ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • পরশমণি : পর্ব ৩


    সাগুফতা শারমীন তানিয়া (September 23, 2023)
     

    ১১.

    চোখে পড়বার কথা যখন উঠলই, তখন বলা যাক। যে ব্যারামকাঠি বাজারে সে একদিন পরোটা ভাজত, সেই বাজারে ইদানীং শিরোমণিকে নিয়মিত রুই-কাতলা-খাসির মাংস-গলদাচিংড়ি ইত্যাদি কিনতে হয় (লোকে গ্রামের সিনসিনারি ভালবাসে বটে, কিন্তু সঙ্গে ভালবাসে শহুরে সচ্ছলতা), বেছে বেছে ভাল আনাজ কিনতে হয় (কিনে বলতে হয়, ক্ষেতের ফসল), লোকের চোখ তো টাটায়। বাজারের যে অন্ধ বুড়ি ছেঁড়াআঁচল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে, যাকে কুকুর শুঁকে যায়, সে আর শিরোমণিকে নাতিজ্ঞানে তুই-তোকারি করতে ভরসা পায় না। অন্ধও টের পায় শিরোমণি দাসের গা দিয়ে ভুরভুর করে টাকার গন্ধ ছাড়ছে, বিলাইতি ডলার, মোহরের মতো ভার— যার একটির দাম একশো টাকারও বেশি।

    কে বলেছে পয়সা না থাকলেই কেবল পয়সার লোভ থাকে! পয়সা বাড়তে শুরু করলে পয়সার লোভ বাড়ে। লোভ বাড়লে তৈমুর হোসেনকে ওদের কেমন উৎপাতের মতো মনে হতে লাগল। সদাইপাতি করে সে, রাঁধে সে আর তার বৌ, ভিডিও এডিট করে তার ভাগ্নে রতন, রতন নিজেও মাঝে মাঝে ভিডিওর কাজটুকু করে— গাঙশালিকের হলদে ঠোঁটে ধরা ব্যাঙাচি, শালিকের ডানার মতো শ্লেটরঙা সন্ধ্যা, খেসারি কলাইশাকের সবুজ ক্ষেত, উঠানের সজনেগাছের ছায়া বরাবর লকলকে মোরগটার দৌড়, বিজন গ্রাম্য জঙ্গল আর মগ্ন আলপথ, নদীর পাড়ের কাছে পাখিদের হুটোপুটি করে গা ধোয়াধুয়ি…সেসবের পটভূমিতে মণিমামা আর মামীর চমৎকার গেঁয়ো রান্না। তৈমুর বরং পেট পুরে ভালমন্দ রান্না খায়, ভাগের অর্ধেক পয়সা নিয়েও যায়। রতন চালাকচতুর ছোকরা, সে-ই একসময় শলা দিল মামাকে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তো তারও রয়েছে, তৈমুরের কাছে পয়সা যাবারই বা দরকার কী! স্টুডিও রূপছায়ার তৈমুর হোসেনকে পরশমণির রান্নাঘর থেকে বিদায় করে দিল শিরোমণি, আসলে দিল পলারাণিই।  

    অপমানিত-বিরক্ত-ক্রুদ্ধ তৈমুর হোসেন শিরোমণির উপার্জিত টাকার পরিমাণ নিয়ে গল্প শুরু করল, যতটা সত্যের সঙ্গে মাপমতো মিথ্যা মিলালে তা দৈত্য বনে যায়, ততটা মিলিয়ে। প্রথম গল্প করল বিউটি শীলের কাছে। বিউটির কাছ থেকে পুরো ষোলআনির জানতে বাকি রইল না আর। মন্ডল ট্রেডার্সের সামনের চৌকিতে বসে সফদর বিহারি ঠা-ঠা করে হাসতে হাসতে তৈমুরকে জিজ্ঞেস করল, ‘তেরি বিল্লি তুঝেহি মিয়াঁও?’ উত্তরে তৈমুর কী বলল জানা যায় না। ‘মালু’রা ব্যাংকে টাকা না রেখে ঘরেই লুকিয়ে রাখে আর সোনা কেনে…যেন বিপদে পড়লে চট করে বর্ডার পাড়ি দেয়া যায়— এসব নিয়ে হাটের লোকে আলাপ চালিয়ে গেল। কেদারপুর থেকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মানুষ মুফতি আবুল আলা মোশাররফিকে ফেসবুকে প্রশ্ন পাঠাল— হিন্দুবাড়িতে চুরি-ডাকাতি করে যদি কোনও সম্পদ অর্জন করা হয়, সেই মাল (দ্বীনের) কাজে, ইসলামের কাজে ব্যয় করা হলে তা জায়েজ হবে কি না। মুফতি মোশাররফি হুজুর অবশ্য তার উত্তরে বলেন—  ‘মুসলিম দেশে অ-মুসলিমগণ আমানত, হালাল পয়সা ছাড়া হালাল কাজে ব্যয় করা অন্যায়, নাজায়েজ।’ 

    ১২.

    উপজেলার কুমারটুলি ষোলআনিতে একটি হিন্দু বাড়িতে লোমহর্ষক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এসময় ডাকাতের হামলায় কমপক্ষে পনেরো জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।  

    স্থানীয় সূত্র জানায়, সাত-আটজন মুখোশ পরা ডাকাতের একটি দল দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। তারা অস্ত্রের মুখে শিরোমণি দাস ও তার পরিবারের সদস্যদের মারধোরের পাশাপাশি গৃহকর্তা সোনামণি দাস ও তার নাতিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে। এসময় ডাকাত দলটি প্রায় দশ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, নগদ পাঁচ লাখ টাকা, মোবাইল সেট-সহ দুই লক্ষ টাকার মালামাল লুট করে বীরদর্পে চলে যায়।   

    ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে সহকারী পুলিশ সুপার বদিউজ্জামান জানান, খবর পেয়ে গতকাল সকালে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। কুমারটুলি থানায় একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে, মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ বাদী হবেন। এ ঘটনায় আহতদের মধ্যে রতন নামে এক ব্যক্তিকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সদর হাসপাতালের আইসিইউ-তে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

    ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান সজল জানান, গত সপ্তাহেও তাঁর ইউনিয়নে সনাতনপল্লীর সংখ্যালঘু ৬টি পরিবারে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। সপ্তাহ না পেরোতেই আবার সংখ্যালঘুর বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। ডাকাত দলকে ধরতে প্রশাসন তৎপর রয়েছে বলে কুমারটুলি থানার অফিসার-ইন-চার্জ (ওসি) জিল্লুর রহমান জানান।

    এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট ও হিউম্যান রাইটস্ কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিস (এইচআরসিবিএম) নেতারা উপর্যুপরি ডাকাতির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে দ্রুত, সময়ের মধ্যে মালামাল উদ্ধার ও জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়।

    ১৩.

    কেমন পুতুলখেলার মতো ছোট ছোট ওদের চায়ের কাপ-পিরিচ, ছোট ছোট বাটিতে বেঁটে দেয়া তরকারি, অপরিসর ঘর, তেমনি সংকীর্ণ মন পিসিদের, সে মনের নাগাল পেল না শিরোমণি। সে আর পলারাণি যে ইউটিউবে রান্না দেখাত, জিনিসপত্র বেচবার বিজ্ঞাপন দিত, লাখ লাখ লোক দেখত, ওসব তো পিসিরা জানতেই পারেনি। বড়জোর জানে— শিরোমণি তাদের ভাইয়ের একটিমাত্র ছেলে, অকম্মা-গোছের, মাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়, পরে অর্থাভাবে আর পরীক্ষা দেয়া হয়নি তার, হোটেলে রেঁধে আয়-রোজগার করত…এদিকে নাম তার ‘শিরোমণি’। অমন কুটুমের তোয়াজ হয় নাকি! পিসেমশাই রাধাপদই বরং খেতে বসে সেধে সেধে খাওয়াল—  আরেকটা মাছভাজা নাও, আলুটা নাও, লজ্জা কোরো না, আর দুটি ভাত, দইটা খাও, মহেশতলার দই। খিটখিটে পিসিরা চেয়ে চেয়ে দেখল, তাদের ভাইপো শিরোমণির পাতলা শরীরে বামুনদের মতো ফোলা ফোলা ভুড়ি হয়েছে, বৌ পলারাণির সরুপানা চোয়াল-টোয়াল ভরে এসেছে, তলপেটে চর্বি, বঁটির সামনে উঠতে বসতে গিয়ে হেসে ফেলে। কাঁচা পয়সা হাতে এসে ওদের জীবন বদলে গেছিল, এখন আর শরীরের অত পরিশ্রম ওদের সয় না। পিসিরা এখানে বিয়ে হয়ে এসে ইস্তক কত কষ্ট করেছে, বিড়ি বেঁধেছে, ধান ভেনেছে, আলুর গুদামে পচা আলু বেছে তুলেছে— কয়েক বেলা ওসব গল্প শুনল সে আর তার বৌ, শুনতে শুনতে আড়ালে নিজেদের নিয়ে কেমন একরকম ক্লান্ত গরিমায় ভরে উঠল ওদের মন। তারপর মনে পড়ল, ওসব অতীত হয়ে গেছে, এখন স্বামী-স্ত্রীর আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে।  

    দেশ ছেড়ে এসে প্রথম সন্ধ্যায় রঘুনাথপুরে দিনমণি পিসির মাটির দাওয়ায় চিত হয়ে শুয়ে শিরোমণি দেখেছিল ইন্ডিয়ার অন্ধকার আকাশে একে একে তারা ফুটছে, পাড়াগাঁয়ের বাতাসও যেন অন্ধকার, সেই অন্ধকার বাতাসে কান পেতে সে শুনেছিল তারাদের মতো করে এক গাছ থেকে আরেক গাছে জুড়ে যাচ্ছে ঝিঁঝির ডাক। যেমন করে একেক পয়সা জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছিল তার সোনার ভবিষ্যৎ। একদিনে কি আর হয় অমন! পিসেমশাই বলেছিল, ‘ধরে নাও এইবার দেশে ফিরলে, আর ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না!’ শিরোমণি ও-কথায় মাধ্যমিক-ফেল ছাত্রের মতো চেয়ে ছিল। জন্মে ইস্তক ঘর বলতে সে চেনে ষোলআনিতে তার সামান্য ভিটেমাটি, একটিমাত্র সদর, একটিই খিড়কি। দেশ বলতেও ষোলআনি গ্রাম আর পাশের ঘুমটি নদী। তাদের বাঁশবন, আম-কাঁঠাল-সুপারির গাছ, আঙিনায় ঝনঝনে লাল লঙ্কাগাছটা— কী ঝাল তার, কী স্বাদ ঝোলে! হনুমানে হুপহাপ করে এসে আঙিনার বেগুন খেয়ে নিত। আম আঁটি শানে ঘষে বাঁশি বানাত মামা-ভাগ্নে, পাছপুকুরে মা-মরা রতন ভাসাত সুপারির ডোঙা— আহ্‌ রতন আর নাই! বাবা সোনামণি দাস নাই! চোখ ফেটে জল আসছিল তার, পিসি বরং উসকে দিল চোখের জল, ‘ক্যান আসলু বাবা, এটে যা রুজি অটেও তাই! না পারমিন জু্মিজোমা কিনবা, না পারমিন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলবা! উন্য রাজ্যোত গেলে অবশ্যো ভিন্নো কথা।’

    পিসেমশাই বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘মেয়েমানুষের বুদ্ধি! খবর তো আর দ্যাখো না একবেলা! নতুন আইনের আওতায় বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবে শোনোনি? আর ভোটার কার্ড রেশনকার্ড সবই জুটে যাবার বন্দোবস্ত আছে, চিন্তা কোরো না! জেলে পুরবে না!’

    এবার পিসির মাতৃশোক উথলে ওঠে, ‘আসলু তো বাপধোন, হামাকেরে মাওক লিয়া আসলু না ক্যা!’

    বিরাজবালা ছেলের সঙ্গ ধরেছিল, কিন্তু ঠাকুরমা কিছুতেই পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছাড়ল না। ‘অ বুড়ি, তোক খাবা দিবে কে? চোকে দ্যেকিস না, হাঁটপ্যা গেলে আছাড় খায়ে পড়িস, অ বুড়ি তোক আপোদ বিপদে দেখপে কে?’

    কিছুই শুনল না, কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে পড়ে রইল, যুগীকাকিমা এসে বলল, ‘হামরা আচি, হামরাই কাকিকে দ্যাকমো হিনি!’       

    জ্যান্ত বাছাগুলোকে একটু আড়াল করে শেয়ালনি নিজের মরা বাচ্চার মড়াটাকে বিষণ্ণমুখে নিজেই খাচ্ছিল, রোদের রঙ তখনও চড়া হয়নি, সেই অবিশ্বাস্য ক্ষুন্নিবৃত্তির দৃশ্য দেখে ফিরে আসতে আসতে শিরোমণির মনে হয়েছিল, তাকে একটা মরা শেয়ালশাবকের মতো ছিঁড়ে খাচ্ছে কে? তার জন্মদাত্রী দেশ?

    ১৪.

    রঘুনাথপুরেও আর সব আছে, চিরচেনা সেই বর্ষাভেজা কাদামাটির রাস্তা, দু-ধারে ধানচারা গজানো বীজতলা, রেল ওভারব্রিজ, ক্যানেলের ঘোলা জল, তীরে তীরে ঘাসঝোপ আর দানা খেতে আসা তিলা মুনিয়া। শ্মশানকালী মন্দির। গাঙের ধারে দোকানের চালাঘরের সামনে চা খাওয়ার কাঠের বেঞ্চি। ঘুরেফিরে তবু বুকের জ্বালা নিভল না তার। সে তো গরিবই ছিল, আজন্ম। তবু যেন একটা স্বপ্নরাজ্য ছিল তার, ডুব দিয়ে উঠলেই সামনের দিনগুলো রঙিন মনে হতো, গত কয়েক বছরে সেই স্বপ্নরাজ্য আপনা থেকেই ধরা দিয়েছিল তার জীবনে, রাজত্ব ফেঁদে বসেছিল সে, আজ সেই রাজ্য থেকে উৎখাত হবার অনুভূতি ছাড়া সে আর কোনও সাড়া পেল না, অপমানে হয়রান একটা অনুভূতি, নিঃস্ব হবার অনুভূতি। পরিচিতের হাতে, ডাকাতের হাতে, থানা-পুলিশের হাতে, হাটখোলা বর্ডারের দালালের হাতে। ডাকাতি হবার পরও তো দেশ ছাড়তে চায়নি সে, রতন আর বাবু মরবার পরেও নয়, অশান্ত মনে ঘুরে বেড়াত— তখনও নয়। এরপর আসল উড়ো চিঠি, পলারাণিকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার হুমকি। কখনও তার মনে পড়ে ঘুমটির চরের ভেতর গেল মাঘ মাসে শেয়াল গর্ত করেছিল, চার পাঁচটা বাচ্চা। সবক’টা বাঁচেনি। জ্যান্ত বাছাগুলোকে একটু আড়াল করে শেয়ালনি নিজের মরা বাচ্চার মড়াটাকে বিষণ্ণমুখে নিজেই খাচ্ছিল, রোদের রঙ তখনও চড়া হয়নি, সেই অবিশ্বাস্য ক্ষুন্নিবৃত্তির দৃশ্য দেখে ফিরে আসতে আসতে শিরোমণির মনে হয়েছিল, তাকে একটা মরা শেয়ালশাবকের মতো ছিঁড়ে খাচ্ছে কে? তার জন্মদাত্রী দেশ?

    খরার আকাশ, সিলভার কাপের মতো ঝলসাচ্ছে রুপালি চাঁদ। পিসিদের ঘরগুলো এত গায়ে-গায়ে। পাশের ঘরের বাচ্চাদের কান্না-চটাশ চটাশ মশা মারার শব্দ-নিচু গলার আলাপ, সবই শোনা যায়। প্রথম রাত থেকেই দমবন্ধ হয়ে আসছিল তার। দ্বিতীয় রাতে পলারাণি ফিসফিসিয়ে কদর্য গালি দিল তাকে, মনে করিয়ে দিল, এখন থেকে, আজ থেকে শুধুই অবনত-মস্তক মৌনতা। মিইয়ে যেতে যেতে কী হল তার! ক্ষিপ্ত উলঙ্গ শিরোমণি কাদায় শোলমাছের মতো ঘষটে ঘষটে স্ত্রীর শরীরে ঢুকে গেল। দুটো দীর্ঘদিন বিবাহিত মানুষ শেকলে ঝোলানো তালার মতো, আলগা, ঝুলন্ত, কিন্তু বাঁধা। মানুষে মানুষে তেমন কোনও বন্ধন আসলে তৈরি হয় কি? ওরকম কোনও মানবিক বন্ধনের আশায়, অন্বেষণে কি না শিরোমণি স্ত্রীকে সে রাতে কিছুতেই ছাড়ল না। স্বামীর এমন পাষণ্ড ধর্ষকের মতো ব্যবহার পলারাণি কখনও দেখেনি। সে গুনগুন করে কাঁদল বহুক্ষণ। পরে ভোরের দিকে ঠান্ডা বাতাসে জুড়িয়ে গেল তার শরীর, ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে দেখল, ঝড়বৃষ্টির পরের সকাল কেমন পরিচ্ছন্ন মলিন রিক্ত, যেন বহু কিছু ধসে গেছে, বয়ে গেছে— উড়িয়ে নিয়ে গেছে তাদেরকে বাতাস, নিরাত্মীয় বান্ধবের মতন। এখানেও আঙিনায় সজনেগাছ আছে একটা— ফিঙেপাখি এসে কর্কশ ডাক ছাড়ছিল, গা-কেমন করে উঠল তার। নতুন জল পেয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি কাঁচা সবুজ পাতা গজিয়েছে গাছে, গাছতলায় কালো কাদামাটিতে শামুকে শামুকে জোড়া লেগে মাংসল কুস্তি লড়ছে।       

    ১৫.

    আজ আবার ক্যামেরার সামনে শিরোমণি দাস। আসলে দুঃখের দিনে সবচেয়ে বিপদের ব্যাপার হল মনে দুঃখকষ্টের কথাগুলো চেপে রাখা দুষ্কর, ওসব যেন নাড়ি উগরে বের হয়ে আসে। দেশ ছাড়বার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠতে উঠতে একদিন জুটমিলের ময়দানে বসে পিসতুতো ভাই তপনকে নিজের গল্প করেই ফেলেছিল শিরোমণি। তপন খানিকটা রাধাপদ পিসেমশাইয়ের ধাত পেয়েছে, হাসিখুশি, খোলামেলা, সাহায্য করতে ভালবাসে। দাদার শীর্ণ মুখের দিকে চেয়ে তার মায়াই হচ্ছিল, সেই বলেছিল, ‘ওরম আবার শুরু করো না তুমি! আমি তোমায় ব্যবস্থা করে দেব, যদ্দিন না তুমি নিজে শিখে নিচ্ছ, তদ্দিন আমায় কিছু টাকা দিও, তাহলেই তো হলো! রান্নায় একটু মিষ্টি দেবে, তোফা হবে…আর, আর মা-কে জানিও না।’  

    আজ সে আর তার বৌ বানাচ্ছে পুরি আলুর তরকারি, ছোলার ডাল। পেছনে তালগাছতলায় ভেবিয়ে ডাকছে ছাগলছানাগুলো। বহুকাল আগে মরা শামুকের মতো ঠনঠনে শাদা বাদুলে মেঘ আজ আকাশে। তপনের ক্যামেরায়— শিরীষগাছের শুঁটিঝনঝনে ডালে গ্রামীণ রোদ, কাঁচাহলুদ রঙ। খরাসহিষ্ণু সজনেগাছটায় সত্যি আগের মতো কুহু ডাকছে একটা পাগলা কোকিল, এ অসময়ে। শিরোমণির ভিউয়ার্সরা কেউ কি বুঝছে— পেছনের গ্রাম, ছাগলের ডাক, তালগাছ বদলে গেছে? কোকিলটাই শুধু যেন রাজসাক্ষী, যে জানে কী হয়েছে, ডেকে ডেকে লোক জড়ো করে পাখিটা যেন বলতে চাইছে অনেক কিছু বদলে গেছে, এ গ্রাম সে গ্রাম নয়, এ দেশ সে দেশ নয়। খড়ির আগুনের তাপে চোখ জ্বলছে শিরোমণির। যেন আগুনের ধোঁয়ার ওপারেই বসে আছে অন্ধ বুড়িটা, বুকটা মাছের ডিমগুচ্ছের মতো নেতিয়ে রয়েছে জীর্ণ পেটে-কোলে, নিশিন্দা ঝোপের দিকে চেয়ে চেয়ে কাকে যেন বলছে— ‘লুচির কাঁইত দিবা যুয়ান কালোজিরা আফির শুকনাঝালের গুঁড়া- তাহোলেই হ্যবে মশল্লা লুচি!’… ঠাকুরমা বলত, ‘সব্বোদা নাম ক্যরমিন, নাম বিনে শান্তি আসে না।’ শিরোমণি চোখের জল চেপে খামির দলে আর তৎপর হাতে পুরি ভাজে, মনে মনে নাম ধরে ডাকে নিজের গ্রামকে। ষোলআনি গ্রাম। ষোল আনা রেখে দিল যে।

    (সমাপ্ত)

    কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ফরিদুর রহমান

    ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook