খুট করে শব্দটার ঠিক পরেই শোনা গেল একটা ঘরঘর আওয়াজ। দেওয়ালের একটা চৌকো অংশ পেছন দিকে হেলে যেতে শুরু করল। বিলি গিলচার বললেন— এটা আসলে একটা কাঠের পাটাতন, উপরে ইঁট দিয়ে ক্যামোফ্লাজ করা আছে। কাঠের পাটাতনটা হেলে গিয়ে সেতু তৈরি করে জুড়ে যাচ্ছে একটা গোপন আন্ডারগ্রাউন্ড চেম্বারের সঙ্গে। চেম্বারটা আসলে একটা উইং। সেলুলার জেলের উইং। এটা এই জেলের একটা বিশেষত্ব। সবকটা উইং-এর সঙ্গে মূল টাওয়ারের যোগাযোগ তৈরি হত এরকমই কাঠের পাটাতন ফেলে। এখানে পাটাতনটা ইঁটের পোশাক পরানো, তার কারণটা বুঝতেই পারছ। প্রিটি সিম্পল। এটা সেলুলার জেলের একটা ভূগর্ভস্থ স্পেশ্যাল শাখা। সেলুলার জেলের অনেককিছুই সরকারি হিসেবের বাইরে। এই গোপন ভূগর্ভস্থ শাখার হদিশও কোনও লিখিত তথ্যপঞ্জীতে পাবে না। এটার সন্ধান আমি পেয়েছি অবশ্য আমার ব্যক্তিগত কাগজপত্রে। আমার পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া নথি। আমার বাবা আমেরিকান, কিন্তু মা ছিলেন এক অভিজাত ব্রিটিশ রমণী। আমার দাদু ইংল্যান্ডের বিখ্যাত এক ঐতিহাসিক চরিত্র। বিংশ শতকের প্রথম ভাগে এই সেলুলার জেলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কারাধিপতি ছিলেন তিনি। নাম— ডেভিড ব্যারি। এই গোপন উইং তাঁর নিজস্ব অধিকার। এখানে যা ঘটেছে, তা কোনও আইন আদালত মেনে ঘটেনি। আর এটা নিয়ে আমি অন্তত গর্ববোধ করি। অপরাধীকে যোগ্য শাস্তি দিতে তাঁর হাত কখনও কাঁপেনি, তাঁর বিবেক অবিচলিত থেকেছে। যে জায়গাগুলোয় প্রচলিত আইন নুইয়ে পড়েছে, তাঁর মেরুদণ্ড কিন্তু অবিচলিত থেকেছে। তাঁকে নিয়ে আমাদের পরিবার তাই বরাবরই শ্রদ্ধাশীল থেকেছে।
— আমরা একটা হাসপাতালের মাঝখানের চত্বরে, একটা পরিত্যক্ত কুয়োর তলায় এসেছি বিলি। এটা সেলুলার জেল কী করে হবে?
— সেলুলার জেলের আজকের যে চেহারাটা দেখা যায় এরিক, সেটা আসলে সাতভাগের আড়াই ভাগ। পুরো আর্কিটেকচারটা ছিল সাত রশ্মিবিশিষ্ট একটা সূর্যের মতো। মাঝখানে একটা টাওয়ার— তার সাতদিকে চলে গেছিল সাতটা উইং। প্রত্যেকটা উইং তিনতলা, প্রতি তলায় নির্দিষ্টসংখ্যক বন্দীশালা। উফ্ কী অনবদ্য ছিল ব্যাপারটা ভাবতে পারছ! এর সবটাই নানা বিপর্যয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। পড়ে আছে উইং নম্বর এক, সাত আর ছয়ের অর্ধেক। মাটির তলার এই অংশটা আসলে পাঁচ নম্বর উইং-এর গোপন অংশ। এটার ঠিক উপরেই ছিল পাঁচ নম্বর শাখার ধ্বংসাবশেষ। সুনামির পর ঠিক হয় ওই ধ্বংসাবশেষ আর রাখা হবে না। ওইসব কিছু পরিষ্কার করেই তৈরি হল নতুন এই হাসপাতাল। কিন্তু মাটির তলায় এই অংশটা রয়েই গেল। এটা নিয়তি, যে এই অংশটা পড়েছে হাসপাতালের দুই বাড়ির ঠিক মাঝখানে। ফলে বাড়ির পিলার গাঁথতে যারা মাটি খুঁড়েছে, তারা এর সন্ধান পায়নি।
— তা বেশ। ধন্যবাদ বিলি। দারুণ একটা জায়গা দেখা হল। এবার তবে ফেরা যাক, সন্ধে হয়ে আসছে। ভেতরটাও অন্ধকার।
— ফিরব কী হে? অন্তত একটা সেলের ভেতরে ঢুকে না দেখলে তো বিষয়টা অনুভব করতেই পারবে না। তাই জন্যই আমি চুরুটটা ধরাইনি এখনও, মাটির তলার ঘরে বুঝতেই পারছ, ধূমপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনিতেই অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতসেতে জায়গা! অবশ্য আমরা সামান্য সময়ই থাকব। কেন এখানে তোমায় এনেছি, সেটাও তো বলা দরকার! ওটা সেলের ভেতর ঢুকে বললেই ভাল জমবে! চলো চলো এরিক, ভয়ের কিছু নেই। সাপেদের এখনও শীতঘুম ভাঙেনি। আর আমার পকেটে একটা শক্তিশালী টর্চ আছে। ওটা জ্বালালে অন্ধকারে দেখতে পাবে সবই…
অনিচ্ছাসত্ত্বেয় একটা কারা-ঘরের ভেতর ঢুকতে বাধ্য হলেন এরিক দত্ত। বিলি গিলচার জোর করছেন যখন! বিলিও ভেতরে ঢুকলেন, ঢুকে টর্চটা জ্বেলে আলো ফেললেন ভিজে আর বুনো গন্ধ মাখানো ঘরটায়। তারপর দরজাটা আড়াল করে দাঁড়ালেন। বললেন— শোনো এরিক, প্রোজেক্ট বিটিটু-র কাজকর্মের সূত্রে কিছু বেয়াড়া লোককে ছোটখাটো শাস্তি দেওয়া অবশ্যপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। এখন আমরা তো আর প্রথাগত আইনের দ্বারস্থ হতে পারব না! নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়া ছাড়া অন্য রাস্তা নেই। তা আমার প্রস্তাবটা হল, প্রয়োজনে কয়েকজনকে এখানে বন্দি করে রাখলে কেমন হয়? আর কেউ তো এসব কথা জানতেও পারবে না! শপথ করে বলছি, মাত্র কিছুদিনের জন্যই বন্দি করব। কাউকে মারব না, ধরব না। চোখ বেঁধে আনব। তারপর কিছুদিন পর ছেড়েও দেব। সে যতদিন আমাদের ‘রাজনৈতিক বন্দি’ হয়ে থাকবে, সেই সময়টায় গুছিয়ে নেব সংগঠনের গোপন কিছু প্রগতিশীল কাজ। কী? পরিকল্পনাটা কেমন মনে হচ্ছে?
এরিক দত্ত এ’রকম একটা বক্তব্য দুঃস্বপ্নেও আশা করেননি। তিনি চমকে তাকালেন বিলি গিলচারের দিকে। পুরো ব্যাপারটা তাঁর পাগলের প্রলাপ বলেই মনে হচ্ছে। অবশ্য বিলির মুখের ভাবভঙ্গী ঠাহর করা গেল না অন্ধকারে। টর্চের আলোটা বিলির হাতেই ধরা। এরিকের দিকেই তা তাক করা। অতএব কিচ্ছু দেখতে পেলেন না এরিক। শুধু রুদ্ধস্বরে বললেন— বিলি, এটা নিশ্চয়ই সিরিয়াসলি বলছ না তুমি। তা রসিকতাও যদি হয়, জানতে ইচ্ছে করছে— এটা ঠিক কোন ক্যাটাগরির রসিকতা!
২৩।
বর্তমান সময়
বিলি গিলচার বললেন— এটা আবার কী ধরনের রসিকতা ব্রহ্ম? এরিক কোথায় গেছে না গেছে, তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? তুমিই বা কী করে নিশ্চিত হচ্ছ যে ওর কোনও বিপদ ঘটেছে…
ব্রহ্মের চোখমুখ থমথমে হয়ে এল। তিনি উদাসদৃষ্টিতে দূরে কোথাও তাকিয়ে চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে ধীরেধীরে বললেন— বিলি, আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে যে এরিক এখনও ক্যাম্পে ফেরেনি। অন্য কিছু একটা ঘটেছে। খুব বিশ্রী, সাংঘাতিক একটা কিছু। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে— এরিক কি আদৌ বেঁচে আছে? তবে না না— এটা ভুল ভাবছি। এরিক অবশ্যই বেঁচে আছে। এরিকের বেঁচে থাকাটা যে কোনও লোকের জন্যই খুব দামি— সে যে পক্ষেরই লোক হোক না কেন। এরিক সম্পর্কে যা যা চিন্তা করছি— ওর বিপদ ঘটেছে কিছু একটা, তবে আপাতত ঠিকই আছে সে— এটা আমার একটা ইনট্যিউশন বলতে পারো। আমার ইনস্টিংক্ট, আমি দেখেছি, ভীষণ কার্যকরী হয়ে সত্যিটা আমায় জানিয়ে দেয়। তবে সে কথা না হয় পরেই হবে। আপাতত এটুকু শুনি— ওকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে তুমি, মিটিং-এর পর?
— দ্যাটস নান অফ ইয়োর বিজ়নেস।
ব্রহ্ম ঠাকুর বিলি গিলচারের ধমকে বলা উত্তরটা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন তাঁর দিকে। তারপর সব অবসাদ যেন এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে মুখের বিদ্রূপ-হাসিটা ফিরিয়ে আনলেন। আবারও তাঁর কণ্ঠে ঝলকে উঠল সেই পরিচিত স্ফূর্তি। বললেন— সুপার্ব বিলি, সুপার্ব। আহা কী সুন্দর বললে। তোমার ধমক যে কী মিষ্টি— এর কোনও তুলনাই হয় না! তবুও যে তোমার ‘বিজ়নেস’-এ আমায় সামান্য নাক গলাতেই হবে এবার বিলি! আমাকে কয়েকটা কথা এখন বলতেই হবে, যা আমার নয়, তোমারই ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত, বা বলা ভাল তোমার ক্র্যাক করা কোটি কোটি বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটা জবরদস্ত বিজ়নেস ডিল সংক্রান্ত, যে কথাগুলো আমার ধারণা স্যর ক্যাভির মতো অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং জিনিয়াস মগজও এখনও টের পাননি। আমি টের পেয়েছি যখন, অগত্যা আমিই না হই ব্যাপারটা ফাঁশ করি স্যর ক্যাভির কাছে? কী বলো বিলি?
বিলি গিলচার কপালে ভুরু তুলে তাকিয়ে রইলেন ব্রহ্মের দিকে। কিছুই বললেন না।
ব্রহ্ম বললেন— বেশ বেশ বিলি, তুমি নীরব যখন, আমি তাহলে সরাসরি স্যর ক্যাভিকেই বলি—শ্রদ্ধেয় স্যর ক্যাভি, আপনি কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছেন, আপনার প্রস্তাবিত কিছুকিছু ডিটেইল বাইপাস করে আপনার এই মানবহিতকারী গবেষণাকে বেমালুম হাইজ্যাক করে নেওয়া হচ্ছে? এটা করা হচ্ছে বর্তমান যুদ্ধযুগের ইনথিং, অস্ত্রভাণ্ডারের মিচকে শয়তান ‘এনার্জি বম্ব’ বানানোর বিশাল বাণিজ্যিক বরাত পেয়ে? এবং এটাও কি জানেন, প্রথম থেকেই এটা নির্ধারিত ছিল যে এমনটাই করা হবে? একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে যখন আপনি জানতে পারবেন, আপনার আর কিছুই করবার উপায় থাকবে না? কারণ আপনিও ততদিনে বনে যাবেন এক মার্কামারা ‘মারচেন্ট অফ ডেথ’! এই গবেষণায় আপনি জড়িয়ে ছিলেন, এই তথ্য সামনে ভাসিয়ে তখন উলটে আপনাকেই ব্ল্যাকমেইল করা হবে?
বিলি গিলচারের মুখটা এখন দেখবার মতো একটা রূপ নিয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন না এই আলোচনাটা চলতে দেওয়া উচিত, নাকি থামালেই ভাল। তবুও যতটা পারেন মনের জোর জড়ো করে বিলি বলে উঠলেন— বাড়াবাড়ি কোরো না টেগোর, সম্পূর্ণ আষাঢ়ে গল্প বানাচ্ছ তুমি…
— আষাঢ়ে গল্প? তাই না হয় বানাই একটু। শুনেই দ্যাখো না, ক্ষতি তো নেই! স্যর ক্যাভিও শুনুন, জানুন। একটা গবেষণা হাইজ্যাক করে নেওয়া বা হাইজ্যাক করবার উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু করে চালিয়ে নিয়ে যেতে হলে যেসব কাজ করতে হয়, সেগুলো পরপর গুছিয়েই তুমি করেছ বিলি। সিয়েটল ল্যাবের অ্যাকসিডেন্ট না হাতির মাথা! লজিক্যালি এবং টেকনিক্যালি ওটা পসিবলই তো ছিল না! এবং ওটা সত্যিই সম্ভব হলে ওখান থেকে কিছু লোকের পালানো এবং ধরা পড়া সম্ভব হত না। এই দুটো একসঙ্গে হবে কেমন করে? অ্যাকসিডেন্ট হলে সবাই মরত। আর পরিকল্পিত ব্যাপার হলে অনেক ভেবেই তার বাস্তবায়ন করা হত, অত সহজে হাইওয়ে-পেট্রলের কাছে ধরা পড়বার মতো গবেটরা অন্তত আমাদের বিটিটু প্রকল্পে কাজ করে না। কিন্তু দ্যাখো, অবলীলায় দুটো বিপরীতধর্মী জিনিস একসঙ্গে ঘটেছে। অতএব আমি প্রথম থেকেই বুঝেছি, এর পুরোটাই একটা ষড়যন্ত্র। ওটা আসলে তোমার তৈরি করা প্ল্যান। তুমি সিয়েটল ল্যাব এবং আমেরিকার পাট চুকোতে চাও যাতে স্টিফেন হকিং-এর মেশিনারির ছত্রছায়া থেকে তুমি বেরোতে পারো। তুমি পুরনো লোকেদের আর চাইছ না, কারণ এ ব্যাপারটায় তোমার একাধিপত্য ছাড়া সুবিধে পাচ্ছ না বিশেষ। তুমি আমার নাম প্রকাশ্যে এনেছ, মিথ্যে করে ‘দ্য হিডেন ব্যালেন্স’-এর কানে এ কথাটা তুলে দিয়েছ যে ‘বিটিটু’ মানে হল ‘ব্রহ্ম ঠাকুর প্লাস টু’, যাতে আমি ধরা পড়ি। তারপর একমাত্র আমাকেই বার্তা পাঠিয়েছ— ‘অ্যাবর্ট প্রোজেক্ট বিটিটু’। তার মানে ডেসপারেটলি তুমি আমায় বের করে দিতে চেয়েছ, যাতে ‘ব্যালেন্স’এর হাতে আমি ধরা পড়লেও তোমাদের কোনও ক্ষতি না হয়। এরপর কিশিমোতোকে তুমি তার বাবার প্রাণভয় দেখিয়ে বশ করেছ—
—শাট আপ টেগোর। শাট আপ। তোমার আর একটা কথাও—
— তোমায় শুনতে হবে না। কঙ্কালগুলো যেমন করে কানে হাত চাপা দিয়েছিল, তুমিও তাই দাও। কিন্তু স্যর ক্যাভি, আপনি শুনুন, যদি আপনিও এই প্ল্যানের অংশ না হয়ে থাকেন। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি— আমার সঙ্গে দেখা হতেই আপনি কিছু কড়া কথা আমায় শুনিয়েছেন। ষড়যন্ত্রকারী হলে হয়তো বিলির মতোই চকলেট হিরো বা লাভার-বয় হয়েই থাকতেন। ফলে আপনি এখন অন্তত, আমার বেনিফিট অফ ডাউট পাচ্ছেন। যাই হোক, আপনাকে জানানো যাক, এই প্রকল্পের অন্যতম পার্টনার হিসেবে আমাকে নির্বাচনের হকিং-সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা— যেটাকে আজ এই সাক্ষাতের প্রথমেই বিলি ‘ভুল সিদ্ধান্ত’ বলে দাগিয়েছে। শুনুন স্যর ক্যাভি, আপনি আপনার পরিকল্পনায় নেপচুনিয়াম ব্যবহার করবার কথা বলছিলেন। এবার ধরুন ধান্দাবাজি করে ওখানে বেশি পারমাণবিক ভরের ক্যুরিয়াম ব্যবহার করা হল।কী হবে বলুন তো? সামান্য এই অদলবদলেই কি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী গবেষণাটা অনেকটাই নতুন মারণাস্ত্র ‘এনার্জি বম্ব’ তৈরির একটা তাজা ষড়যন্ত্র হয়ে দাঁড়াবে না? কী মনে হচ্ছে আপনার, স্যর কেভিন ‘ক্যাভি’ আইজ়্যাক?
কথার তোড় থামিয়ে ব্রহ্ম মনেমনে ভাবলেন, মজা করে এই ষড়যন্ত্রের নাম দেওয়াই যায়— ‘শব্দ ব্রহ্ম দ্রুম’, যেখানে ব্রহ্ম আর দ্রুমের আসল অর্থ বদলে নিতে হবে। ব্রহ্ম হয়ে যাবে বোমার ভাল নাম, দ্রুম আর গাছ থাকবে না, হয়ে যাবে ‘দুড়ুম’ করে ফাটবার শুদ্ধ প্রতিশব্দ। মানে, শব্দ থেকে তৈরি হবে বোমা, যা ফাটবে দুড়ুম করে। এই রসিকতাটা ইংরেজিতে কী করে আর বোঝাবেন? তাই ব্রহ্ম ঠাকুর মনেমনেই এটা ভাবলেন, তাঁর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল সূক্ষ্ম কৌতুকের বঙ্কিমরেখা।
ব্রহ্ম ঠাকুর দুড়ুম করে তাঁর বাছাই করা শব্দের ম্যাজিক বোমা ফাটিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় চারিদিকে এখন পিন ড্রপ সাইলেন্স। শুধু শোনা যাচ্ছে কিছুদূর থেকে বাতাসে ভেসে আসা রাতের নির্জন সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার শব্দ। স্যর ক্যাভি কী বলবেন কী করবেন বুঝে না পেয়ে একবার ব্রহ্মের দিকে, একবার বিলি গিলচারের দিকে তাকাচ্ছেন। ব্রহ্ম বললেন— কী ব্যাপার স্যর ক্যাভি? আমায় অবিশ্বাস করছেন? গিলচার যার নাম, সেই ভালচারকে অবিশ্বাস করতেই পারেন, তবে আমাকে বিশ্বাস না করবার কোনও যুক্তিই কিন্তু নেই। তবুও যদি বিশ্বাস না করেন, তাহলে এই দেখুন—
ব্রহ্ম ঠাকুর পলকের মধ্যে তাঁর আলখাল্লার বুকের কাছে লুকনো ‘ডিসকভার’ ম্যাগাজ়িনের লেটেস্ট সংখ্যাটা ছুড়ে দিলেন স্যর ক্যাভির দিকে। সেটা পড়ল গিয়ে ক্যাভির সামনের মাটিতে, ক্যাভি লুফতে পারলেন না। ব্রহ্ম বললেন— কথায় বলে, নেভার জাজ আ বুক বাই ইটস কাভার। আমি এর কাভারে একটা আর্টিকেলের উল্লেখ দেখে সেই ভুলটাই করে ফেলেছিলাম। কিন্তু চোখ খুলে গেল একটু আগেই ছাব্বিশ নম্বর পাতায় একটা সাক্ষাৎকার দেখে। অবশ্য এই সাক্ষাৎকারটাও প্রচ্ছদ কাহিনি ‘অ্যাটমিক আন্দামান’এরই অংশ। এটার সংযোজনের জন্যই আজ মাঝদুপুরে এক প্রাজ্ঞ মহিয়সী এবং বিদ্যুৎ ঝলকের মতোই রূপসী পণ্ডিতকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হতে আর রাগ করতে দেখেছি। আহা রে, রেগে গিয়ে তাঁর নাকের ডগাটা একেবারে লাল হয়ে উঠেছিল— সেই মনোহরণ দৃশ্যটি আমি ভুলতেই পারছি না। স্যর ক্যাভি, আপনাকে এখন সেই অপূর্ব সুন্দর দৃশ্যটি দেখাবার সুযোগ আমার নেই। তবে এই পত্রিকার ছাব্বিশ নম্বর পাতাটা দেখানো যেতেই পারে। একবার দেখবেন নাকি পাতাটা খুলে, স্যর ক্যাভি?
পত্রিকাটা মাটি থেকে তুলে নিতে স্যর ক্যাভি নিচু হতেই বিলি গিলচার হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে।
(ক্রমশ)
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র