মুখ দিয়ে হুশহাশ শব্দ করতে করতে তিনকড়ি বলল, মাংসটা কী ঝাল হয়েছে মাইরি! বলে দু’বার হেঁচকি তুলে পাতের ওপর গড়িয়ে পড়ে মরে গেল। সুবল হতবাক। শেষ বিকেলের রোদে কলাপাতার ঝিলিমিলি, শীতের মিঠে আমেজ, মাটি খুঁড়ে বানানো উনুনের নিভন্ত আগুন থেকে সরু ধোঁয়ার সুতো উঠে এসে চোখ জ্বালা-জ্বালা করছে। নেহাত মন্দ লাগছিল না সবটা মিলিয়ে। মাংসটা ঝাল হয়েছে সাংঘাতিক। তার ওপর বুড়ো পাঁঠা চিবোতে গিয়ে চোয়াল খুলে যাওয়ার জোগাড়। আর বোঁটকা গন্ধ। তবু তা-ই বা দেয় কে? জুত করে আলু-ঝোল দিয়ে ভাত খাচ্ছিল সুবল। একটু মেটুলিও রেখেছিল শেষপাতে খাবে বলে। তিনকড়ির অবস্থা দেখে খাওয়া মাথায় উঠল। প্রথমে ভেবেছিল ভড়ং। চোত গাজনে ওরকম অনেক ভেল্কি দেখায় তিনকড়ি। মৃগী রুগি, গন্নাকাটা, অষ্টাবক্র। লোকে তা দেখে হাসে, টিটকিরি দেয়, মজা করে। সুবলকে তখন ‘পেশেন্ট’ সামলাতে হয়। এখন পাতের ওপর হেলে পড়া তিনকড়িকে দেখে আর তার মুখে গ্যাঁজলা উঠছে দেখে বুক হিম হয়ে গেল সুবলের। সে তাকিয়ে দেখে কলাপাতায় ডাঁই করা রান্না না-হওয়া মাংসের পাশেই বোকা পাঁঠা অবতারের নিষ্প্রাণ মুণ্ডুটা অপলক তাকিয়ে আছে। গোটা গায়ে জাড়কাঁটা দিয়ে শিহরন লাগে তার। দূরে পিকনিক পার্টিদের তারস্বরে মাইক বাজছে, মায়ের মতো আপন কেউ আর নাই। সুবল বোঝে, তিনকড়ি গিয়েছে। তারও নিস্তার নেই। ভগবানের মার।
পরিকল্পনাটা বলতে গেলে তিনকড়িরই। পৌষ মাসের অকাল-বৃষ্টিতে প্রাইমারি ইস্কুলের বাতিল শেডের নিচে বসে বিড়ি টানছিল দুজনে। একটু দূরে কয়েকটা ছাগল এসে দাঁড়িয়েছিল বৃষ্টির মাঝে। গা ঝাড়া দিচ্ছিল থেকে থেকে, বৃষ্টির জল লেগেছে বলে। অবতার কোথা থেকে সুযোগ বুঝে জুটে গিয়ে ব্যা-ব্যা করে তার বাসনার কথা জানান দিচ্ছিল। তিনকড়ি তাই দেখে বলেছিল, ‘দ্যাখো কাণ্ড! মাদিগুলো হিট-এ এল কি না তার ঠিক নেই, এ ব্যাটা ডিউটি করতে চলে এসেছে। বোকা পাঁঠা কি আর সাধে বলে?’ সুবল বলে, ‘ব্যাটাকে সাতখোলাম করলে কেমন হয়?’ কচুপাতায় টলটল করছে সদ্য হওয়া বৃষ্টির জল। তিনকড়ি কচুপাতা ছিঁড়ে আনে গোটা সাতেক। সুবল খুঁজে-পেতে নিয়ে আসে মাটির ঢ্যালা, ইটের টুকরো, টর্চের বাতিল ব্যাটারি। অবতারের বাসনা তখন আর শুধু ব্যা-ব্যা করাতে আটকে নেই। সে ওপরের ঠোঁট ফাঁক করে শ্বাস টানতে টানতে মিহি ছাগুলে শব্দ করে মাদিগুলোর পিছনে ওঠার চেষ্টা করছে। বৃষ্টি ধরে গেছে। ছাগলগুলো অল্প সময়েই ইস্কুলের বাতিল শেডটা নাদিতে-চোনায় নোংরা করে মাঠে নেমে যায় চরতে। হতভম্ব অবতার সুবলের আ-আ ডাক শুনে সেদিকেই এগিয়ে যায়। বোকা পাঁঠা।
সাতখোলামে ছাগল জব্দ। ছাগলকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে চোখের ওপর আর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কচুপাতায় মুড়ে ইঁট-পাটকেলের টুকরো রেখে দিলে ছাগল আর নড়বে-চড়বে না। ভাববে, কেউ তাকে চেপে ধরে শুইয়ে রেখেছে। ছাগলের বুদ্ধি! বেলা পড়ে এসেছিল। ওদের সন্ধেবেলা এক বাড়িতে কাজ আছে। এঁটো পাতা ফেলার কাজ। শ্রাদ্ধবাড়ির নিয়মভঙ্গ। কাজের শেষে বেঁচে যাওয়া দই-মিষ্টি-মাছ ভালই জুটবে ওদের কপাল ভাল থাকলে। শ্রাদ্ধবাড়িতে ওদের খাওয়ার বহর দেখে প্রায়ই লোকে বলাবলি করে, যার শ্রাদ্ধ তার আত্মা ওদের ওপর ভর করেছে। তাই ওই পরিমাণ খেতে পারে ওরা দুজন। তা হবেও বা। কিন্তু একজন মানুষের আত্মা দুজনের ওপর ভর করে কী করে, সেটা আর তলিয়ে ভেবে দেখেনি তিনকড়ি আর সুবল। কাজের বাড়ি ভোজের শেষে তারা দুজন পাশাপাশি উবু হয়ে খেতে বসলে তাদের খাওয়া দেখতে লোক দাঁড়িয়ে যায় মাঝেসাঝে। আর মড়া-পোড়ানো দলে ভিড়ে গিয়ে যা জুটে যায়। সেও খাওয়ার বৃত্তান্ত। শ্মশানে পৌঁছে মুড়ি-ফুলুরি কি কচুরি- জিলিপি। ফেরার পথে হোটেলে পেটচুক্তি ডাল-ভাত-সব্জি। সঙ্গে মাছ বা মাংস, পার্টির যা মর্জি। দুঃখশোকের মাঝেও কোথাও একটা ভালমন্দ খাওয়ার সুযোগ লুকিয়ে থাকে, সেটা ওরা জানে। সাতখোলাম হয়ে শুয়ে থাকা অবতারকে দেখে তিনকড়ি বলে, ‘সলিড মাল। যত্ন করে রাঁধলে দশজনে খেয়ে শেষ করতে পারবে না।’ ‘যাঃ, কী যে বলিস? ধম্মের পাঁঠা, মারলে পাপ হবে যে।’ সুবল কপালে হাত ঠেকিয়ে নমো করে। ‘কলিকালে আবার ধম্ম কী রে?’ তিনকড়ি পিচিক করে থুতু ফেলে বলে। ‘চ এই শীতেই লাগিয়ে দিই ফিসটি।’ সুবলের লোভ লেগে যায়। অঢেল মাংস খাবে ভাবতেই চোখ চকচক করে ওঠে। বলে, ‘যদি কেউ জেনে ফেলে?’ তিনকড়ি অবতারের গা থেকে ইঁট-ঢ্যালা সরাতেই সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে। ব্যা-ব্যা ডাক ছেড়ে গদাইলস্করি ঢঙে ইস্কুলের শেড ছেড়ে চলে যায়। সেদিকে তাকিয়ে তিনকড়ি বলে, ‘কেউ জানতে পারবে না। ধম্মের পাঁঠা। কারও বাবাকেলে সম্পত্তি না।’ অবতার দুলকি চালে চলে যেতে থাকে। এই সামান্য অত্যাচার সে গায়ে মাখে না। মানুষ তাকে ভালবাসে, সে জানে। এই গ্রাম তার নিজের তালুক। সে সবার আদরের অবতার। সব্বাই তাকে খাতির করে চলে, এটা সে তার পাঁঠার বুদ্ধি দিয়েও বুঝতে পারে। এটা তার গ্রাম। এ গ্রামের সমস্ত মাদি ছাগলের গর্ভসঞ্চারে তাকে লাগে। এই জন্য গোটা গ্রাম তাকে তোয়াজ করে চলে। সে অবতার, ধর্মের পাঁঠা। ভগবানের নামে উৎসর্গ করা, জনপদের কল্যাণে। খেতখামারে, হাটেবাজারে, গেরস্তবাড়িতে তাকে কেউ এমনি এমনি ফেরায় না। কলাটা-মুলোটা সে পেয়েই থাকে। ফলন্ত লাউগাছ মুড়িয়ে খেলেও লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে না লোকজন। বাবা-বাছা করে সরিয়ে দেয় তাকে। সে অবতার।
