ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ঝিনুকের বোতাম


    অরুণ কর (August 2, 2023)
     

    বোধহয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নিশিকান্ত। 

    তপেশ এসে গায়ে মৃদু ধাক্কা দিতেই ধড়মড় করে জেগে উঠে অপ্রস্তুত মুখে হাসলেন। 

    তপেশ বলল, ‘নিশিমামা, বেলা যে পড়ে এল, এবার খেতে বসবে চলো।’

    নিশিকান্তর হয়তো তখনও ঘোর কাটেনি। তিনি ঘোলাটে চোখে একবার চারপাশটা দেখে নিয়ে চশমার জন্যে পকেটে হাত দিলেন।

    তপেশ ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কী হল, উঠে পড়ো। দূরের আত্মীয় যারা এসেছিল, খাওয়া-দাওয়া করে সবাই চলে গেছে। এখন আমরা বাড়ির ক’জন আর তুমি বাকি। আকাশের অবস্থা তো দেখছ, এখনই হয়তো আবার বৃষ্টি নামবে।’ 

    তপেশের কথা শুনে নিশিকান্ত আকাশের দিকে চাইলেন, কিন্তু মেঘ ঠিক কতটা, ভাল করে ঠাহর করতে পারলেন না। তাঁর দু’চোখেই ছানি পড়েছে। কম্যান্ড হসপিটালের ডাক্তার কাটাবার কথা বললেও গড়িমসি করে এখনও কাটানো হয়নি।

    তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার কাচটা ভাল করে মুছে নিয়ে চোখে লাগিয়ে তপেশের দিকে তাকালেন। গোঁফদাড়ি-সহ মাথা কামানো তপেশকে বেশ ছেলেমানুষের মতো দেখাচ্ছে। এমনিতেই রোগা ছিপছিপে চেহারা, চট করে বয়েস বোঝা যায় না। অবশ্য কতই-বা বয়স হবে, বড়জোর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ, থুতনি আর কপালটা অবিকল বিনুর মতো, মেয়ে হলে মিলটা আরও স্পষ্ট হত।

    তপেশ নিশিকান্তকে চুপ করে থাকতে দেখে আগের কথার খেই ধরে বলল, ‘তোমাদের আশীর্বাদে সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল, মাঝখান থেকে এই বৃষ্টিটাই সব গোলমাল করে দিল। অবশ্য একদিক থেকে ভালই হয়েছে, আকাশের অবস্থা দেখে অনেকেই তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে চলে গেছে। বাড়িঘরের যা অবস্থা, বৃষ্টির মধ্যে একসঙ্গে সবাইকে বসতে দেওয়াই সমস্যা।’ 

    তপেশের কথায় যেন হালকা রসিকতা। সদ্য মাতৃবিয়োগ হয়েছে, অথচ ওর চালচলনে শোকের বদলে যেন ভারমুক্তির স্বস্তি। শেষের দিকে বিনু কি খুব ভুগছিল? কই, তেমনটা তো শোনেননি! নিশিকান্ত মনে-মনে ক্ষুণ্ণ হলেন। কথা ঘোরাবার জন্যে বললেন, ‘সারাদিন খাটাখাটনি, উপোসকাপাস, আমার জন্যে তোরা বসে আছিস কেন? জানিস তো, আমার শরীর ভাল নেই। বয়স তো কম হল না, তোর মা’র চাইতে আমি বছর দুয়েকের বড়। এই অবেলায় আমি আর খাব না, বাবা। যা, তোরা খেয়ে নে, আকাশ একটু পরিষ্কার হলেই আমি বেরিয়ে পড়ব।’ 

    তপেশ হাঁ হাঁ করে উঠে বলল, ‘এটা তুমি কী বললে, মামা? তুমি অতিথি মানুষ, কাজের দিনে যখন এসেই পড়েছ, দুটো ডালভাত মুখে না দিলে হয়? যা পারো, সামান্য কিছু অন্তত… আমি জোর করব না।’

    নিশিকান্ত মৃদু হাসলেন। ‘কাজের দিনে যখন এসেই পড়েছ’ কথাটা তাঁর কানে যেন খটাস করে লাগল। তপেশ হয়তো সহজভাবেই বলেছে, তবুও তাঁর মনে হল, এভাবে বিনা নিমন্ত্রণে হুট করে চলে আসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। 

    তিনি নরম গলায় বললেন, ‘আজ থাক বাবা, আরেকদিন নাহয় এসে খেয়ে যাব, আজ আর জোরাজুরি করিস নে।’

    তপেশ নাছোড়বান্দার মতো বলল, ‘তা বললে কি হয়? তুমি কি বাইরের মানুষ? জানো মামা, শেষের দিকে মা প্রায়ই তোমার কথা বলত। নতুন কোনও কিছু মনে রাখতে পারত না, অথচ পুরনো দিনের কথা সব মনে ছিল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কেবল সেসবই বলত। তোমাদের একসঙ্গে কচুপাতা মাথায় দিয়ে ইস্কুলে যাওয়া, হালদারদের জাম গাছে উঠে জাম চুরি করা… আচ্ছা মামা, তুমি না কি একবার শেয়ালের গর্ত থেকে বাচ্চা চুরি করে এনে পুষেছিলে! গল্প করতে-করতে মা হাসত আর বলত, তোর নিশিমামা একটা আস্ত পাগল ছিল।’

    তপেশ হো হো করে হেসে উঠল।

    নিশিকান্তর বুকের মধ্যেটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। তপেশের হাসিটা অসহ্য মনে হল। তিনি উত্তর না দিয়ে বিনুর ছবির দিকে চাইলেন। 

    তপেশ একা মানুষ, সব দিক নিজেকেই সামলাতে হচ্ছে। কথার মাঝে হঠাৎ চেঁচাতে-চেঁচাতে ও অন্যদিকে ছুটল, ‘আরে, আরে, ওটা কী করছ? তোমাদের কাণ্ডজ্ঞান আর কবে হবে? দইয়ের হাঁড়িটা ওখানে রাখলে কেন? চারদিকে কুকুর-বিড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখতে পাচ্ছ না! নেতাই, তোকে না বললাম ভাজা মাছগুলো আলাদা করে তুলে রাখতে! যারা আজ থেকে যাচ্ছে, তাদের জন্যে কি আমি বিকেলে ফের মাছ কিনতে ছুটব?’

    ওসব কেজো কথাবার্তা শুনতে নিশিকান্তর ভালো লাগছিল না। তিনি বিনুর ছবির থেকে মুখ ঘুরিয়ে ঘোলাটে চোখে ফের আকাশের দিকে চাইলেন।

    আজ সকাল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আপাতত একটু বিরাম দিলেও আকাশের মুখ ভার। শীতকালের বৃষ্টির মতো বিরক্তিকর আর কিছু হয় না। ত্রিপলের ফোঁকর গলে জল পড়ে সারা উঠোনটা কাদা হয়ে গেছে। তার ওপর দিয়েই অজস্র পায়ের আনাগোনা। কয়েক বস্তা কাঠের গুঁড়ো ছড়িয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি।

    একটা সস্তা কাঠের চেয়ারের ওপর বিনুর বাঁধানো ছবি, সেটার উপর রজনীগন্ধার এত মালা চড়ানো হয়েছে যে ওর মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। একটা নিভে যাওয়া মোমবাতির সামনে উগ্র গন্ধের ধূপ জ্বলছে। কাচের প্লেটে দুটো সন্দেশ, তার ওপরে ধূপের ছাই জমা হচ্ছে। পাশে প্লাস্টিকের গেলাসে জল।

    নিশিকান্ত ভাল করে ছবির দিকে চাইলেন। এটা হয়তো বিনুর শেষ বয়সের ছবি। সাদা সিঁথি, কাঁচাপাকা চুল, কপালে স্পষ্ট বলিরেখা। নিশিকান্তর কেমন যেন কষ্ট হতে লাগল। চেনা বিনুকে কিছুতেই ছবির বিনুর সঙ্গে মেলাতে পারলেন না। 

    বিনুর বিয়ের দিনটা ওঁর হঠাৎ মনে পড়ে গেল। অঘ্রাণ মাসের সন্ধের লগ্নে বিয়ে, অথচ দুপুর থেকে শুরু হয়েছিল মুষলধারে বৃষ্টি। সে-সময়ে গ্রামের দিকের বিয়েবাড়িতে প্যান্ডেল-ট্যান্ডেল বাঁধার চল ছিল না। গোবরছড়া দিয়ে নিকোনো উঠোনে সামিয়ানা টাঙিয়ে তার নীচে শতরঞ্চিতে বরযাত্রীদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রবল বৃষ্টিতে সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। উঠোনময় জলকাদা, রাস্তাঘাটও জলে থই থই। যোগেশকাকা নিজে অশক্ত রুগ্ন মানুষ, তার ওপরে কন্যা সম্প্রদানের জন্যে সারাদিন উপোস করে আছেন। তিনি দিশেহারা হয়ে কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

    নিশিকান্ত একাই আশপাশের বাড়ি থেকে ঘাড়ে করে কয়েকটা চৌকি নিয়ে এসে সেগুলো জোড়া দিয়ে মোটামুটি একটা ভদ্রস্থ বসার ব্যবস্থা করেছিলেন। বৃষ্টির জল আটকাবার জন্যে চার কোণে খুঁটি পুঁতে পলিথিনও টাঙিয়েছিলেন। অবশ্য ভাগ্য ভাল বলতে হবে, বিকেলের পর বৃষ্টির বেগ কমে এসেছিল। আলোর জন্যে পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে গোটা দুয়েক হ্যাজাক চেয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু জ্বালতে গিয়ে দেখা গেল, অসাবধানে বৃষ্টির জল লেগে সেগুলোর ম্যান্টল খসে গেছে। অগত্যা ওই জলবৃষ্টির মধ্যেই মাইল তিনেক উজিয়ে চাঁদপাড়া বাজারে ছুটতে হয়েছিল ম্যান্টলের জন্যে।

    বিপত্তি কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। সন্ধেবেলা দেখা গেল, লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ বরের দেখা নেই। সকলেই উদ্বিগ্ন। অবশেষে বরযাত্রীদের একজন এসে খবর দিল, হাটখোলা মোড়ের কাছে বরের গাড়ি কাদায় আটকে গেছে, রাস্তায় জল জমে আছে বলে বরকে হাঁটিয়েও আনা যাচ্ছে না। সে-রাতে প্রায় সিকি মাইল রাস্তা অম্বরীশকে কাঁধে করে জল পার করিয়ে ছাদনাতলায় নিয়ে এসেছিলেন নিশিকান্ত।

    বিনু চিরকালই রোগা ছিপছিপে, তবে নাক-মুখ ছিল একেবারে নিখুঁত, কাটা-কাটা। চোখদুটো গভীর, কালো এবং প্রশস্ত। লাল বেনারসীতে বিনুকে সেদিন এত সুন্দর লাগছিল যে, তাকালেই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। 

    বরকে ছাদনাতলায় নামিয়ে নিশিকান্ত অন্য কাজের তদারকিতে যাওয়ার সময়ে এক ঝলক ওর দিকে তাকাতেই বিনুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গিয়েছিল। বিনুর সেই বিস্ময়ভরা চাহনির মধ্যে কী যে ছিল, এত বছরেও নিশিকান্ত সেটা ভুলতে পারেনি। আজও চোখ বন্ধ করলে বিনুর সেই লাল জরির ওড়নার আড়াল থেকে তাকানো চোখদুটো মনে পড়ে যায়। 

    সেবারেও এরকম বিনা নেমন্তন্নে বিনুর বিয়েতে এসে পড়েছিলেন নিশিকান্ত। বিনু কিংবা যোগেশকাকা ভাবতেই পারেননি, এত তিক্ততার মধ্যেও নিশিকান্ত আসতে পারে।

    ওকে দেখে সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করেছিল। 

    আসলে বিনুর সঙ্গে নিশিকান্তর সম্পর্কটা জানাজানি হতেই দু’বাড়ির সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করেছিল। অথচ এক সময়ে দুটো পরিবারে কী ভাবই না ছিল! ভালমন্দ রান্না হলে বাটি চালাচালি, পালাপার্বণে দেয়াথোয়া, সব মিলিয়ে যেন একটাই পরিবার ছিল। 

    একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিন্নমূল দুটো পরিবার নিঃসম্বল অবস্থায় বর্ডার পেরিয়ে টাকির রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। নিশিকান্ত তখন বছর দশেকের। ওই ক্যাম্পেই যোগেশকাকার সঙ্গে নিশিকান্তর বাবা গোবিন্দ সেনের দেখা। খুলনা কলেজে দু’জনে একসঙ্গে পড়তেন। তবে কলেজ শেষ হওয়ার পরে আর সেভাবে যোগাযোগ ছিল না। বিদেশ-বিভুঁইয়ে চরম দুর্দশা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ওঁরা একে অপরকে আবিষ্কার করে যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছিলেন। সেই যে ওঁরা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, আর ছাড়েননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দু’জনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আর ওদেশে ফিরবেন না। বিনুর বয়েস তখন আট বছর।

    তারপর অশেষ কষ্টের মধ্যে ওঁদের দিন কেটেছে। এক সময়ে শিক্ষকতা করা দু’জনেই বেঁচে থাকার তাগিদে হেন কাজ নেই, যা করেননি। 

    যোগেশকাকার এক ভায়রাভাই থাকতেন কদম্বগাছির ওদিকে। স্পিনিং মিলে কাজ করতেন। সেই সূত্রে বছর দুয়েক পরে উনি সেখানে কাজ পেয়ে গিয়েছিলেন। সামান্য মজুরের চাকরি, কিন্তু ভাতকাপড়ের অভাব হত না। 

    তার আগেই অবশ্য দুই বন্ধু পাশাপাশি জমি কিনে ফেলেছিলেন। কবরস্থানের গা ঘেঁষা বনজঙ্গলভর্তি জমি, দিনের বেলাতেও শেয়াল বেরোত। নিতান্ত জলের দরে পেয়েছিলেন বলে কিনতে পেরেছিলেন। তখন এদিকে লোকজন বড় একটা আসত না। পথঘাট কিছুই ছিল না।  

    একটু বড়ো হওয়ার পর ধীরে-ধীরে বিনু যেন কেমন করে নিশিকান্তর শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো হয়ে উঠছিল। নিশিকান্ত বরাবরই ভীতু প্রকৃতির মানুষ। বিনুকে সামনাসামনি কখনও সাহস করে ভালবাসার কথা বলতে পারেননি বটে, তবু ওর মনে হত, বিনুকে ছাড়া উনি বুঝি বাঁচবেন না। 

    সে-সময়ে নিশিকান্তর লক্ষ্য ছিল, যে করেই হোক একটা চাকরি জোগাড় করা। কলেজে পড়তে-পড়তে পেয়েও গিয়েছিলেন, আর্মিতে কনস্টেবল। 

    রাজস্থানে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগের দিন একান্তে বিনুকে বলেছিল, ‘এই যে আমি চলে যাচ্ছি বিনু, তোর কষ্ট হচ্ছে না?’

    বিনু খুব অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কষ্ট হবে কেন? তুমি চাকরি পেয়েছ, তাও আবার পাকাপোক্ত সরকারি চাকরি! তোমার এখন কত দাম! সেনকাকু এসে কত জাঁক করে বাবাকে এসব বলে গেলেন! আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ারও পরামর্শ দিয়ে গেলেন! আমি যেন শাঁকচুন্নি, তোমার ঘাড় মটকাবার জন্যে…’

    কান্নাকে আড়াল করতে বিনু কথা শেষ না করে এক ছুটে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছিল। 

    যুগিপাড়ার বলাই খাওয়া শেষ করে যাওয়ার সময়ে তপেশকে বলল, ‘আসি তাহলে! ভেটকি মাছের পাতুড়িটা বেশ হয়েছে, তবে সর্ষেটা আরেকটু কম হলে আরও সরেস হত।’

    নিশিকান্তের কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠল। 

    প্যান্ডেলের ভেতরে বাড়ির লোকজন এবং বাকি আত্মীয়দের ডেকে-ডেকে বসানো হচ্ছে। সার্ভিসের ভাড়াটে ছেলেগুলো অলস হাতে পাঁপড়ভাজা নিয়ে চিবুতে-চিবুতে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। নীল প্যান্ট, সাদা শার্ট, নীল টাই, মাথায় পাতলা কাপড়ের চুল-ঢাকা টুপি, বেশ একটা কর্পোরেট লুক। একজন মানুষ মারা গেছে, তাঁর আত্মার শান্তির জন্যে এই অনুষ্ঠান, অথচ গোটা বাড়িতে শোকের চিহ্নমাত্র নেই।

    আবার বিনুর বিয়ের দিনটা মনে পড়ে গেল নিশিকান্তর। মাটিতে বিছানো ভাঁজ করা চট, তার ওপরে বরযাত্রীরা খেতে বসেছে। সামনে সার-সার কলাপাতার এক কোণে নুন আর ছোট করে কাটা পাতিলেবু। একপাশে মাটির ভাঁড়ে জল। প্যান্টের ওপর গামছা বেঁধে পাড়ার ছেলেরা পরিবেশন করছে। ধোঁয়া-ওঠা সাদা ভাতে চিলতে কলাপাতার তেকোণা দোনায় তোলা গরম ঘি পড়ছে, সোনামুগের ডাল, বোঁটাসমেত লম্বা বেগুনভাজা, মাছের মাথা দিয়ে পাঁচমেশালি সব্জির ছ্যাঁচড়া। হাঁকডাক, হইচই, হাসিমস্করা, তার মধ্যে নিবারণ এক বরযাত্রীর পাতে এক বালতি রসগোল্লা উপুড় করে ঢেলে দিল। পাতা থেকে রস গড়িয়ে চটে মাখামাখি, তার মধ্যেই টপাটপ রসগোল্লা তুলে মুখে দিচ্ছেন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক। দৃশ্যটা মনে পড়তেই হাসি পেয়ে গেল নিশিকান্তর।

    ‘নিশিদা না? কবে এলে? এ কী চেহারা হয়েছে তোমার?’ 

    নিশিকান্ত ঘোলাটে চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। প্রৌঢ়ের সামনের পাটির দাঁতগুলো সবই প্রায় পড়ে গেছে, মাথাজোড়া মস্ত টাক, পেল্লাই ভুঁড়ি। তবে মুখের হাসিটি একদম ছেলেমানুষের মতো।

    তামলিদের ছেলে ভূষণ। বরাবরই একটু বোকা ধরনের ছিল। তবে এক সময়ে খুব ভাল ফুটবল খেলত। কলকাতার দলে চান্সও পেয়েছিল। ওর বাপের ছিল তেজারতির ব্যবসা, তিনি ওকে কলকাতায় যেতে দেননি বলে সে কী আফশোস! 

    নিশিকান্ত মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘তোকেও তো চেনার উপায় নেই! ভাল আছিস?’

    ‘ভালো আর কী! আছি এক রকম। ছেলেটা তো মানুষ হয়নি, যাকে বলে পঞ্চ ম-কার সিদ্ধ, আয়পত্তর কিছু করে না, টাকার দরকার হলেই এসে জুলুম করে। জামাইটা মরবার পর মেয়েটাও বাচ্চাকাচ্চাসমেত ঘাড়ে এসে জুটেছে! যাক গে সেসব কথা। তুমি কেমন আছ? বাব্বা, কতকাল পরে দেখা! বিনুদির বিয়ের পর সেই যে তুমি দেশান্তরী হলে…’

    নিশিকান্ত বড় লজ্জায় পড়ে গেলেন। ভূষণের বোকামি এখনও যায়নি দেখে একটু ভয়ও পেলেন। কথা ঘোরাবার জন্যে বললেন, ‘পানুর খবর কী রে? সেবার হরিদ্বারে হর কি পৌড়ি ঘাটে সন্ধ্যারতির সময়ে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সঙ্গে একপাল ছেলেপুলে।’

    ভূষণ অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী! তুমি শোনোনি, পানু কবে মরে গেছে! বছর পাঁচেক তো হবেই। ওর বড় ছেলে নিমাই আমার নামে মামলা করেছে, সম্পত্তি পুরোটা বুঝিয়ে দেওয়ার পরেও ওর ধারণা, আমি নাকি ওকে ঠকিয়েছি। কী ঘেন্না, কী ঘেন্না!’

    আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। ভূষণ ছাতা খুলে হাঁটতে-হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, ‘তা উঠেছ কোথায়? তোমার মামার ছেলেরা তো সম্পত্তি সব বেচে দিয়ে কলকাতায় চলে গেছে।’

    নিশিকান্ত মনে হয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। একটা প্লেটে গোটা চারেক রসগোল্লা এবং এক গ্লাস জল নিয়ে তপেশের বউ মিতু বলল, ‘মামা, শুনলাম আপনার শরীর খারাপ, কিছু খেতে চাইছেন না। কিন্তু কাজের বাড়ি, একেবারে খালি মুখে কি যাওয়া যায়? এই মিষ্টি ক”টা অন্তত…’

    এক সময়ে নিশিকান্ত মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসতেন। কিছু না পেলে দলা-দলা ভেলিগুড় খেতেন। কিন্তু ব্লাড সুগারের জন্যে আজকাল আর মিষ্টি খান না। তবে মিতুকে সে-কথা বলতে সংকোচ হল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্লেট থেকে একটা মিষ্টি তুলে মুখে দিয়ে জলের গ্লাসের জন্যে হাত বাড়ালেন।

    হঠাৎ তপেশ এসে বলল, ‘তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে নিশিমামা। সে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ছোট্ট চৌকো কাঠের কৌটো বের করে নিশিকান্তর হাতে দিল। তারপর নিস্পৃহ গলায় বলল, মরার আগের দিন মা এই কৌটোটা আমাকে দিয়ে বলেছিল, তোমার সঙ্গে যদি কখনও দেখা হয়, তাহলে এটা যেন তোমাকে দিই।’

    তপেশ আর দাঁড়াল না।

    কৌটোটা নিশিকান্তর কেমন যেন চেনা-চেনা মনে হল। যোগেশকাকারা সেবার পুরী বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফিরে আসবার পর বিনু এই কৌটোটা দেখিয়ে বলেছিল, ‘তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি নিশিদা। কিন্তু এখন দেওয়া যাবে না।’ 

    বলতে-বলতে খুব রহস্যময় হেসেছিল বিনু। 

    নিশিকান্ত খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার জন্যে এনেছিস, অথচ এখন দেওয়া যাবে না, কী এমন মহার্ঘ্য জিনিস?’

    মুহূর্তে বিনুর মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘টিউশনি করে ক’টা টাকাই বা পাই যে দামি জিনিস কিনব!’ 

    একটু পরে মুখ নামিয়ে লাজুক হেসে বলেছিল, ‘আমার কাছে এটা অনেক-অনেক দামি।’ 

    রাস্তায় নেমে অনেকক্ষণ ধরে কৌটোটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন নিশিকান্ত। তারপর আলগোছে কৌটোটা খুলেই অবাক হয়ে গেলেন। সরু চেনে গাঁথা এক সেট ঝিনুকের বোতাম, পাঞ্জাবিতে পরার। সস্তা চেনে মরচে পড়লেও ঝিনুকের সাদা বোতামগুলো নতুনের মতো ঝকঝক করছে। 

    হঠাৎ কিশোরী বিনুর মুখটা মনে পড়ে গেল নিশিকান্তর। হাসিতে উজ্জ্বল-অমলিন ঝকঝকে মুখ।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook