে হয়, তার সেই ছোট্টবেলার রাখালবন্ধুকে এখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রাচুর্যের মাঝে তার খুদের নাড়ুগুলোকে বড় অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কৃষ্ণ তাকে জিজ্ঞেস করে, সে তার বন্ধুর জন্য সঙ্গে করে কোনও উপহার এনেছে কি না; লজ্জায় সুদামা প্রথমে কোনও উত্তর দিতে পারে না, তার পর কোনও রকমে তার কাছে তুলে দেয় সেই ঝোলায় বাঁধা খুদের নাড়ুগুলো। সুদামা অবাক হয় দ্যাখে, শত রাজভোগকে ম্লান করে তার খুদের নাড়ুগুলো পরম তৃপ্তিতে আস্বাদন করেছেন তার বাল্যবন্ধু। দিম্মা বলত, আমাদের বাড়তে থাকা দম্ভ ও হীনম্মন্যতাই আসলে দুর্গাপুজোর অসুর। ধর্মে কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক, আমাদের দুর্গাপুজো ছিল অনেকটা সেই খুদের নাড়ুগুলোর মতো, সামগ্রী যাই হোক না কেন, তাতে মিশে থাকত এক অনাড়ম্বর আনন্দ আর আর এক অদ্ভুত খামখেয়ালিপনা।
আরেকটু এগিয়ে ডানদিক নিলেই বাড়ি, বিকেল হয়ে এসেছে, আচ্ছা আজকে অষ্টমী তো? ভোগ নিলাম মানে তো তাই দাঁড়াচ্ছে, তবে পাড়ার মাইকে গানের সাথে-সাথে ঘোষণা চলছে যে, আর কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে বিসর্জনের তোড়জোড়! কী অদ্ভুত, তাহলে আজকে কি বিজয়া দশমী? কিন্তু সেটাই যদি হয়, তাহলে অষ্টমীর ভোগ এল কোথা থেকে? সব গুলিয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতর, অবশ্য যাবারই কথা। কারণ পুজো এখন শুরু হয়ে যায় খুঁটিপুজো থেকেই, তাই একটু খেই হারিয়ে ফেলেছি। আসলে এই মেগা কার্নিভালের বিপুল আনন্দের হাতছানি ভুলিয়ে দিচ্ছে চোরের মুখ, চুরি, খুন হওয়া স্বপ্ন, স্বপ্নে আশা লাশেদের, বন্দুকের বিস্ফোরণ, বিস্ফোরণে হারানো বাড়িঘর, সব… তাই আজকে অষ্টমী না দশমী সেটা গুলিয়ে যাওয়া আর এমন কিছু না!