ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অস্পষ্ট আলোর দেশে


    সাজ্জাদ শরিফ (August 26, 2023)
     

    কবিতা লেখার প্রক্রিয়া দুর্জ্ঞেয়। রোলাঁ বার্থ লিখেছিলেন, সাহিত্য রচনার মুহূর্তে রচয়িতার মৃত্যু ঘটে। সেই মুহূর্তে যিনি লিখছেন, ব্যক্তি হিসেবে তিনি তখন অবলুপ্ত; যাঁর উদ্ভব ঘটেছে, তিনি আর সেই ব্যক্তিটি নন। সেটি আলো-আঁধারিতে নিমজ্জিত অন্য এক সত্তা। যাঁরা লেখেন তাঁরা জানেন, এমন মুহূর্তের মুখোমুখি বার বারই তাঁদের পড়তে হয়। দুর্জ্ঞেয়কে ভাষার ফাঁদ পেতে ধরতে গিয়ে তারা এরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। ভাষার অচেনা বিন্যাসে দুর্জ্ঞেয়কে ধরাই তো কবিতার কাজ!

    এই সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়া যেন এক বিভাজকরেখা। রেখার একদিকে সেই মানুষটি যিনি আর দশটি মানুষের মতোই নিতান্ত সাধারণ একজন ব্যক্তি, আরেকদিকে রচনায় লিপ্ত এক রহস্যময় আগন্তুক। রচনা-মুহূর্তে ব্যক্তিটি সেই আগন্তুকের বাইরে মৃতবৎ পড়ে থাকে। অচেনা আগন্তুক সেই ব্যক্তির কাঁচা আবেগ, পাপ-পুণ্য, উদ্দীপনা ও বিমর্ষতা, আনন্দ-ব্যর্থতা-গ্লানি-সহ জীবনের সব উপাদান নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করেন, বেশির ভাগটাই সেই ব্যক্তির সচেতনে নয়। সেই সাধারণ ব্যক্তিটির পক্ষে তাই এই আগন্তুকের মন উদ্ঘাটন করা অসম্ভব।

    কোনও কবি যখন তাই নিজের কবিতা নিয়ে কথা বলেন, তাঁকে বলতে হয় সেই কবিতার বহিরাগত হিসেবেই। অন্য পাঠকের চেয়ে তাঁর সামান্য একটু বেশি সুবিধা এটুকুই যে, তিনি ব্যক্তি হিসেবে সেই রচয়িতার কিছুটা বেশি ঘনিষ্ঠ। সে-কারণে অন্য যে কারো চেয়ে জানার দাবিটা তিনি বেশি করে করতে পারেন। তবে তাঁর সব কথাই যে ধোপে টিকবে, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।

    কবি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্ট্রিপার। যাঁরা স্ট্রিপটিজ করেন, একের পর এক বস্ত্র ছাড়তে-ছাড়তে তাঁরা বড়জোর নিজেদের নগ্নদেহটুকুই স্পটলাইটের নীচে উন্মোচিত করতে পারেন। নির্বস্ত্র শরীরই তাঁদের সর্বশেষ প্রদর্শন-সীমানা। কবি এগিয়ে যান আরও গভীরে। শরীরের আবরণ উপড়ে ফেলে নিজের নগ্ন আত্মাকে তিনি বের করে আনেন; সূর্যের প্রখর আলোর নীচে তা মেলে ধরেন অকুণ্ঠভাবে। ভাষার অচেনা পরিধিতে আবেগের চাপে তখন থরথর করতে থাকে ভাষা। ভাষার আবরণও তখন খসে পড়েছে। কারণ অর্থের মোড়ক খুলে বাইরে রেখে শব্দকে কবিতায় প্রবেশ করতে হয়। কবিতা ভাষার রতিময় অবস্থা। কবিতা কবি আর ভাষার যৌনতার শিল্পকলা। কবির নগ্নতার শেষতম সীমানা তাই কবিতা। এর বাইরে কবির কাছে আর কী উন্মোচন করে দেখানোর থাকতে পারে?

    কবিতা একইসঙ্গে আবেগের জননী ও সন্তান। আবেগই সেই কারণ, যার মধ্য দিয়ে কবির সঙ্গে বিষয়ের নিবিড় একাত্মতা ঘটে। বিষয়ের সঙ্গে সেই সংযোগ যুক্তি ও বুদ্ধির মধ্যস্থতায় ঘটে না। ঘটে এক আবেগময় প্রত্যক্ষ সংযোগে। এই সংযোগে কবিতার ভাষায় যা ঘটে, তা জটিলতম রহস্যময় কাহিনির চেয়েও দুর্গম। সেই আবেগের দূতিয়ালিতে যে-কবিতা রচিত হয়, সেটি নিছক একটিই মাত্র আবেগ নিয়ে সব পাঠকের কাছে পৌঁছয় না। এমনকী একই পাঠকের কাছেও নানা সময়ে আবেগের নানা তারতম্যে তা ধরা দেয়। কেন এমন হয়, সে-রহস্যের সন্ধানে শিল্পতাত্ত্বিকেরা বহু যুগ ধরে বিচিত্র তত্ত্বকথা বলছেন। কিন্তু রহস্যের উদ্ঘাটন হয়নি।

    আবেগে বিদ্ধ হওয়ার পর থেকে কবিতা রচিত হয়ে ওঠা পর্যন্ত পুরোটা ভ্রমণপথ কবির কাছে স্পষ্ট থাকলে প্রতিটি নতুন কবিতার রচনা-মুহূর্তে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত হতে হত না। ভ্রমণপথের এই আবছায়াই হয়তো তাঁকে নতুন ভ্রমণপথের অভিযানে ছুটিয়ে নিয়ে মারে।

    নিজের কবিতার পথও আমার কাছে কুজ্ঝটিকাময়। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন পথে আমি প্রবেশ করেছি এক নির্জন কিন্তু কৌতূহলী পর্যটকের মতো। সেখানে প্রগাঢ় কুয়াশার ফাঁকফোকরে কোথাও চোখ চলে না, আবার পরিব্যাপ্ত অস্পষ্টতার মধ্যে হঠাৎ আভাস দেয় অপূর্ব কোনও ছিন্ন দৃশ্য। সেই আবছায়া ভ্রমণপথের, সেই অস্পষ্ট আলোর দেশের কিছু ছেঁড়াখোঁড়া স্মৃতির মালা গাঁথার চেষ্টা করা যাক। তার মধ্যে কবিতার পটভূমির কিছুটা খোঁজ পাওয়া যেতে পারে হয়তো। কিন্তু কবিতার অন্তিম খোঁজ তো কবিতারই ভেতরে।

    ১.

    পৃথিবীর ত্বক ঘেঁষটে

    চলছে যে কেঁচো তার স্পর্শই জগৎ

    কেঁচোর রহস্যে স্থির মাটির ওপরে

    ভাঙা শশব্যস্ত পথ, তাতে কলা বেচতে বেচতে রথ

    দেখতে দেখতে খুঁজি সিঁড়ি

    আকস্মিক অন্ধকারে, পিচ্ছিল ধাঁধায়

    ওপরে রেলিংয়ে ঝুঁকে নাড়ু খাচ্ছে উদাসী কিশোর

    মেঘ থেকে মেঘে ওড়ে কাক

    নাড়ু ও কেঁচোর দিকে দ্বিধাগ্রস্ত দু চোখে তাকায়

    সবার ওপরে ন্যস্ত মহাকাশ

    স্তব্ধ, অসহায়

    (‘রঙ্গমঞ্চ’)

    এক নতুন অভিজ্ঞতায় ভরে উঠল আমাদের জীবন, ২০০১ সালে। আমাদের প্রথম সন্তান শ্রেয়া শময়িতার জন্ম হল। ওর সব কিছুতেই আমাদের আনন্দ। তবু গোসল করাতে নিয়ে ওকে যখন চেপে ধরে রাখি শরীরের সঙ্গে, যখন আদুর গায়ে ও উঠে আসে আমার শরীরের ওপরে, সে-আনন্দের কোনও সীমা থাকে না। নিজের শিশুসন্তানের তুলতুলে শরীরের উষ্ণতা মিশে যাচ্ছে আমার উষ্ণতায়। ত্বকের সঙ্গে ত্বকের শুধু স্পর্শ নয়; স্পর্শের এই বিদ্যুতে আমার সত্তার গভীরে মিশে যাচ্ছে আমার মেয়ের সত্তা, অব্যক্ত আবেগে। স্পর্শেই রচিত হচ্ছে মনের নৈকট্য। অথবা, হয়তো, স্পর্শই নৈকট্য।

    মেয়ের সঙ্গে এই অভিজ্ঞতার টান আমার কল্পনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল পৃথিবীতে প্রাণ স্ফুরিত হওয়ার অস্পষ্ট অলৌকিক সেই মুহূর্তগুলোয়। ত্বকই তো ছিল প্রথম স্ফুরিত প্রাণের আদি ইন্দ্রিয়। বিশ্বে জেগে ওঠা আদিতম এককোষী প্রাণ অ্যামিবার ছিল শুধু ত্বকের এক আবরণ। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে ত্বকই তার একমাত্র যোগাযোগের পথ। স্পর্শই প্রাণের প্রাচীনতম অনুভূতি। প্রাণ কতভাবে বন্ধুর পথে বিবর্তিত হতে-হতে যে পৌঁছাল মানুষ অব্দি! আর প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া করতে-করতে, সুদীর্ঘ পথে, এল একের পর এক আরও সব ইন্দ্রিয়। বিভিন্ন কালপর্বে প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়ার তীব্র চাপে ত্বকই বিকশিত হয়ে ধীরে-ধীরে রূপান্তরিত হল কানে, নাকে, চোখে, জিভে। সব ইন্দ্রিয়ই ত্বকের সম্প্রসার।

    আমার মেয়ের সঙ্গে আমার স্পর্শের সরল আনন্দের পথ ধরে ইতিহাসের সেই দীর্ঘ কুয়াশামাখা সময় এলেবেলে ভাবনায় ভরিয়ে দেয় আমার মাথা। দেখি, যত পরে যে-ইন্দ্রিয়ের আবির্ভাব, তার মর্যাদাই যেন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বেশি। কারণ সে এসেছে আরও বহু পরে, অনেক জটিল পথ পার হয়ে, পরবর্তী যুগের জটিলতর চাহিদা মেটাতে। আমাদের সমাজে, রাষ্ট্রে, আইনে, সাক্ষ্যে দৃষ্টি আর শ্রুতিরই দাম্ভিক উপস্থিতি। আর সব ইন্দ্রিয়ের তলায় কোথায় চাপা পড়ে গেছে স্পর্শ নামের সেই প্রথম জননী ইন্দ্রিয়ানুভূতিটি।

    অথচ না, আদি সেই অনুভূতিটিই কী প্রবল হয়ে ফিরে-ফিরে আসে, তার সমস্ত তীব্রতা নিয়ে, প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে। স্পর্শই হয়ে ওঠে অন্তরঙ্গতমতার প্রকাশ। বন্ধুর করমর্দনে, প্রিয়জনের আলিঙ্গনে, সন্তানের চুমুতে। ভালবাসার মানুষের সঙ্গে গভীরতম শারীরিক সংস্পর্শের বাসনায় সেই আদি অনুভূতিরই বিস্ফোরক প্রকাশ। সে বলে, আমি মরিনি, নিবিড় আবেগের মুহূর্তে আমি ছাইকে ছাপিয়ে বেরিয়ে আসা আগুন। বাংলা ভাষার এ-ও এক প্রতিভা যে, তা নৈকট্য বোঝাতে ব্যবহার করে ‘সংস্পর্শ’ শব্দটি, যার মধ্যে ‘স্পর্শ’ লুকিয়ে আছে গোপনে।

    এ-পর্যন্ত এসে মনে হয়, আমাদের চারপাশের চোখে দেখা অভিজ্ঞতার জগতে ত্বকসর্বস্ব কেঁচো এখনও মাটি ঘেঁষটে চলতে-চলতে বয়ে চলেছে পৃথিবীর সঙ্গে প্রাণের সেই কবেকার বিশুদ্ধ স্পর্শের সম্পর্কটি। একবারেই যে এসব ভাবনা এসেছে, তা নয়। এসেছে নানা সময়ে, ছিঁড়ে-ছিঁড়ে। এটুকুই মাত্র। এসব নিয়ে কখনো কবিতা লেখা হবে কোনও, মনে সেরকম কোনও ভাবনাই জাগেনি। কিন্তু কবিতার কোন বীজ যে কোত্থেকে কোথায় এসে ঝরে পড়ে!

    বেশ অনেকগুলো বছর পরে, এসব ছেঁড়াখোঁড়া ভাবনার ছায়ার ভেতর থেকে, প্রথম তুষারের হালকা পাতির মতো হঠাৎই মাথায় একটি কবিতার চরণ উড়ে এসে পড়ল। আমার মাথায় গুনগুন করে উঠল, ‘পৃথিবীর ত্বক ঘেঁষটে/ চলছে যে কেঁচো তার স্পর্শই জীবন।’

    চরণটা মাথায় আসতেই মনে হল, আরে, ‘পৃথিবী’র পরে ‘ত্বক’ বসে যাওয়ায় পৃথিবীও কেমন প্রাণী হয়ে উঠল একটা, স্পর্শের সতেজ অনুভূতি-সহ। কেঁচোর সঙ্গে পৃথিবীর এখন বেশ একটা স্পর্শময় অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা।

    আমার কবিতা লেখা হয়ই এভাবেই। প্রথম চরণটি আসে স্বর্গ থেকে। প্রথম চরণ তো এল, কিন্তু এ থেকে কি জন্ম নেবে কোনও কবিতা? নেবে, যদি অন্তত কিছুটা হলেও এগোনোর পথ খুঁজে বের করতে পারি আমি। এর পর হয়তো আবার উদ্ভাসিত হবে আকস্মিক কোনও শব্দ, শব্দবন্ধ বা প্রতিমা। লাইনটা লিখে ফেলি খাতায়। কিন্তু এখন? কীভাবে যে এগোনো যাবে, তার আর পথ খুঁজে পাই না।

    পথ দেখাল কেঁচোই। একটার পর একটা ইন্দ্রিয় এসে যেমন ক্রমশ তলানিতে ফেলে দিয়েছিল ত্বককে, তেমনই পৃথিবীর মাটিতে লেপ্টে থাকা কেঁচোর সরল অনুভূতির জগৎকে চাপা দিয়ে মানুষ, পাখপাখালি আর নিঃসীম মহাবিশ্ব স্তরে-স্তরে উঠে গেছে ওপরের দিকে। আর সবটা মিলিয়ে বিরাট এক মঞ্চে সবাই যেন চরিত্র, অপার কোনও নাটকে।

    নিজের শরীরের পুরো ত্বক দিয়ে কামড়ে ধরে পৃথিবীর চামড়ার ওপর দিয়ে, আমাদের পায়ের প্রায় তলায়, বয়ে চলেছে কেঁচো আর কেন্নোর আদিম জীবনপ্রবাহ। সেই সরল জীবনপ্রবাহের ওপরে মানুষের কত না জটিল জীবনধারার জট লেগে থাকা জাল। মানুষের প্রসঙ্গ আসতে আসতেই সেই জীবনপ্রবাহের ছবিতে মাথার ওপরে চলে এল রেলিংয়ে নাড়ু হাতে ঝুঁকে থাকা এক কিশোরের ছবি। তারও মাথার ওপরে উড়ছে নগরবাসী কাক। এই দৃশ্যে কীভাবে যেন এসে উঁকি দিল আমার কিশোর বয়সের স্মৃতি। স্কুল থেকে ফেরার পর আম্মা নাড়ু খেতে দিয়েছে আমাকে। স্কুলের পোশাক না ছেড়েই নাড়ু হাতে দাঁড়িয়েছি তেতলার ঝুলবারান্দায়। আমার নাড়ুটায় তীক্ষ্ণ চোখ রাখতে-রাখতে আকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা চতুর কাক। ছিনিয়ে নিয়ে গেল আমার আধখাওয়া নাড়ুটা। সেই বয়সে নাড়ু হারানোর কষ্টের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল সামান্য কাকের কাছে হেরে যাওয়ার অমর্যাদা। কিন্তু কবিতার ছবিটি আমার কিশোর বয়সের স্মৃতির মতো সরল নয়। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি খাদ্যবস্তুকে ঘিরে কিশোর আর কাকের মধ্যে বাসনার লড়াইয়ের পূর্বাভাস। কাক কেঁচোর দিকেও তাকাচ্ছে, খাদ্যলোভে। এখানে কাকের বাসনা কেঁচোর জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।

    মাটি থেকে স্তরে-স্তরে ওপরে উঠতে উঠতে কবিতাটি এবার পৌঁছে গেল উচ্চতম ধাপে। লেখা পৌঁছাল এর শেষ ছত্রে, ‘সবার ওপরে ন্যস্ত মহাকাশ/ স্তব্ধ, অসহায়।’

    মানুষ, কেঁচো, পাখি মিলিয়ে এই পুরো নাট্যমুহূর্তের ওপরে ঝুলে রইল স্তম্ভিত হয়ে থাকা মহাকাশ। ‘মহাকাশ’-এর সামনে ‘ন্যস্ত’ শব্দটা এসে বসল আলটপকা, আমার সচেতন ভাবনার একেবারে বাইরে থেকে। এসে যে বসল, তাতে অনন্ত বিস্তৃত নভোমণ্ডলীর চরিত্রটা পাল্টে গেল এক ঝটকায়। এই শব্দটা এখন আমি কেটে দেওয়ার কে?

    লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে লক্ষ করে দেখি, কবিতাটিতে আমার অজান্তে অন্ত্যমিলের আভাসও চলে এসেছে। যে সমিল কবিতা লেখার সময়ে মনের যে-প্রস্তুতি থাকে, সেরকম কোনও প্রস্তুতি এর জন্য একেবারেই ছিল না। মনের সুদূরতম কোণে তেমন কোনও বাসনাও ছিল না। কবিতাটি নিজেই যেন গড়ে নিল নিজেকে।

    এভাবেই একটি আবেগের আঘাতে অন্য আবেগ আর স্মৃতি জেগে উঠতে উঠতে, পরস্পর বিনুনি পাকাতে-পাকাতে আকার পেল ‘রঙ্গমঞ্চ’ কবিতাটি। মাটি থেকে ধাপে-ধাপে আকাশ অব্দি উঠে ছড়িয়ে যাওয়া বিচিত্র বাসনা আর নিরাসক্তি গাঁথা পড়ল একটি কবিতার সুতায়।

    ২.

    কেটে নেয়া মাথা, রক্তের ফোঁটা,

    পিরিচে দু’চোখ নড়েচড়ে উঠে

    দ্যাখে চুপচাপ: দু ফাঁক যোনির

    ভেতরে সাপের মোচড়ানো লেজ,

    গহ্বরে ছোটা। রাত, সাবধান!

    ঘুমের মধ্যে অস্ত্রোপচার—

    পোড়া ছাই, ধার অস্ত্রের ফলা,

    সুতো, যকৃৎ; সুনসান ফাঁকা:

    ছুরি…‘চুপ করো’… ছুরি… চিৎকার…

    শবাধারে চিৎ, ছুরিচিকিৎসা।

    অদৃশ্য গলা, ‘যুগ যুগ ধরে

    অপেক্ষা যাঁর শেষ রাত্তিরে

    আসবেন তিনি; ততক্ষণ আমি

    দেখি বুক চিরে, তুমি তো কখনও

    আস্ত ছিলে না।’ আলগা শরীর

    চান্দ্র হলুদে কেউ নয় চেনা

    হাজার ঘোড়ার দামামা পিটছে

    আবহবাতাস… মাতাল গন্ধ…

    আধো জাগা শব… দেহহীন ভার…

    আর নীল লাল রুপালি নীরব

    (‘ছুরিচিকিৎসা’)

    টমাস ভল্‌ফহার্টের কথা মনে পড়ে। জার্মানিতে হাউজ অফ পোয়েট্রি নামে কবিতায় নিবিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের তিনি প্রধান। বার্লিনে এক আন্তর্জাতিক কবিতার আসরে কবিতা পড়ে মঞ্চ থেকে নেমেছি। আমি পড়েছি মূল বাংলায়। জার্মান কবি হেন্ডরিক জ্যাকসন সেটা পড়েছেন জার্মান ভাষায়, তাঁরই অনুবাদে। টমাস চেয়ার থেকে উঠে এলেন। ‘ছুরিচিকিৎসা’র প্রসঙ্গ টেনে বললেন, কবিতাটা এগোতে-এগোতে শেষের আগে আগে কেমন আলগা-আলগা হয়ে আসছিল বাক্যের বাঁধুনি। বাক্য ভেঙে ছিটকে বেরিয়ে আসছিল শব্দবন্ধগুলো। শেষে গিয়ে শব্দগুলো একেবারে টুকরো-টুকরো হয়ে আলাদা হয়ে থাকল। মূলেও কি এমনই নাকি?

    তাঁর মন্তব্যে কবি ও বন্ধু মাসুদ খানের কথা মনে পড়ে গেল। কবিতাটা ছাপা হয়েছিল ‘গাণ্ডীব’ পত্রিকার ১৯৮৭ সালের নভেম্বর সংখ্যায়। আমরা বন্ধুরা মিলে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে এই সাহিত্যপত্রটা তখন বের করছি। কবিতার আকাশচুম্বী আবেগের তোড়ে পৃথিবী ভাসিয়ে দেব বলে মনে হচ্ছে। নতুন এক-একটা কবিতা যেন একেকটা বিধ্বংসী বোমা। তা দিয়ে সে-সময়ের কবিতার আদল ভেঙেচুরে দেওয়ার অদম্য বাসনা কাজ করছে সবার মনে।

    পত্রিকায় কবিতাটি পড়ে মাসুদ খান ছুটে এলেন আমার কাছে। বললেন, ‘সাজ্জাদ, কবিতাটা শুরু হল খুব স্পষ্ট মূর্ত ছবিতে। মাঝখান থেকে ক্রমশ বিমূর্ত হয়ে পড়ল। কেমন অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা না?’

    কবি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্ট্রিপার। যাঁরা স্ট্রিপটিজ করেন, একের পর এক বস্ত্র ছাড়তে-ছাড়তে তাঁরা বড়জোর নিজেদের নগ্নদেহটুকুই স্পটলাইটের নীচে উন্মোচিত করতে পারেন। নির্বস্ত্র শরীরই তাঁদের সর্বশেষ প্রদর্শন-সীমানা। কবি এগিয়ে যান আরও গভীরে। শরীরের আবরণ উপড়ে ফেলে নিজের নগ্ন আত্মাকে তিনি বের করে আনেন; সূর্যের প্রখর আলোর নীচে তা মেলে ধরেন অকুণ্ঠভাবে।

    তাঁর কথা শুনে পরস্পরবিরোধী দুটো ঘটনা মনে পড়ে গিয়েছিল আমার। প্রথমটা ঠিক ঘটনা নয়, মন্তব্য। এজরা পাউন্ড কবিতার কতগুলো শর্ত দিয়েছিলেন একবার। কবিতায় মূর্তের সঙ্গে বিমূর্ত মিশিয়ে দিও না কখনও, এরকম ছিল তাঁর একটি শর্ত। আর দ্বিতীয় ঘটনাটি ছিল পাবলো নেরুদাকে নিয়ে। নেরুদা নিজেই লিখেছিলেন তাঁর স্মৃতিকথায়। কবি ও পণ্ডিত টি.এস. এলিয়ট একবার তাঁর কবিতা পড়ে শোনাতে চাইলেন নেরুদাকে। আর নেরুদা ছুটে পালালেন পাশের ঘরে। দরজায় খিল এঁটে বসে রইলেন সেখানে। রুদ্ধ দরজার অন্য পাশ থেকে তবু তাঁকে কবিতা শোনাচ্ছেন এলিয়ট। আর নেরুদা দু’কান চেপে চেঁচিয়ে বলছেন, না, না, না। নেরুদার মনে হচ্ছিল এই কবিতা না আবার তাঁর কবিতার ওপর বাইরের একটা চাপ তৈরি করে; তাঁর কবিতায় কাঁচা আবেগের যে-দাগ পড়ে থাকে, এলিয়টের কবিতার প্রভাবে তা না আবার মার্জিত আর পরিশীলিত হয়ে উঠতে শুরু করে। নেরুদার স্মৃতিকথার প্রচ্ছন্ন ভাব থেকে মনে হয়, তাঁর নিজের স্বতঃস্ফূর্ত কবিতাকে তিনি রাখছেন এলিয়টের প্রজ্ঞার গাঢ় স্পর্শ লাগা কবিতার বিপরীত মেরুতে। এতটাই বিপরীতে যে তাঁর মনে হচ্ছে, সেই কবিতা শোনার অভিজ্ঞতাও তাঁর কবিতায় মারণ আঘাত হানতে পারে।

    এক বিবেচনায় এ হয়তো বড়ই বাড়াবাড়ি। কিন্তু কোন কবিই বা অন্যের শর্তে কবিতা লেখেন? তার চেয়ে বড় কথা, আগের শর্ত না ভাঙলে নতুন কবিতাই বা কবি লিখে উঠতে পারবেন কীভাবে? আমার কবিতা যখন রচনা-মুহূর্তের একান্ত চাপে এজরা পাউন্ডের শর্তের সীমারেখা নিজেই পার হয়ে গেছে, সেটা আমি পাহারা দিয়ে আটকে রাখার কে!

    খুব খারাপ সময় যাচ্ছে তখন আমার। বাবার ব্যবসা লোপাট হয়ে আমাদের পরিবার পথে পড়ে গেছে প্রায়। প্রতিদিনের আর্থিক অনিশ্চয়তা অস্থির আর উগ্র করে তুলেছে আমাদের সবাইকে। আমার সামনে আলোর কোনও দিশা নেই। যে-মেয়েটার সঙ্গে তখন আমার ভাব, সে-ও সম্পর্ক গুটিয়ে নিয়েছে হঠাৎ করে। তরুণ সেই বয়সে অসহনীয় হয়ে উঠল হতাশায় ভরা সেই সময়ের জীবন।

    দেশের ভেতরটাও অসম্ভব অস্থির। দেশে সামরিক একনায়কতন্ত্র চলছে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যে-সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল, এক দশক পর সেটি আরও শক্ত শেকড় গেড়ে বসেছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক বুটের তলায় মানুষ নিষ্পিষ্ট আর অসহায়। মাঝেমধ্যে উত্তপ্ত সিসার মতো ছাত্রদের মিছিলের ঢল নামছে রাজপথে। খুন করে, মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে তা দমন করছে রাষ্ট্র। মুক্তিচেষ্টায় রুখে দাঁড়ানো ছাত্ররা আততায়ী শাসকের হাতে রক্তাক্ত হয়ে, মারা পড়ে চলে যাচ্ছে হাসপাতালে আর মর্গে।

    বাড়ি থেকে পালিয়ে-পালিয়ে বেড়াচ্ছি সেই সময়টাতে। বন্ধুদের সান্নিধ্যে রাত আর দিনের ফারাক নেই। কখনও ঢুকে পড়ছি সরকারবিরোধী উত্তপ্ত মিছিলে। আমার দুই গল্পকার বন্ধু— পারভেজ হোসেন আর শহীদুল আলমও— একসঙ্গে ঢুকে পড়েছিল একটা মিছিলে। সেখান থেকে শহীদুল ফিরল পুলিশের বেদম মার খেয়ে অসম্ভব আহত হয়ে।

    সে এক অসম্ভব গ্রন্থিহীন সময়। অর্থহীনতায় ভরে উঠছে চারপাশ। যে-সংগতির জন্য মনের ভেতরে তড়পাচ্ছি, কোথাও তার দিকনিশানা নেই। নিশ্বাস নেওয়ার মতো সামান্য বাতাস নেই কোথাও। সুর বলতে কিছু নেই। সব সুর ক্যাকোফোনিতে লুপ্ত। প্রবল ব্যক্তিগত হতাশায়, কাঁচা সেই বয়সের অবোধ তাড়নায়, আত্মহত্যার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হয়ে অনেকগুলো দিন হাসপাতালে থেকে ফিরে এসেছি এ-কবিতাটি লেখার মাস কয়েক আগে।

    অবসাদগ্রস্ত ঘোর তখনও কাটেনি। এক রাতে মনে হল, ক্যাকোফোনিরও তো জায়গা হতে পারে কবিতায়। চপল কোনও ছন্দের সঙ্গে বিষয়ের বিরোধাভাস তৈরি করে সেটা কি করে দেখা যায় না? মুক্তির দরকার তো ওই ছন্দগুলোরও। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আমরা মুক্তির শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করি। দেখাই যাক না, তমসার অভিজ্ঞতাও এমন ছন্দে লেখা সম্ভব হয় কি না।

    মাথায় হঠাৎ-হঠাৎ ছেঁড়া-ছেঁড়া কবিতার ছত্র ভেসে আসছে। কোনও মাথামুন্ডু নেই তাদের। কোনটা যে ব্যক্তিগত, আর কোনটা রাষ্ট্রিক— তালগোল পাকিয়ে জট লেগে যায় সব, একটা আরেকটার সঙ্গে। এই করতে-করতে এক ছটফটানিভরা রাতে লেখা হয়ে গেল একটি কবিতা।

    কবিতাটি আমার শক্তি নিংড়ে বের করে নিয়েছিল। লিখে ওঠার পর পড়ে দেখি এর মধ্যে স্পষ্ট কোনও বিষয় নেই। তালগোল পাকিয়ে আছে ভেতরের আর বাইরের পৃথিবী। আছে কয়েকটি চরিত্র। একজন বোধ করি শিকারি, আরেকজন তার শিকার। আছে তাদের ছিন্ন সংলাপ। ভূতুড়ে সংলাপও ঢুকে পড়েছে কোত্থেকে। আর আছে নিদারুণ একটি আবহের আভাস।

    পর পর কয়েক রাত জেগে কবিতার ঘোর জ্বরে লিখে ফেললাম আরও পাঁচ-সাতটি। প্রায় সবই তালপ্রধান মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত ছন্দে। দেখতে পাচ্ছিলাম, এসব ছন্দের নিয়তি স্থির হয়ে আছে যেন ঝলমলে আর মধুর বিষয়ে সুর জোগাতে। এই সংকীর্ণ ব্যবহারের বাইরে এরা কবিতার আরও গহন অভিজ্ঞতা বহন করতে পারে কি না, সে-ও আমার জন্য ছিল একটা অভিজ্ঞতা।

    কবিতাটিতে ছত্রের শেষে কোনও অন্ত্যমিল রইল না। স্পষ্ট বাক্যে সূচিত কবিতা শেষের দিকে যেতে-যেতে ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে, এক পর্যায়ে বাক্য থেকে ঝরে পড়ছে ছিন্নবিচ্ছিন্ন শব্দবন্ধ আর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া শব্দ। আর একেবারে শেষ চরণে চলে এসেছেন জীবনানন্দ দাশ, আকস্মিকভাবেই। যে-কুহকী দৃশ্যে শেষ হয়েছিল তাঁর ‘শব’ কবিতার শেষ ছত্র, তার শেষ চারটি শব্দ, ঢুকে পড়েছে চোরের মতো মৃদু পদক্ষেপে। এক অপ্রাকৃতিক নিসর্গদৃশ্যে সেই কবিতায় ‘পৃথিবীর অন্য নদী’তে অজানা কাল থেকে ভাসছে রহস্যময়ী এক নারীর শব। জীবনানন্দ লিখছেন, ‘এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব/ ভাসিতেছে চিরদিন: নীল লাল রুপালি নীরব।’

    ছয় মাত্রার দু্টো করে পর্ব মিলিয়ে একেকটি ছত্র, মাত্রাবৃত্তে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কবিতাটা যাতে অবিরল ধারায় বয়ে যেতে পারে, সে-কথা মাথায় রেখে ছত্রের শেষে কোনও অতিপর্ব দেওয়া হল না। এতে শেষদিককার চূর্ণ-চূর্ণ শব্দবন্ধ আর শব্দগুলোও একটার ঘাড়ে এসে পড়ল আরেকটা।

    যেমনটা বলেছি আগে, নিজের ভেতরে ও বাইরে তখন আমি খুঁজছি সংগতি। যে-সংগতি আমি পাচ্ছিলাম না কোথাও, কিন্তু অধীর হয়ে ছিলাম তৃষ্ণায়, কবিতার মধ্যেও কি তা পাব না? আবার সে-সংগতি যে দৃশ্যমান নেই, এ-ও তো সত্য। হয়তো সুপ্ত হয়ে আছে কোথাও, এখনও অধরা, তবু তার জন্যই তো তৃষ্ণা। এই এক তীব্র আকুতি কাজ করছিল, যখন লিখছি কবিতাটি। সেটাই বোধ করি মনকে তাড়িয়ে নিয়ে এল খুবই প্রচ্ছন্ন ধ্বনিসংগতি রচনার দিকে। অন্ত্যমিল চলে এল কবিতাটিতে। বাইরে থেকে যা একেবারেই স্পষ্ট হল না; থাকল ভেতরে-ভেতরে, সন্তপর্ণে লুকিয়ে। পড়ার সময়ে চোরাগোপ্তা অন্ত্যমিলে সেই আবছা মিলের প্রতিধ্বনি, কবিতাটির ছিন্নবিচ্ছিন্ন শব্দমালার ভগ্নস্তূপের মধ্যেও, অন্তরালে কাজ করবে কোথাও— লিখতে-লিখতে এমনই ইচ্ছা জেগে উঠেছিল সম্ভবত।

    কবিতাটি ভেঙে দিলেই কেবল লুকানো সেই শিথিল অন্ত্যমিল চাক্ষুষ হয়ে ধরা দেয়:

    কেটে নেয়া মাথা, রক্তের ফোঁটা,

    পিরিচে দু চোখ নড়েচড়ে উঠে দ্যাখে চুপচাপ:

    দু ফাঁক যোনির ভেতরে সাপের মোচড়ানো লেজ, গহ্বরে ছোটা।

    রাত, সাবধান! ঘুমের মধ্যে অস্ত্রোপচার—

    পোড়া ছাই, ধার

    অস্ত্রের ফলা,

    সুতো, যকৃৎ;

    সুনসান ফাঁকা: ছুরি… ‘চুপ করো’… ছুরি… চিৎকার…

    শবাধারে চিৎ,

    ছুরিচিকিৎসা। অদৃশ্য গলা,

    ‘যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা যাঁর শেষ রাত্তিরে

    আসবেন তিনি; ততক্ষণ আমি দেখি বুক চিরে,

    তুমি তো কখনো আস্ত ছিলে না।’

    আলগা শরীর… চান্দ্র হলুদে কেউ নয় চেনা

    হাজার ঘোড়ার

    দামামা পিটছে আবহবাতাস… মাতাল গন্ধ… আধো জাগা শব…

    দেহহীন ভার…

    আর নীল লাল রুপালি নীরব

    আপাত চপল একটি ছন্দে গভীর রাত অব্দি রচিত কবিতায় লিপিবদ্ধ হল এক তালছাড়া কিম্ভূত তামসিক অভিজ্ঞতার পঞ্জি। তাতে ধরা পড়ল ঊষর আর তালকানা একটি মনের ছবি। আর তার সঙ্গে মিশে রইল আমাদের ইতিহাসের এক দগ্ধ সময়ের ভস্মরাশি।

    কয়েকটা বছর পর বাংলাদেশের ‘দলছুট’ ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবামে এই কবিতাটিকে গান হিসেবে জায়গা করে দেওয়া হল। এই কবিতা যে গানের মতো করে গাওয়া যেতে পারে, এ ছিল প্রায় অসম্ভব এক কাণ্ড। কবিতাটিতে সুর দিয়ে গান হিসেবে গাইলেন সঞ্জীব চৌধুরী। সঞ্জীব ছিলেন পাগলাটে। বামপন্থী ছাত্র-রাজনীতি করে এসেছিলেন। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে পাগলের মতোই মিলেমিশে গিয়েছিলেন। তিনিই গানটা করাতে মনে হল, এই কবিতার ভেতর দিয়ে তিনিও সেই গ্রন্থিহীন সময়ের কোনও অনুভব সম্ভবত পাচ্ছেন।

    ৩.

    শামুক, তোমার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টি মেলে রাখি

    ক্রমশ এগোও তুমি নিরুদ্বেগ, শান্ত, অপিপাসু

    তোমার নিবিষ্ট গতি আমি ধরে রাখি এই দেহে

    ওই খোলে, রাজসিক মুকুটের তলে

    লুকিয়ে রাখছ মৃদু চলনভঙ্গিমা, ক্ষতি, মৃত্যু-সম্ভাবনা

    নরম পায়ের নীচে ক্ষয়ে যাচ্ছ ক্রমাগত পলে-অনুপলে

    যত্নে তুলে রাখি আমি ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের কণা

    ভ্রমণ সমাপ্ত হলে পড়ে থাকো দেহমুক্ত উদাসীন খোল

    তোমার সর্বস্ব নিয়ে আমি হয়ে উঠি দ্যাখো তোমার জাতক

    (‘জন্মান্তর’)

    শামুক চলে তার বিখ্যাত মন্থর গতিতে। তার নরম শরীরের ওপর শক্ত প্যাঁচানো খোলসের বড় এক বোঝা। সেই বোঝা নিয়ে শামুকের এই মন্থর জীবনের চলমানতাই বিরাট এক ট্র্যাজেডি। না, পিঠের ওপরে বোঝাটির কারণে নয়। একজন বলছিলেন শামুকের গল্প। আমি তার মধ্যে পেয়ে গেলাম চূড়ান্ত ট্র্যাজেডিতে ভরা মহাকাব্যিক জীবনের কাহিনি।

    শামুক সপ্রাণ সত্তা। সে চলে। আর তার শরীর এতটাই নরম আর ক্ষয়শীল যে, চলার পথে ক্ষয়ে যেতে থাকে ক্রমশ, একটু-একটু করে। চলতে-চলতে, ক্ষয়ে যেতে-যেতে, তার সম্পূর্ণ শরীর নিঃশেষিত হয়ে যায় একটা সময়ে। পড়ে থাকে শুধু শূন্য খোলস। এই সচল মন্থর জীবনই, এক অর্থে, তার মৃত্যুর কারণ। শামুকের চলমান জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যুরও মুহূর্ত। এই যার জীবন, তার চেয়ে বড় ট্র্যাজেডির মহানায়ক আর কে হতে পারে?

    গল্প শেষ হয়ে যেতে পারত এখানে এসেই। কিন্তু এক ভাবনা উসকে দেয় আরেক ভাবনাকে। কয়েক দিন পর মাথায় আবার ফিরে আসে শামুকের এই গল্প। মনে হতে থাকে, শামুকের গল্পটির মধ্যে কোথায় যেন প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে মানুষের মহাজীবন আর মহানিয়তির আভাস। মাঝেমধ্যে মনে হতে থাকে, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনও কবিতা। লিখতেও বসি কাগজ-কলম নিয়ে। লেখা হয় না। কিছু দূর এগিয়েই বুঝতে পারি, কোথাও দাঁড়াচ্ছে না কিছু। শামুকের এ-গল্পে প্রতীকের প্রত্যক্ষতা এতটাই বেশি দৃশ্যমান যে, কবিতার মধ্যে সেটা বাজে প্রসাধনের মতো আলগা হয়ে থাকে। একে ভেতর থেকে ভেঙে দিতে না পারলে দাঁড়াবেই না কোনও কবিতা।

    লেখার ভাবনাটা চলেই যায় মাথা থেকে। হঠাৎ-হঠাৎ ফিরে আসে মাঝেমধ্যে। আফসোস হয়, লিখতে পারলাম না বলে। সেটাকে তাড়িয়েও দিই সঙ্গে-সঙ্গে। এরকম করে লেখার কোনও মানেও তো হতে পারে না, বোঝাই নিজেকে।

    এভাবে সাত-আট বছর কেটে যায়।

    অফিসের কাজে আমি খুলনা যাচ্ছি। দীর্ঘ পথ। চলে এসেছি ব্যস্ত শহরের বাইরে। গাড়ির জানালার বাইরে বিস্তীর্ণ ধানখেত। তার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে উদ্দাম বাতাস। জীবনানন্দ দাশ আর ফেদেরিকো গারর্সিয়া লোরকার সবুজ বাতাস। আমার তন্দ্রামতো পাচ্ছে। সেই আধো তন্দ্রায় ভাবনাটা হঠাৎ ফিরে এল একটা চরিত্রসমেত।

    এবার শামুকের সঙ্গে আমি দেখতে পেলাম কবিকে। শামুকের গল্পটি নিয়ে আমার অসফল প্রচেষ্টার ছবিটাও এবার উঠে আসছে তার সঙ্গে। কবি লক্ষ করে যাচ্ছে শামুকের জীবন। লক্ষ নয়, অনুসরণই করছে, ওর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে। ক্ষয়ে যাচ্ছে শামুক, আর কবি সঙ্গে-সঙ্গে তুলে রাখছে তার শরীরের ক্ষয় হয়ে যাওয়া অবশেষ। পরম মমতায় আর অতুলনীয় যত্নে। শামুকের এই ট্র্যাজেডি তার কাছে যেন এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার নয়। এই ট্র্যাজেডিতে, এই নিবিড় পর্যবেক্ষণ আর মমতাময় সংরক্ষণে তারও ঘটছে রূপান্তর। এই রূপান্তরে মানুষ হিসেবে তার ভূমিকা আছে। কবি হিসেবেও বোধ করি। আবার এর মধ্য দিয়ে সে-ও তো হয়ে উঠছে, একাধারে মানুষ ও কবি হিসেবে।

    পুরো ছবিটা যে গাড়ির মধ্যেই এল, সেটা একেবারেই নয়। যা এল, তাকে বলা যেতে পারে একটা আবছা আভাস।

    গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকলাম হোটেলের কামরায়। আসন্ন কবিতার জ্বরে আমি কাঁপছি। টেনে নিলাম কাগজপত্র। এক টানে লেখা হয়ে গেল ‘জন্মান্তর’ কবিতাটি। কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করেও যে কবিতা লিখতে পারিনি, সেটা দাঁড়িয়ে গেল বিনা প্রয়াসে, সাত-আট মিনিটের মাথায়।

    কবিতার এই এক রহস্য। কোন কবিতা যে কীভাবে রচিত হয়ে ওঠে! কিশোর বয়সে ‘কাসাসুল আম্বিয়া’য় পড়া ইউনুস নবীর গল্পের বীজ থেকে জন্ম নিয়েছিল ‘মৎস্যপুরাণ’ কবিতাটি। আবার কেবল সেই গল্পটিই নয়। স্বাধীনতার পর পর মুক্তধারা যে কিশোর সাহিত্যের বই প্রকাশ করেছিল, সেখান থেকে পড়েছিলাম কোনও এক অনামা লেখকের বইয়ে তিমির পেট থেকে উদ্ধার পাওয়া এক মানুষের রোমাঞ্চকর সত্য গল্প। ধর্মীয় পুরাণের দূরের অস্পষ্ট পৃথিবী ধরাছোঁয়ার ভেতরে এক বাস্তব উত্তেজনা নিয়ে হাজির হয়েছিল সেদিন। ‘মৎস্যপুরাণ’ কবিতায় তার ছায়া এসে পড়েছে তিমি আর তার উদরে চলে যাওয়া মানুষটির গহন এক সম্পর্কে।

    কবি একাই কবিতা লেখেন না। কবিতা তার মধ্য দিয়ে আসে, আরও বহু-বহু মানুষের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ যোগের অভিজ্ঞতার এক অন্তহীন মিশ্রণের মধ্য দিয়ে। কবির কোন আবেগকে কীভাবে ব্যবহার করে ভাষার কোন বিন্যাসে সে আবির্ভূত হবে, কবি তার পুরো নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। আবার কবিতাও যে কোন পাঠককে তার পরিসীমার বাইরে কোন অচেনা দেশে নিয়ে ফেলবে, তারও কোনও ছক নেই। এই অনিশ্চয়তা আর অপ্রত্যাশিতের মধ্যেই কবিতার সৌন্দর্য। মানুষের জীবনও কি এই অপ্রত্যাশিতেই ভরা নয়?

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook