অবান্তর লিস্টি
ট্রেন দুর্ঘটনায় মরে, নৌকো চড়ে গাদাগাদি করে অন্যদেশে পালাতে গিয়ে ডুবে মরে, আফগানিস্তানে থাকলে মেয়ে হলেই মরে বা জ্যান্তে মরে— হয়তো যৌন দাসী করে রাখা হল, আমেরিকায় থাকলে অতর্কিতে কোনও একা-পড়ে যাওয়া অবসাদগ্রস্ত বেপরোয়ার গুলিতে মরে, মণিপুরে থাকলে কুকি হলে এবং মেতেইদের সামনে পড়ে গেলে বা মেতেই হলে এবং কুকিদের সামনে পড়ে গেলে মরে। পোকামাকড়ের মতো মরে। এদের ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’ বলা হলে হাসি পায়, এদের মাথার উপর এমন একজন বিরাজ করছেন যিনি সদাকরুণাময় ও স্নেহছলছল— শুনলে হেঁচকি ওঠে। কিন্তু আরও প্রকাণ্ড মজা হল, মানুষ মারেও অতই সহজে। উগান্ডায় বাচ্চাদের ইস্কুলে গিয়ে গুলি করে, কুপিয়ে, এবং ঘরে আটকে পুড়িয়ে মেরে আদর্শ ফলাল কিছু উগ্রপন্থী, প্রতিবেশীরা শুতে যাওয়ার আগে শুনতে পেতেন সেই ছাত্রেরা গান গাইছে, তাঁরা আচমকা একদিন সম্মিলিত কর্কশ আর্তনাদ শুনতে পেলেন। এভাবে এই উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ছাত্রদের মেরেছে ১৯৯৮ সালেও, আবার মারল এই ২০২৩-এর জুন মাসেও। অসুবিধে কোথায়? আমার অমুকের শাসন পছন্দ নয়, তাহলে তার রাজত্বকে বিপর্যস্ত করতে আমি নিরাপদ শিকার বেছে নেব, এখানে বাচ্চা মারব, সেখানে গেরস্থ মারব, যাতে আমার গায়ে প্রতিরোধী গুলি না লাগে, আর আমি হাসতে হাসতে শিবিরে ফিরে এসে ঝাল-ঝাল আদর্শ প্রচারিতে পারি। আবার হন্ডুরাসে মহিলাদের জেলখানার মধ্যেই একটা গ্যাং তাদের উল্টোদলের কয়েদিদের গুলি করে কুপিয়ে এবং পুড়িয়ে মারল, কীভাবে তারা এতগুলো অস্ত্র হাতে পেল সেও বিস্ময়, আর যত বিদ্বেষ থাক এত হিংস্রভাবে ৪৬টা মেয়েকে হত্যা করার অনায়াস নিষ্ঠুরতা আয়ত্ত করল কী করে সেও স্তম্ভিত করার ব্যাপার। অবশ্য তা বলা একদম ভুল হল, হন্ডুরাসে প্রায়ই প্রতিদ্বন্দ্বী গুন্ডাদলের হাঙ্গামা লেগে থাকে, জেলখানাতেও প্রকাণ্ড দাঙ্গা হয়, ২০১৯-এই জেল-যুদ্ধে ১৮ জন মারা গেছে। আসলে সভ্যতা বা মহাপুরুষের কোটেশন যা-ই শেখাক, মানুষ মনে করে, আমি আমার শত্রুকে থেঁতলাব। চোখ গেলে দেব। ধরা পড়ার ভয় না থাকলে প্রতি মিনিটে অলিতে-গলিতে ৩২ জন সবল মুগুর মেরে অন্তত ৩৩ জন দুর্বলকে (৬৪-ও হতে পারে) ফ্ল্যাট করে দিত। অনেকে তো এখন লিভ-ইন সঙ্গিনীকে খুন করে আবার টুকরো করে কেটে কিছু অংশ রেঁধে খেয়ে অবধি নিচ্ছে। আপদও গেল, খিদেও মিটল, মন্দ কী? বারেলিতে ৩০ বছর বয়সের এক সমকামী মহিলা এক তান্ত্রিকের কাছে গেছিলেন, লিঙ্গ-রূপান্তরের জন্য, যাতে তিনি বান্ধবীকে বিয়ে করতে পারেন। কিন্তু বান্ধবীর মা এই লেসবিয়ান সম্পর্ক ভাঙার জন্য তান্ত্রিককে অন্য কাজ করতে বলে। তান্ত্রিক সেই পরামর্শ অনুযায়ী, সাহায্যপ্রার্থিনীকে কুপিয়ে খুন করে, মৃতদেহটা অনেকটা পুড়িয়ে, একটা জঙ্গলে ফেলে দেয়। আর এলুরুতে যে মেয়েটি তাঁর বোনকে যে-তিনজন বিরক্ত করছে ও ফলো করছে তাদের বকেছিলেন, তাকে সেই লোকগুলো অ্যাসিড ছুড়ে মারল, তিনি অন্ধ হয়ে গেছিলেন, মাসখানেক হাসপাতালে থেকে এবার মারা গেলেন। আরও চমৎকার একটা ঘটনা ঘটল কানপুরের এক মাঠে, সেখানে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। ১৪ বছরের একটি ছেলের বল-এ ১৭ বছরের একটি ছেলের স্টাম্প উড়ে গেল। ক্লিন বোল্ড। এ তো সহ্য করা যায় না। তার ওপর আবার ১০ টাকা বাজি ছিল, আউট করলে বোলার টাকা পাবে, না হলে ব্যাটসম্যান। এবার ব্যাটসম্যান ছেলেটি বলল, ক্রিজ ছেড়ে যাব না। বোলারের সঙ্গে ঝগড়া শুরু। তারপর ব্যাটসম্যানটি ফোন করে তার ভাইকে ডাকল এবং দুজন মিলে বোলারটিকে পেটাতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ ধোলাই দেওয়ার পর, তাকে পিচ-এ শুইয়ে গলা টিপতে থাকল, যতক্ষণ না সে মরে যায়। মিটে গেল। বোল্ড করেছ, খুন হলে। কে তোমাকে উইকেটে বল করতে বলেছিল? এই বোলারটির মাসি-কে ব্যাটসম্যানের পরিবার বছর তিনেক আগে পিটিয়ে মেরেছিল। তার মানে এই এদের বেশ একটা মারুয়া ঐতিহ্য আছে। এরা অপছন্দের লোককে একেবারে নিকেশ করে দেওয়ায় বিশ্বাস করে। আবার সুরাত এক্সপ্রেসে এক মহিলাকে তিনজন পুরুষ বিরক্ত করছিল, তারপর তাঁর সামনে বসে বিশ্রী খিস্তিখামারি শুরু করে, পরে ফোনে ছবি তুলতে শুরু করে, মহিলার সঙ্গে পুরুষ-আত্মীয় ছিলেন, তাঁরা দুজনে প্রতিবাদ করতে, পুরুষটিকে পেটানো হয়, মহিলাটিকে শারীরিক নিগ্রহ করা হয়। তাঁরা দুজন যখন পালাতে চেষ্টা করেন, ট্রেনের দরজার কাছে তাঁদের ঠেসে ধরে, মহিলার শাড়ি খুলে দেওয়া হয়, পুরো উলঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়, দুজন বয়স্ক লোক ছাড়া কোনও প্যাসেঞ্জার তার প্রতিবাদ করেননি। তারপর মহিলাকে তিনজন মিলে ধর্ষণের চেষ্টা করে, কিন্তু যখন দেখা যায় মহিলা ও পুরুষটির নিরন্তর বাধায় তা সম্ভব হচ্ছে না, তখন তাঁদের ধাক্কা মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর কী ঘটে, তা নিয়ে খবরের কাগজদের নানা মত। কোথাও লেখা, তাঁরা সংজ্ঞাহীন হয়ে রেললাইনের ধারে পড়ে ছিলেন, গ্রামবাসীরা দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কোথাও লেখা, দুজনেই ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় কিছুক্ষণ পড়ে থাকার পর পুরুষটি নিজের ছেঁড়া পোশাকে মহিলাকে আবৃত করে, তাঁকে পাঁজাকোলা করে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে পাঁচ কিলোমিটার জঙ্গলের পথ হাঁটেন, তারপর একটা গ্রাম পেয়ে সেখানে সাহায্য প্রার্থনা করেন, কেউ সাহায্য করে না, পরের গ্রামেও সবাই নারাজ, কারণ প্রায় নগ্ন এক মেয়ে চলেছে, সঙ্গে একটা পুরুষ, কে এসব ঘোটালায় জড়াবে। তৃতীয় গ্রামে এক বয়স্ক দম্পতি তাঁদের আশ্রয় দেন, মহিলাকে একটি শাড়ি পরতে দেন, ওষুধ দেন কাটাছেঁড়ায় লাগানোর জন্য এবং হাসপাতালে পৌঁছে দেন। ট্রেনে বস্ত্রহরণের সময় কেউ বাধা দেয়নি, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ ভারতীয়রা সাধারণত খুন বা ধর্ষণে বাধা দেয় না, অপরাধীর স্বাধীনতায় খুব বিশ্বাস করে, ট্রেন তো তবু একটা পাবলিক প্লেস, রাজসভার মতো ঘেরা জায়গাতেও এক সম্রাজ্ঞীর বস্ত্রহরণে কেউ বাধা দেননি, এমনকি প্রকাণ্ড বোধসম্পন্ন বয়স্করাও না (একজন ছোকরা প্রতিবাদ করেছিলেন, বিকর্ণ), এ আখ্যান আমাদের চেনা। তারপর গ্রামগুলোতেও কপালে দ্রুত হাত ঠেকিয়ে ‘মাপ করো, পথ দ্যাখো’ প্রতিক্রিয়া নিয়েও বলার কিছু নেই, হয়তো ধর্ষক মস্তানেরা পিছু ধাওয়া করছে, আমি শাড়ি দিচ্ছি দেখলে আমায় যদি পেটায়, তখন কে বাঁচাবে? পাশের গ্রামের মোড়ল? পশ্চিমবাংলায় পথ হাঁটতে আমি যদি দেখি পঞ্চায়েত নির্বাচনের বখেড়ায় গুলি চলছে আর একটা লোক পেটে গুলি খেয়ে গোঙাতে গোঙাতে আমার কাছে জল চাইল, আমি আর আমার মিনারেল ওয়াটারের বোতল মুহূর্তেকও সে তল্লাটে থাকব? বড়জোর তার কাতর চোখ আর রক্তভেজা রাস্তা আর কাটাপাঁঠার মতো ছটফটানির গল্প বলে মদের আসর জমাব। তাই এই লিস্টি বাগিয়েও আসলে কোনও লাভ নেই। যে কোনও দুদিনের খবরের কাগজ হাতে নিয়ে চোখ বুজে এখানে-ওখানে আঙুল রাখলেই এমন পঁচিশটা খবর দেখা যাবে, যেখানে মানুষের ব্যবহার তাকে নিকৃষ্টতম জানোয়ার হিসেবে দুহাজারবার প্রমাণ করে। যুগে যুগে তা-ই হয়ে এসেছে। চেঙ্গিজ খাঁ-র দলবল যখন অধিকৃত গঞ্জের লোককে অনর্গল কচুকাটা করত বা মেয়েদের ধর্ষণ করত, তখন কেউ ভাবত না সেুলো নীতিগত ভাবে অন্যায়, কারণ এরকমটাই তো দস্তুর। এখন কেউ কেউ ভাবে, বা একটু লেখালিখি চেঁচামেচি হয়। এর বাইরে কোনও তফাত হয়নি। হওয়া শক্ত, কারণ প্রাণপণ সুললিত উপদেশ আর বুঝদার বুকনিতেও জন্তুর প্রবৃত্তি পাল্টায় না। মানুষ মানুষকে মারবে। এবং যদি-বা নিজে না মারে, মার খাওয়ার ভয়ে প্রহারকারীকে বাধা দেবে না। এভাবে বসুন্ধরা চলবে, চাট্টি বড় বড় বাণীর আড়ালে যারা লুকোতে চায় লুকোবে, তাতে বাস্তবের কিস্যু এসে যায় না। সত্যি বলতে কী, যাঁরা বলেন মনুষ্যজীবন এক বিশাল গভীর কাণ্ড, তার তাৎপর্য আকাশচুম্বী, তাঁদের হাত (বা আলখাল্লা) ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে চিড়বিড়ে রৌদ্রে একটা গণধোলাইয়ের মুহূর্তে হাজির করতে পারলে মন্দ হয় না। তবে একটা প্রাপ্তি আছে, এই খবর বা তার কম্বো নিয়ে সার্থক ওয়েব-সিরিজ তৈরি হতেই পারে, যেমন একসময় বিজয় তেন্ডুলকর বা মহেশ এলকুঞ্চওয়রের নাটক হযেছে, বা শ্যাম বেনেগাল গোবিন্দ নিহালানির সিনেমা। আর তা দেখে যদি গোল্লা-গ্লোবের ২০ জনের তিন মিনিট করে মুঠো ক্রোধ-কঠিন ও রগ বেদনা-দবদব হয়, তবেই আমরা পেয়ে গেলাম এক নিটোল ঘণ্টার সহ-মরম, যা এই সভ্যতার পক্ষে প্রায় অমৃত-আইসক্রিম।