চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিরুদ্ধে খেলা পড়লে এখনো সল্টলেক স্টেডিয়ামে ভিড় জমে। গ্যালারিতে দেখা যায় বিশালা পতাকা। শহর এবং শহরতলির কিছু পাড়াও একদিনের জন্য সেই রঙে সেজে ওঠে। বাইপাসে চোখে পড়ে ম্যাটাডোর বোঝাই মাঠমুখী বা মাঠফেরতা মানুষের ঢল। বেশকিছু বছর আগের সঙ্গে তফাৎ, আজকাল তাদের বুকে বাজে করুণরাগিণী।
পতাকার রঙ লাল-হলুদ। দলের নাম ইস্টবেঙ্গল। বয়স ১০৩। ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে অবদান বহুদিনের। বাংলা এবং বাঙালির এক অংশের আইডেন্টিটি। ইলিশের প্রতীক। তথাকথিত বাঙালিয়ানার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে যে কারণে এই পরিচয়, এই মুহূর্তে তার ধারেকাছে নেই ইস্টবেঙ্গল। হতাশার প্রায় শেষ সীমায় অগুনতি সমর্থকের দল, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যেখানে আছে বাঙালি। অনেক বছর হল তাঁদের প্রিয় ক্লাবের প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য।
আশায় আশায় বসে ছিলেন অসংখ্য মানুষ, যেদিন ঘোষণা হয় ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) খেলতে চলেছে লাল-হলুদ। দিনটা সেপ্টেম্বর ২৭, সাল ২০২০। দুমাসের নীচে শুরু হতে চলেছে ভারতীয় ফুটবলের গ্ল্যামার প্রতিযোগিতার সাত নম্বর সংস্করণ। মোহনবাগান সঞ্জীব গোয়েঙ্কার এ-টি-কের সঙ্গে চুক্তিতে যোগ দিয়ে আসরে নেমে পড়েছে। দেরিতে হলেও, ইস্টবেঙ্গল ইনভেসটর খুঁজে পেয়েছে। এইবার নিশ্চয় কাটতে চলেছে দুর্দিন। প্রিয় ক্লাব আবার ফিরে পেতে চলেছে হারানো গরিমা।
তিন বছর হল। মানে ইস্টবেঙ্গলের এইটা আইএসএল-এ তৃতীয় মরসুম। প্রথমবার এগারো দলের মধ্যে নবম। দ্বিতীয় দফায় এগারোর মধ্যে এগারোয়। চলতি মরশুমে কুড়ির মধ্যে ষোল ম্যাচ খেলে নয় নম্বরে। আইএসএল-এ ছাপ্পান্ন ম্যাচে জয় নয়, ড্র ১৬, হার ৩১। গোল ৫৮, গোল হজম ১০০! যখন মোহনবাগান লড়ে চলেছে ফাইনাল বা সেমিফিনাল পৌঁছবে কি না, ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা দেখছেন তাঁদের দল লাস্ট হবে না হবে না। এই দুর্দশা লাল-হলুদের ইতিহাসে কোনোদিন হয়নি।
দুর্দিন আসে সব ক্লাবের। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, আর্সেনাল, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, জুভেন্তাস, এসি মিলান থেকে কলকাতা ময়দানের মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল কেউ ব্যতিক্রম নয়। চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে সব ক্লাব, যারা এতদিন ধরে একটা জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে। ইতিহাসে নজির বহু। ইস্টবেঙ্গলের ক্ষেত্রে চোখে রাখার বিষয় গত কুড়ি বছরের দুঃখজনক রেকর্ড। জাতীয় পর্যায়ে লিগের দিক থেকে দেখতে গেলে শেষ খেতাব ২০০৩-০৪ মরসুমে। শেষ সর্বভারতীয় টুর্নামেন্টে জয় ২০১২-য় ফেডারেশন কাপ। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব খেলছে কিন্তু কিছু জেতেনি দশ বছরেরও বেশি। বাস্তব? রুঢ় হলেও সত্যি।
খানিক ঝালিয়ে নেওয়া যাক। ইস্টবেঙ্গল জাতীয় পর্যায়ে কিছু না জিতলেও, আই-লিগ প্রতিযোগিতায় রানার্স-আপ হয়েছিল বার পাঁচেক। কয়েকবার তাদের সঙ্গে চ্যাম্পিয়ন দলের ফারাক ছিল এক বা দুই পয়েন্টের। শেষ দিন পর্যন্ত জেতার দৌড়ে তারা ছিল। জেতেনি, কিন্তু যারা জিতেছিল তাদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেয়নি লাস্ট হুইসল অবধি। হতাশ হলেও, ভেঙে পড়েনি লাল-হলুদ প্রেমী বাহিনী। বুক বেঁধেছিল নতুন দিন দেখার আশায়। তারপর, দিনের পর দিন আইএসএল-এ শোচনীয় পারফরম্যান্সের পর, তারা প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার অবস্থায়।
কারণ কী? একটা নয়। প্রথম, ক্লাবের তরফ থেকে উপযুক্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ খুঁজে না পাওয়া। এই জন্য, তিন বছরই ইস্টবেঙ্গলকে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হয়েছে। মূলত, তাঁর হস্তক্ষেপে জুটেছিল শ্রী সিমেন্ট প্রথম দুবছর। এই বছর ইমামি। প্রত্যেকবার চুক্তিসই নিয়ে জলঘোলা হয়েছে। ভোট জিতে ক্লাবের পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন না টাকা ঢালছেন যাঁরা— কাঁদের হাতে থাকবে ক্ষমতা? খেলোয়াড়, কোচ, সাপোর্ট স্টাফ নিয়োগ এই বিষয়ে কাদের হাতে থাকবে কর্তৃত্ব? ক্লাবে কাঁরা ঢুকতে পারবেন এবং কখন, কাঁরা ঠিক করবে? প্রশ্নগুলো কঠিন এবং উত্তর কারও জানা নেই। এই কারণেই, ইস্টবেঙ্গল দল তৈরি করেছে অন্য সব ক্লাব দল গড়ে ফেলার পর। সমস্ত ভালো ভারতীয় খেলোয়াড় অন্য দল তুলে নেওয়ার পর। পার্থক্য করতে পারতেন বিদেশিরা। সেই ক্ষেত্রেও ব্যর্থ লাল-হলুদ। সেই মানের বিদেশি ইস্টবেঙ্গল ঘরে তুলতে পারেনি।
বহুবছর ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পরিচালন সমিতি বা এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য দেবব্রত সরকার। ময়দানে পরিচিত ‘নীতু’দা’ নামে। তাঁর বক্তব্য, আই লিগ থেকে আইএসএল-এ আসার মধ্যে কিছু ফাঁক থেকে গিয়েছে। “আই লিগে আমাদের বার্ষিক বাজেট হত ১০ কোটির কাছাকাছি। সেটা এক ধাক্কায় প্রায় চারগুণ বেড়ে গিয়েছে। আইএসএল-এর অন্যান্য দলের ব্যাপারটা আলাদা। তারা শুরু থেকেই বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইসের সঙ্গ পেয়েছে। মোহনবাগানের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা খানিকটা তাই। আমরা শুরু করেছি শূন্য থেকে। এই সিস্টেমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, আদর্শ ইনভেসটর খুঁজে পেতে আমাদের একটু সময় লাগবে। ক্লাবের ইতিহাস বহু বছরের। সবদিক বিবেচনা না করে, আমরা ইনভেসটরের হাতে সমস্ত কর্তৃত্ব তুলে দিতে পারি না,” বলছেন দেবব্রত। যে ১০ সদস্যের বোর্ড ইস্টবেঙ্গল ক্লাব চালায় এই মুহূর্তে, তার সাতজন ইমামির। বাকি তিন ক্লাবের। তাদের মধ্যে দেবব্রত একজন।
দেবব্রত খুব একটা ভুল বলছেন না। আইএসএল ফ্র্যাঞ্চাইসগুলোর এক বছরের খরচ ৪০ কোটির কাছাকাছি। ফ্র্যাঞ্চাইস ফি প্রায় ১৩ কোটি, খেলোয়াড় এবং কোচের পিছনে খরচ আনুমানিক ২০ কোটি। এরপর আছে হোটেল, যাতায়াত, প্র্যাকটিসের মাঠ আয়োজন করা, পাবলিসিটি ইত্যাদি। আইএসএল সেন্ট্রাল পুল, নিজস্ব স্পন্সর, টিকিট বিক্রির নগণ্য টাকা থেকে বছরে আয় খুব বেশি হলে ১৫ কোটি। অর্থাৎ, প্রত্যেক দলের বার্ষিক ক্ষতি অন্তত ২৫ কোটি। কোন নিয়োগকারী এই চুক্তিতে আগ্রহী হবেন! আসলে, আইএসএল-এর অর্থনৈতিক মডেলটাই বেশ নড়বড়ে। যতদিন চলছে ঠিক আছে। কতদিন চলবে, কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবেন না।
তবে লাল-হলুদ রঙের যারা ভক্ত, তাদের কাছে এইসব ব্যাপার খুব বড় নয়। ইস্টবেঙ্গল খেতাব জিতুক বা না জিতুক, খানিকটা সম্মানজনক জায়গায় শেষ করুক, সেটাই তারা চান। একটু লড়ুক। অন্য দলকে বেগ দিক। হারতে পারি, না লড়ে নয়। কিন্তু এ কোন ইস্টবেঙ্গল? ছাপ্পান্ন ম্যাচে নয় জয়? হাফটাইমে ২-০ এগিয়ে থেকে হার ৪-২? একাধিক বার এগিয়ে থেকেও ভেঙে পড়া? এ কোন ধরনের ডিফেন্স? কোথায় মাঝমাঠ? বিপক্ষ দল সেন্টার সার্কেল পেরিয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়ছে পেনাল্টি বক্সে? খুব খারাপ না খেললে, এই রকম বিপর্যয় বারবার ডেকে আনা যায় না। কি করলেন কোচ স্টিফেন কন্সটানটাইন?
ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে কন্সটানটাইনের পরিচয় অনেক বছরের। জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। ওতপ্রোত চেনেন এই দেশের ফুটবল সিস্টেম। খুব একটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলা যায় না, তবে তিনি জানেন কী ভাবে এখানে খেলা হয়। বিদেশি খেলোয়াড় নির্বাচন করার ব্যাপারটা পুরোটাই ছিল তাঁর হাতে। প্রথম দিকে তিনি ঠিক বলছিলেন। তাঁর কথায় উঠে আসছিল সেই সত্য, ইস্টবেঙ্গল যথেষ্ট সময় পায়নি দল গুছনোয়। আসরে নেমে অন্য সব দল অনেক আগেই ঘর সাজিয়ে নিয়েছিলো। আদ্যন্ত বাস্তব। তবে, তারপর, তাঁর কথায় ভেসে ওঠে কিছু অসামঞ্জস্য। তিনি বলেন, সব খেলোয়াড় তিনি নির্বাচন করেননি। এইটা সত্যি নয়। সমস্ত বিদেশি কন্সটানটাইন নিজেই বেছে নিয়েছিলেন। সেই খেলোয়াড়দের ব্যর্থতা তাঁর ঘাড়েই বর্তায়। এটা অস্বীকার করার জায়গায় তিনি নেই। সে তিনি যাই বা নাই বলুন।
এই প্রসঙ্গে, ইস্টবেঙ্গল এবং ভারতীয় ফুটবলের অবিস্মরণীয় তারকা ভাইচুং ভুটিয়ার কিছু মতামত বাস্তবসম্মত মনে হয়। লাল-হলুদের হয়ে আত্মপ্রকাশ বছর ১৬ বয়সে। হয়ে ওঠা ভারতীয় ফুটবলের আইকন। তাঁর মতে, ইস্টবেঙ্গল আইএসএল-এ খেলার জন্য পর্যাপ্ত প্রতিশ্রুতি কখনওই করতে পারেনি। “খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ব্যাপারটা যখন শেষ মুহূর্তে আপনি জানতে পারেন আপনার দল খেলছে। কী ভাবে আপনি পাবেন ইনভেসটর সেই ক্ষেত্রে? আমার মনে হয়, এটা ইস্টবেঙ্গলের দোষ নয়। এটা আমাদের ফুটবল সিস্টেমের পরিকাঠামোর দোষ। আপনি তো জানবেন অন্তত মাসদুয়েক আগে আপনার ক্লাব খেলবে কি না! টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার একমাস আগে জানলেন আপনারা খেলবেন, কী ভাবে তৈরি করবেন জেতার মতো দল?”
নিজের তৈরি রাজনৈতিক দল, হামরো সিকিম-এর হয়ে আগামী লোকসভা ভোটে লড়াইয়ের জন্য তৎপর, ভাইচুং-এর আরও কিছু বলার আছে। “এই পরিকাঠামো ঠিক নয়। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান স্পোর্টিং, এই দলগুলোকে বিনা ফ্র্যাঞ্চাইস ফিতে আইএসএল-এ খেলতে দেওয়া উচিত। ভাবুন এই ক্লাবগুলোর সমর্থক সংখ্যা। থাক রেলিগেশন-প্রোমোশন এর ব্যাপার (যেটা আইএসএল-নেই)। ভালো না খেললে দল থাকবে না টপ পর্যায়ে। থাক না নেমে যাওয়ার ভ্রুকুটি। ভারতের ফুটবল ফেডারেশান এবিষয়ে সচেষ্ট আর চিন্তিত হলে ভাল হত। মনে হয় না, আমাদের ফেডরেশান এই নিয়ে খুব একটা ভাবছে”।
ভাইচুং-এর চিন্তাভাবনা হয়তো খানিকটা উদ্দেশ্যপ্রনোদীত। তিনি নিজে সম্প্রতি ফেডারেশন ভোটে লড়ে শোচনীয় ভাবে হেরেছেন। তবে তিনি মনেপ্রাণে ইস্টবেঙ্গল। এই ক্লাবে খেলে তাঁর আত্মপ্রকাশ এবং উন্নতি। ভাইচুং বোঝেন সমর্থকদের ব্যথা, হতাশা। তিনি চান, এই হতাশার শেষ হোক। তবে, রানার এ বোঝার টানার দিন কবে শেষ হবে? রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে? একদিন উঠবে। উৎকণ্ঠায় জাগরিত আপাতত অগণিত লাল-হলুদের সমর্থক।