জগজিৎ সিং, বিয়ার, ধারের ভালবাসা
সোমনাথের ছিল একটা একচিলতে নিজের ঘর, যেরকম আমাদের কারও ছিল না। সেটাকে ঠিক চিলেকোঠা বলা চলে না, কেননা চিলেকোঠা তো হয় ছাদের মাথায়, সোমনাথের ঘরখানা ছিল তাদের একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝবরাবর। দু’দিকের সিঁড়ির মাঝখানে একটা ছোট আর নীচু দরজা দিয়ে ঢুকে গেলেই সোমনাথের সেই গোপন আস্তানা। দশ হাত লম্বা আর পাঁচ হাত চওড়া একখানা ঘর, যার সিলিং বেশ নীচু, আর ঘরের শেষে একখানাই গরাদ-বসানো জানলা।
ঘরের বাকি কথায় আরেকটু পরে আসছি, তার আগে সোমনাথ আর সময়, দুটোরই পরিচয় দেওয়া দরকার। সময়টা ’৯৫-’৯৬ সাল, আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগেকার কথা। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি, আমার বিষয় তখন ভূগোল। আশুতোষ কলেজের বিশাল বাড়িটার মধ্যে যখন ব্যাগে বইখাতা পুরে ঢুকতাম, ভয়ই লাগত। আগামী জীবনটাকে ঠাহর করতে পারতাম না ঠিক। সে অবশ্য কবেই বা পেরেছি! সেই ভূগোলের ক্লাসেই আলাপ সোমনাথের সঙ্গে। আমার চেয়ে কিঞ্চিৎ লম্বা, চৌখস চেহারা, নাকে চশমা ঝোলানো সদাহাসিমুখ সোমনাথ অনেকটা যেন আমারই মতো। জীবন নিয়ে বিরাট কোনও পরিকল্পনা নেই, নিয়মের-শাসনের তোয়াক্কা নেই, যেমন ইচ্ছে বেঁচে নেওয়ায় বিশ্বাসী বেপরোয়া সোমনাথ। এসব দিকে আমার সঙ্গে মিল থাকলেও, অমিল ছিল একটি বিষয়ে। সে ছিল পড়াশোনায় দিব্যি ভাল। যাই হোক, তাতে আমাদের বন্ধুত্বে বাঁধা আসেনি কোনওদিন।
তা এই সোমনাথের বাড়ি ছিল হাজরাতেই, কলেজ থেকে মিনিট তিনেকের হাঁটাপথে। শরিকি তিনতলা বাড়ি। ঘরে-ঘরে এই পরিবার সেই পরিবারের বসত। সোমনাথরাও থাকে দু’তিনটে ঘর নিয়ে। তারই মধ্যে এই একচিলতে ঘর পড়েছে সোমনাথের ভাগে। সেখানে বন্ধুরা অবাধে ঢুকলেও, দিনের আলো বিশেষ ঢোকে না। একপাশে একখানা মলিন চৌকি পাতা, অন্যপাশে তার লেখার টেবিল আর চেয়ার, এক কোনায় একজন বৃদ্ধ টেবিল ফ্যান, হাওয়া দিতে যার আর ইচ্ছে করে না। এই ছিল মোটের ওপর তার ঘরের সজ্জা। বন্ধু বলতে অবশ্য হাতে গোনা। আমি আর কৌশিক। ভূগোলের সৌরভও আসত কখনও-সখনও, কিন্তু আমার, কৌশিকের আর সোমনাথের আড্ডা ছিল বাঁধা। কৌশিক পড়ত ইংরেজি, হতে চাইত চিত্রকর। সোমনাথ পড়ত ভূগোল, হতে চাইত অ্যানথ্রোপলজিস্ট। আমিও পড়তাম ভূগোল, কিছুই হতে চাইতাম না। আমরা তিনজন, দুপুর পেরিয়ে বিকেলের দিকে হাজির হতাম তার ওই ঘরে। হয়তো একটা ক্লাস অফ হয়ে গেছে, বা সেদিন মাঝে দু’খানা ক্লাস বাতিল, হুট করে চলে এলাম তার আস্তানায়। মিথ্যে বলব না, অনেকদিন ক্লাস কেটেও আড্ডা জমিয়েছি আমরা। হয়তো পাস-এর ক্লাস, বা এমন কোনও অধ্যাপক পড়াবেন, যাঁর ক্লাস মোটে ভাল লাগে না। ব্যাস, টুক করে চলে এলাম ওদের বাড়ি, ওর ঘরে। স্কুলে এই ব্যাপারটা কখনও করতে পারিনি বলে বেশ একটা রোমাঞ্চ হত। একে তো ইউনিফর্মের বালাই ঘুচে গেছে, তার ওপর যখন ইচ্ছে কলেজ থেকে বেরিয়ে আড্ডা, এ-জিনিসের স্বাদ আগে পাইনি বলেই বেশ লাগত ব্যাপারটা।
এখন কথা হচ্ছে, জড়ো হয়ে ওই ছোট্ট আস্তানায় আমরা করতামটা কী? বাইরে হয়তো গনগনে গ্রীষ্মের দুপুর বা ছিমছাম হেমন্তের বিকেল, ভেতরে আমরা তিনজন। কৌশিক আর আমার প্রিয় জায়গা ছিল ওই একফালি চৌকির দুই কিনারা, সোমনাথ বসত তার চেয়ারে। তখন প্রেম হওয়া আর প্রেম ভেঙে যাওয়া ছাড়া জীবনে বিশেষ কোনও ঘটনাও নেই। আর আমাদের তিনজনের মধ্যে সোমনাথ ছাড়া কারও প্রেমের ইচ্ছে বা সম্ভাবনাও নেই। তাই ওই বিষয়ে আলোচনা হলেও, বেশিদূর গড়াত না। তারপরেই ঝোলা থেকে বেরোত যার-যার ডাইরি। কৌশিক আর আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করছি তখন, সোমনাথ লিখছে অ্যানথ্রোপলজি বিষয়ক প্রবন্ধ, গম্ভীর আর চোস্ত ইংরেজিতে। পালা করে সেইসব পড়া হত। নিজেদের লেখা নিজেদেরই কেমন লাগছে, সে নিয়ে আলোচনাও হত। বৃদ্ধ টেবিল ফ্যান ঘরঘর শব্দ করে হয়তো বিরক্তিই জানান দিতেন, কিন্তু সে আমরা পাত্তা দিতাম না বিশেষ।
এইরকম চলছিল বেশ কিছুদিন, তারপর আমাদের আড্ডায় নতুন এক সদস্য এলেন। তিনি অবশ্য আমাদের তিনজনেরই পরিচিত, তিনজনেরই সমান বন্ধু, কিন্তু এই আড্ডায় আগে তাঁরা আসা হয়নি। তিনি জগজিৎ সিং। তখন সোমনাথের প্রেম ভাঙছে। তার প্রেমিকা আমাদেরই সহপাঠী কলেজে, তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়েও জোড়া লাগানো যাচ্ছে না। অ্যানথ্রোপলজি বা কবিতা, কাজে দিচ্ছে না কোনওটাই। অগত্যা জগজিৎ সিং। তাঁর নতুন অ্যালবাম বেরিয়েছে সবে। শুনে সোমনাথের মনে হচ্ছে, সব ক’টা গজল তাঁকে নিয়েই লেখা, আর আমাদের মনে হচ্ছে, ইশ, যদি আমাদের নিয়ে লেখা হত!
এমতাবস্থায় যা হয় বা হতে পারে, তা-ই হল। এক প্রবল গরমের দুপুরে ভাঙা প্রেম আর জোড়া ক্যাসেট সহযোগে আমাদের মনে হল, কিঞ্চিৎ সুরাপানের ব্যবস্থা হলে মন্দ হয় না। আমি বা কৌশিক, কারও বাড়িতেই এহেন একার ঘর বরাদ্দ নেই, তাই আমাদের বাড়িতে সে-সুযোগও হবে না। আর সে-সময়ে পানশালায় ঢোকার সাহস বা রেস্ত, কোনওটাই ছিল না। সোমনাথের একচিলতে ঘর সেদিক থেকে তোফা। তার বাবা-মা খোঁজ নিতেও আসেন না, বকা দিতেও না। অতএব ওই একটি জায়গায় আমরা বেলাগাম হতেই পারি।
পান যে একেবারে করিনি তখন কেউ, তা নয়। এক-আধবার মুখে ছুঁইয়েছি হয়তো, কিন্তু এরকম দুঃখের দিনে একজোট হয়ে সুরাসেবন কেউই করিনি। তাই সেই দুঃখের মধ্যেও, কোথায় যেন, এক ধরনের রোমাঞ্চ লুকিয়ে ছিল। সিদ্ধান্ত তো নেওয়া হল, কেনাও কিছু কঠিন নয়। দু’পা হাঁটলেই দোকান, এই ভরা দুপুরে সেখানে ক্রেতাও বিশেষ নেই। কিন্তু নেশা করতে তো টাকা লাগে, তার কী হবে? আমাদের মধ্যে সোমনাথই একমাত্র টিউশন পড়ায়, সে গোটা কুড়ি টাকা দিতে পারল। আমার আর কৌশিকের কাছে একটা করে দশ টাকার নোট, বাড়ি ফেরার ভাড়া বাবদ। বাকি পকেট ফাঁকা। এখন তিনজনের একটু নেশা করতে হলেও অন্তত দু’বোতল বিয়ার দরকার, কড়া জাতেরই। তার দাম, যতদূর মনে পড়ছে, ষাট টাকা। অর্থাৎ, বোতল পিছু তিরিশ। সে-টাকা পাব কই?
যে-কোনও কারণেই হোক, কলেজের বান্ধবীরা আমাদের খুব ভালবাসত, বিশ্বাস করত। এবং খেয়াল করে দেখেছি, তাদের মিষ্টি সব হাতব্যাগে ভাল টাকাকড়িও থাকত। তারা সম্পন্ন ঘরের সন্তান, আমাদের মতো ফেলনা অবস্থা তাদের নয়। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। আমি আর কৌশিক ফিরে গেলাম কলেজে, সোমনাথ দাঁড়িয়ে থাকল সুরার দোকানের আশেপাশে। যে-বুদ্ধিটা বার করেছিলাম, তাতে সোমনাথকে কাজে লাগানো যেত না। আমি আর কৌশিক আলাদা-আলাদা বান্ধবীদের কাছে গিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ রে, দশটা টাকা হবে? বাড়ি ফেরার পয়সা নেই। সামনের হপ্তাতেই শোধ করে দেব।’ সোনালি, মিষ্টি, মিলি, পরমিন্দর, এদের কাছে হাত পাততে লজ্জা কীসের? এরাও, আমাদের অবোধ এবং অবধ্য মুখ দেখে সঙ্গে-সঙ্গে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা কোনও কথা হল?’ বলে ব্যাগ থেকে বার করে দিল টাকা। আমরা ‘ঋণী’ মুখ করে মাথা নীচু অবস্থায় কলেজের দরজা অবধি এসে দু’হাত তুলে ছুট লাগালাম। কেনা হল ঠান্ডা দু’বোতল বিয়র, আমাদের বয়সের তুলনায় যথেষ্ট কড়া। তার সঙ্গে জগজিৎ সিং-এর ককটেলে ওই ভর গরমের বিকেলবেলা যে-নেশাটা হল, তা আজ আর কোথাও কিনতে পাওয়া যায় না।
এই করে প্রায় বছর দুয়েক চলেছিল আমাদের ধার-নেওয়া অভিযান। কখনও পারলে শোধ করতাম, কখনও করতামও না। বান্ধবীরা কোনওদিন সেসব কথা তুলতও না, এতই তারা সরল আর ভাল। আজ সোমনাথের সঙ্গে আর যোগাযোগ নেই। তার সেই ছোট্ট আস্তানাটা কেমন আছে, জানি না একেবারেই। কৌশিক রাজস্থানে থাকে, একটা কলেজে আর্ট পড়ায়, নিজের স্টুডিওতে ক্যানভাসের সামনে রাত জাগে। আর আমি এসব গল্প লিখে রাখি পাতায়। সেই প্রেম নেই, প্রেম ভাঙার দুঃখও নেই। আর বাড়ি ফেরার ছলে দশ টাকা ধার চাওয়ার বান্ধবীরাও উড়ে-উড়ে দূরে চলে গেছে। আছে কেবল গ্রীষ্মের একলা দুপুর আর হেমন্তের বিষণ্ণ বিকেল। যারা সাক্ষী ছিল তিনটে মাতাল ছেলের নেশার, যে-নেশায় মিশে ছিল ধারের ভালবাসা। আজকের নেশায় সেই ধার আর নেই…
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র