ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আত্মানুসন্ধানের এক ব্যতিক্রমী স্বর : অ্যানি এরনো


    সিদ্ধার্থ দে (April 29, 2023)
     

    সময় বিমূর্ত, তার প্রকৃত চরিত্র ঠাহর করা দুষ্কর। অথচ আমাদের জীবন অতিবাহিত হয় তারই অঙ্গুলিহেলনে, তাকে অস্বীকারও করতে পারি না। ভাষায় বোঝাতে আশ্রয় নিই রূপকের। কল্পনা করে নিই সময় এক সীমিত সম্পদ, টাকাপয়সার মতো, বলি ‘সময় নষ্ট কোরো না’, ‘হাতে অনেকটা সময় আছে’, বা ‘আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে’। জর্জ ল্যাকফ ও মার্ক জনসন তাঁদের অসামান্য বই Metaphors We Live By তে সময়কে নিয়ে আমাদের এই রূপকাশ্রয়ী কল্পনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পাশাপাশি উস্কে দিয়েছেন এক বিকল্প চিন্তা : আচ্ছা, এমনটা যদি হয়, আমার হাতে সময় নেই, আমিই সময়। আমার মধ্যে দিয়েই তার প্রকাশ। আমার সত্তা, আমার জীবন কতকগুলি মুহূর্তের যোগফল বই তো নয়! যখন কাউকে ‘খানিকটা সময় দিই’, তা তো নিজেরই একটা অংশ তাকে দেওয়া। 

    অ্যানি এরনোর ‘দ্য ইয়ার্স’ (The Years) বইটা পড়তে পড়তে এই চিন্তাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আশ্চর্য এই রচনা ! ১৯৪১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তাঁর জীবনের ৬৬ বছরের আত্মকথা লিখতে বসেছেন এরনো, কিন্তু সে লেখা নিজের কথা ছাপিয়ে হয়ে উঠছে সময়ের কথা, একটা আস্ত প্রজন্মের কথা! বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে আপাত শান্তি আসছে, মানুষের আলাপে আলোচনায় থেকে যাচ্ছে তার ভয়াবহতার স্মৃতি, রাজনৈতিক চিত্র বদলে বদলে যাচ্ছে, দ্য গল্, মিত্তেরাঁরা চক্রাকারে ঘুরছেন ক্ষমতার চাকায়, ফ্রান্স তথা বিশ্বের আকাশে আবির্ভূত হচ্ছেন নতুন নতুন চিন্তক — সার্ত্র, বুভোয়ার, ফুকো, বার্থ, আসছে ভিয়েতনামের যুদ্ধ, ছাত্র আন্দোলন, পাল্টে যাচ্ছে সমাজ, যা কিছু নিষিদ্ধ ছিল তা উদযাপিত হচ্ছে ক্রমে ক্রমে, প্রযুক্তি এসে আমূল বদলে দিচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবন, টেলিভশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট — একের পর এক এসে আছড়ে পড়ছে সময়ের ঢেউ। আর তারই মধ্যে আভাসে ইঙ্গিতে আমরা লক্ষ্য করছি এক মেয়ের বড়ো হয়ে ওঠা, নারী হয়ে ওঠা। বুভোয়ার যেমনটা বলেছিলেন, “একটি নারী জন্মায় না, সে নারী হয়ে ওঠে।” এই ‘হয়ে ওঠার’ কাহিনী পল্লবিত হচ্ছে সময়ের বৃহত্তর আখ্যানের মধ্যে। আমরা দেখছি তার জীবনের নানান খন্ডচিত্র — তার প্রথম স্বমেহনের অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে তার সন্তানদের নিজেদের পরিবার গড়ে তোলা অবধি। স্মৃতির হাত ধরে মিলেমিশে যাচ্ছে ব্যক্তিগত আর সমষ্টিগত। এরনো লিখছেন, “কামের মতোই, স্মৃতির শেষ নেই। সে মৃতের সাথে জীবনকে, বাস্তবের সাথে কল্পনাকে, স্বপ্নের সাথে ইতিহাসকে জড়িয়ে দেয়।”

    আর এই জড়িয়ে যাওয়া আখ্যানে তাই কোনো একক ‘আমি’কে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। গোটা বইয়ে কোথাও ’আমি’ নেই, রয়েছে ‘আমরা’। আবার কখনো কখনো নিজের ছোটবেলা, কৈশোর, যৌবনকালকে লেখিকা দেখছেন এক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব থেকে, ব্যবহার করছেন থার্ড পার্সন। কারণ, সময়ের ব্যবধানে মেয়েটি যে পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, যেন কতকগুলি ভিন্ন ভিন্ন সত্তার কোলাজ, যে কোলাজের উপর কোনো একরূপতা আরোপ করা অসম্ভব। প্রচলিত অর্থে এই আখ্যান তাই ‘আত্মকথা’ নয়, এই আখ্যান আদতে সময়ের আখ্যান, সময়ই তার কথক। প্রায় ২৫০ পাতা আর ৬৬ বছর সময়কাল ব্যাপ্ত এই বই লেখা হয়েছে এক অদ্ভুত ঘটমান কালে, continuous tenseএ, এক নিত্য বর্তমান, নিজেকেই নিজে গিলতে গিলতে এগোচ্ছে। যেন সময়ের Palimpsest — পুরোনো লেখা মুছে দিয়ে চলছে পুনর্লিখন, নিরন্তর। আমাদের আত্মনির্মাণও তো আসলে তেমনই, প্রতিনিয়ত পুরোনো সত্তাকে মুছে দিয়ে নূতন সত্তার জন্ম। সময়ই এই রচনার ‘আমি’। লক্ষ্য করে দেখুন মূল ফরাসিতে বইটির নাম Les Années (বছরগুলি); লেখিকার নামের সাথে শব্দটি প্রায় সমোচ্চারিত।

    ২০০৮ সালে প্রকাশিত এই বইটিকে ইংরেজি অনুবাদক এলিসন স্ট্রেয়ার এরনোর অন্যান্য রচনাগুলির নিরিখে এক বিচ্যুতি বলেছেন। আপাতভাবে কথাটি যথার্থ। রচনার দৈর্ঘ্যে, বা বহু স্বরের ব্যবহারে এমনকী এর বিশাল ব্যাপ্তিতেও এই বই এরনোর অন্যান্য বইয়ের থেকে আলাদা। কিন্তু নিহিত বিচারে এই বইয়ের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায় তাঁর লেখার সাধারণ চিহ্নগুলি। এই বইয়ের মতোই একের পর এক বইতে নিজের অতীতে ফিরে গিয়েছেন এরনো, আর সেখান থেকে খনন করে এনেছেন নানান স্মৃতিচিহ্ন, যেগুলিকে জড়ো করে পুনর্নির্মাণ করেছেন একেকটা অধ্যায়। নিজেকে বুঝবার জন্য তো বটেই, একইসঙ্গে নিজেকে ভেঙেচুরে নিজের মাধ্যমে জীবনকে বুঝবার এক বিরামহীন প্রয়াসে ব্রতী হয়েছেন। পোড়-খাওয়া কোনো সত্যান্বেষী গোয়েন্দার crime scene পুনর্নির্মাণ করার মতো তাঁর লিখনপদ্ধতি। যেখানে কেউ সন্দেহের বাইরে নয়, নিজের স্মৃতিকেও  বারংবার প্রশ্নচিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করাচ্ছেন। সশরীরে ফিরে যাচ্ছেন স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলিতে। কুড়িয়ে নিচ্ছেন কিছু বস্তুনিষ্ঠ সূত্র, কিছু clue — কখনো নিজের ডায়েরির পাতা, কখনো কোনো সাদা কালো ছবি, কখনো কোনো বিজ্ঞাপনের সুর, কোনো গানের লাইন, কোনো বন্ধুর করা একটা আলগা মন্তব্য। স্মৃতির ফাঁকফোঁকর দিয়ে যাতে কোনোমতেই মিথ্যার অনুপ্রবেশ না ঘটে, তাই তাঁর এই নিরলস পরিশ্রম। 

                                              ******************************

    তাঁর গদ্যশৈলীও এই কাজে তাঁর সহায়ক ও পরিপূরক। নির্মেদ, অনাড়ম্বর ঝরঝরে বাক্যগুলো যেন বিজ্ঞানের বস্তুনিষ্ঠা আর সাহিত্যের সত্যের মধ্যে এক আশ্চর্য্য মেলবন্ধন। ‘সিম্পল প্যাশন’ (Simple Passion) বইটির কথাই ধরা যাক। নাতিদীর্ঘ এই বইটির উপজীব্য এক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের উচাটন। এক বছরের মাত্র সম্পর্ক। পুরুষটি বিদেশী, পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশের মানুষ, কর্মসূত্রে প্যারিসে থাকেন। বিবাহিত এবং বয়সে তরুণ এই পুরুষটি সকলের অগোচরে কখনো কখনো লেখিকার কাছে আসেন। এর প্রতি এক অদ্ভুত মোহে আচ্ছন্ন হন লেখিকা, যে আচ্ছন্নতা তার দৈনন্দিন যাপনকে তছনছ করে দেয়, তৈরি হয় এক অবসেশন। বই পড়তে পড়তে সেই পুরুষের কথা ভাবেন শুধু, সিনেমা দেখতে দেখতেও। বাড়ি থেকে বেরোন না, পাছে তার ফোন এসে সাড়া না পায়। রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময়ে ঘোরের মধ্যে থাকেন, গন্তব্য স্টেশন পার হয়ে যায়, নামতে ভুলে যান। 

    সাহিত্যে এই বিষয় একেবারেই নতুন নয়। পাঠক ভেবে বসতেই পারেন যে এ একেবারে জমজমাট, রগরগে বিধ্বংসী প্রেমের কাহিনি। কিন্তু এই বইটির বিশেষত্ব যত না এর বিষয়বস্তুতে তার চেয়ে অনেক বেশি এর লিখনভঙ্গিমায়। গোটা বইতে এতটুকু চটুলটা নেই, ভাবালুতা নেই, যৌনতার চিহ্ন আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কিন্তু তা নিয়ে দেখনদারী নেই। সর্বোপরি, শেষ হয়ে যাওয়া এই সম্পর্কের পুনর্নির্মাণে আত্মপক্ষ সমর্থনের তিলমাত্র প্রচেষ্টা নেই। তবে কীসের জোরে এই কাহিনি আবিষ্ট করে রাখে পাঠককে? নির্মোহ সত্যের জোরে। আর সেই জোরেই বইটির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য হয়ে ওঠে টানটান, জ্বলজ্বলে। অদ্ভুত মণিমুক্তো ছড়িয়ে বইটিতে — “কতবার আমরা মিলিত হলাম তার হিসেবে রাখতাম আমি। মনে হতো প্রতিবার আমাদের সম্পর্কে নতুন কিছু যোগ হলো বুঝি। কিন্তু এই স্পর্শগুলো, এই সুখগুলোই জমতে জমতে আমাদেরকে দূরে সরিয়ে দেবে, আস্তে আস্তে খরচ হয়ে যাবে কামের পুঁজি।”; “কখনো কখনো ভাবতাম সঙ্গমে মাখামাখি এই বিকেলগুলোর কি মানে ওর কাছে? হয়তো শুধু ওটুকুই — যৌনসুখ। অন্য কারণ খোঁজার দরকারই বা কি! শুধু একটা জিনিসই নিশ্চিত করে বুঝতে পারতাম, ওর কাম বা তার অভাব। ওর পুরুষাঙ্গটা দেখলেই সেই অনস্বীকার্য সত্যে পৌঁছে যাওয়া যেত।”; “আমার সৌভাগ্য, যে সত্যিটা আমরা সকলেই একদিন না একদিন জানতে পারি, সেটা আমি প্রথম থেকেই জানতাম — আমাদের ভালোবাসার মানুষটাকে আসলে আমরা চিনি না।”

    সংবেদনশীল পাঠকমাত্রেই এই বাক্যগুলির অন্তরে নিহিত সত্য এবং সর্বজনীনতা উপলব্ধি করবেন। নিজের জীবনের একটা অধ্যায়ের বর্ণনায় এই ব্যাপ্তি লাভ করতে লেখককে রচনার প্রতিটা স্তরে আপসহীন আত্মনিরীক্ষণ করতে হয়েছে। বইয়ের নানান জায়গায় পাঠকের সামনে এই কাটাছেঁড়ার কথা তুলে ধরেছেন এরনো। নিজের স্মৃতির বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্ন করেছেন। “আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে আমি ওর শরীরটাকে মনে রাখতে চাইতাম — মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি। পরিষ্কার দেখতে পেতাম ওর সবুজ চোখ, কাঁধের ভাঁজ, কপালের উপর নেমে আসা চুল। ওর কামড় অনুভব করতাম, ওর মুখের ভিতরটা, ওর উরুর আকার, ওর চামড়ার স্পর্শ। বুঝতে পারতাম এই পুনর্নির্মাণ আসলে একধরনের হ্যালুসিনেশন, এখানে স্মৃতিতে আর পাগলামিতে কোনো তফাৎ নেই।” 

                                                    *****************************

    এই যে নিজেকে বেআব্রু করে পাঠকের সামনে তুলে ধরা, কোনো রাখঢাক না রেখে, কাল্পনিক চরিত্রের আড়ালে নিজেকে না লুকিয়ে — এর এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি আছে, এক স্বতন্ত্র স্বর যেন উঠে আসে বইয়ের পাতা থেকে, এবং পড়া ফুরোনোর পরেও সে স্বর লেগে থাকে কানে। ‘হ্যাপেনিং’ (Happening) বইটিতে এই স্বর যেন আরো স্পষ্ট, আরও অকপট। ২০০০ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে এরনো ফিরে দেখছেন ১৯৬৩ সালে ঘটে যাওয়া তাঁর জীবনের একটি যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায়। অনভিপ্রেত গর্ভধারণ ও গর্ভপাত। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর বহু জায়গার মতোই ফ্রান্সেও তখন গর্ভপাত ছিল আইনত নিষিদ্ধ। একটি বছর কুড়ির মেয়ে, নিজের শরীরকে সে চিনেই উঠতে পারেনি তখনো, ক্ষনিকের প্রেমের খেসারত দিতে এক অজানা ভার নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক, সাহায্যের প্রত্যাশায় হন্যে হয়ে ফিরছে প্যারিসের অলিগলি, চোরাগোপ্তাভাবে যদি গর্ভপাত করানো যায়। কোথাও বিদ্রুপ, কোথাও নীতিপুলিশি, কোথাও আবার লোলুপ দৃষ্টি — সবটাই সয়ে নিচ্ছে সে, এই ভার তাকে নামাতেই হবে।

    নিজের সম্বন্ধে হোক বা দুনিয়ার, কোনো কিছুই লুকোচ্ছেন না এরনো। শরীরে আগত এই নতুন প্রাণটির প্রতি কোনো দয়ামায়া তার হয়নি, হয়নি অপত্যস্নেহের উন্মেষ। নিজের ডায়েরিতে নিজেকে ‘গর্ভবতী’ বলে উল্লেখ তো করেন নি, জরায়ুর অভ্যন্তরে থাকা প্রাণটিকেও শুধুমাত্র একটি বস্তু হিসেবে দেখেছেন, লিখেছেন ‘জিনিসটা’, ‘ওটা’। কলেজের এক পুরুষ সহপাঠী, সে তখন আন্দোলন করছে মেয়েদের নানা অধিকার নিয়ে, তাকে সবটা বলেছেন, কিন্তু সাহায্য পাওয়া তো দূরস্থান, বরং সেও সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এরনো ক্ষোভ প্রকাশ করছেন না, বরং সহজভাবে লিখছেন, “আসলে, ঘটনাটা শুনে ওর মনে আমার সম্পর্কে ধারণাটা পাল্টে গিয়েছিলো, আমি তখন সেই ধরনের মেয়ে যে ‘হ্যাঁ’ বলবে, ‘না’ বলবে না। ছেলেরা তখন এই দুই ভাগেই মেয়েদের ভাগ করতো।” এইসব খোলামেলা স্বীকারোক্তির পাশাপাশি, তাঁর লেখায় অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে খুঁটিনাটি জিনিসের স্মৃতি। ঋতুস্রাবের রক্ত, একটা ছোপ লাগা অন্তর্বাস, একটা সরু লম্বা দণ্ড (যেটা যোনির মধ্যে ঢুকিয়ে গর্ভপাত করা হবে), একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা, একটা ওষুধের শিশি — ছোট ছোট এই ছবিগুলি ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে তাঁর লেখায়, অতীতকে জ্বলজ্যান্ত করে তোলে। মনে পড়ে যায় টি এস এলিয়টের নৈর্ব্যক্তিকতার তত্ত্ব — objective correlative : কবি তাঁর ‘আমি’কে আনবেন না কাব্যে, তাঁর অনুভূতির, যন্ত্রণার বর্ণনা করবেন না; তিনি শুধু কিছু শব্দ, কিছু বস্তু, কিছু ছবি সাজিয়ে দেবেন, পাঠকের মনে দৃশ্যটি আপনিই ফুটে উঠবে, অনুভূতিগুলি জাগরুক হবে। এরনো লিখছেন, “আমি আসলে ঠিক মনে করতে চাইছি না, আমি সেই মুহূর্তটায় ফিরতে চাইছি। একদম সেই মুহূর্তটায়, অবিকল — এতটুকু আগে বা পরে নয়।” বলছেন, “লিখবার সময় সতর্ক থাকতে হবে, যাতে কাব্যিক উচ্ছ্বাস এসে না পড়ে, রাগ বা যন্ত্রণার আস্ফালন এসে না পড়ে। এই বইতে কান্না বা চিৎকার থাকলে চলবে না, কারণ যে সময়ের কথা লিখছি তখন আমার জীবনে দুটোর কোনোটারই সুযোগ ঘটে নি।” নিজের অতীতকে এতো শীতল, বস্তুনিষ্ঠ গদ্যে ফুটিয়ে তোলা, প্রায় আবেগহীন, বাহুল্যবর্জিতভাবে — এমন উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে বিরল বললেও অত্যুক্তি করা হবে না! আত্মজৈবনিক রচনায় তা আরোই অপ্রতুল।

                                                    ****************************

    নিজেকে নিয়ে লিখেও এই ‘আমি’কে ছাপিয়ে যেতে পারা, নিজের অতীতকে এক নির্লিপ্ত দূরত্ব থেকে দেখতে ও দেখাতে পারা — এটাই বোধয় অ্যানি এরনোর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, যা তাঁর আত্মকথাগুলিকে সাহিত্যপদবাচ্য করে তুলেছে, এনে দিয়েছে সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার। নারীবাদীরা সঙ্গত কারণেই তাঁকে দলে টেনেছেন। তাঁর লেখায়, যাপনে, দৃষ্টিভঙ্গিতে বুভোয়ার, গ্রিয়ার, মিলেটদের ছাপ অনস্বীকার্য। কিন্তু কোলরিজ যেমনটা বলেছিলেন, প্রকৃত স্রষ্ঠার মন লিঙ্গভেদের ঊর্ধ্বে। এরনোর লেখায় তাই নারীজীবনের কথা মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পুরুষ পাঠকের সমস্যা হয় না। দেশকালের তফাতে অনেক ছোটখাটো রেফারেন্স হয়তো সবসময় ধরা যায় না, কিন্তু একটা জীবনের মধ্যে দিয়ে সময়ের বহমানতা, একজন ব্যক্তির মধ্যে দিয়ে সমাজের গতিপ্রকৃতি, আর সর্বোপরি একজনের স্মৃতির মধ্যে দিয়ে সর্বজনীন সত্যের প্রকাশ পাঠক সহজেই দেখতে পান। 

    সর্বত্র নিজেকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর যুগে, আত্মপ্রেমে ও আত্মগরিমায় হাবুডুবু খাওয়ার, আর অহরহ সত্যের সাথে মিথ্যেকে গুলিয়ে ফেলার এই সময়ে এমন একটি নৈর্ব্যক্তিক, ঋজু ও সত্যনিষ্ঠ স্বর তাই বিশ্বের পাঠককূলের কাছে এক আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে, সন্দেহ নেই।

    (* অ্যানি এরনোর ইংরিজিতে অনূদিত বইগুলি ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য সেভেন স্টোরিজ প্রেস কর্তৃক বিশেষভাবে মুদ্রিত হয়েছে। আমি সেই সংস্করণেই আলোচিত বইগুলি পড়েছি।

    • আলোচনার বিভিন্ন জায়গায় আমি বইগুলিকে শুধুমাত্র ‘বই’ হিসেবেই উল্লেখ করেছি, তার উপর নির্দিষ্ট কোনো সংরূপ বা genre পরিচয় আরোপ করি নি, কারণ কাজটা আমার অত্যন্ত জটিল বলে মনে হয়েছে। এরনোর লেখাগুলিকে পাঠক ও সমালোচকরা কখনো স্মৃতিকথা, কখনো আত্মকথা, কখনো বা আত্মজৈবনিক উপন্যাসও বলেছেন। এই সবকটা তকমাই আমার সমস্যাযুক্ত বলে মনে হয়েছে। আমি তাই যথাসাধ্য তকমাগুলো এড়িয়ে গিয়েছি।
    • বইয়ের উদ্ধৃতিগুলির ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ আমার করা, নেহাতই আলোচনার ছন্দ রক্ষার্থে তর্জমা করতে হয়েছে, মূলের বা অনূদিত ইংরেজীরও কিছুমাত্র স্বাদ যদি তাতে ধরা না পড়ে, তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। )

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook