ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ছায়াবাজি: পর্ব ১৬


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (August 7, 2023)
     

    স্মার্ট লাবণ্য

    একটি মেয়ে (লিসা) বাড়ি বদল করছে, এতদিন অনেকে মিলে একটা ফ্ল্যাটে থাকত। ছবিতে (‘দ্য গার্ল অ্যান্ড দ্য স্পাইডার’, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: দুজন মিলে— ব়্যামন জুরচার, সিলভ্যান জুরচার, ২০২১) সেই বাড়ি-বদলের দুটো দিন দেখানো হয়। ছবির কিছুটা ঘটে নতুন বাড়িতে, এটা-সেটা লাগানো হচ্ছে, প্রতিবেশী আলাপ করতে আসছে, লিসার মা সাহায্য করতে আসছে, আরও কিছু বন্ধু। আর কিছুটা আগের বাড়িটায়, সেখান থেকে অমুক-তমুক প্যাক করা হচ্ছে, কোনটা যাবে কোনটা থাকবে ঝাড়াই-বাছাই চলছে, অন্য ফ্ল্যাটের বাচ্চারা এসে দুষ্টুমি করছে। লিসার এক বান্ধবী (মারা) হচ্ছে নায়িকা, যার খুব কষ্ট হচ্ছে লিসা চলে যাচ্ছে বলে, যদিও সে মুখ ফুটে কিছু বলছে না। বলার অবকাশও নেই, গোটা ছবি জুড়েই যেই না কেউ কারও সঙ্গে একটু নিবিষ্ট ভাবে লম্বা কোনও সংলাপ-চালাচালিতে যেতে চায়, তখুনি কেউ ডেকে একটা হাতুড়ি দিতে বলে, বা দড়িটা কোথায় আছে জানতে চায়, কিংবা নালিশ করে যে কুকুরটা এসে দরজা আঁচড়ে দিয়েছে, বা স্রেফ এমন নালিশময় ভাবে তাকিয়ে থাকে যে খেলা ভেঙে অন্যত্র চলে যেতে হয়। সারাক্ষণ লোকজন যাচ্ছে আসছে ঢুকছে বেরোচ্ছে, চা ফেলে দিচ্ছে জানলা ভেঙে ফেলছে। তার মধ্যে মানুষের মানুষকে ভাল লাগছে খারাপ লাগছে রাগ ঝলকাচ্ছে ঈর্ষা ছলকাচ্ছে। সেগুলো দু-চারটে চাউনিতে, একটা-আধটা সিগারেট খাওয়ার সময় বাইরে তাকিয়ে থাকাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ছবির শুরুতেই মাটি খুঁড়ে একটা যন্ত্র প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়, সেটাকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে মারা, যেন তার বুক ভেঙে যাওয়ারই শব্দ শুনতে পাচ্ছে। লিসা ও মারার পারস্পরিক ব্যবহার দেখে মনে হয় এটা নিছক বন্ধুত্ব নয়, তাদের প্রেমসম্পর্ক আছে, এবং মারা-র প্রচণ্ড অভিমান বুঝতে পেরেও লিসা এই চলে আসার (বাড়ি থেকে, সম্পর্ক থেকে, আগের জীবন থেকে বেরিয়ে আসার) সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্লোজ-আপে মারার ব্যথিত চাউনি এমন প্রস্ফুটিত, তার ঠোঁটের ওপরে হারপিসের ছোট ক্ষত থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়াকে হৃদয়ের ক্ষরণ ভেবে নিতে আমাদের অসুবিধে হয় না।

    ছবিটা পুরোপুরি সংলাপের ওপর ভর দিয়ে চলে না, কিন্তু সংলাপকে প্রায়ই কাব্য আক্রমণ করে। একদম প্রথমেই মারা বলে, লিসার সঙ্গে সে আগের বছর যে বাইক-ট্রিপটায় গেছিল, সেখানে লিসাকে সে হারিয়ে ফ্যালে এক সময়, তারপর একটা ফোয়ারার পাশে বসে ছিল, আচমকা প্রচুর ছোট ছেলেমেয়ে সেখানে এসে কলরব করতে শুরু করে, তারপর আবার তেমন আচমকাই আবার তারা কোথায় চলে যায়। ফোয়ারাটা যেন তাদের গিলে নিয়েছে, আর হাওয়া এসে ফোয়ারারা জলের ফোঁটাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেন তারা কখনও ছিলই না। এটাকে কেউ এমনি একটা ঘটনার বিবরণ হিসেবেও দেখতে পারে, আবার কেউ মারার এখনকার মনের ছবি হিসেবে দেখতে পারে, যেখান থেকে অকলুষ উল্লাস ও দ্রবতার সহসা নির্বাসন ঘটছে। এক সময় লিসার মা’র সঙ্গে বাড়ি-বদলের হেড-মিস্তিরির একটা ভাল-লাগা তৈরি হয়, জানলা সারাতে সে যখন ব্যস্ত, মা বলে, কিছু জানলা বন্ধ হতে চায় না, জোর করতে গেলে আর্তনাদ করে। তখন কেউ কাচ ভেঙে দেয়, জানলা আর কিছু বলে না, কারণ সে তো খোলাই থাকে। মিস্তিরি বলে, যদ্দিন না সেটা সারিয়ে দিতে কেউ আসছে। মা বলে, তারপর একটা হাত আসে, যা সেই সারাতে-আসা লোকটার হাতকে আদর করে, কাঁধকে, গলাকে, তারপর সেই লোকটা পাথর হয়ে যায়। এবং জানলাটাকে আর কিছু করে না। মিস্তিরি বলে, তাতে জানলাও সুখী হয়, সেও। আবার ফ্ল্যাটবাড়ির যে-মেয়েটি কখনও ঘর থেকে বেরোয় না, তার সম্পর্কে একটা বাচ্চাকে মারা বলে, ওর কোনও ত্বক নেই, তাই কোনও ডিফেন্স নেই। কারও সঙ্গে মিশলেই সে গলে যাওয়া লাভার মতো তার গায়ে লেগে যায়, এবার ছাডা়ছাড়ি খুব কষ্টের হয়। তাই সে ঘরেই থাকে, থাকতে থাকতে একদিন আর ঘুম থেকে উঠবে না। কিন্তু তদ্দিন বাস করবে শুধু একাকিত্ব, আকাঙ্ক্ষা আর যন্ত্রণার সঙ্গে।

    লিসা আর মারা-র সম্পর্ককে লিসার মা ভাল চোখে দ্যাখে না। মারা যখন লিসাকে একটা কাগজ উপহার দেয় (তাতে লিসার নতুন বাড়ির ফ্লোর-প্ল্যানটা আঁকা আছে), আর লিসা মারাকে চুমু খায়, মা একটু কঠোর গলাতেই বলে ওঠে, এবার তোমারও হারপিস হয়ে যাবে। পরে এই মা’কে মারা বলে, সে যখন প্রিন্ট নিচ্ছিল ফ্লোর প্ল্যানটার, হঠাৎ একবার প্রিভিউ করতে গিয়ে সব জড়িয়েমড়িয়ে এমন কাণ্ড হয়ে গেছিল, লাইনগুলো লাইনের ওপর উঠে, ছবি আবোলতাবোল হয়ে গিয়ে, কোনও কিছুর মানে বোঝা যাচ্ছিল না। তারপর যতবারই চেষ্টা করল, ওরকমটা আর হল না, সবই স্পষ্ট থাকল, যেমন থাকা উচিত। কে জানে, হয়তো সে চাইছিল জড়ানো, না-বোঝাতে-পারা ছবিটাই দিতে। লিসা কোনও কারণে তার মাকে সহ্য করতে পারে না, বাবা আসবে কি না বারবার জানতে চায়, আর মাকে আঘাত করতে ছাড়ে না। মা হেড-মিস্তিরির সঙ্গে খুব হাসাহাসি করছে দেখে সে ‘থামো!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে, পরে একসময় মাকে বলে, সে কোনও দিনই তাকে মা বলে ভাবেনি, একবার তাকে মেল করতে গিয়ে কম্পিউটারে কী একটা ভুল করে টিপে ফেলায় এ (Alt T) একটা ডেথ-ক্রস চিহ্ন চলে এসেছিল, লিসা ভেবেছিল ওটা সুদ্ধুই পাঠাবে, কিন্তু তারপর ডিলিট করে দেয়। তারপর বুঝেশুনে আবার চিহ্নটা ফুটিয়ে তোলে, আবার ডিলিট করে দেয়। মা’র সঙ্গে মিস্তিরির একটা প্রণয় গোছের হচ্ছে দেখে লিসা মা’র উপহার দেওয়া ছোট্ট গাছ ছিঁড়েখুঁড়ে নষ্ট করে দেয়, যদিও তা আমরা নিশ্চিত জানি না, মা যখন ওটা দেখতে পায়, লিসা বলে, পড়ে গিয়ে এরকম হয়ে গেছে।

    ছবিতে মাঝে মাঝে একটা বুক-উদ্বেল করা বাজনা বেজে ওঠে, তখন ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু শট দেখানো হয়, হয়তো ফ্লাস্কের ওপর তপ্ত বাষ্পের বুড়বুড়ি কাটা, কল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল, ক্যাবিনেটের ওপর স্ক্রু-ড্রাইভারের আঁচড় ( মারা ঘষে দিয়েছিল), মারা-র আঙুল থেকে খোলা রক্তমাখা ব্যান্ডেড, জানলার আলসেতে তার নিভিয়ে দেওয়া সিগারেট-টুকরো, একটা স্পঞ্জ যা কুকুরটা চুরি করে নিয়েছিল আর অন্য জায়গায় ফেলেছিল, আর অবশ্যই সেই মাকড়সা— ছবির নামে যে আছে— যা লিসার গায়ে উঠেছিল, সেখান থেকে পরম আদরে মারা নিয়ে নেয়, তারপর তার হাত থেকে লিসা নেয়, কিছুক্ষণ এমন চালাচালির শেষে লিসা সেটাকে দেওয়ালে ছেড়ে দিয়ে আসে। প্রথম দিনের শেষে সবাই গাড়ি করে বাড়ি ফিরতে থাকে, লিসা তার ফোনে কী একটা মেসেজ দেখে হাসে, মারা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, তার কান্না আসছে, আর সেসময় এই ছবি মিস্তিরিদেরও ভোলে না, তারা একটা জায়গায় বসে বিয়ার খাচ্ছে। এই বাজনা সহসা থেমে মাটি ড্রিল করে শলাকার ঢুকে যাওয়া দেখানো হয় ফের, এবং সেটা এবার মনোযোগ দিয়ে দেখছে একটা বাচ্চা ছেলে। এরপর দেখানো হয় লিসা-মারা’র ফ্ল্যাটবাড়িটায় থাকা অনেককে: এক প্রবীণা মহিলা, যাঁর বাড়িতে প্রতিবেশীর বেড়াল ঢুকে পড়েছিল বলে তিনি সেটাকে পুষে নেন, পরে তাঁর বাজারের থলেতে বেড়ালের খাবার দেখে কার সন্দেহ হয়, এবং কেয়ারটেকার এক সময় তাঁর ফ্ল্যাটের চাবি খুলে দেখতে পায় বেড়াল বসে আছে। একটি মেয়ে, যে সারাদিন ঘুমোয় ও রাতে জিম যায়। একটি মেয়ে, যার ঠোঁটের নীচে পিয়ার্সিং সে খুলে ফেলেছে, এখন মদ খেয়ে সেই ফুটো দিয়ে মদ উগরে দিতে পারে। একটি ছেলে, যে তাকে স্পষ্টই ভালবাসে কিন্তু সে ছেলেটিকে অতটা চায় না। একটা গল্প বলে লিসার মা। লিসা ছোট থাকার সময় তাকে একটা পাখির পালকের জ্যাকেট কিনে দেওয়া হয়েছিল, আর বলা হয়েছিল এটায় ভর্তি পাখি আছে, চুপ করে থাকলে যাদের ডাক শোনা যায়। আর পালক ছিঁড়ে বের করে নিলে একটা করে পাখি মরে যায়। লিসা তারপর পালক ছিঁড়ে বের করেছিল, আর জ্যাকেটটাকে ভয় পেত, কারণ তা মরা পাখিতে ভর্তি। যখন প্রবীণা মহিলার কথা বলা হয়, তাঁর ঘরে নিখুঁত গোছানো একলা বিছানার কথা বলা হয়, আর সেখানে বসে বসে তাঁর বেড়ালটার কথা ভাবার কথা বলা হয়, কিছু পরে একটা শটে তাঁকে দেখা যায়, সেই একলা ঘরে বসে তিনি বিছানায় হাত বোলাচ্ছেন। এদিকে লিসার শৈশবের সেই জ্যাকেটের পালকগুলো ছিঁড়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আগেই, একটা কোত্থেকে সেই প্রবীণার বিছানাতেও এসে পড়েছে।

    এরা পরস্পরকে প্রেম করে, না ঘেন্না করে, না একইসঙ্গে দুটোই করে, আমরা বুঝতে পারি না। মিস্ত্রির ছেলে মারা-র সঙ্গে কথা বলে, কেমন হবে সেই ছেলেটির আর পিয়ার্সিং-মেয়ের সম্পর্ক, তা-ই নিয়ে। কিন্তু সত্যিই তা নিয়ে কি? না কি, সেটার বকলমে, নিজেদের সম্পর্ক হলে কেমন হত, তা নিয়ে?

    পরের দিন সকালে লিসা ও মারার একটা বিচ্ছিরি ঝগড়া মতো হয়, লিসা কাপ ভেঙে ফেলায় মারা বলে, নতুন যে মেয়েটা এই ফ্ল্যাটে আসবে, আশা করা যায় তোর চেয়ে যত্নবতী হবে। আর লিসা বলে, আশা করা যায় সে তোর সঙ্গে থাকতে পারবে, কারণ তুই তো মরার দিনটা অবধি এইখানেই থেকে যাবি, কোথাও যেতে পারবি না। তার একটু পরেই মারা একটা থার্মোকলের কাপের ভেতর একটা পেন্সিল ঢুকিয়ে দেয়, প্রায় মাটি ড্রিল করে যন্ত্র ঢোকানোর মতোই সে কাজ, তীব্র ও নিষ্ঠুর। গোটা ছবিটা কিছু প্রতীক, কিছু ইঙ্গিত, কিছু আশ্চর্য অপ্রত্যাশিত সংলাপ, কিছু কেজো সংলাপ, অনেক মানুষের অনবরত আসা-যাওয়া মিলিয়ে তৈরি। গল্পটা শুধু মারা-র, কিন্তু কোলাজধর্মে তা অনেকেরই, কারণ আমরা বহু ব্যাপার ভাল বুঝতে না পারলেও অনেক চরিত্রের প্রতি আগ্রহী হই ও মাঝেমাঝে সমব্যথীও। ফ্ল্যাটের বিভিন্ন বাড়িতে ও ঘরে যারা থাকে, তাদের অনেকের সম্পর্ক আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় না। যে দুই মেয়েকে মনে হয় যৌন প্রতিদ্বন্দ্বী, তাদের পরে মনে হয় যৌন সহযোগী। রাতে ওই বাড়িতে একটা ফেয়ারওয়েল পার্টি হয়েছিল, তাতে মিস্তিরির ছেলেও এসেছিল, কারণ তার মারা-কে পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু মারা তাকে পাত্তা দেয় না। ছেলেটি তখন সেই পিয়ার্সিং-মেয়েটির সঙ্গে শোয়। আবার সেই মেয়ে যখন পাশে ঘুমন্ত ছেলেটিকে আদর করছে, তা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছে দিনে-ঘুমোনো মেয়েটি। পরের দিন, সেই মেয়েটির ঘরে ছেলেটিকে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় পিয়ার্সিং-মেয়ে। এরা পরস্পরকে প্রেম করে, না ঘেন্না করে, না একইসঙ্গে দুটোই করে, আমরা বুঝতে পারি না। মিস্ত্রির ছেলে মারা-র সঙ্গে কথা বলে, কেমন হবে সেই ছেলেটির আর পিয়ার্সিং-মেয়ের সম্পর্ক, তা-ই নিয়ে। কিন্তু সত্যিই তা নিয়ে কি? না কি, সেটার বকলমে, নিজেদের সম্পর্ক হলে কেমন হত, তা নিয়ে? তারপর মারা ছেলেটিকে বলে, আমি তোমায় ভালবাসি না। এখানে একটা মাছি আছে (অনেকক্ষণ ধরে ভনভন করছিল)। হয়তো সে তোমায় ভালবাসে। কিন্তু আমি এবার মাছিটাকে মেরে ফেলব। তারপর সে এক সপাট আঘাতে মাছিটাকে মেরে ফ্যালে। তারপর বলে, এবার আর কেউই তোমায় ভালবাসে না। কিন্তু তার চোখ দেখে সারাক্ষণ উল্টোটাই মনে হয়। সারা ছবি জুড়ে কত যে তাকিয়ে থাকা আছে, ইয়ত্তা নেই। লিসা মারাকে বলছে, সে স্বপ্নে দেখেছে সে বয়স্ক মারার গায়ে হাত বোলাচ্ছে কিন্তু তার জামায় ও চামড়ায় ময়লা, আর লিসার মা দাঁড়িয়ে শুনছে। প্রবীণা সম্পর্কে ওরা কথা বলছে যে বেড়ালটা নিয়ে নেওয়ার পর থেকে প্রতিবেশীর দিকে তাকালে ওঁর মুখে থাকত হাসি কিন্তু চোখে থাকত জল, আর তিনি দরজা খুলে শুনছেন। যে কোনও দুজন কথা বললে, সেই কথা শুনতে পায় অনেকে, কেউ কাজ করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়ে, কেউ উৎকর্ণ হয়ে নিজের ঘর থেকে শোনে, কেউ কথা-রতদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এবং সেই তাকানোও মুহূর্তে বদলে যায়। যার তাকানোর মধ্যে কামনা আছে, একটু পরেই সেখানে ক্রোধ এসে বসে। বা হতাশা। ছবিটা যেন মারা-র সেই পিডিএফ-এর ভুলের মতোই বলতে চায়, অর্থবোধক শব্দ সবটা প্রকাশ করে না। বা এমনকী ভাবনার উল্টোটাও প্রকাশ করে। চরিত্রদের ব্যবহারেও ধারাবাহিকতা দেখা যায় না। যে-মেয়ে মাকড়সার প্রতিও সদয়, সে নিজের বান্ধবীর হবু প্রতিবেশীর প্রতি রূঢ়, এবং তার কুকুরের গায়ে গরম কফি ফেলে দিতে পিছপা নয়। যে মেয়ে এখুনি গালাগাল দিল, সে তারপরেই সান্ত্বনাময় কথা বলে। যে লিসার মা মারাকে পছন্দ করে না বলে মনে হল, পরেরদিন মারার সঙ্গে তার যেন দিব্যি একটা সখ্য তৈরি হয়। লিসার পোশাকে মদ পড়ে যেতে মারা বলে, তোর জামাটাও এবার মাতাল হয়ে গেল, আর লিসার মা হেসে ওঠে। লিসা তাতে আরও রেগে যায়। আবার, যে পিয়ার্সিং-মেয়ে মারা-কে ঈর্ষা করছে বয়ফ্রেন্ডের ঈপ্সিত বলে, মারা-র সামনে এসে ঝরঝর করে নির্ভার হেসে ফ্যালে, তারপরেই বয়ফ্রেন্ডকে নগ্নস্তনী অন্য মেয়ের দিকে ঠেলে দেয়, যাতে মারা তাদের আশ্লেষ দেখতে (আসলে বন্ধ দরজার ওপার থেকে কথা ও ধ্বনি শুনতে) বাধ্য হয়। সেই ছেলেটিরও ভাল লাগে মারা-কে, কিন্তু সে শোয় একবার মেয়ে১ ও একবার মেয়ে২-এর সঙ্গে, আর দ্বিতীয় সঙ্গমশয্যায় যখন মারা এসে বসে, হাত ধরে বলে, যেও না।

    আবার কী আশ্চর্য, থিম মিউজিক-টা চলছে এবং পর পর শট দেখানো হচ্ছে: গ্লাসের গর্ভ থেকে পেনসিল খুলে নিচ্ছে মারা, মদ উপচে পড়ে যাচ্ছে, টেবিল ভাসিয়ে মেঝেতে পড়ল, কুকুর তা চেটে খাচ্ছে, কুকুরেরই কামড়ানো ভ্যাকিউম ক্লিনারের তার সেলোটেপ দিয়ে ঠিক করা হয়েছে— তা এককোণে রাখা, মারা-র আঁকা কয়েকটা ছবি, লিসার মা’র উপহার দেওয়া ছোট্ট টবে গাছ, লিসার মা পিয়ানো বাজাচ্ছে,— হঠাৎ এর পরে এসে পড়ে একটা শট, যেখানে হোটেলের ঘরে একটা বিছানা ঠিক করছে একটা হাত। কী হল? চমকে গিয়ে আমাদের মনে পড়ে এই বাড়ির এক মেয়ে সম্পর্কে কিছুক্ষণ আগে মারা-র বলা একটা গল্প। সেই মেয়েটি হোটেলে কাজ করত কিন্তু অন্য কাজ পছন্দ হত না, শুধু ঘর পরিষ্কার করতে ভাল লাগত। তাই এখন সে বিলাস-জাহাজে কাজ নিয়েছে, শুধু শান্তিতে ঘরের পর ঘর পরিষ্কার করে যায়, আর হয়তো ভাবে এই বাড়িতে রাখা একটা পিয়ানোর কথা, যা সে প্রায়ই বাজাত। পরের শটে সেই মেয়েটি জাহাজের ঘরের টেবিলে এসে হাত রাখে, তারপর জাহাজের জানলার কাছে যায়, সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ক্যামেরা ফিরে আসে এই বাড়িতে মারা-র মুখে, সে হাসছে। মুচকি হাসি, যেন মেয়েটির সার্থকতার বোধে সে খুশি। তাহলে আমরা কি ছবি জুড়ে প্রায়ই মারা-র মনোজগতের ছবি দেখছি? তার যে-মেয়েটার কথা মনে পড়ছে, তাকে আমরা এখন দেখলাম। গতকাল রাতে প্রবল ঝড়বৃষ্টির সময় সে জানলা বন্ধ করতে উঠে দেখেছিল, সামনে বাড়ির কুঁড়েঘরের মতো টালির ছাদে দাঁড়িয়ে প্রবীণা সোল্লাস ভিজছেন ও তাকে হাত নেড়ে ডাকছেন, সেটা তার মানে ছিল তার কল্পনা? সে তো একটা সংলাপে বলেছে, আমি চোখের পাতা না ফেলে মিথ্যে বলতে পারি, এবং আরেক দৃশ্যে একটা বাচ্চাকে বলেছে, আমি মিথ্যেবাদী। সে কি কিছুটা বাস্তব কিছুটা কল্পনা মিশিয়ে তৈরি করছে একটা ভাবনাস্রোত, যা আমরা দেখছি? বা, আমরা বাস্তবই দেখছি, তার মধ্যে প্রায়ই ঢুকে পড়ছে তার ভাবনা? মারা-কে যার খুব ভাল লাগে, সেই মিস্তিরি-ছেলেটির সঙ্গে এ-বাড়িতে বসে থাকার সময়েও কেন মারার গায়ে একটা মাকড়সা উঠে আসে, এবং সে সেটাকে পরম যত্নে চালান করে দেয় ছেলেটির হাতে, যে আবার ফিরতি দেয় মারার হাতে? এই মাকড়সা নিশ্চয়ই আরেকটা মাকড়সা, লিসার সঙ্গে চালাচালির আগের বাড়িটার-টা নয়। না কি একই মাকড়সা, যাকে মারা বারেবারে তৈরি করে, আর দ্যাখে কেউ তার সঙ্গে স্পর্শ ভাগ করে নিতে চায় কি না? কারণ সে তো বলেইছে, তার শৈশবে তার ঘরের দেওয়ালে, ঠিক খাটের ওপর, একটা মাকড়সা থাকত। মা তাকে তাড়াতে গেলেই মারা উচ্চৈঃস্বরে চেঁচাত, কারণ রাত্রে মাকড়সা এসে তার সঙ্গে দেখা করে গেলে তবেই সে ঘুমোতে পারত। সেই মাকড়সা অবশ্য কোথায় চলে গেছিল, এবং তার জাল রয়ে গেছিল, তারপর তাও কোথায় উধাও হল। তাকে, সেই নিশ্চিত বন্ধুকে কি নির্মাণ করে মারা, এবং নির্মাণ করতে চায় নিশ্চিন্ত শৈশব, আশ্বাস-আশ্রয়?

    আবারও আশ্চর্য করে দিয়ে, এতগুলো চরিত্র থাকতে, ছবি শেষ হয় সেই জাহাজে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়া মেয়ের নিজভাষ্যে। সে দ্যাখে জাহাজটা সারাক্ষণ প্রকাণ্ড ওলটপালট খায়, কিন্তু জাহাজের মধ্যে সব স্থির থাকে, সে নিজে, অন্য যাত্রীরা, মোমবাতি, ফুলদানি। হয়তো জাহাজের নিজের চুম্বক-প্রতিভায়। সারাদিন সূর্যের তাপ তার চোখ ও সমুদ্রের ত্বককে জাগ্রত রাখে, রাতে সে সমুদ্রের তলার বিশাল নীরব অন্ধকার রাজত্বের কথা ভাবতে পারে। আর, জাহাজের ডেক-এ দাঁড়িয়ে সে কল্পনা করে, তার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, আর জ্যোৎস্না তাদের দুজনকে ধুয়ে দিচ্ছে। নেপথ্যে যখন এই কথা চলছে, সেই সময় মন্তাজে সব প্রধান চরিত্রকে দেখানো হয়, এমনকী সেই মেয়েটিকেও দেখাতে ভুল হয় না, যে বাড়ির উল্টো-ফুটের দোকানে সারাদিন তাক-এ জিনিস গোছায় রোবটের মতো, কিন্তু মারা তাকে একদিন ক্যাফেতে দেখেছিল, খুব হেসে বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে। ছবি জুড়ে আছে উপমা, প্রতীক, সংলাপের সামান্য পুনরাবৃত্তি, এমনকী আচরণেরও (লিসার মা যেভাবে মিস্তিরিকে আদর করে, রাতজাগা মেয়ে সেভাবেই আদর করে মিস্তিরির ছেলেকে), কিন্তু সব ছাপিয়ে আছে জীবন, তার লাখো অনুপুঙ্খে (কারণ এ ছবি জীবন-ডিটেলের উদযাপনও বটে— জানলা খোলার সময় রোদ্দুরের ঝিলিকের প্রাণময়তায়, স্টিল লাইফ চিত্রের মতো জামা-জুতো কুঁকড়ে থাকায়, গেলাস থেকে মদ পড়ে উপহারের কাগজ ভিজিয়ে টেবিল ভাসিয়ে দেওয়ার অনিবার্যতায়), আর তার প্রায় অবাস্তব অতিলৌকিক বহমানতায়।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook