এশিয়ান গেমস ব্যাপারটার সঙ্গে খেলাপ্রেমী বাঙালির নাড়ির টান, সেকথা বলা যায় না। চার বছরে একবার হয়। দেশ থেকে ঝাঁক বেঁধে খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের যেতে দেখা যায়। মেডেলজয়ীরা মনে থাকেন কয়েকদিন। বাংলার হলে, কিছুদিন বেশি। তারপর মূলত ক্রিকেট-ফুটবল, সঙ্গে খানিকটা টেনিস ও অলিম্পিক্স। এর বাইরে খেলার জগতে কোথায় কী হচ্ছে, আমাদের হেলদোল বিশেষ নেই। এশিয়ান গেমসও সেই দুয়োরাণি গোছের।
চিনের হ্যাংঝোউ শহরে এই খেলার আসরের ১৯ নম্বর সংস্করণ। সেপ্টেম্বর ২৩ থেকে অক্টোবর ৮। ভারত থেকে কোচ-ম্যানেজার ধরে ৯২১ জনের দল। অ্যাথলিট ৬৫৫। এশিয়ান গেমসের জন্য এতজনের নাম আগে ঘোষণা করা হয়নি। প্রত্যাশাও দলের মতো বিশাল। ২০১৮-য় এসেছিল ৭০টা মেডেল। ভারতের জন্য রেকর্ড। এবার লক্ষ্য তার বেশি এবং জল্পনা ভিত্তিহীন নয়। আগে কলকে জুটত না, কিন্তু এখন ভারত সামনের সারিতে, এমন খেলার সংখ্যা বাড়ছে।
ব্যাডমিন্টন, কুস্তি, বক্সিং, শ্যুটিং, ওয়েটলিফটিংয়ে এসেছে অলিম্পিক এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ পদক। দেখা গিয়েছে ধারাবাহিকতা। উঠে এসেছে নতুন মুখ। মহিলা-পুরুষ হকি দলের পালে লাগা নতুন হাওয়ার কথাও বলতে হবে। তিরবেগে না হলেও, সব মিলিয়ে অগ্রগতি চোখে পড়তে বাধ্য। তাক লাগিয়ে দিয়েছেন জ্যাভলিন তারকা নীরজ চোপড়া। যা ধরছেন, সোনা হয়ে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য সাফল্যের তালিকা। তাঁকে দেখে উজ্জীবিত ট্র্যাক-অ্যান্ড-ফিল্ড অ্যাথলিটদের দল। বিতর্ক, খেয়োখেয়ি, কোর্ট-কাছারি সত্ত্বেও, এতগুলো অলিম্পিক ইভেন্টে এমন সময় ভারতের ইতিহাসে আসেনি। হ্যাংঝোউয়ে মেডেল ৭০ ছাড়ালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
তবে তার মানে এই নয়, বাংলার প্রতিনিধিরা প্রথম দিকে থাকবেন। এশিয়ান গেমসে মেডেল জেতায় প্রায় চিরকাল তৃতীয় বা চতুর্থ সারিতে রাজ্যের ছেলেমেয়েরা। এইবার ৬৫৫ জনে আছেন মেরেকেটে ২০। গতবার হেপ্টাথলনে সোনা জিতেছিলেন স্বপ্না বর্মণ, ব্রিজে ‘পেয়ার’ বিভাগে প্রণব বর্ধন ও শিবনাথ দে সরকার। স্কোয়াশ তারকা সৌরভ ঘোষাল পেয়েছিলেন সিঙ্গলস ও টিম বিভাগে ব্রোঞ্জ। ব্রিজে পুরুষ ও মিক্সড টিমে ব্রোঞ্জজয়ী দলে ছিলেন বাংলার তিনজন। সব মিলিয়ে মেডেলের সংখ্যা ছয়। ২০১৪-য় ছিল চার, ভারতের ৫৭। সোনাজয়ী দলে সৌরভ, ব্যক্তিগত রুপো। আর্চারিতে তৃষা দেবের ব্যক্তিগত ও টিম ব্রোঞ্জ।
এইবার দাবিদার বলতে, শ্যুটার মেহুলি ঘোষ, হেপ্টাথলিট স্বপ্না বর্মণ, স্কোয়াশে সৌরভ ঘোষাল, ক্রিকেট দলে রিচা ঘোষ, তিতাস সাধু। গল্ফে অনির্বাণ লাহিড়ী, শিবশঙ্কর প্রসাদ চৌরসিয়ার নামও যোগ করা যেতে পারে। জিমন্যাস্ট প্রণতি নায়েক কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ব্রোঞ্জ পেয়েছেন। ব্রিজ দলে আছেন সুমিত মুখার্জি। তবে মনে রাখতে হবে, স্বপ্না ও সৌরভ জাতীয় পর্যায়ে অন্য রাজ্যের হয়ে খেলেন, অনির্বাণ কোনও দিনই বাংলার বাসিন্দা নন। এঁরা ছাড়া, ভিকট্রি স্ট্যান্ডে অন্য কেউ জায়গা পাবেন, জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। অতএব খুব বেশি হলে, বাংলার প্রাপ্তির ভাঁড়ারে থাকবে সেই পেনসিল।
কারণ অনেক। আগ্রহ থাকলেও, দেখা বা আলোচনা করা ছাড়া খেলার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কম। শহরের দিকে বাচ্চাদের স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে মাঠে নামার পাট চুকেছে বহুদিন। মাঠই তো সেই কবে রূপকথার অংশ হয়ে গিয়েছে! কারও ক্ষেত্রে জোটে কোচিং সেন্টার যাওয়ার সুযোগ। তবে সেইগুলোও হরেদরে স্কুলের পর আরেকটা স্কুলের মতো। খেলা শেখার পরিবেশ হয়তো আছে, খেলায় মজে যাওয়ার সম্ভাবনা ততটা নেই। নতুন প্রজন্ম মাঠে নেমে ছোটাছুটি বন্ধ করে দিলে, খেলোয়াড় আসবে কোথা থেকে? কলকাতার হয়েছে সেই দশা।
ফলে, বাংলার খেলা জেলায় সীমাবদ্ধ। এশিয়ান গেমসে সফল বাঙালিদের মধ্যে সিংহভাগের উঠে আসা কোনও না কোনও গ্রাম থেকে। জ্যোতির্ময়ী শিকদার, সরস্বতী সাহা, সোমা বিশ্বাস থেকে হালফিলের স্বপ্না, কেউ ব্যতিক্রম নন। পশ্চিমবঙ্গে খেলোয়াড়দের সুযোগসুবিধে বিশেষ নেই বলে, অনেকে ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ ও অন্যান্য রাজ্যের হয়ে খেলেন। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মেডেল জিতলে, সেখানে মেলে জুতসই আর্থিক পুরস্কার। সাফল্য বড় হলে, পাওয়া যেতে পারে চাকরি বা কম দামে জমিও। তুলনায়, বাংলায় প্রায় কিছুই দেওয়া হয় না। অন্য রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এমন খেলোয়াড়দের ভাষায়, এখানে জোটে দু’গাছা শুকনো ফুল!
খেলার জগতে ভারতের উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নেমেছে রাজ্যে খেলার মান। এককালে প্রায় এগারো, এখন ফুটবল দলে বাঙালির সংখ্যা হাতেগোনার থেকেও কম। এশিয়ান গেমস দলেও শিবরাত্রির সলতে ইছাপুরের রহিম আলি। ক্রিকেটে এই মুহূর্তে শূন্য। টেবল টেনিসে দেশ শাসন করত বাংলা। এখন পুরুষ দলে জায়গা হয় না কারও। মহিলা দলে সাকুল্যে দু’জন। বেশিরভাগ দলে বাংলার প্রতিনিধি শূন্য। জাতীয় পর্যায়ে মনে রাখার মতো কিছু করছেন, এমন খেলোয়াড় দূরবিন দিয়ে খুঁজতে হয়। যে কোনও খেলায়। স্বপ্না, মেহুলি বা দু’চারজন ব্যতিক্রম। এঁদের সাফল্য রাজ্যের ক্রীড়াবিভাগ বা অন্যান্য দপ্তরকে উৎসাহিত করেনি অ্যাথলিটদের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে। চাকরি বা আর্থিক পুরস্কার শুধু সফল খেলোয়াড়দের চাঙ্গা করত না। উঠতিদের কাছে বার্তা যেত, খেলাধুলো করলে এই রাজ্যেও উন্নতির সম্ভাবনা আছে।
হয়েছে ঠিক উল্টো। বাংলায় খেলে সচ্ছল জীবন তো দূরের কথা, ভাত জুটবে কি না ঠিক নেই। হরিয়ানা, কেরল বা তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে অনুদান, পুরস্কার, উৎসাহ ইত্যাদি পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। প্রতিভা খুঁজে তাদের কোচিং, প্র্যাকটিস, পুষ্টিকর খাবার এবং অল্প পরিমাণে স্কলারশিপ দেওয়া হয় ছোট বয়স থেকেই। সরকারি ও বেসরকারি, দু’তরফেই মেলে সাহায্য। বাংলার ছেলেমেয়েরা জুনিয়র পর্যায়ে আরম্ভই করে এইসব জায়গার ছেলেমেয়েদের থেকে পিছিয়ে। বিশেষ করে খেলার ক্ষেত্রে, গলদ যদি গোড়ায় হয়, শোধরানো মুশকিল। ব্যবধান বাড়তেই থাকে। এই সমস্যা বোঝার মানুষ আছেন কিন্তু অভাব সমাধান খুঁজবেন এমন ব্যক্তির। তাই বাংলার খেলা তলানিতে ঠেকলেও, করার কিছু নেই।
অতঃকিম? মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ডার্বি আবার জমে উঠবে মনে হচ্ছে। অনেকদিন ধরে রাজ্যের খেলার মতো নীচের দিকে যাচ্ছিল লাল-হলুদ। এই মরশুমে ছবি পালটানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সামনেই ইন্ডিয়ান সুপার লিগ। বড় ম্যাচে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ভিড় উপচে পড়বে নতুন উদ্দীপনায়। যদিও দু’দল মিলিয়ে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা খুব বেশি হলে পাঁচ, তাতে কিছু যায় আসে না। আবার দুর্গাপুজোর হপ্তাদুয়েক আগেই শুরু ঘরের মাঠে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। চলবে কালীপুজোর পর পর্যন্ত। ইডেনে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা, সেমিফাইনাল সমেত পাঁচটা ম্যাচ। আর পায় কে! কোহলি, বুমরাদের নিয়ে রমরমিয়ে কাটবে সময়। এশিয়ান গেমসের প্রাক্কালে বৃষ্টিভেজা এশিয়া কাপ ক্রিকেটেই নজর রেখে তার মহড়া সারা। হ্যাংঝোউ তাই খায় না মাথায় দেয়, কী আসে যায়!