এআই আসিছে!
এ খুব আশ্চর্য যে ইলন মাস্ক এবং আরও সাংঘাতিক বিখ্যাত সফল ও প্রতিপত্তিশালী মানুষ, তাঁদের মধ্যে বাঘা বৈজ্ঞানিকরাও আছেন, একটা খোলা চিঠিতে বললেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টলিজেন্সের নিত্যনতুন উন্নতি ও গবেষণার কাজ অন্তত ছ’মাস বন্ধ থাক, তদ্দিনে একটু খতিয়ে দেখা হোক, মানুষ-সমাজের পক্ষে ওই কৃত্রিম বুদ্ধির পাঁইপাঁই প্রগতি আদৌ অনুকূল কি না। আরে ভাই, আবিষ্কার কবে তার পরিণামের কথা ভেবেছে? মানুষ আবিষ্কার করে আবিষ্কারের নেশায়, নতুনতার আনন্দে, আশ্চর্য একটা কীর্তির যে চরিতার্থতা-বোধ— তার লোভে। একটা লোক যদি ল্যাবরেটরিতে মানুষ বানাতে পারে, তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে পারে, পরে সেই ‘প্রাণী’ রেগেমেগে আবিষ্কর্তার বউকে হত্যা করবে জানতে পারলেও, স্রষ্টা থেমে থাকতে পারবে কি? সম্ভবত না, কারণ নিজের হাতে অসম্ভব কাণ্ড ঘটানোর যে প্রকাণ্ড উত্তেজক তৃপ্তি, কোনও মানুষই তার আকর্ষণ এড়াতে পারে না, ওই কীর্তির মধ্যে দিয়েই সে ঈশ্বর হওয়ার স্বাদ পায়। এবং ঈশ্বর হওয়াই মানুষের প্রবলতম আকাঙ্ক্ষা। অ্যাটম বোম একটা দেশকে বহুযুগ ধরে সর্বনাশে নিয়ে যাবে জানলেও অ্যাটম বোমার আবিষ্কারক নিজেকে একটা নতুন ও দুর্দান্ত কাজ করা থেকে বিরত রাখতে পারেন না।
কৃত্রিম বুদ্ধি এসে বিশ্বময় ওলটপালট লাগিয়ে দিয়েছে, কোন অ্যাপ শেক্সপিয়র-ধাঁচের সনেট লিখে ফেলছে, কে দুরন্ত অনুবাদ করছে, কে চিঠি লিখছে নিখুঁত, সোজা কথায় প্রতিভাকেও এখন নির্মাণ করা যাচ্ছে, এতে কিছু মানুষের আঁতে লেগেছে ঠিকই। দুশ্চিন্তাও জেগেছে: যদি অ্যাপ এসে ভাল কবিতা লিখতে শুরু করে, তাহলে কবিদের কী হবে? যখন লোকে হুড়হুড়িয়ে মুদ্রিত গ্রন্থ পড়তে শুরু করল এবং কিছুতেই গাছতলায় কথকতা শুনতে গেল না, এবং কথকঠাকুরদের দিন গেল, তাঁদের খ্যাতি ও রুজির কী হল? ঘুচে গেল, আর কী! যখন চাকা আবিষ্কার হয়ে গেল, তখন যে ঝাঁকামুটেরা মানুষ ঘাড়ে করে এখান থেকে ওখান নিয়ে যেত, তাদের কী হল? অন্য লাইন দেখতে হল। সভ্যতা যত এগিয়েছে, নতুন-নতুন ব্যাপার এসে পুরনো ব্যাপারকে ঠেলে ধাক্কিয়ে ছিটকে দিয়েছে, সেটাকেই অনেকে প্রগতি বলে সংজ্ঞায়িত করেছে। ইলেকট্রিসিটি এসেছে বলে হ্যারিকেন মোমবাতি প্রদীপের এন্তেকাল ঘটেছে, অটো-টোটো এসে আর রিকশার রমরমা নেই। যদিও ব্যবহারিক জিনিসগুলোর সঙ্গে প্রতিভা সমান-তুলনীয় নয়, কারণ প্রতিভাকে ধরা হয়েছে একটা ভগবানদত্ত গুণ, যা থাকলে আছে না-থাকলে নেই, কিন্তু যা কোনওভাবেই কিছুতেই তৈরি করে ফেলা যায় না, অননুকরণীয়। সেই কারণেই জনতার ৮৮০ ভোল্ট শক লেগেছে, কারণ বোঝাই যাচ্ছে প্রতিভাও বানিয়ে তোলা যায়, এমন একটা রোবট বানানো যায় যে প্রতিভাবান, এমনকী প্রকৃত প্রতিভাবান বলে পরিচিত লোকের শৈলীকে যে প্রায় হুবহু নকল করে ফেলতে পারে। এতে লোকের প্রকাণ্ড সুবিধে হবে, নোটস বানাতে বা নিজের ভাবনাকে সুচারু রূপ দিতে, কিন্তু মানুষের অ্যাদ্দিনের পূজিত বিগ্রহ খানখান হয়ে যাবে। লোকে অট্টালিকা বানানো বা নগরপত্তনকেও তেমন মর্যাদা দেয়নি, কিন্তু মোনালিসা আঁকা বা ‘গীতাঞ্জলি’ লেখাকে অ্যাক্কেরে মাথায় তুলে রেখেছে। ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী!’ আকুল মুগ্ধবাক্য উচ্চারণান্তে মানবজাত মুহুর্মুহু মুচ্ছো গেছে। তারা ভেবেছে, সত্যজিৎ যা পারেন বা মোৎজার্ট যা পারেন, তা আর কেউ কখনও পারবে না, প্রাণপণ চেষ্টা করেও পারবে না, সহস্র বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেও পারবে না, তাই এই শিল্পীরা অনন্য, একক, একমেবাদ্বিতীয়ম। কিন্তু এবার ধাঁ করে প্রমাণিত: এগুলো এমন কয়েকটা গুণপনার সমাহার, যা ইচ্ছে করলে ল্যাবরেটরিতে বানিয়ে ফেলা যায়। তাহলে যাঁদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ও যাঁদের চরণামৃত খেয়ে আমাদের দিন গেল ও রাত্তির থমকে থাকল, তাঁরা অনন্য নন, এখন অগণ্য, এবং তর্ক আরেকটু দূর গড়ালে: নগণ্য, কারণ ছেচল্লিশ হাজার সলিল চৌধুরী গিজগিজ করলে আর সলিল চৌধুরীর মূল্য কী?
যদি শিল্পসাহিত্যের আকাশচুম্বী কৌলীন্য অকস্মাৎ উবে যায়, তাহলে মানুষের এতদিনের একটা সমীহ-কুর্নিশের দস্তুর চূর্ণ হবে, কিন্তু সাংঘাতিক বেশি পরিমাণে ভাল লেখাও তো লোকে পড়তে পারবে, বা ভাল সিনেমা দেখতে পাবে। আখেরে তাতে লাভ না ক্ষতি? অভ্যাসকে গোঁয়ারের মতো আঁকড়ে থাকা কোনও কাজের কথা না, দেখতে হবে তাতে ভাল হচ্ছে না খারাপ। খারাপ কিছু কাণ্ড নিশ্চয়ই হবে, ফেসবুক-সাহিত্যিকদের ঝামেলা ঘটবে, কারণ চ্যাটজিপিটি এত ভাল লিখতে শুরু করবে যে তার পোস্টের তলায়ই লাইক পড়বে, বা কোনও মানুষ ভাল লিখলে লোকে বলবে নির্ঘাত ও লেখেনি চ্যাটজিপিটি লিখে দিয়েছে। রোবট বা এআই-দের সম্বর্ধনা কিংবা পুরস্কার প্রদানও হবে না, ডেকরেটরদের স্বল্প ক্ষতি হল। কিন্তু পড়েশুনেদেখে আনন্দলাভের গলি ও প্রগলি খুলে যাবে লাখে লাখে, ইচ্ছে করলেই একটা ছড়া পড়ে নেওয়া, বা ফরমায়েশমতো একটা ছড়া পাঁচ মিনিটে (বা পাঁচ সেকেন্ডে) লিখিয়ে নেওয়া জলভাত হয়ে যাবে। হয়তো তাতে মানুষের জীবনে শিল্পের স্থান কিছু সস্তা হবে, কিন্তু ততদিনে শিল্পের বদলে অন্য আকর্ষণীয় খেলাধুলোও আমদানি হবে গুচ্ছের। অনেকে বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধি আর যা-ই করুক একেবারে জিনিয়াসের ম্যাজিক করে উঠতে পারবে না, মোটামুটি স্তরের শিল্প তৈরি করতে পারবেমাত্র। এ হচ্ছে মানুষের সুপ্রাচীন আশাবাদের কণ্ঠ: যতই ক্ষতি হোক একেবারে প্রলয় ঘটবে না যাঃ। কিন্তু তাও যদি হয়, একটা চ্যাপলিন যদি না-ই জন্মাতে পারে কম্পিউটারে, তাহলেও হলিউডি থ্রিলার বা রম-কম, দক্ষিণী নাচা-গানা অ্যাকশন, বলিউডি ধাঁ-চকচক, সোজা কথা উত্তম পালিশ-সহ মাঝারিয়ানা তো দিব্যি জন্মাবে, এবং তারই তো জয়জয়কার, বেশিরভাগ লোকে তো বেশিরভাগ সময় সেই স্তরের শিল্পই হদ্দমুদ্দ উপভোগ করছে।
এই বিরাট লোকেরা কৃত্রিম বুদ্ধির বিরুদ্ধে চিঠি লিখছেন কেন? তাঁরা শিল্প নিয়ে নয়, অর্থনীতি নিয়ে ভাবিত। কৃত্রিম বুদ্ধি এসে এমনভাবে চাকরি খাচ্ছে ও খাবে, আধমণি কৈলাসও অনুরূপ জোশ-সহ মণ্ডামিঠাইকে অ্যাটাক করতেন না। কনটেন্ট-লেখক দরকার হবে না, অনুবাদক দরকার হবে না, হিসেবরক্ষক, প্রুফরিডার, এমনকী ছোটখাটো জিংগল বা সিরিয়াল টাইটল-সংগীতের সুরকারও বাতিল (কেউ কেউ বলছেন ড্রাইভার, সৈন্য, ডাক্তারও এই তালিকায় পড়বে)। কিন্তু তা নিয়ে ছ’মাস প্রখর ভেবেচিন্তে যদি দেখা যায় কাঁড়ি কাঁড়ি লোক সত্যিই রুজি হারাবেন ও না-খেয়ে মরবেন, এআই-বিজ্ঞানীরা ‘ওঃ, কী ভুল করছিলেম রে মা’ পুকারি চাটিবাটি গুটিয়ে বাড়ি গিয়ে ঢ্যাঁড়স ফলানোয় মন দেবেন? তা হয়? বামফ্রন্টের কম্পিউটার-বিরোধিতাকে আমরা আজ কী চোখে দেখি? মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করার অভিযানে গোড়া থেকে দৌড়চ্ছে, নইলে খামকা পাথর ঠুকে আগুন বের করার চেষ্টা করত না, আর সেই আবিষ্কারের ফলে কী পুড়ে যেতে পারে তা ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি বলেই তা থেকে সতেরো-হাজার সুবিধে নিষ্কাশন করে নিয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধি সত্যিই রাজত্ব বিস্তার করলে নতুন চাকরিও নিশ্চয় তা থেকেই গজাবে, নতুন পৃথিবীর নতুন প্রয়োজন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হবে, নতুন কর্মী দরকার হবে। আর যদি না-ও হয়, যদি সত্যিই শুধু ক্ষতি হয়, তাহলেও সে ক্ষতি মেনে চলতে হবে। মানুষ যখন রকেট বানায় আর তা নেপচুনের চুন কীভাব খসছে তা নিয়ে দু’লাখ তথ্য পাঠায়, তখন অনেকেই বলেন আরে এই টাকায় একটা দরিদ্র দেশকে বছর চারেক পেটভরে খাওয়ানো যেত, কিন্তু সেই তর্কে হাবল টেলিস্কোপ কুঁচকে যায় না। আজ যদি নেতাজি এসেও বলেন, ল্যান্ডলাইনে ফিরে যাও, সমাজের একলসেঁড়েপনা কমবে, বাঙালি মোবাইল বর্জন করে কালো ভারী টেলিফোনে প্রণিপাত করবে না। তাই, কিছু শিহরিত ও কিছু আতঙ্কিত কম্বো-দৃষ্টিতে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে, যদি সে জটিল মনোভাব প্রকাশ করতে তুতলে যান, নো পরোয়া, চ্যাটজিপিটি দু-সেকেন্ডে অমোঘ কাব্য তৈরি করে নির্ভুল বানানে পরিবেশন করে দেবে।