এ তল্লাটে সিঙ্গাপুরি কলা চাষের খুব জোর। বিঘের পর বিঘে কলার ক্ষেত। ট্রাক-বোঝাই কলা দূরদূরান্তে চালান যায়। কলা হল গিয়ে লক্ষ্মী। তাই কলাবাগানে আঁশ ঢোকানো বারণ। শীতকাল ফিসটির মরসুম। চারিদিকে তারস্বরে মাইক বাজছে। দলে দলে সব চলেছে হাঁড়ি-ডেকচি-মাংস-মশলা নিয়ে নদীর চরে বা বাবুদের বাগানে পিকনিক করতে। শুধু কলাবাগানে ওসব নিষেধ। স্থানীয় কলাচাষি সমিতি নোটিস দিয়ে রেখেছে, ‘কলাবাগান দেবত্বস্থান। এখানে ফিস্ট করা নিষেধ। অন্যথায় জরিমানা হইবে। অনুমত্যানুসারে।’ যাকে বলে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। তিনকড়ি কলাবনে ঘাপটি মেরে ছিল অস্ত্রপাতি নিয়ে। সুবল আগে থেকে চাল-মশলা-হাঁড়ি-ডেকচি এনে রেখে গেছে। এখন তার ওপর দায়িত্ব পড়েছে অবতারকে ভুলিয়েভালিয়ে এখানে নিয়ে আসা। সে কাজে খুব একটা বেগ পেতে হয় না সুবলকে। অবতার ভয়টয় জানে না। পুরুষ্টু পাকা কলার লোভ দেখিয়ে তাকে কলাবনের গভীরে চপার হাতে অপেক্ষায় থাকা তিনকড়ির সামনে নিয়ে আসে সুবল। তিনকড়িকে দেখে আনন্দে শিং বাগিয়ে ঢুঁসোতে যায় অবতার, খেলা। ‘ওই দ্যাখো, ওই দ্যাখো’ বলে সেই ঢুঁয়ের ধাক্কা সামলাতে সামলাতে মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করতে থাকে তিনকড়ি। আরামপ্রিয় পাঁঠা শান্ত হয়ে আদর খাবে ভাবে। অবতার ঘাড় বাড়িয়ে দেয়।
তিনকড়ির নাবালক ছেলে বাপের হয়ে নমো নমো করে প্রায়শ্চিত্ত করছে। সদ্য ন্যাড়া হয়েছে সে বাপের শ্রাদ্ধে। তার ঝামেলা কম। তার ওপর বাপ-মরা ছেলে, লোকে এমনিই আহা-উহু করছে। নিস্তার নেই সুবলের। তার ওপর মন্দির কমিটির আর পাঁচ পাবলিকের যত ঝাল এসে পড়েছে। একপ্রস্থ ধোলাই হয়ে গিয়েছে। বাঁ চোখের নিচটা কালশিটে মেরে ফুলে আছে। ঠোঁট ফেটে হাঁ হয়ে আছে। পাঁজরে বিষব্যথা। জুতোপেটা করার সময় কারও একটা হাওয়াই চটির ফিতেয় লাগানো সেফটিপিন খুলে গিয়ে লম্বা আঁচড় টেনে দিয়েছে গালে। ওখানটাতেই সবচেয়ে বেশি জ্বালা করছে কেন কে জানে। মন্দির কমিটির পুরোহিত তারক ঘোষাল এখন গলা কাঁপিয়ে নানারকম নরকের বর্ণনা দিচ্ছে। কুম্ভীপাক, রৌরব, রসাতল— সাত-সতেরো। পুরোহিতের বাজারে সারের দোকান। এত সব নরকের খবর রাখে কোথা থেকে কে জানে? উত্তেজনায় পুরোহিতের মুখের কষে সাদা ফেনা। ঘাড় নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে বলে নামাবলি সরে গিয়ে ঘাড়ের পোষা দাদ দেখা যাচ্ছে। ওদিকে মন্দির কমিটির জোর বচসা চলছে। কথা আছে প্রথমে মাথা কামিয়ে, ঘোল ঢেলে, মুখে চুনকালি মাখিয়ে নগর পরিক্রমা করানো হবে। মধু ঘোষ কোন সকালে এক জেরিকেন ঘোল রেখে গিয়েছে সে জন্য। ঘোল ঢালার পর প্রায়শ্চিত্ত। এখন তর্ক বেধেছে, কাপড় পরিয়ে না ল্যাংটো করে ঘোরানো হবে। নানা জনের নানা মত। ল্যাংটো করে ঘোরানোর দিকেই পাল্লা ভারী। কিন্তু থানার বড়বাবু একটু দূরে ঘোষালবাড়িতে বসে চা খাচ্ছেন। তিনি বলে পাঠিয়েছেন, আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে। শাস্ত্রে যেটুকু বিধান আছে শুধু সেটুকুই করতে। অল্প বয়েসের ছেলেমেয়েগুলো টাচফোনে ভিডিও তুলছে। ফোন হাতে কেউ বায়না করছে, কাকু একবার জুতো মারুন না মুখে। ছবি তুলব। পরে এসেছি। তা লোকে নিরাশ করছে না। নতুন করে এক-আধটা জুতোর বাড়ি এসে পড়ছে সুবলের গালে। অল্পবয়েসিদের উৎসাহ বেশি। ভিড় দেখে ছোলাবাদাম নিয়ে বসেছে এক বুড়ো। তার থেকে লঙ্কার গুঁড়ো চেয়ে এনে সুবলের কাটা জায়গায় লাগানোর পরিকল্পনা করছিল নিজেদের মতো। বড়রা কেউ ধমক দিলে ও-বিষয়টায় ক্ষান্ত দেয় সব। বেলা চড়ছে হু-হু করে। মাছি ভনভন করছে সুবলের কাটা জায়গাগুলোয়। শেষ ফাগুনেও বাতাসে শীতের টান। টানা রোদের মাঝে বসেও সুবলের জাড়কাঁটা দিয়ে শীত করে। কাঁপুনি দেয় সারা শরীর জুড়ে। পাবলিক চেঁচিয়ে ওঠে, অ্যাক্টিং করছে শালা। মার কানের গোড়ায়।
কানের ভেতর সর্ষেদানা ঢুকিয়ে দিলে ছাগল নাকি মরে যায়। আনাড়ি হাতে ভোঁতা চপারে অবতারকে জবাই করতে গিয়ে সে কী নাজেহাল অবস্থা! দু’দুটো লোক। হোক না অকম্মা পেটুক। চার পা চেপে মুখটা পা দিয়ে ঠুসে ধরেও কিছুতেই বাগে আনা যায় না অবতারকে। এত জোর তার গায়ে কে ভেবেছিল! হাঁফাতে হাঁফাতে তিনকড়ি বলেছিল, ‘আগে থেকে পিল্যান করে কানে সর্ষে দিয়ে মারলেই হত রে। এ তো ভারি আতান্তর দেখছি।’ পায়ের চাপ ঠেলে গোঙানি উঠে আসছিল অবতারের। তার নিরুদ্বিগ্ন, যথেচ্ছ আশকারা পাওয়া জীবনে, শুধু সুখাদ্য, আহ্লাদ আর রমণ পেতে অভ্যস্ত জীবনে এমন সঙ্কট সে তার বোকা পাঁঠার বুদ্ধি দিয়ে নাগাল পাচ্ছিল না।
কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। পুরোহিতমশাই সে কথাই সাধুভাষায় গাল ফুলিয়ে ঘোষণা করছেন। শুধু অধোবাস পরিয়ে নগর পরিক্রমা। গলায় জুতোর মালা। তবে সব আগে মস্তক মুণ্ডন। সকলে হইহই করে ওঠে। দে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে। ত্যালা পরামানিকের ছেলে বিট্টু আধুনিক ফ্যাশনদুরস্ত ইয়াংম্যান। বাজারে ‘নিউ স্মার্ট লুক’ সেলুন খুলেছে। সেখানে ছেলেদের কান ফোঁড়ানো, উল্কি আঁকা, এসব হয়। এই ধরনের পাতি ছুটকো কাজে তার আসার কথা নয়। কিন্তু মন্দির কমিটির ব্যাপার আলাদা। ক্ষুরে নতুন ব্লেড ভরে পানমশলা ঠাসা মুখ নেড়ে সুবলকে ইঙ্গিত করে সে।
সুবল ঘাড় বাড়িয়ে দেয়।