ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভূমিকন্যা


    অম্লান চক্রবর্তী (February 4, 2023)
     

    দুষ্মন্ত ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে তাজমহল দেখেছে; ঈদের সাজে বড়া ইমামবাড়া দেখেছে; এমনকী অজিত ভাইয়ার সাথে একবার দিল্লি গিয়ে রিপাবলিক ডে প্যারেডও দেখে এসেছে। কিন্তু ফাইলে চোখ বোলাতে-বোলাতে ক্লান্ত মায়া যখন হাতদুটো দু’পাশে ছড়িয়ে সশব্দে হাই তুলল, দুষ্মন্তর মনে হল এর চেয়ে আকর্ষণীয় কিছু সে তার ছাব্বিশ বছরের জীবনে দেখেনি। 

    এমন নয় যে, সে সুন্দরী মেয়ে দেখেনি। মহল্লা-কাঁপানো সোনম এ-বছরই ভাবি হয়ে ঘরে এসেছে। তাছাড়া এই লখনৌ শহরে ছড়ানো অজিত ভাইয়ার হাফডজন ডাকসাইটে গার্লফ্রেন্ড আর সুগন্ধাজি, যার সাথে অজিত ভাইয়ার বিয়ে হবে, তাদের নিয়ে দুষ্মন্তর নিত্য কারবার। অজিতের বাবা সৎপালজি আজ এমএলএ, কাল মন্ত্রী হবেন, শহরের সবাই জানে। অজিত দলের যুবমোর্চার নেতা। বাপ বলে দিয়েছেন, এখন যত খুশি বয়েসসুলভ মস্তি করে নাও, কিন্তু শেষমেশ বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে সুগন্ধাজির সাথেই। অজিতও বাধ্য ছেলের মতো ভবিতব্য মেনে নিয়ে আপাতত ফুলে-ফুলে ঢলে-ঢলে বেড়াচ্ছে। তবে বাপের মতো ছেলেরও রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রবল। পাশের রাজ্য হরিয়ানায় প্রাইভেট কোম্পানিগুলোয় ৭৫ শতাংশ চাকরি ভূমিপুত্র-ভূমিকন্যাদের জন্য বাধ্যতামুলক করে আইন হয়েছে। অজিত ভাইয়া ন্যায্য প্রশ্ন তুলেছেন, এ-রাজ্যেও তা হবে না কেন? কৃষিজমি উবে যাচ্ছে, চাষির ঘরের ছেলেপুলেদের চাষবাসে মন নেই। অন্তত কম মাইনের চাকরিগুলো রাজ্যের মধ্যে ধরে রাখতে না পারলে দুষ্মন্তর মতো ছেলেগুলো কাল কাট্টা-রামপুরি হাতে চুরি-ছিনতাই শুরু করবে। সেটা কি কারুর জন্য ভাল হবে? 

    ‘অফিসের জমি দেব— আমরা। বিজলি-পানি দেব— আমরা। আর চাকরির বেলায় উড়ে এসে জুড়ে বসবে বাইরের লোক? মামার বাড়ি পেয়েছে? আপনাদের অজিত কি এখানে চুড়ি পরে বসে আছে?’ গত সপ্তাহে আম্বেদকর ময়দানে হাত নেড়ে বক্তৃতা করে এভাবেই রক্ত গরম করে দিয়েছিল অজিত ভাইয়া। চুড়ির বদলে কব্জির কাছে ঝকঝক করছিল রোলেক্স সাবমেরিনার। 

    গত তিন মাসে গোটা যুবমোর্চায় একটা জোয়ার এসে গেছে এই একটা ইস্যুতে। চোখে স্বপ্ন আর পায়ে ধুলো মেখে হাজার-হাজার দুষ্মন্তরা ভরিয়ে দিয়েছে সমাবেশ। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছে অজিত ভাইয়ার প্রতিটি শব্দ। হাততালিতে আর স্লোগানে কানে তালা ধরিয়ে দিয়েছে। তাদের অগুন্তি পায়ের চাপে ন্যাড়া হয়ে গেছে শহরের একাধিক পার্ক। 

    আর অবশ্যই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে অজিত ভাইয়ার কেরিয়ার-গ্রাফ। অজিত ভাইয়ার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে তারও কদর বেড়েছে। সবাই জানে, দুষ্মন্তকে ডিঙিয়ে অজিত ভাইয়ার কাছে পৌঁছানো সহজ নয়।  

    আজ চারদিন হল নিয়ম করে সন্ধেবেলা আইসিইউ-তে আসছে দুষ্মন্ত। অজিত ভাইয়ার নানি হিপ বোন ভেঙে ভর্তি। সারাদিন বুড়ির গোঙানির বিরাম নেই। বার বার নিজের কাপড় ফেরত চাইছে, বলছে বাড়ি যাবে। হাসপাতালের খাবার ছুঁয়েও দেখছে না। মায়া-সহ বাকি নার্সরা হাল ছেড়ে দিয়েছে; শুধু সারণ্য বলে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান নার্স নাছোড়বান্দা হয়ে লড়ে যাচ্ছে। 

    ‘কিয়া হুয়া নানি? কানা কালো’, বিটকেল হিন্দিতে প্রায়-অচৈতন্য বুড়িটাকে খাওয়ানোর জন্য দেওয়ালে মাথা ঠুকে যাচ্ছে মেয়েটা।

    অবশ্য সৎপালজির মা বলে কথা। হাই-প্রোফাইল রুগি, সেইজন্যই আইসিইউ-তে যখন-তখন আসতে পারে দুষ্মন্ত। নিয়মের বাইরে গিয়ে বেডের পাশে একটা চেয়ারও রাখা আছে তার জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা দুষ্মন্তর মোটেই পোষায় না। দরজা ঠেলে ঢুকতেই বেটাডিন আর ফ্লোর-ক্লিনারের মিশ্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে আছড়ে পড়ে। তার ওপর রাত-দিন গুলিয়ে দেওয়া ফ্যাকাশে আলো আর চারপাশের বেডগুলো থেকে মৃদু গোঙানির আওয়াজ যেন মস্তিস্ককে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। হলের মাঝখানে একটা ইউ আকৃতির টেবিলের মাঝখানে স্তূপাকার ফাইল আর তার ওপর উপুর ঝুঁকে আছে ফরসা, গোলগাল চেহারার মায়া। বয়েস পঁচিশের মতো হলেও রোগ আর রুগিদের নিয়ে কারবার বলেই হয়তো ইতিমধ্যেই একটা ভারিক্কি ব্যক্তিত্ব এসে গেছে। এই অসুস্থতার মধ্যে মায়াকেই একমাত্র নিরাময় মনে হয়। তবে যেটা দুষ্মন্তর সবচেয়ে মনে ধরল, সেটা হল মায়ার বেপরোয়া ভাব। যে-নির্লিপ্ততা সব রোগীদের জন্য সে বরাদ্দ রাখে, এমএলএ-র মায়ের জন্যও তার ব্যতিক্রম হল না।  

    ‘ও বুড়ি, থামছে না কেন?’ দুষ্মন্তর উপস্থিতি যেন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মায়া জিজ্ঞাসা করল।

    ‘কানা বি নহি কায়া’, সারণ্য উত্তর দিল। ‘আম্মা, কানা কালো।’

    বুড়ির চেয়েও সারণ্যের ওপর যেন বেশি বিরক্ত হয়ে মায়া যেটা বলল, তার অর্থ মোষের সামনে বাঁশি বাজানো বৃথা এটা তার এতদিনে বোঝা উচিত ছিল। ‘কিছু মনে কোরো না, তোমরা সাউথ ইন্ডিয়ান নার্সরা বড্ড স্লো।’

    দুষ্মন্তর সাউথ ইন্ডিয়া নিয়ে ধারণা স্বচ্ছ নয়। এখনও মুম্বই যাওয়াই হয়ে উঠল না। তার ধারণায় মুম্বইয়ের ওপারে সবই সাউথ ইন্ডিয়া। সেখানে পাল্লা  দিয়ে নারকেলের চাষ আর ‘দাবাং’ ছবি তৈরি হয়, এবং লোকে রজনীকান্তকে পূজো করে— এটুকুই সে জানে। সেখানকার মেয়েরা কেমন হয় সে জানে না। সারনণ্যকে দেখে মনে হয়, না জানলেও চলে। নিকষ কালো, লাবণ্যহীন একটা মেয়ে। হাড্ডিসার শরীরে ফিঙেপাখির মতো চষে বেড়াচ্ছে। আলাদা করে শুধু শান্ত চোখদুটো চোখে পড়ে। এমন একটা উচ্চস্বরে এবং হাস্যকরভাবে হিন্দি বলে, যাতে কাজও চলে যায়, আর শ্রোতার মনোরঞ্জনও হয়। 

    অজিত ভাইয়া বলেছিল, সাউথ ইন্ডিয়ান নার্সরা চুপচাপ আর কর্মঠ হওয়ার জন্য হাসপাতালগুলো ওদেরকেই রাখতে চায়। কিন্তু একবার নতুন আইন পাশ হলে এদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে শুধু স্থানীয় মেয়েদের রাখা হবে। 

    ‘আম্মা-আম্মা করে সময় নষ্ট না করে এখানে এসো তো সারণ্য’, ডাকল মায়া। ‘কেউ যদি অনাহারে মরবে প্রতিজ্ঞা করে থাকে, তাতে তোমার আপত্তি কি থাকতে পারে বুঝি না। এই দ্যাখো মোনার কাণ্ড। সাত নম্বরের পেচ্ছাপের এন্ট্রি করেনি। তোমার সিন্ধু দিদি দেখলে আমাকে সম্বরে ডুবিয়ে গিলে খাবে। একবার মোনাকে ফোন করে জেনে নাও তো! কতবার আমি ওই চুড়েলকে বাঁচাব?’

    দুষ্মন্তর সাউথ ইন্ডিয়া নিয়ে ধারণা স্বচ্ছ নয়। এখনও মুম্বই যাওয়াই হয়ে উঠল না। তার ধারণায় মুম্বইয়ের ওপারে সবই সাউথ ইন্ডিয়া। সেখানে পাল্লা  দিয়ে নারকেলের চাষ আর ‘দাবাং’ ছবি তৈরি হয়, এবং লোকে রজনীকান্তকে পূজো করে— এটুকুই সে জানে। সেখানকার মেয়েরা কেমন হয় সে জানে না। সারণ্যকে দেখে মনে হয়, না জানলেও চলে। নিকষ কালো, লাবণ্যহীন একটা মেয়ে। হাড্ডিসার শরীরে ফিঙেপাখির মতো চষে বেড়াচ্ছে। আলাদা করে শুধু শান্ত চোখদুটো চোখে পড়ে। এমন একটা উচ্চস্বরে এবং হাস্যকরভাবে হিন্দি বলে, যাতে কাজও চলে যায়, আর শ্রোতার মনোরঞ্জনও হয়। 

    ভিজিটিং আওয়ার্স পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ক্যান্টিনের ছেলেটা বাকিদের সঙ্গে ওকেও এক কাপ চা দিয়ে গেছে। সেটা শেষ করে দুষ্মন্ত আইসিইউ থেকে বের‍িয়ে এল। এই সপ্তাহে তিনটে র‍্যালি আছে অজিত ভাইয়ার। পার্টি অফিসে দিনরাত্রি তার প্রস্তুতি চলছে। বেরিয়ে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে অজিত ভাইয়াকে ফোন করল। ওপাশ থেকে একটা পরিচিত গালি ভেসে এল। দুষ্মন্ত বুঝল ভাইয়া মুডে আছে। পাঁচ মিনিট ধরে ঝড়ের মতো যা কানে এল, দুষ্মন্ত বুঝল ভাইয়া আকণ্ঠ গিলে থাকলেও চিন্তাভাবনায় তার বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই। র‍্যালির প্রস্তুতি কী হবে, ভাইয়ার কম্পিউটার মগজে তার ব্লু-প্রিন্ট প্রস্তুত। দুষ্মন্তদের শুধু দাঁড়িয়ে থেকে কাজগুলো করিয়ে নিতে হবে।

    ‘আগুন জ্বালিয়ে দেব শালা, আগুন!’ ভাইয়া গর্জে উঠল।

    ফোন রাখার পর দুষ্মন্তর নিজের শিরা দিয়েও যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। উত্তেজনায় মুখে যে একটা আভা এসে গেছে, না দেখেও সেটা বুঝতে পারল। এই না হলে লিডার! এরকম নেতার জন্য প্রাণ বাজি রেখে বিপদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানো যায়। 

    জানুয়ারির সন্ধেবেলা শীত যেন খ্যাপা কুকুরের মতো দাঁত বার করে ঘোরে, আর খোলা চামড়া পেলেই বসিয়ে দেয়। পার্টি অফিসের দিকে পা বাড়াতেই দুষ্মন্ত বুঝতে পারল গলায় মাফলারটা নেই। নিশ্চয়ই ভেতরে ফেলে এসেছে।

    আইসিইউ-র দরজায় দারোয়ানটা ওকে ফিরতে দেখে সেলাম ঠুকল। নানিজির বেডের কাছাকাছি এসেই চোখে পড়ল ওপাশের রেলিং থেকে ঝুলছে পরিপাটি করে ভাঁজ করা মাফলারটা। আর পাশে খাবারের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারণ্য। মায়া যথারীতি হাবুডুবু খাচ্ছে ফাইল নিয়ে।

    ‘আপনার মাফলার, দেখেই বুঝেছিলাম। ভেবেছিলাম কালকের আগে আসবেন না’, সারণ্য বাদামি মাফলারটা বাড়িয়ে দিল। দুষ্মন্ত আড়চোখে দেখল মায়া ফাইলে চোখ রেখে কলম দিয়ে মাথা চুলকোচ্ছে। দুষ্মন্তর নিজের মাথায় র‍্যালির পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছে। মাফলারটা সশব্দে একবার ঝেড়ে নিয়ে সে গলায় পেঁচিয়ে নিল। 

    শুধু বেরোনোর সময়ে কানে এল, নব্বই পেরোনো জড়বৎ এক বৃদ্ধাকে এক অনাত্মীয় দক্ষিণ ভারতীয় যুবতী অক্লান্তভাবে শুনিয়ে চলেছে তার একঘেয়ে আকুতি : ‘কানা কালো আম্মা। কিয়া হুয়া?’

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook